সে সময় জোরদার স্বদেশী আন্দোলন চলছে। বিপ্লবীরা তাদের কাছে চক্ষুশূল। স্বদেশীদের গণহারে ধরপাকড় করে অত্যাচার চালাচ্ছে ব্রিটিশ পুলিশ। সেই অত্যাচার থেকে বাদ গেল না নেতাজির আদর্শে দীক্ষিত এক বিপ্লবী সন্ন্যাসী। ব্রিটিশ পুলিশ তার ক্ষতবিক্ষত দেহ ভাসিয়ে দিল পুকুরে। কিন্তু দীক্ষিত হওয়া একনিষ্ঠ বিপ্লবীর অন্তর থেকে বিপ্লবের আদর্শ মুছে দেওয়া কি এত সহজ!!
মরণের দ্বার থেকে ফিরে এলেন তিনি। এরপর ছড়িয়ে দিলেন আরো জোরদার আন্দোলনের আগুন। সমাজে আন্দোলন না করলে যে কিছুই পাওয়া যায় না। গ্রামের অন্ধ মানুষগুলোকে আলো দিতে গড়ে তুললেন ‘বিজয়কৃষ্ণ রিলিফ সোসাইটি’ যা ‘নেতাজী চক্ষু হাসপাতাল’ নামে পরিচিত। আজকের প্রতিবেদনে বলবো সেই বিপ্লবী সন্ন্যাসীর কর্মযজ্ঞের কথা। শুরু করি একটি ঘটনা দিয়ে –
সালটা ১৯৪০। ঠিক এক বছর আগে সুভাষচন্দ্র বসু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফরওয়ার্ড ব্লক। রাজনৈতিক দলটিকে মজবুত ভিতের উপর দাঁড় করাতে, ভারতমাতাকে শৃংখল মুক্ত করতে নেতাজি তখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় চষে বেড়াচ্ছেন। নেতাজির সফরসঙ্গী হলেন তাঁর অন্যতম প্রিয অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্তী। শীতের এক গভীর রাত্রে পুরুলিয়ার রামচন্দ্রপুর গ্রাম থেকে মোটরগাড়ি চেপে দুজনে চলেছেন আদ্রা রেলস্টেশনে। রাস্তা মোটেও ভালো নয়। আচমকাই ব্রেক কষলেন চালক। সামনে এক বৃদ্ধ উপুড় হয়ে পড়ে আছেন বনেটের ওপর, বয়স আন্দাজ আশির ওপর। নেতাজি ও অন্নদাপ্রসাদ তাড়াতাড়ি নেমে বৃদ্ধকে শুশ্রূষা করতে লাগলেন। বুঝতে পারলেন বৃদ্ধ দৃষ্টিহীন, সম্ভবত কানে কম শোনেন বৃদ্ধের অসহায়তা দেখে দুজনের চোখেই জল চলে এলো। অস্ফুট স্বরে নেতাজি বললেন, ‘অন্নদা, এদের জন্য কি কিছু করা যায় না?’ নেতাজির সেই একটি ছোট্ট কথা অন্নদার হৃদয়কে সেদিন নাড়িয়ে দিয়েছিল।
১৯৪১ সালে ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দিয়ে কলকাতা ছেড়ে নেতাজি চলে গেলেন। যাওয়ার আগে অন্নদাকে বারম্বার মনে করিয়ে দিলেন সেই বৃদ্ধের কথা। অসহায় দুঃস্থ দৃষ্টিহীনদের জন্য চিকিৎসার যদি কিছু করতে পারেন। অন্নদা আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘আপনি যখন বলেছেন, তখন করবোই।’
তখন ব্রিটিশ সরকারের বেশ রমরমা ব্যাপার। অন্নদার যেকোনো সামাজিক কাজই সন্দেহের চোখে দেখছিলেন ব্রিটিশরা। ফলে প্রথম দিকে গ্রামের অন্ধ মানুষকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বেশ বেগ পেতে হয় অন্নদাকে। দমবার পাত্র তিনি নন। রামচন্দ্রপুর গ্রাম ও তার আশেপাশের দরিদ্র দৃষ্টিহীনদের প্রথমে তালিকা তৈরি করেন অন্নদা। উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ তুলে দেন তাদের হাতে। এই ভাবেই দু’বছর কাটলো।
কেমন আছে জানতে অন্নদা গেলেন একদিন এদের সবার বাড়িতে। একের পর এক বাড়িতে গিয়ে তিনি হতাশ হয়ে ফিরলেন কারণ অধিকাংশ মানুষই চিকিৎসা করার অর্থ নিয়ে সংসার খরচা চালিয়েছেন। তিনি বুঝতে পারলেন এভাবে হবে না। ঠিক করলেন নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এমন একটি চক্ষু হাসপাতাল তিনি করবেন। কিন্তু ভাবলেই তো হবে না, দস্তুরমতো ব্রিটিশদের সঙ্গে তাকে লড়াই করতে হবে।
