ইদানীং কান পাতলেই চাষিদের মুখে একটা কথা প্রায়শঃ শোনা যায় বন্ধুদের দেখা নেই। কী সেই কথা? তাহল বর্ষা এল। বৃষ্টি হল। এখনও বিদায় নেয়নি বর্ষা। অথচ তাদের ডাক শোনা গেল না। চাষিদের মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ। কারণ যাদের ডাক শোনার অপেক্ষায় থাকেন চাষিরা, তারা হল এদের পরম উপকারী বন্ধু। বন্ধুর দেখা নেই মানেই চাষির ক্ষতি। অর্থাৎ সেই বন্ধুরা হল সোনা ব্যাঙ (বৈজ্ঞানিক নাম Bufo periglenes বা Rana Tigrina) ও কোলা ব্যাঙ (Indian Bullfrog) বৈজ্ঞানিক নাম : Hoplobatrachus tigerinus। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, মায়ানমার, পাকিস্তান, নেপাল ও আফগানিস্তানে এই ব্যাঙ দেখতে পাওয়া যায়। এটি Dicroglossidae পরিবারের Hoplobatrachus গণের অর্ন্তগত। এরা চাষের ফসলের ক্ষতিকারক কীট-পতঙ্গ, পোকামাকড় খেয়ে উপকার করে। অথচ বিগত কয়েক বছর ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে এদের সংখ্যা কমছে। ডাকও তাই শোনা যাচ্ছে না। চিন্তায় চাষিরা।
কেন এমনটি হল। রহস্য বা কী? একটা সময় দেখতাম পুকুরঘাটে মা-কাকিমাদের হ্যারিকেন, লণ্ঠন কিংবা লম্ফ হাতে যেতে। আলো দেখেই পুকুরপাড়ে উঠে আসা সোনা কিংবা কোলা ব্যাঙ দীর্ঘ লাফ দিয়ে জলে গিয়ে পড়ত। পড়ার আগে মা-কাকিমাদের গায়ে অনেকবার দেখেছি পেচ্ছাব করে দিতে। মা-কাকিমাদের গালিগালাজের হাত থেকে রেহাই পেত না রাতের ব্যাঙগুলো। মনে মনে হাসতাম। হলুদ ডোরা কাটা বড় বড় ব্যাঙগুলো যেন মা-কাকিমাদের সহ্য করতে পারত না। এসব দেখে ভাল লাগত। আরও ভাল লাগত যখন বাবার সঙ্গে মাঠে যেতাম সকাল কিংবা সন্ধ্যায়। দেখতাম খেতের আলে ঘাসের মাঝখানে চুপটি করে শিকারি হয়ে অপেক্ষা করত। বাবা বলত, এই ব্যাঙগুলো পোকামাকড়, কীট পতঙ্গ খেয়ে ফসলকে রক্ষা করে। এদের মারতে নেই। এরা আমাদের লক্ষ্মী।
নিরীহ, শান্ত এই উভচর প্রাণীদের দেখে মনে হত খুব দুঃখি। এত জোরে জোরে লাফ দেয় যেন কাউকে তোয়াক্কা করে না। ধরার ইচ্ছা জাগত। কিন্তু সাহস পেতাম না। বাবা বলতো, এদের ধরতে নেই। ধরলে হাতে ঘা হবে। কিংবা মারতেও নেই। তখন বুঝিনি এদের ধরলে আমাদের ফসলের ক্ষতি। তাই বাবা অন্য অজুহাতে ব্যাঙ ধরা থেকে আমাদের বিরত রাখতে যুক্তি খাড়া করত। এও দেখেছি অন্ধকারে রাতে বাবার সঙ্গে পড়ে ফিরছি। বাবার হাতে পাঁচ ব্যাটারির টর্চ লাইট। জোরালো আলো। এই টর্চ দিয়ে বাবা মাঠের ফসল পাহারা দিত। এমনকী চোর-ডাকাত চেনার জন্যও বাবা টর্চ কাছে রাখত। আমার সৌভাগ্য হত যেদিন ওই টর্চ নিয়ে বাবা আমাকে আনতে যেত। সপ্তাহে চারদিন পাশের গ্রামে প্রাইভেট পড়তে যেতাম। বাবার ডিউটি ছিল আনতে যাবার। যেদিন ওই টর্চ নিয়ে রাতে ফিরতাম দেখতাম কোলা ব্যাঙ আর সোনা ব্যাঙের দাপাদাপি।
