সাদা পায়জামা, গায়ে মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলানো সুতির ব্যাগ, মুখ ভর্তি পান, সামান্য বাঁদিকে হেলানো মাথা, চশমার ফ্রেমের ভিতর এক অদ্ভুত গহন চাহনি, যে মানুষটির মন্দ্রকন্ঠে অচিরেই ভিজে ওঠে চোখের কোল, তাঁর নাম দেবব্রত বিশ্বাস, বাঙালীর পরম প্রিয় ‘জর্জ বিশ্বাস’ বা ‘জর্জদা’।
শোনা যায় রাজা পঞ্চম জর্জের দিল্লি আগমনের ঠিক আগে তার জন্ম হয়েছিল বলে তাকে ডাকা হতো জর্জ নামে। ২৬ বছরের সঙ্গীতজীবন, তারপর ব্রাত্য করে দেওয়া হয়েছিলো নানান আছিলায়। ভারতের গণনাট্য আন্দোলনের অন্যতম পুরোধাপুরুষ। আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর একাত্মতা প্রকাশ করেছেন গণসংগীতের মধ্যে।
বাঙালির কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর জর্জ বিশ্বাস, একে অপরের পরিপূরক। অসাধারন গায়কীর এই মানুষটির রসিকতা ছিল উপভোগ করার মত। কখনো কখনো কেউ কেউ হয়তো রাগও করেছেন সে সব শুনে অথচ অনুধাবন করার ক্ষমতা থাকলে মজাকে মজা ভেবেই উপভোগ করার মানসিকতা থাকলে বোঝা যেত অহেতুক কাউকে আঘাত করার উদ্দেশ্য তার কখনো ছিল না। স্থুলো স্বার্থের সম্পর্ক ছিল না তার কারোর সঙ্গেই, তিনি এইসবের অনেক ঊর্ধ্বে ছিলেন। তিনি নিজেকে নিয়েও তো কম রসিকতা করতেন না। দেবব্রত বিশ্বাসের নানা রসিকতা নিয়েও তো অজস্র গল্প আছে। তার কিছুটা শোনাই।
একদিন একদিন এক ওভারস্মার্ট যুবক হঠাৎই ঘরে ঢুকে বললেন, ‘জর্জদা যেমন করেই হোক আমাকে তৈরি করে দিতে হবে, যাতে আমি অবিকল আপনার মত গাইতে পারি।’ জর্জদা খুব শান্ত স্বরে তাকে বললেন, ‘উত্তেজিত ক্যান, বসেন। মন দিয়া শোনেন। আমার এখানে ঢোকার আগে ডানদিকে যে ওষুধের দোকান আছে দ্যাখসেন, ওই দোকানে গিয়া কইবেন দু-ফাইল হাঁপানি ওষুধ দ্যান। ওই ওষুধ শেষ কইরা তারপর আমার কাছে আসবেন, আমার মত হাঁপানি না জুটাইলে তো আমার মত গাইতে পারবেন না।’
কেউ একবার জানতে চেয়েছিলেন জর্জ বিশ্বাসের কাছে, ‘আপনি বাঙাল ভাষায় কথা বলেন, তাহলে গান গাওয়ার সময় তা করেন না কেন?’
জর্জ বিশ্বাস উত্তরে বলেছিলেন, আমার জন্ম ওপার বাংলায়, আমার ভাষা বাঙাল, তো আমি সেই ভাষা কমু নাকি ফরাসি ভাষায় কমু?.. তাছাড়া ভালো লাগবে আপনের যদি ওই ভাষায় রবিবাবুর গান গাই! শোনেন না, বলে তাকে শুনিয়ে দিয়েছিলেন — এতদিন যে বস্যে সিলেম পথ চিন্যে আর কাল গুন্যে’…. বলাবাহুল্য হাসি চেপে রাখতে পারেনি প্রশ্নকর্তা। জর্জ বিশ্বাস একবারে মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন তার।
একবার এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অনেক নামীদামি শিল্পী। গ্রিন রুম থেকে খুব মন দিয়ে জর্জবিশ্বাস শুনছেন নীলিমা সেনের গান, ‘আজ যেমন করে গাইছে আকাশ’। এমন সময় তার পাশে বসা আর এক বিখ্যাত শিল্পী জর্জদার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথের হাসির গানগুলি খুব নেগলেট হচ্ছে কিন্তু। ভাবছি আপনার সহায়তায় কয়েকটা রেকর্ড করি। প্রিয় শিল্পীর সেই গান শোনায় ব্যাঘাত ঘটায় খুব রেগে গেলেন জর্জ বিশ্বাস। শিল্পীকে বললেন আপনে এমন গাইলেই তো পাবলিক হাসে, আলাদা কইর্যা রবীন্দ্রনাথের হাসির গান শেখনের আর দরকার কি?’
