১৭ অগাস্ট, শনিবার শ্রাবণ মাসের শেষ দিন। বহু পরিবারে এই শ্রাবণ সংক্রান্তির দিনে পূজিতা হন দেবী মনসা।এই দিনে সমাপ্ত হবে একমাস ব্যাপী মনসা পূজা, নাগপঞ্চমী ও অষ্টনাগ পূজা। মনসা হলেন সর্প দেবী। সর্পভীতি থেকে মুক্ত হওয়ার বাসনায় বাঙালি নারীরা এই ব্রত পালন করে। হিন্দু সমাজে দেবী হিসেবে মা মনসা কে পুজো করার পেছনে রয়েছে নানান পৌরাণিক কাহিনী। আজকের লেখায় তারই কিছু অংশ বলব সঙ্গে রয়েছে সাপে কাটলে তৎক্ষণাৎ করণীয় কর্ম।
শ্রাবণ মাস মূলত বর্ষাকাল। এই সময় খুব সাপের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। গ্রাম বাংলার বেশিরভাগ মানুষই কৃষিজীবী। মাঠে-ঘাটে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময়ই তারা সাপের কামড়ের শিকার হন। মনসাকে সাপের দেবী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই সাপের ছোবল থেকে বাঁচতে সর্পের দেবী মনসা কে পুজো করার রীতি প্রচলিত হয়েছে বাংলার ঘরে ঘরে।
নিম্নবর্গীয় মানুষদের কাছে মা মনসা হলেন প্রজননের দেবী। তাই বিয়ের সময় সন্তান কামনায় তার পূজো করা হয়। শ্রাবণ মাসে মনসা দেবীর ঘট মূর্তি স্থাপন করে সিজমনসা গাছকে মনসার প্রতিক হিসেবে পূজা করা হয় এই ব্রত পালন করলে বন্ধ্যাত্বমোচন ঘটে, সন্তান লাভ হয়, মৃত ব্যক্তির জীবন লাভ, হারানো জিনিস ফিরে পাওয়া যায় ধনবান হওয়া, অন্ধত্ব এবং কুষ্ঠ রোগ দূরীভূত হয়। ব্রতের দিন অনেকেই সাপের গর্তে দুধ ঢালেন।
এই পুজোয় নানাস্থানে নানারকম নিয়ম নীতি মেনে চলা হয়। যেমন — পুরুলিয়ায় মনসা পূজায় হাঁস বলি দেওয়া হয়।রাঢ বাঁকুড়ায় জ্যেষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের দশমী তিথিতে দশহরা ব্রত পালন করে মনসা পূজা করা হয়। তখন এখানে ঘুড়ি ওড়ানো হয়। মনসা পূজার অঙ্গ হল অরন্ধন। রাঢ়ে চৈতন্যদেবের সময়ে মনসাকে মা দূর্গার এক রূপ মনে করা হত। তাই কোনো কোনো জায়গায় পূজায় বলি দেয়া হত।
উত্তরবঙ্গ অঞ্চলে রাজবংশী জাতির কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দেবদেবীদের অন্যতম হলেন মনসা। প্রায় প্রত্যেক কৃষক গৃহেই মনসার ‘থান’ বা বেদী দেখা যায়। দক্ষিণ দিনাজপুরের ফুলঘড়ায় শরৎকালে দূর্গাপূজার পরিবর্তে মনসা পূজা হয়। ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে এ পূজা হচ্ছে।
ভারতের অসম রাজ্যেও মনসাপূজা বিশেষ জনপ্রিয়। এই রাজ্যে ওজা-পালি নামে একধরনের সংগীতবহুল যাত্রাপালা সম্পূর্ণ মনসার কিংবদন্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে শ্রাবণ সংক্রান্তিতে অরন্ধন হয়। সেদিন মনসা পূজো করা হয় উনুনে সিজ মনসার ডাল রেখে দুধ দিয়ে ডালটিকে স্নান করানো হয়। এভাবে মনসা পূজা করা হয়। আবার কোথাও মনসার প্রতিমাগুলো পুজো হয়। বাংলাদেশে ১লা শ্রাবণ থেকে সংক্রান্তি পর্যন্ত সব নারীর ব্রত পালন করে।
ব্রতেতে আলপনা একটি প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে।
এই ব্রতের আল্পনায় মনসা অর্থাৎ সাপের মোটিফ থাকবেই ।এছাড়া মনসা ব্রতের করন্ডি চিত্রের (এটি ভাট শোলার উপর অঙ্কিত) ব্যবহার দেখা যায়।
ব্রতিকে ব্রত পালনের পূর্ব দিন নিরামিষ আহার গ্রহণ করে। এই ব্রত পালনের সময় যে গীত গাওয়া হয় তাতে এই ব্রতের ফল প্রকাশ পায়।
অপুত্রকে পুত্র দেও
নির্ধারণকে ধন দেও
রোগশোক করো বিমোচনো ।
মনসার শ্রীচরণ যে জন করে স্মরণ।
তার সব শত্রু হয় ক্ষয়।।
মনসা সংক্রান্তির আগের দিন রাত্রে হয় মনসার জাগরণ। ঐদিন সারারাত ধরে গাওয়া হয় জাগ গান। কিছু গ্রামে এই পালা গানকে বলা হয় ‘সয়লা’। এই পালার বিষয় হল — পদ্মপুরাণ বা মনসা মঙ্গল।
