মাত্র একটি ঘটনায় সহসা বাঙালি মধ্যবিত্তের সমষ্টিগত বিবেকবোধ দারুণ বেগে জেগে উঠলো এবং দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রান্তরে। বাংলার স্মরণাতীত কালের ইতিহাসে এমনটা ঘটেছিল কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও বলা যায় অশীতিপর মহিলা যিনি এতকাল মিছিল দেখেছেন খিড়কি থেকে, তিনিও রাস্তায় নেমে এসে মিছিলে পা মিলিয়েছেন। এতকাল যে তরুণী কোনও প্রতিবাদ সভা সমাবেশের আঁচ থেকে নিজেকে শত হাত দূরে রেখেছিলেন, তিনিও তাঁর মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে স্লোগান দিচ্ছেন। প্রতিদিন সেক্টর ফাইভে অফিসে ঢোকা আর সন্ধ্যার পর বাড়ি ফেরা ছাড়া যে আইটি কর্মী জীবনে অন্য কোনও ক্ষেত্রেই অংশগ্রহণ করার সময় পেতেন না, তিনিও পথে নেমে এসেছেন প্রতিবাদীর ভূমিকায়। তাই বলাই যায় এই ধরনের গণআন্দোলন কেবল দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তো বটেই, উত্তরকালেও সর্বস্তরের এত সংখ্যক সাধারণ মানুষের সোৎসাহে বিচারের দাবীতে অংশগ্রহণ বাংলা কখনো দেখেনি।
কিন্তু এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সাধারণ মানুষ যেখানে বিচারের দাবীতে রাস্তায় নেমেছেন, সেখানেই মেয়েদের লক্ষ্যনীয় অংশগ্রহণ এবং বলাই বাহুল্য আরজি কর হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসকের নৃশংস ধর্ষণ-খুন-এর প্রতিবাদে দেশজুড়ে যে প্রতিবাদের ঝড় তার মধ্যেই স্বাধীনতার মাঝরাতে পথের দখল নেয় মেয়েরা। সেই জমায়েতে সামিল হওয়ার বার্তা ছিল রাজনৈতিক রঙ ছেড়ে শুধুমাত্র নারী সুরক্ষা আর তাতেই সাড়া দেয় গোটা রাজ্য। বালি থেকে বেহালা, কোচবিহার থেকে কলকাতা স্বতস্ফূর্ত প্রতিবাদে দেখা গেল এই বাংলার মেয়েরাই নেতৃত্ব দিলেন। ১৯৭৫ সালে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়াতে গভীর রাতে ল্যাবরেটরি থেকে বাড়ি ফেরার পথে খুন হয়েছিলেন মাইক্রোবায়োলজিস্ট সুজ়ান স্পিথ। সেই খুনের প্রতিবাদে শুরু হয়েছিল ‘টেক ব্যাক দ্য নাইট র্যালি’। পরে ১৯৭৬ সালে জার্মানি এবং ১৯৭৭ সালে ইংল্যান্ডের লিডসে এমন আন্দোলন শুরু হয়। বাংলায় সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় স্বাধীনতা দিবসের মধ্যরাতে।
জুনিয়ার ডাক্তারদের আন্দোলন ঘিরে গণজাগরণের অভিনবত্ব এখানেই। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা ঘর থেকে বেরলেন, প্রতিবাদে আওয়াজ তুললেন “উই ওয়ান্ট জাস্টিস”। অর্থাৎ মেয়েরা সোচ্চারে তাঁদের মত প্রকাশ করলেন। আসলে আরজি কর হাসপাতালের মহিলা ডাক্তার ধর্ষণ-খুনের প্রতিবাদে যে গণআন্দোলন তাকে একভাবে নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে দাঁড়ানোর আন্দোলন বলাই যায়। কারণ, সাধারণভাবে যে মেয়েরা রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে চায় না সেই মেয়েরাও অনুভব করলেন যে কলেজ হাসপাতালের মতো জায়গাতেও যদি একজন মহিলা ডাক্তার ধর্ষিতা এবং খুন হন, তাহলে তাঁর নিজের রাজ্যে এমন কোন জায়গা আছে যেখানে তাঁরা নিরাপদ বোধ করতে পারেন। যদিও ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর গত কয়েক বছরের সমীক্ষা অনুযায়ী এই বাংলা সংখ্যার নিরিখে নারী নির্যাতনে দেশের শীর্ষ স্থানে অবস্থান করছে। পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর বললেই ফুরিয়ে যায়না, বাস্তবে মেয়েদের চলতে ফিরতে প্রতি পদে পদে আশঙ্কা বয়ে বেড়াতে হয়। সমীক্ষা বা সংখ্যা যে কথাই বলুক না কেন, বহুক্ষেত্রেই যে এই নির্যাতনের ঘটনাগুলি চাপা পড়ে যায় — কখনো পরিবার অভিযোগ করতে ভয় পায় বলে, কখনো পুলিশ অভিযোগ নথিবদ্ধ করাতে চায় না বলেও।