শরীর তখন নুইতে শুরু করেছে হাঁপানির দৌরাত্ম্যে, চলাফেরার সুবিধার জন্য সেই সময় একটি লাঠির সাহায্য নিতেন। সম্ভবত রবীন্দ্রসদনে একটি অনুষ্ঠানে গেছেন, মঞ্চ থেকে জর্জ বিশ্বাসের নাম ঘোষণা করা হলো। আসরে ঢোকার ঠিক আগে সাহায্যের জন্য পিছন ফিরে চেনা কাউকে খুঁজতে গিয়ে বললেন, ‘এই লাঠিটা কেউ ধরেন দিকি?’
পেলব কণ্ঠের খ্যাতনামা এক পুরুষ শিল্পী এগিয়ে এসে বললেন, ‘জর্জদা লাঠিটা আমাকে দিন’। জর্জদার সহাস্য উওর, ‘দুঃখিত অমুকবাবু, এইডা তো আপনার দ্বারা হইব না, বড় ম্যাস্কুলিন আছে।’ দেবব্রত বিশ্বাসের নাম তখন খ্যাতির তুঙ্গে, ভাবা যায় গাইতে যাবার পূর্ব মুহূর্তেও তিনি এমন রসিকতা করতে পারতেন। যেখানে তাঁর নামের মর্যাদা রক্ষার জন্য তাকে ভালো গাইতেই হবে। সাধারণত এই সময় শিল্পীর একটু টেনশনই থাকে, অথচ জর্জ বিশ্বাসের অপরিসীম পরিহাস করার ক্ষমতার কাছে কোন টেনশনই ধোপে টিকতোনা। তার কারণ যে কোনো অনুষ্ঠানে গাইতে যাওয়ার পাকা কথা দেবার পর থেকেই শুরু হয়ে যেত তার গান বাছাই এবং রিহার্সাল। এর অন্যথা হয়নি প্রায় কখনই।
১৯৪২ সালে জর্জ বিশ্বাস ভাড়া এলেন ১৭৪ ই, রাসবিহারী এভিন্যুর একটি ছোট্ট ঘরে। সেখানেই প্রত্যেকদিন সন্ধ্যেবেলা বসত সান্ধ্য আড্ডা। আড্ডায় থাকতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তাঁর বন্ধুবান্ধবরা এবং আরো অনেকে। নির্ভেজাল আড্ডা, গান, রসিকতায় কাটত দিনগুলি। একদিন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বন্ধু ও সঙ্গীত সহকারী সমরেশ রায় আগে আগে চলেছেন এবং গলি থেকেই একটু জোর গলাতেই চেঁচিয়ে বলছেন, — ‘জর্জ আছো নাকি? জর্জ?’ দোর খুলে তখন দেবব্রত বিশ্বাস ঠাট্টা করে সমরেশ রায়কে বললেন, ‘জর্জ জর্জ করে কও কেন? কাকা কইতে পারো না?’ কারন সমরেশ রায় ছিলেন জর্জ বিশ্বাসের থেকে ১১ বছরের ছোট। আর সেদিন থেকেই দেবব্রত বিশ্বাসকে কাকা ডাকা শুরু করলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
এই ঘরেই গান শেখাতেন জর্জ। বাদল দিনের এক সকালে ছাত্র অর্ঘ্য সেন এলেন গানের ক্লাসে। মুখে পান নিয়ে তখন মন্দ্র সপ্তকে সুর ভাঁজছেন জর্জ। একটু পরে ফের চুন নিলেন জিভে। তার পর হারমোনিয়মের বেলোতেই মুছে দিলেন চুনের হাত। কখনও লুঙ্গিতেও মুছতেন। শুরু করলেন গান। বাইরে তখন আকাশভাঙা শ্রাবণ।
অর্ঘ্য কী শিখলেন প্রথম দিন? ‘কখন বাদল ছোঁয়া লেগে’।
একদিন জর্জকে সাহস করে প্রশ্ন করে বসলেন অর্ঘ্য, ‘‘জর্জদা, রেসের মাঠে যান কেন?’’