১৯৪৩ সালে কূল গুরু বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর নামে তৈরি হলো ‘বিজয় কৃষ্ণ রিলিফ সোসাইটি’। সেই সংগঠনের উদ্যোগে রামচন্দ্রপুর গ্রামে অস্থায়ী শিবির করে দরিদ্র চক্ষুরোগীর অস্ত্রপাচার ও চিকিৎসা শুরু করলেন অন্নদা। এভাবেই চলল বেশ কয়েক বছর।
১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ, ১৯৪৫ ও ১৯৪৬ সালে মানভূম অঞ্চলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে হাজার হাজার পরিবার সর্বস্বান্ত হয়। ‘বিজয়কৃষ্ণ রিলিফ সোসাইটি’র তরফ থেকে এঁদের জন্য সাধ্যমত খাবার, জামাকাপড়,এমন কি বাড়ি তৈরি করার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
এরপর ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট দেশ স্বাধীন হলো। কিছু লোভী নেতাদের জন্য স্বাধীনতা এলো চুক্তিতে, দেশ-ভাগ হল। শুরু হলো নেতাজীর নামে অপপ্রচার। রাজনীতির নোংরা দিকে আর তাকালেন না অন্নদা। শুধুমাত্র নেতাজির ইচ্ছেকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে পথ চলতে শুরু করেন। প্রয়াগে মাঘী সপ্তমীতে অন্নদা তার ধর্মগুরু স্বামী কিরণচাঁদ দরবেশের নির্দেশে সন্ন্যাস নিলেন।তাঁর নতুন নাম হল স্বামী অসীমানন্দ সরস্বতী।
১৯৫৩ সালে ২৩শে জানুয়ারি নেতাজীর জন্মদিনে রামচন্দ্রপুরে তৈরি করা হলো ‘নেতাজি আই হাসপাতাল’। প্রথম দুবছর হাসপাতালে শুধুমাত্র শীতকালীন অস্ত্রোপচারের জন্য অস্থায়ী শিবির করা হতো। এর ঠিক দু বছর পরেই ১০ শয্যার স্থায়ী হাসপাতালে গড়ে তুললেন এই বিপ্লবী। বর্তমানে নেতাজি চক্ষু হাসপাতাল শ্রী শ্রী বিজয়কৃষ্ণ আশ্রম রিলিফ সোসাইটির তত্ত্বাবধানে পুরুলিয়া এবং এর পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড এবং বিহারের রোগীদের জন্য মানসম্পন্ন চোখের যত্ন এবং সার্জারি প্রদান করে। এটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের অধীনে কাজ করে। বর্তমানে ২৪২শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালটি বার্ষিক ১,৩০,০০০ জন রোগীকে চিকিৎসা পরিষেবা দান করছে।।
অন্নদাপ্রসাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন মধ্যপ্রদেশে ইন্দোরের বাসিন্দা। বহু যুগ আগে পুরুলিয়ার পঞ্চকোট রাজপরিবারে কূল পুরোহিত হয়ে তারা এসেছিলেন। রাজপরিবারের তরফ থেকে রামচন্দ্রপুরে তাদের জমিদারি দেয়া হয়েছিল। ১৯০৪ সালে এই গ্রামে জন্ম হয় অন্নদার। জমিদারি দেখাশোনার ক্ষেত্রে উদাসীন বরং ভালোবাসতেন সামাজিক কাজকর্ম ও দুস্থদের পরিষেবা করতে। ১৯১১ সালে মাত্র ৭ বছর বয়সে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন। অন্নদা তখন তিনি ছিলেন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র।
