কোষ্টিয়া, নারাহ, সানবান্ধা, বিকনা, জানবেদিয়া, মানকানালি আর পুরন্দরপুর নিয়ে বাঁকুড়ার দু নম্বর ব্লক।
সেখানকার কোষ্টিয়া গ্রামে প্রায় দু’শো বছর ধরে চলে আসছে শীট পরিবারর দুর্গাপুজো। এই পরিবারের উথানের কাহিনী বেশ আকর্ষনীয় – মেষপালক থেকে বড়লোক হওয়ার গল্প। পরিবারের আদি পুরুষ সার্থক শীটের আদি বাড়ী ছিল বেলিয়াতোরের কাছে বনগ্রামে। নিতান্তই সাধারন চাষি পরিবার, তাই বাড়তি উপার্জনের জন্য মেষপালকের কাজও করতেন সার্থক শীট। এইরকমই একদিন তিনি মেষ চড়তে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। সেইসময় তিনি স্বপ্ন দেখেন মা দুর্গা তাকে দুর্গা পুজো করার কথা বলছেন। ঘুম ভেঙে গেলে কি ভাবে পুজো করবেন সেই নিয়ে চিন্তিত হয়ে পরলেন। যাই হোক, মায়ের আদেশ অমান্য না করে একটি চালা তৈরি করে তিনি মা দুর্গার পুজো শুরু করেন।
এরপরই সার্থক শীটের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে। বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠেন সার্থক শীট। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে একের পর এক জমিদারি ক্রয় করেন, মালিক হয়ে ওঠেন কয়েক হাজার হেক্টর বনভূমির। অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় পর তিনি বনগ্রাম ছেড়ে কোষ্টিয়াতে চলে আসেন। আড়ম্বর করে মায়ের পুজো শুরু করেন। জমিদার বাড়ির পাশেই তৈরি হয় বিশাল নাট মন্দির সাথে বিষ্ণু আর দুর্গা মন্দির, যা আজও সেই ফেলে আসা সময়কে মনে করিয়ে দেয়। শীট পরিবার মাহিষ্য সম্প্রদায় ভুক্ত। পরিবারের পুজো বৈষ্ণব মতে অনুষ্ঠিত হয়। তাই বলিদান নিষিদ্ধ। পুজোতে বেশ কয়েকটি ব্যতিক্রমী প্রথা রয়েছে। সপ্তমী ও অষ্টমীর দিন নিরামিষ ভোগ আর নবমীতে আমিষ ভোগ দেওয়া হয়। এ পরিবারের পুজোর আর একটি বিশেষত্ব ছিল, পুজোকে কেন্দ্র করে দিনেরবেলায় যাত্রা অনুষ্ঠান। এই দিনের বেলার যাত্রার পিছনে রয়েছে এক অন্যরকম কাহিনী৷
তখনকার দিনে চারিদিকে বনে জঙ্গলে ঘের ছিল এই কোষ্টিয়া গ্রাম৷ প্রায়ই লেগে থাকত বুনো হাতির উপদ্রব৷ তাই বিভিন্ন গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে আসা প্রজারা যাতে দিনের আলো থাকতে থাকতেই বাড়ি ফিরতে পারে, তার জন্যই ছিল এই ব্যবস্থা৷ তবে এখন আর যাত্রাপালা হয় না জানালেন শীট পরিবারের সদস্য মৃনাল কান্তি শীট। এই পুজোকে কেন্দ্র করে আগে সকলকে মায়ের ভোগ প্রসাদ খাওয়ানো হতো৷ ষোলটি গ্রাম থেকে প্রজারা আসতেন। এখন জমিদারি প্রথা আর নেই, অনেক সম্পত্তি সরকারের হাতে চলে গিয়েছে। পুজোও হারিয়েছে আগের জৌলুস৷ তবে আজও গ্রাম ছাড়াও বাইরে থেকে মানুষ ছুটে আসে এই পুজো উপভোগ করতে৷ পুজোর চারটে দিন আনন্দে মেতে উঠেন তারা। শীটেদের বতর্মানে শাখা প্রশাখা নিয়ে আটত্রিশটি পরিবার। সকলেই এই মহাপুজাতে অংশ গ্রহন করেন। জানালেন পরিবারের আর এক সদস্য। “দেবতার জন্য নির্দিষ্ট কোন দেবোত্তর সম্পত্তি না থাকলেও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন বেশকিছু সম্পত্তি থেকে পুজোর খরচ উঠে আসে। আর গ্রামের মানুষজনতো আছেনই। এ তো শীট বাড়ির পুজো নয়, এ গ্রামের মানুষের আবেগ” — গর্বভরে জানালেন মৃনাল শীট মশাই।
প্রথা মেনে পুজোর পুরাহিত আসেন পিড়িরাবনি গ্রাম থেকে দুজন আর প্রতাপপুর থেকে একজন।সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত জ্বলে অক্ষয় প্রদীপ। রুজির টানে যারা গ্রামের বাইরে থাকেন পুজোর সময় প্রতিবছর তারা গ্রামে ফেরেন শীট বাড়ির পুজোয় অংশ নিতে। দশমীর দিন বিদায়ের আগে মা কে পান্তা ভাত আর চ্যাং মাছ ভোগ দেওয়া হয়। ঘট বির্সজনের পর শুরু হয় সিঁদুর খেলা আর সব শেষে মা কে কাঁধে করে নিয়ে স্থানীয় নির্দিষ্ট পুকুরে বিসর্জন। সব শেষে শান্তির জল ছেটানোর মধ্যে দিয়ে পুজোর সমাপ্তি। সন্ধ্যায় আশেপাশের গ্রামের শিল্পীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।