রাঢবঙ্গে মনসা পূজা উপলক্ষে অনেক জায়গাতেই মনসামঙ্গল গান গাওয়ার রীতি প্রচলিত আছে। স্থান বিশেষে প্রতিদিন দুটি করে মোট ষোলপালা গান গাওয়া হয়, শেষের দিন থাকে অষ্টমঙ্গলা গান। আবার অনেক থানে গান গাওয়া উপলক্ষে বেহুলা লক্ষিন্দরের বিয়েও হয়। উত্তর ২৪ পরগনার বনগা অঞ্চলে দশহরা শ্রাবণ সংক্রান্তি বা ভাদ্র সংক্রান্তিতে বা বিশেষ দিনে মানত উপলক্ষে মনসার ভাসান গান পরিবেশিত হয়। এই উপলক্ষে বেহুলা লক্ষিন্দারের বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
বেহুলা লক্ষিন্দার হলো স্বর্গের শাপভ্রষ্টা ঊষা আর অনিরুদ্ধ। মনসার প্রচারের জন্যই তাদের মর্ত্যে জন্মগ্রহণ। চম্পকনগরের বণিক চাঁদ সওদাগর যদি মনসা পূজো করে তবে এই মনসার পূজা মর্ত্যে প্রচারিত হবে। কিন্তু চাঁদ সওদাগর ছিলেন শিব ভক্ত তিনি কিছুতেই মনসার পূজা করতে রাজি হন না। কিন্তু নিজের মর্যাদা মর্ত লোকে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে চাঁদ সওদাগরের হাত থেকেই পুজো নিতে হবে মা মনসাকে। সেই নিয়েই এগিয়ে গেছে কাহিনি। কাহিনি শেষে পরিলক্ষিত হয় যে চাঁদ সওদাগর বাধ্য হন মা মনসার পুজো করতে। আজও বাংলার বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যে মনসাপূজা তাই বিশেষভাবে প্রচলিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত সর্বশেষ এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে প্রতি বছর অন্তত পাঁচ লাখ ৮০ হাজার মানুষ সাপের দংশনের শিকার হয়, এবং মারা যায় অন্তত ছয় হাজার মানুষ।
তবে মনে রাখবেন বাংলাদেশ অধিকাংশ সাপই বিষহীন, অল্প কিছু সাপ বিষধর। সাপে কাটা রোগীকে প্রথমে আশ্বস্ত করতে হবে, ভয়ের কোন কারণ নেই বলে। আক্রান্ত অঙ্গটিকে অবশ্যই স্থির রাখতে হবে এবং সেই অংশটি যাতে নড়াচড়া না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিষধর সাপের কামড়কে অ্যান্টি-ভেনম দিয়ে চিকিত্সা করতে হয়। তাই যতখানি সম্ভব দ্রুত তাকে কাছে পিঠে হাসপাতাল কিংবা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।
অনেকেই বলে থাকেন সাপে কাটা জায়গাটিকে শক্ত বাঁধন বা গিঁট দিয়ে আটকাতে। মোটেও এসব করবেন না, এর কোন বৈজ্ঞানিক কারণ নেই। বরং শক্ত করে বাধলে রক্ত চলাচল বিঘ্ন হতে পারে।
সিনেমায় অনেক সময় দেখায় আক্রান্ত স্থানে মুখ লাগিয়ে চুষে রক্ত বের করে দেওয়া, এটি মোটেই করবেন না। কোন পরিস্থিতিতেই আক্রান্ত স্থানে মুখ লাগাবেন না।
বরং কিছু সাবধানতা আগে থেকে অবলম্বন করুন যেমন — সাপখোপ থাকার সম্ভাবনা যেসব গ্রাম এলাকায় সেখানে মশারি টাঙিয়ে ঘুমানো, আগাছায় ঢাকা ক্ষেতখামারে মোটা রাবারের জুতা পরে হাঁটা, ঘরের আশেপাশে জঞ্জাল না জমানো ইত্যাদি।
আপনার এলাকায় যেখানে সাপের আনাগোনা বেশি, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সেই সাপের আচরণ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করুন। সাপ কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে, কীভাবে সাপ মনে করে যে সে আক্রান্ত যার কারণে সে ফণা তোলে, কোন সাপ কোন সময়ে কোথায় থাকে — এসব তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিলে সাপ এড়িয়ে চলার ব্যাপারে মানুষ আরও সচেতন হবে।
গ্রাম বাংলায় সর্পদেবী মনসা বিশেষ ভাবে সমাদৃত। তিনি ভক্ত বৎসল। জরৎকারু, জগৎগৌরী, মনসা, সিদ্ধযোগিনী, বৈষ্ণবী, নাগভগিনী, শৈবী, নাগেশ্বরী, জরৎকারুপ্রিয়া, আস্তীকমাতা, বিষহরী ও মহাজ্ঞানযুতা — তাঁর এই দ্বাদশ নাম স্মরণ করে লেখার ইতি টানলাম।
খুব সুন্দর লেখা।