পঞ্চম জর্জের রাজ্যভিষেকের অনুষ্ঠানে স্কুলে তার প্রশংসা করে একটি গান গাওয়ার কথা ছিল ছোট্ট অন্নদার। একবারে শেষ মুহূর্তে তিনি বেঁকে বসলেন। শিক্ষকদের জানালেন তিনি গাইবেন না। যারা দেশের মানুষের উপর অত্যাচার করেছেন তাদের বন্দনা তার মুখ দিয়ে হবে না মুখের উপর না শুনে শিক্ষকরা রেগে গেলেন। বেত দিয়ে বেধরক পেটালেন অন্নদাকে। পিঠ লাল হল ছোট্ট অন্নদার তবু সরলেন না তার গোঁ থেকে।
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে তিনি যোগ দিলেন। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে মানভূম থেকে বর্ধমান পর্যন্ত তার নেতৃত্বে শুরু হল বিশাল কর্মযজ্ঞ। বয়স্ক গ্রামবাসীদের অক্ষরদানের জন্য খুললেন রাতের স্কুল। নারী শিক্ষা প্রচারে খুললেন মহিলা স্কুল। ততদিন নেতাজির আদর্শকে ধ্যানজ্ঞান করে নিয়েছিল অন্নদা, নেতাজীও তাকে সহযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন। তার নেতৃত্বেই ‘মানভূম কর্মী সংসদ’ নামে একটি নতুন সংগঠনের জন্ম হয়, যার সভাপতি হলেন সুভাষচন্দ্র ও সম্পাদক অন্নদাপ্রসাদ। ‘তরুণ শক্তি’ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদনা করতেন অন্নদা ।এর জন্য রাষ্ট্রদোহী হিসেবে দেড় বছর কারাবাসে সাজাও দেয় ব্রিটিশ সরকার।
কারা মুক্ত হওয়ার পর স্বাধীনতার আন্দোলনে ঝাঁপ দিলেন অন্নদা। কর্মকাণ্ড রূখতে ১৯৩০ সালে বিশাল বাহিনী নিয়ে হাজির হয় দুই ম্যাজিস্ট্রেট। অন্নদা পাঠাগারে অভিযান চালিয়ে স্বদেশী বই পত্র পুড়িয়ে তাকে মাটিতে ফেলে ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ দেয়। রাজি না হলে একটি পাকুর গাছের গুড়ির সঙ্গে তাকে বেঁধে শুরু হল বেত্রাঘাত। যন্ত্রণায় জ্ঞান হারালেন অন্নদা। দড়ি দিয়ে বেঁধে ঘোড়া গাড়ির সাথে বহুদূর টেনে যাওয়া হয়। মৃত ভেবে তার দেহটিকে ফেলে দেয়া হয় পুকুরে।
অবশেষে গ্রামবাসীর সহায়তায় তাকে উদ্ধার করা হয়। বছরখানেক পর সুস্থ হয়ে আবার গ্রামে ফিরলেন। জোরদার আন্দোলনের ডাক দিলেন সুভাষ, উত্তাল হলো মানভূম। নানা উত্থান পতনের কর্মকাণ্ডে এগিয়ে চললেন অন্নদা। পরে প্রত্যক্ষ রাজিনীতি থেকে সন্ন্যাস নেয়ার পর নিজেকে সঁপে দেন সমাজ সেবায়।
১৯৬৮ সালের ১৩ ই আগস্ট প্রয়াত হন অসীমানন্দ সরস্বতী। নেতাজি চক্ষু হাসপাতালের অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব পেলেন তাঁর পুত্র নন্দদুলাল চক্রবর্তী। তিনি মারা যান ২০১৩ সালে। তখন থেকে এই দাতব্য প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব সামলাচ্ছেন অসীমানন্দর নাতি হিমাদ্রিশেখর চক্রবর্তী। নেতাজি আদর্শের একটি অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করেছিলেন অন্নদা। আজও বহু দুস্থ মানুষের সেবা করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠান।দেশবাসীর অন্ধত্ব ঘোচাতে তারই অসাধ্য সাধন কাজকে প্রণাম জানাই।।
একদম নতুন একটা কর্মকান্ডের কথা জেনে সমৃদ্ধ হলাম।
এই ধরণের আরো খবর পাবার আশায় রইলাম।
আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই আপনাকে।
সতত সম্মান ও শ্রদ্ধা..বরাবরের মতোই অসাধারণ সুন্দর লাগল..🙏💐
থ্যাঙ্ক ইউ