প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণের পরেই ঘটে গেল এক মর্মান্তিক ঘটনা। কলকাতার আর জি কর মেডিকেল হাসপাতালে এক ছাত্রী-ডাক্তারের মৃত্যু। সাধারণ মৃত্যু নয়, তরুণী সেই মেয়েটিকে কেউ (বা কারা) ধর্ষণ করে খুন করেছে। কলেজের সেমিনার হলে তার দেহ পাওয়া গেছে। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। কিন্তু পুলিশ বা রাজ্য সরকারের কিছু কিছু কার্যক্রম ও কিছু বক্তব্য সাধারণ মানুষের ক্ষোভের কারণ হয়। বিরোধী দলগুলি সরকারবিরোধী আন্দোলনের সুযোগ খুঁজছিলেন।
এই রকম পরিস্থিতিতে অকস্মাৎ রঙ্গমঞ্চে দেখা গেল এক যুবতীকে। নাম তাঁর রিমঝিম সিনহা। কেষ্টপুরের বাসিন্দা তিনি। বিধাননগর মিউনিসিপ্যাল স্কুল ও অশোক হল গার্লস হলে পড়াশুনো করেছেন তিনি। স্নাতকোত্তরের পাঠ সম্পূর্ণ করেছেন প্রেসিডেন্সী কলেজে। বিষয় ছিল সমাজতত্ত্ব। ১৪ আগস্ট তিনি সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট করে মেয়েদের রাত দখলের ডাক দিলেন। এর আগে, ২০১৯ সালে, এক মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় রাত দখলের ডাক দিয়েছিলেন তিনি। সেবার সাফল্য আসে নি। এবার এলো।
আর জি করের মর্মান্তিক ঘটনায় সেখানকার প্রাক্তন অধ্যক্ষের এক মন্তব্য রিমঝিমকে বিশেষভাবে উত্তেজিত করে তুলেছিল। ‘কেন এত রাতে একা একা মেয়েটি সেমিনার হলে গিয়েছিল’ — সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রাক্তন অধ্যক্ষ। রিমঝিম যাদবপুরের এইট-বি বাস স্ট্যাণ্ডে মেয়েদের জমায়েতের ডাক দেন — ‘মেয়েরা রাত দখল করো’। এবার তাঁর আহ্বানে অভূতপূর্ব সাড়া দেন শহর ও শহরতলির নারীরা। রিমঝিমের দাবি ছিল : কর্মক্ষেত্রে নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, সুরক্ষিত শৌচাগারের ব্যবস্থা করতে হবে, স্কুলস্তরে লিঙ্গ-সাম্যের পঠন-পাঠন শুরু করতে হবে।
রিমঝিমের আহ্বানে বিরোধীদলের নারীরা যেমন এসেছেন, তেমনি শাসকদলের নারীরাও এসেছিলেন বলে শোনা যায়। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বিরোধীদল অরাজনৈতিক এই আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক লাভ ঘরে তুলতে আগ্রহী ছিলেন। শাসক দলের একের পর এক ভুল পদক্ষেপ তাঁদের সেই সুযোগ করে দিচ্ছিল। সেসব ভিন্ন প্রশ্ন। রাজনৈতিক লাভ ঘরে তোলার জন্য নতুন স্লোগান : দাবি এক, দফা এক : পদত্যাগ, পদত্যাগ। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের ছাত্ররা এই দাবি তুলেছিল, সফলও হয়েছিল। আমাদের রাজ্যে বিরোধীরা যদি সফল হন, তাহলে রিমঝিমরা কি নিশ্চিন্তভাবে বলতে পারবেন যে নারীরা আর ধর্ষিতা, অপমানিতা হবেন না; পুরুষতন্ত্র মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না আর ?