জর্জের জবাব, ‘‘তুমি বিয়া করো নাই কেন? তুমি যেমন বিয়া করো নাই, আমি তেমনই রেসের মাঠে যাই। এটা আমার চয়েস।’’
বাংলা ছাড়াও জর্জ বিশ্বাস সংস্কৃত, ইংরেজি, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান ভাষায় রবীন্দ্র সংগীত গেয়েছেন। রাশিয়ান ভাষায় রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া নিয়ে একটা মজার ঘটনা বলি।
মস্কোয় কাজ করতেন ননী ভৌমিক। তিনি ছিলেন একজন বাঙালি বামপন্থী সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও অনুবাদক। তার স্ত্রী ছিলেন রাশিয়ান — স্বেৎলানা। একবার তিনি তাঁর স্ত্রী স্বেৎলানাকে নিয়ে IPTA (ভারতীয় গণনাট্য সংঘ)-এর পুরোনো সাথী জর্জদার বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। রসিক জর্জদা তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে সন্তর্পনে, জেনে নিয়েছেন তাদের দেশের বাড়ির ঠিকানা। তারপরে রাশিয়ান ভাষায় রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে, তাকে মুগ্ধ করেছেন।
স্বেৎলানা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছেন “রাশিয়ার কোন অঞ্চলের গান ?”
জর্জদা গম্ভীর মুখে স্বেৎলানাকে তাদের পাশের জেলার নাম বলে দিয়েছেন। ননী ভৌমিক তো জর্জীয় রসিকতায় পরিচিত — তাই তিনি মুচকি হাসি থেকে পুরো ব্যপারটা শুনতে শুনতে কখন যে অট্টহাসিতে পৌছে গেছেন, সেটা নিজেও খেয়াল করেন নি। হাসিতে যোগ দিয়েছিলেন জর্জ বিশ্বাসও়।
জীবনের শেষ দিকটা ছিল তার খুব কষ্টের, যারা দেখেছেন তারা জানেন। কি অসম্ভব জীবনশক্তি ছিল তাঁর মধ্যে।কত শারীরিক কষ্ট উপেক্ষা করেও গান গেয়েছেন, জানতে দেননি কাউকে। গানের মধ্যে দিয়ে সব যন্ত্রণার উপসম খুঁজতেন জর্জ বিশ্বাস।
জর্জ বিশ্বাস একদিন বলেছিলেন, ‘প্রণবেশ সেনরে কইবেন আমারে লইয়া একটা সংবাদ পরিক্রমা লিখতে।’ তারপর একটু থেমে বললেন “অ, ভুইল্যা গেছিলাম, না মারা গেলে তো আপনারা আবার ল্যাহেন না। এক কাম করেন, পরিক্রমাটা আগে লিখাইয়া শুনাইয়া দিবেন। আমার মরণের পর আপনে ওইড্যা পড়বেন”। জর্জদা প্রয়াত হবার পর তাঁ’র কথামতো প্রণবেশদা তাঁকে নিয়ে পরিক্রমাটা লিখেছিলেন।
কাল ছিল দেবব্রত বিশ্বাসের জন্মদিন। এত বছর পরেও বাঙালি হৃদয় দেবব্রতে লীন। তাঁর স্বতঃস্ফুর্ত গায়কীর অনুকরণ করা সম্ভবত পৃথিবীর কঠিনতম কাজগুলির একটি। দেবব্রত বিশ্বাসের তাই কোনো উত্তরসূরী নেই। চেতন-অবচেতনের নির্জন দ্বীপভূমিতে তিনি একলা, অদ্বিতীয়।
তথ্য ঋণ : সাংবাদিক তরুণ চক্রবর্তীর লেখা প্রতিবেদন, আনন্দবাজার আর্কাইভ, প্রহর এবং অন্যান্য।
বড় প্রিয় শিল্পী। ভালো লাগলো তোমার এই শ্রদ্ধাঞ্জলি।
থ্যাঙ্ক ইউ ❤️
আমার প্রিয় শিল্পী
আমারও