প্রেমে-অপ্রেমে উর্দু কবিতায় ডুবে থাকতেন মিনা। নাজ ছদ্মনামে শায়রিও লিখতেন।কাইফি আজমির কাছ থেকে কবিতা লেখার নানান টুইস্ট শিখেছিলেন তিনি। শোনা যায় এই শখ থেকেই গুলজারের কাছাকাছি আসেন মীনা কুমারী। মীনার কবিতা লেখা নিয়ে কামাল আমরোহীর কোন আগ্রহ ছিল না। কবিতার জন্য গুলজারই ছিল তার আপনজন।
‘বেনজির’ ছবির শুটিংয়ের সময় দুজনের বন্ধুত্ব হয়। ফোনে তাদের গল্প হতো ঘন্টার পর ঘন্টা। গুলজার তাকে গালিব, মীর তাকি মীর কিংবা রুমি পড়ে শোনাতেন। মিনার মেকআপ রুমেও দীর্ঘ সময় ধরে চলতো গল্প। সিনেমা পত্রিকা কেমন করে এই মশলা খবর সহজে ছেড়ে দেয়? খবর চলে যায় কামালের কাছে। একটা ঘটনা বলি।
মিনা একদিন সারারাত ধরে একটি কবিতা লিখলেন, তার মনে হয়েছিল এমন কবিতা তিনি এর আগে লেখেননি। গুলজারকে শোনাতে পারলে কেমন হয়? কিন্তু সেই সময় ফোনে তাকে পাওয়া গেলনা। গুলজার ছিল তখন পরিচালক বিমল রায়ের সহকারী। অবশেষে দিনের শেষে শুটিংয়ের পর মীনা ঠিক যখন সেট ছেড়ে বেরিয়ে যাবেন, তখন একজন এসে বলল, ‘গুলজার ভাই মিলনে কো আয়া’।
স্টুডিও তখন খালি হয়ে যাচ্ছে, কামালের নির্দেশে মেকআপ রুমে গুলজারের প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু মন যে মানতে চায় না, কবিতাটা যে আজ তাকে শোনাতেই হবে। মিনা বললেন, পাঠিয়ে দাও।
গুলজার ঘরে ঢুকলেন দুটো চায়ের কাপ হাতে নিয়ে। চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘বলো কি কবিতা লিখেছ কাল রাতে’?
মিনা অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি কি করে বুঝলে আমি কবিতা লিখেছি?’…
মিনা দরজা বন্ধ করে কবিতা পড়তে শুরু করলেন —
“টুকড়ে টুকড়ে দিন বিতা, ধজ্জি ধজ্জি রাত মিলি
জিসকা জিতনা আঁচল থা, উতনি হি সওগাত মিলি
রিমঝিম রিমঝিম বুন্দো মে, জ্যাহর ভি হ্যায় অউর অমৃত ভি….
জলতি বুঝতি আঁখো মে, সাদা সি জো বাত মিলি”
কবিতা শেষ করে চোখ তুলে মিনা দেখলেন গুলজার তার দিকেই তাকিয়ে আছেন। কবিতার শেষ লাইন-এর মতো নীরব দুইজোড়া চোখ একে অপরের মধ্যে যেন ডুবে গেল। ঠিক এমন সময় দরজার বাইরে ঘা পড়ল। মনে হল দরজাটা যেন এক্ষুনি ভেঙে দেবে। মীনা তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেখলো বকর আলী তাকে সরিয়ে দিয়েছে চিৎকার করছে, ‘কোথায় সেই শয়তানটা?’
গুলজার সাহেব চেয়ারে বসেছিলেন, কিছু বোঝার আগে মীনার গালে সপাটে চড় মেরে দিলেন বকর। চিৎকার করে উঠলেন মীনা। তার চিৎকারে ছুটে এলেন স্টুডিওর লোকজন। বকরের দিকে আঙুল দিলে মিনা বলল এক্ষুনি বেরিয়ে যাও নইলে তোমাকে পুলিশে দেব। ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলেন বকর।
স্তম্ভিত অপমানিত মিনা তখনই ফোন করলেন স্বামী কামালকে। বললেন, ‘এক্ষুনি তোমাকে স্টুডিওতে আসতে হবে, বকরকে আজই তাড়িয়ে দিতে হবে।’
কামাল খুব শান্তভাবে বললেন — কাজের মধ্যে আছি, আমি কোথাও যেতে পারবো না।
‘বেশ তাহলে আমি চলে যাচ্ছি’ বলে ফোন রেখে মিনা চলে গেলেন বোন মধুর শশুর বাড়ি। মধুর স্বামী বিখ্যাত অভিনেতা মেহমুদ আলী।
অনেক রাতে মেহমুদের বাড়ি উপস্থিত হলেন কামাল। কামাল বললেন, অনেক রাত হয়েছে বাড়ি ফিরে চলো। ‘এসব খবর জানাজানি হলে কাগজে ছাপা হবে। তখন আর কিছুই করার থাকবে না।’
মিনা রাজি হলো না। বেরিয়ে যাওয়ার আগে কামাল বললেন — তালাক তালাক তালাক। ১৯৬৪ সালের উভয়ের সম্মতিক্রমে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। জীবনের নিষ্ঠুর পরিহাসে যে সমীকরণে দু’জন মানুষ প্রেমে পড়েছিলো, বিবাহিত জীবনে সেই প্রেমই ধ্বংস করে দিল সম্পর্ককে। একটি সাক্ষাৎকারে কামাল বলেছিলেন, ‘মিনা অভিনেত্রী হিসেবে যতটাই ভালো, স্ত্রী হিসেবে ততটাই খারাপ।’