আমরা দেখব রিমঝিম সিনহা রাত দখলের আন্দোলনের প্রেরণা পেলেন কোথা থেকে! তাহলে পেছিয়ে যেতে হবে গত শতকে। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকের ইংল্যাণ্ডে। নারী মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে সেখানে শুরু হল রাত দখল বা রিক্লেইম দ্য নাইট আন্দোলন। তাঁরা আবার প্রেরণা পেয়েছিলেন আমেরিকা থেকে। ফিলাডেলফিয়ায় মাইক্রো-বায়োলজিস্ট সুজান সু আলেকজান্ডার স্পিথ বাড়ি ফেরার পথে নিহত হলে নারীরা মিছিলে হাঁটেন।
ইংল্যাণ্ডে নারীদের রাত দখল আন্দোলনের প্রত্যক্ষ কারণ ইয়র্কশায়ার রিপার হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক পিটার উইলিয়াম স্যাটক্লিফ (১৯৪৬-২০২০); বিখ্যাত ক্রিমিন্যাল সাইকোলজিস্ট ডেভিড হোমস যাঁর সম্পর্কে বলেছেন, ‘extremely callous, sexually sadistic serial killer’। আর জি কর হত্যাকাণ্ডে পুলিশ যাকে গ্রেপ্তার করেছে, তার মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করা হয়েছে কি না আমরা জানি না; অবশ্য বিরোধী দলের কেউ কেউ বলেছেন যে সে ব্যক্তিকে ফাঁসানো হয়েছে, পেছনে যে সব মাথা আছে তাদের আড়াল করার জন্য।
স্যাটক্লিফের নারীহত্যালীলা (বিশেষ করে যৌনকর্মীদের) শুরু হয় ১৯৭৫ সালের ৫ জুলাই থেকে। সেই দিন তিনি উলসওয়ার্থের কর্মী ৩৬ বছরের আনা রগুলাস্কিকে হাতুড়ি মেরে, তারপরে ছুরি দিয়ে টুকরো টুকরো করে হত্যার চেষ্টা করেন। সেই বছরের ১৫ আগস্ট হ্যালিফাক্সে একইভাবে হত্যার চেষ্টা করেন ১৪ বছরের মেয়ে অলিভ স্মেল্টকে। ২৭ আগস্ট ১৪ বছরের ট্র্যাসি ব্রাউনিকে সিলসডেনে পেছন থেকে আঘাত করে হত্যার চেষ্টা করেন, তবে ভাগ্যক্রমে ট্র্যাসি বেঁচে যান। অক্টোবর মাসে ২৮ বছরের বিবাহ-বিচ্ছিন্না উইলমা ম্যারি ম্যাক-কানের গলায়, বুকে ও পেটে ছুরি মেরে হত্যা করেন।
১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে স্যাটক্লিফ হত্যা করেন ৪২ বছরের এমিলি মোনিকা জ্যাকসনকে। কয়েকমাস পরে লীডসে ২০ বছরের মারসেলা ক্ল্যাক্সটনকে পেছন থেকে হাতুড়ি মেরে হত্যার চেষ্টা করা হয়।
১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২৮ বছরের ইরিনা রিচার্ডশনকে হত্যা করেন স্যাটক্লিফ। ২৩ এপ্রিল হত্যা করা হয় ৩২ বছরের প্যাট্রিসিয়া অ্যাটকিনসন-মিট্রাকে, ২৫ জুন হত্যা করা হয় জায়নি ম্যকডোনাল্ডকে। ১০ জুলাই আক্রন্ত হয়েও অল্পের জন্য বেঁচে যান মারুন লঙ। ৯ অক্টোবর নিহত হন জিন জর্ডান। ১৪ ডিসেম্বর ২৫ বছরের মেরিলিন মুরকে হত্যার চেষ্টা সফল হয় নি।
১৯৭৮ সালে ব্রাডফোর্ডে নিহত হন ২১ বছরের যুভোনি পিয়ারসন। ১৬ মে তিনি হত্যা করেন ভেরা মিলওয়ার্ডকে।
১৯৮০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর উপাধ্যা বানদারা, ৫ নভেম্বর তেরেসা স্কাইস, ১৭ নভেম্বর জ্যাকি হিল স্যাটক্লিফের শিকার হন। ১৯৮১ সালের ২ জানুয়ারি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন স্যাটক্লিফ।