এ রাজ্যে গত দশ বছরে একাধিক নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে, প্রায় সব জায়গাতেই সেই অঞ্চলের মানুষ প্রতিবাদ করেছে কিন্তু এতটা ব্যাপকভাবে সেই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েনি বা এইভাবে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে সেই আন্দোলনে যোগদানও করেননি। প্রশ্ন, সাধারণ মানুষ এইভাবে ঝাপিয়ে পড়লেন কেন? নির্যাতিতা একজন চিকিৎসক বলে? সেই সত্য অস্বীকার করা যেমন যাবে না তেমনি ঘটনাটি ঘটেছে হাসপাতালের নিরাপত্তার বেষ্টনীর মধ্যে। স্বভাবতই মেয়েরা মনে করছেন ঘটনাটি মহিলাদের ক্ষমতায়নের উপরই একটা বড় আঘাত। সমাজে তো মজুত করা সামন্ততান্ত্রিক উপাদানের অভাব নেই। যে কারণে এখনও সামাজিকভাবে নারী ও পুরুষের সমান অবস্থান বহু ক্ষেত্রেই যথাযথভাবে স্বীকৃত নয়। মেয়েদের এগিয়ে চলা, শিক্ষা লাভ করা, সামাজিক উৎপাদনে অংশগ্রহণ করা এক কথায় পুরুষের সমকক্ষ হয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে এগিয়ে যাওয়ায় বহু সময়েই মেয়েদের হাত পিছন থেকে টেনে ধরা হয়।
প্রায়ই মেয়েদের বলে বা শিখিয়ে দেওয়া হয় কিভাবে তারা চলবে, কোন ধরনের পোশাক পরবে, কখন বাইরে বেরোবে এবং ফিরে আসবে। এবং এই খড়ির গণ্ডি টানা হয় রাজনৈতিকভাবেও। আমরা যেমন শুনলাম সরকারি নির্দেশিকা, যেখানে সরাসরি মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে রাতে ডিউটি দিতে নিষেধ করা হল। আবার সরকারি দলের নেতা মন্ত্রীদের মেয়েদের বিরুদ্ধে কুৎসিত ও কদর্য ভাষার মন্তব্যও শুনলাম। কোনো সভ্য দেশের সরকার কি এমন তালিবানি নিষেধ জারি করতে পারে বা প্রস্তাব আকারেও আনতে পারে? আর সেই সব নেতা বা মন্ত্রীরা কোন রাজনৈতিক আদর্শে লালিত পালিত হয়ে কার অনুপ্রেরণায় ওই ধরনের কথা বলতে পারেন? স্পষ্ট বোঝা নিষেধাজ্ঞা বা কদর্য ভাষণের কারণ, যাতে মেয়েরা কখোনই কোনো কর্মক্ষেত্রেই পুরুষের সমকক্ষ না হয়ে দাঁড়াতে পারে। জুনিয়ার ডাক্তারদের আন্দোলনে মেয়েদের অংশগ্রহণ থেকে রাত দখল ওরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না তাই ফোঁস করছে। আন্দোলনের আরেকটি অভিনবত্ব কোনো ফোঁস-ফাঁশ কর্ণপাত করছে না মেয়েরা।
আমরা দেখেছি রাজ্যের শাসক দলের বিভিন্ন নেতা মন্ত্রীরা অন্য রাজ্যের নারী নিগ্রহের পরিসংখ্যান মাথায় নিয়ে ঘোরেন সেগুলির উল্লেখও করেন। আসলে তারা বোঝাতে চান যে এমন তো ঘটেই থাকে, অতএব মাত্র একটি ঘটনাকে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার কোনও কারণ নেই। অতীতেও তারা নারীনিগ্রহের মতো ঘৃণ্য ঘটনাকে “ছোট ঘটনা” বলেছেন। যে কারণে অধিকাংশ ঘটনায় অপরাধী ধরা পড়েনি, বা পড়লেও সরকারের পক্ষ থেকে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কিন্তু এবার রাজ্যজুড়ে যে প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ঢেউ তা ছড়িয়ে গিয়েছে দেশের সর্বত্র এবং পৃথিবীর বিভিন্ন কোণায়। এই আন্দোলন সামগ্রিকভাবে যেমন নারী নিগ্রহের প্রতিবাদী আন্দোলন, তেমনি নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে দাঁড়িয়ে বিশেষ বার্তা দিচ্ছে।