মিনাকুমারী কঠোর পরিশ্রমী অভিনেত্রী ছিলেন। শোনা যায়, তার আমলে ইন্ডাস্ট্রিতে বেশি পারিশ্রমিক নেওয়া অভিনেত্রীদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। সেই আমলে ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি একমাত্র অভিনেত্রী যিনি ইম্পালায় ভ্রমণ করতেন। তার ভালো সময় বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল গাড়ি ও সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া যায়।
অথচ অবাক হবেন জেনে যে, তার মৃত্যুর পরে তার পরিবার হাসপাতালে সাড়ে তিন হাজার টাকাও দিতে পারেননি।
একাকীত্বের শিকার থেকে বেড়োতে একের পর এক প্রেমে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মিনাকুমারী। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হন। ধর্মেন্দ্র তখন ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন আর মিনাকুমারী ছিল খ্যাতির শীর্ষে। মিনা নিজের আধিপত্য খাটিয়ে পূর্ণিমা, কাজল, মাঞ্জালি দিদি, ফুল অর পাথর, ম্যায় ভি লডকি হুঁ এবং বাহারোঁ কি মঞ্জিল-চলচ্চিত্রে তাঁর সঙ্গে জুটি বাঁধেন। ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল তিন বছরের তবে মিনা কুমারীর ঘনিষ্ঠ মহলের মত ছিল ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল মাত্র মাস ছয়েকের। ধর্মেন্দ্রর ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন মিনা, তা কখনো ভুলতে পারেননি ধর্মেন্দ্র।
ধর্মেন্দ্র ছাড়াও মিনাকে প্রেম নিবেদন করেছিলেন ভরত ভূষণ। সেই সময় নাকি এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল, তবে তার প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছিলেন মিনা।
মিনাকে ‘ফিমেল গুরু দত্ত’ নামেও ডাকা হতো।
ধর্মেন্দ্র ছাড়াও তার সঙ্গে নাম জড়িয়ে ছিল লেখক মধুপ শর্মার। ‘আখরি আড়াই দিন’ নামে একটি বইতে মিনা কুমারীর জীবনের নানান দিক তুলে ধরেছেন মধুপ যা পড়লে হয়তো সময় থমকে গিয়েছে বলে মনে হয়। “পাকিজা” ফিল্মের সেটে মিনা কুমারী কে দেখে নাকি বহুবার নিজের সংলাপ ভুলে যেতেন নায়ক রাজকুমার — এতটাই সুন্দরী ছিলেন তিনি।
অনিদ্রা রোগে ভুগতেন মীনা। ডাক্তারের নির্দেশে নিয়মিত এক পেগ ব্র্যান্ডি খাওয়া শুরু করেন। ক্রমে ক্রমে ব্র্যান্ডি আর কবিতার নেশায় ডুবতে থাকেন মিনা। অথচ ‘সাহিব বিবি অউর গুলাম’ ছবিতে মদ্যপ ছোটি বহু-র অভিনয় করেছিলেন এক বিন্দু মদ ছাড়াই। ক্রমে লিভার সোরিয়াসিস রোগ গ্রাস করে মীনাকে।
মীনা যখন সিরোসিস অব লিভারে আক্রান্ত, কামাল আবার মীনাকে প্রস্তাব দেন ‘পাকিজ়া’ ছবির কাজ শুরু করার। সঙ্গীত পরিচালক খৈয়াম ও তাঁর স্ত্রী সঙ্গীতশিল্পী জগজিৎ কৌরের অনুরোধে মীনা অভিনয় করতে রাজি হন।
১৯৭১ সালে ‘মেরে আপনে’ ছবিতে গুলজারের কারণেই অসুস্থ শরীর নিয়ে মিনা শুটিং করেন। এই সময়ে মীনা তাঁর সমস্ত কবিতা গুলজারের হাতে তুলে দেয়। পরে গুলজারের সম্পাদনায় ‘মীনা কুমারী কি শায়রি’ — তহ্না চাঁদ নামে বই প্রকাশিত হয়।
দর্শকের হৃদয়ের কাঙ্খিত এই অভিনেত্রী প্রেমে প্রত্যাখ্যান পেয়েছেন বারম্বার। বহু পুরুষের নাম উঠে এসেছে তার নামের সঙ্গে। অথচ কেউ একবারও বোঝার চেষ্টা করেনি ভালোথাকার, ভালোবাসার জন্য এই মানুষটি খুঁজে বেড়িয়েছে প্রেমের পরশ পাথর। জীবনের নির্মম ট্রাজেডি হয়তো এখানেই।।