এই হত্যাকাণ্ড নারীদের সুরক্ষার প্রশ্নকে তুলে ধরে এবং তাঁরা ‘রিক্লেইম দ্য নাইট’ আন্দোলনের ডাক দেন। ১৯৭৭ সালে লীডসে রাত দখলের মিছিলে নারীরা স্লোগান তোলেন, ‘It’s not us who need to stay at home. It’s the perpetrators who need to be accountable’. জার্মানিতেও অনুরূপ আন্দোলন হয়, যার নাম ‘টেকব্যাক দ্য নাইট’। কালক্রমে পৃথিবীর নানা দেশে এই আন্দোলন ব্যাপ্ত হয়েছে। দিল্লিতে গণধর্ষণের বিরুদ্ধে ২০১২ সালে, ব্যাঙ্গালুরুতে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে রাত দখলের আন্দোলন হয়েছে।
রিমঝিম সিনহা রাত দখলের ডাক দিয়ে যে দাবিগুলি তুলে ধরেছিলেন, তা অত্যন্ত সঙ্গত। রাজনৈতিক কারণে এই আন্দোলন ‘হাইজ্যাকড’ হয়ে গেলে আমরা যে তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরই বহাল থাকবে।
আপনি এই লিখেছেন রিমঝিম সিনহা এই রাতদখলের ভাবনাটা পেয়েছেন বিদেশে থেকে, এবং সে প্রসঙ্গে বিভিন্ন দেশে নানা অপরাধ এবং পুলিশের ভূমিকা র কথা লিখেছেন। তার থেকেও যেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন তা হলো বাঙলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ফলে একটা নির্বাচিত সরকারের পতন দেখে এই রাজ্যের বিরোধীরা উৎসাহিত হয়ে এই রাজ্য সরকারের পদত্যাগ দাবি করছেন। যদি তাই হয় তবে রিমঝিমরা কি বলতে পারবেন যে আর এই রাজ্যে নারীরা ধর্ষিতা, অপমানিতা হবেন না, পুরুষতান্ত্রিকতা মাথা তুলবে না। একথা আপনি লিখেছেন।
এটাই প্রধান ও গুরত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
আমি Facebook করতাম না, বর্তমানে শুরু করেছি। আমি সেখানে 14 Aug. একটা লেখায় এই প্রশ্ন তুলে খুব সংক্ষেপে কিছু কথা লিখেছি। বিশদে লিখতে পারিনি কারন তখন সবে Facebook এ লেখা শুরু করেছি সেখানে দীর্ঘ লেখা লিখতে দ্বিধা হচ্ছিল।
যাইহোক এখনকার আন্দোলনের প্রধান দাবি ন্যায় বিচার চাই (we want justice)। রাজনৈতিক বিরোধী দলের কথা বাদ দিয়ে,প্রধান দাবি ন্যায় বিচার চাই।
একটা ভয়ঙ্কর অপরাধ ঘটেছে সেই অপরাধের ন্যায় বিচার চাওয়ার অবশ্যই যুক্তি আছে। কারন এখন পর্যন্ত খবরে যা প্রকাশ তাতে বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে শাসক এই অপরাধের দোষীদের এবং অপরাধের সত্য কারণ কি তা গোপন করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।
কেন?
এই রাজ্যে এর আগে এই ধরনের, হয়তো এ থেকে আরও বেশি নৃশংস, নির্মম একাধিক অত্যাচারের ঘটনা খুব কৌশলে বা অন্য কোন রকমভাবে চাপা দিয়েছে, ন্যায় বিচার হয় নি। সেকথা সকল সাধারন মানুষ জানেন। তাই এখন দাবি উঠেছে- We want justice (আমরা ন্যায় বিচার চাই)।
ন্যায় সংগত দাবি।
সমাজে এই ধরনের অপরাধ কি ভাবে বন্ধ করা যায় অন্তত বহুলাংশে কমিয়ে আনা যায় তা অনেক বড় সমাজতাত্ত্বিক গবেষণার বিষয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সমাজতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কাজ।
পৃথিবীর কোন দেশেই অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব হয়নি, মাত্রা কম-বেশি হতে পারে।
বর্তমানের রাত দখলকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিচার করে খুব সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন লেখক । লেখককে ধন্যবাদ।