বর্ষাকালে বৃষ্টি পড়লেই তাদের অজস্র হাঁকডাকে কান ঝালাপালা করত। সেইসঙ্গে ঝিঁ ঝিঁ পোকার তারস্বরে চিৎকার। এখন সেই ডাক আর শুনতে পাই না। মনটা উসখুস করে। এর কারণটা কী? একদিনের একটি ঘটনা উল্লেখ না করলে রহস্যটা চাপা থেকেই যেত। সন্ধ্যায় বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টির গতি ছিল মন্থর। বৃষ্টির গতি একটু একটু করে বাড়ছে। মা তালের বড়া আর ফুলুরি করছে। বাবা বলল, আমি একটু মাঠ থেকে ঘুরে আসি, ধানজমির জল আল টপকে কিংবা ভেঙে চলে যাচ্ছে কীনা দেখে আসি। মা বাধা দেয়নি। আমি বাবার নিষেধ সত্ত্বেও পিছু নিয়েছিলাম। ফাঁকা মাঠ। অন্ধকার। বাবার টর্চটা জ্বলে উঠেছে। টর্চের আলোয় সোনা আর কোলা ব্যাঙরা বাবার দিকে দৌড়ে লাফ দিচ্ছে। ব্যাঙদের এই একটা স্বভাব যে আলো দেখলেই কাছে চলে আসা। হঠাৎ দেখি দূরে হ্যাচাকের আলো নিয়ে দু’জন লোক আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। বাবা বলল, কী ব্যাপার? ততক্ষণে ওই দুজনের হাতে যা দেখলাম তা দেখে তাজ্জব! একজনের হাতে হ্যাচাক লাইট আর সঙ্গে একটি বাঁশের ডগায় জাল দিয়ে ছোট্ট ঘর। আর একজনের হাতে একটি বস্তা। তাতে ভর্তি সোনা আর কোলা ব্যাঙ। তারা বস্তা থেকে বেরিয়ে আসার প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এদের বাঁচার আকুতি দেখে। বাবা বলল, ব্যাঙগুলো ধরেছ কেন? এতে চাষের ক্ষতি, এত ব্যাঙ কী করবে? ওই দু’জন বাবাকে দেখে প্রথমে চুপ করে গিয়েছিল, পরে বাবার রাগত মুখ দেখে লোক দুটি বলেছিল, সমস্ত ব্যাঙ বিক্রি করবে। বাবা বলল, কোথায় বিক্রি করবে? আর কারা কিনবে? কত পয়সা পাবে? এর উত্তরও তারা দিয়েছিল। শহর থেকে ব্যবসাদাররা আসে। খুব সকালেই, সামনে হাটে-বাজারে এদের দেখা যায়। এরা প্রত্যেক ব্যাঙ পিছু ১০ টাকা করে দেয়। কিন্তু কী হবে এই ব্যাঙগুলো? তারও উত্তর পেয়েছিলাম। ওরা অকপট স্বীকার করেছিল যে, শহরের হোটেলে ব্যাঙের চপ হয়। তাছাড়া ব্যাঙ থেকে আরও অসংখ্য সুস্বাদু পদ তৈরি হয়। চাহিদা বাড়ছে। তাই ব্যাঙ ধরে ভালো টাকা রোজগার হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো খাদ্য হিসেবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ব্যাঙের পা দেশের বাইরে রপ্তানি হতো। ১৯৮৮-৮৯ ও ১৯৯২-৯৩ সালে যথাক্রমে মোট ৩৩,০৭,২৮১ ও ১৫,৩২০ কেজি ব্যাঙের পা রপ্তানি করা হয়। ব্যাঙের পা রপ্তানি বর্তমানে নিষিদ্ধ।
সেদিন বুঝেছিলাম কেন ব্যাঙের ডাক শোনা যায়নি। বাবা বলেছিল একদিন আসবে যখন আর ব্যাঙের ডাক কেউই আর শুনতে পাবে না। এও বলেছিল বাবা, যেভাবে কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার হচ্ছে ফসলে, তাতে ব্যাঙের মতো কত নিরীহ কেঁচো, শামুক, কাঁকড়া ইত্যাদি উপকারী বন্ধু চাষিরা হারাচ্ছে। বর্ষায় ব্যাঙেদের প্রজননের সময়। তাই ব্যাঙেদের হইহুল্লোড়, চিৎকার, চেঁচামেচি। কেউ রুখতে পারেনি এতদিন। কিন্তু কিছু দালাল, আর অসাধু ব্যবসায়ী রাতের অন্ধকারে চাষিদের পরম বন্ধুদের হত্যা করছে। এরা জানে না নিজেদের পেটেই নিজেরা লাথি মারছে। একদিন আসবে যেদিন এই বন্ধুদের জন্যই প্রার্থনা জানাতে হবে তাদের ফিরে আসার।
এদিকে চাষিদের উপকারী ব্যাঙ ও কীটপতঙ্গদের ফিরিয়ে আনতে কৃষি বিশেষজ্ঞরা মাঠে নেমেছেন। এ বিষয়ে চাষিদের নিয়ে সচেতনতা শিবির গড়ে তুলেছেন। একটাই উদ্দেশ্য ফসল উৎপাদন করতে হলে এই সমস্ত ব্যাঙ ও কীটপতঙ্গদের আগে দরকার। তাই এদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ কেবল বিশেষজ্ঞদের নয়, চাষিদেরও । সর্বোপরি অসাধু ব্যবসায়ীদের এই মারণ ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। তবেই বাঁচবে প্রকৃতি ও ফসল। হাসি ফুটবে চাষিদের মুখেও।