২৪ শে জুলাই, বাঙালির উত্তমাবস্থায় পড়লো ছেদ। দ্রুত বদলে যাওয়া এ সময়ও তিনি মহানায়ক। পাঁচ দশকের মধ্যভাগ থেকে প্রায় আড়াই দশক জুড়ে একাই কুম্ভ হয়ে কাঁধে করে বাংলা সিনেমা শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে চলার অভূতপূর্ব ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা যে উত্তম কুমারের ছিল তা কোন বাঙালি অস্বীকার করতে পারবে না। উত্তম কুমার একধারে ছিলেন যেমন একজন শ্রেষ্ঠ ও জাত অভিনেতা, তেমনি ছিলেন এক সফল চিত্রপ্রযোজক, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সঙ্গীত পরিচালক ও গায়ক। অসংখ্য ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি প্রযোজকের গুরুদায়িত্ব সামলানো উত্তম কুমারের পক্ষেই হয়তো সম্ভব ছিল। বাংলা চলচ্চিত্র জগত তাই তাঁকে ‘মহানায়ক’ আখ্যা দিয়েছিলো।
আর সেই উত্তম ক্যারিশমাকে কাজে লাগিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রকে জনপ্রিয়তার শিখরে তুলতে, উত্তম কুমার এলেন প্রযোজনায়। গড়ে তুললেন উত্তম কুমার ফিল্মস প্রাইভেট লিমিটেড। ৭৭ নম্বর লেনিন সরণির যে বাড়িতে আলোছায়া প্রোডাকশন হাউস ছিল, সেই ঠিকানায় উত্তম কুমার তাঁর প্রোডাকশন হাউজের নাম ১৯৬৩ সালে ইস্টার্ন ইন্ডিয়া মোশন পিকচার্স এসোসিয়েশনের নথিভুক্ত করালেন। উত্তমকুমারের ভাই তরুণকুমার ছিলেন এই প্রোডাকশনসের প্রধান কর্মসচিব।
এই প্রোডাকশন হাউস থেকেই রিলিজ হলো হারানো সুর, সপ্তপদী, ভ্রান্তিবিলাস, উত্তর ফাল্গুনী, জতুগৃহ, গৃহদাহ এবং ছোটি সি মুলাকাত। তিনি মোট ছটি বাংলা ছবি ও একটি হিন্দি ছবি প্রযোজনা করেন। শেষ ছবি ছোটি সি মুলাকাত দিয়েই উত্তম কুমার প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিটির কাজ শেষ হয়ে যায়।
এই প্রোডাকশন হাউসের প্রথম সিনেমা ছিল হারানো সুর। হারানো সুর ছিল অজয় করের সাথে উত্তমকুমার প্রযোজিত প্রথম চলচ্চিত্র। উত্তম বাংলা সিনেমাকে জাতীয় পর্যায়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাই তিনি তাদের ব্যানার আলোছায়া প্রোডাকশন প্রাইভেট লিমিটেডের অধীনে চলচ্চিত্র নির্মাণে আসেন। ছবিটি ১৯৪২ সালের মার্কিন চলচ্চিত্র র্যান্ডম হারভেস্টের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। বাংলায় ছবিতে চিত্রনাট্য লিখলেন নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। স্মৃতিভ্রষ্ট এক নায়কের প্রেম বিবাহ তার পরিণতি নিয়ে জমজমাট এক সাইকোড্রামা ছবি। সিনেমাতে উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেন জুটির অনস্ক্রিন কেমিস্ট্রি দেখলেই বোঝা যায়, কেন এই জুটিকে বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের রোমান্টিক মেলোড্রামার আইকন বলা হতো। এই চলচ্চিত্রে সুচিত্রা সেন চূড়ান্ত আত্মত্যাগী বাঙ্গালী নারীর মূর্ত প্রতীক হিসেবে তার কাল্ট ইমেজ গড়ে তুলেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে, এটি ছিল প্রারম্ভিক যুগের বাংলা চলচ্চিত্রের হারানো সুর। চলচ্চিত্রটি ১৯৫৭ সালে সর্বোচ্চ আয়কারী বাংলা চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে।এটি বাংলা বক্স অফিসে এক মাইলফলক গড়ে এবং সেই বছর জাতীয় পুরস্কারে রাষ্ট্রপতির সার্টিফিকেট অব মেরিট পুরস্কার পায়।
আলোছায়া প্রোডাকশনসের ব্যানারে উত্তমকুমার প্রযোজিত দ্বিতীয় ছবি ‘সপ্তপদী’। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন অজয় কর, চিত্রনাট্যকার বিনয় চট্টোপাধ্যায়, সংগীত পরিচালনায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, প্রযোজকের দায়িত্ব সামলেছিলেন উত্তম কুমার স্বয়ং। ছবিতে অভিনয় করেছিলেন উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন, তরুণ কুমার, ছবি বিশ্বাস প্রমুখ।
রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী রীনা ব্রাউনের প্রেম কাহিনি বাংলা ও বাঙালির খুব কাছের। “এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলতো?” এই গান গেয়ে যখন নায়ক নায়িকা খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল, তখন কৃষ্ণেন্দুর পিতাই বাধা হয়ে দাঁড়ালো। ধর্ম, সংস্কারের বহু বাধা অতিক্রম করে দুটি জীবন আবার মিলিত হবার অবকাশ পায়। ভালোবাসাই প্রথম ও শেষ কথা ছিল এই সুপারডুপার হিট ছবিটির।
ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬১ সালে। উত্তম সুচিত্রার জমজমাট কেমিস্ট্রি, টানটান চিত্রনাট্য, দুর্দান্ত ক্যামেরা ওয়ার্ক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অমোঘ সংগীতের জাদুতে এই ছবি হয়ে উঠেছিল সুপারহিট। সপ্তপদীর রোম্যান্টিক গান আজও বাঙালির প্রেমের থিম সং। ছবিতে অভিনয়ের জন্য মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সিলভার প্রাইজ দেওয়া হয় সুচিত্রা সেনকে। ১৯৬১ সালেই জাতীয় পুরস্কার পায় ‘সপ্তপদী’। এই ছবির রিপিট সেলও দুর্দান্ত।
উত্তমকুমার ফিল্মস প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যানারে প্রথম সিনেমা ভ্রান্তিবিলাস। পরিবেশন সংস্থা ছায়াবাণী প্রাইভেট লিমিটেড। দমফাটা হাসির এই চলচ্চিত্রটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূল কাহিনী থেকে নেওয়া। ভ্রান্তিবিলাস উইলিয়াম শেকসপিয়র রচিত নাটক কমেডি অফ এররস অবলম্বনে লিখিত। এই কাহিনীর ভিত্তিতে ১৯৬৮ সালের বলিউডে সঙ্গীতধর্মী দো দুনি চার এবং ১৯৮২ সালে পুনর্নির্মিত হয় আঙ্গুর নামে। এই চলচ্চিত্রটির মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন উত্তম কুমার এবং সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ।
চিত্রনাট্য রচনা করলেন মানু সেন। ১৯৬৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবি ভালো ব্যবসা করল।
এই বছরই ১১ই অক্টোবর ‘উত্তমকুমার ফিল্মস প্রাইভেট লিমিটেডে’র ব্যানারে আরেকটি ছবি মুক্তি পেল “উত্তর ফাল্গুনী”। উত্তম কুমার প্রযোজক ছিলেন এই সিনেমার কিন্তু তিনি ছবিতে অভিনয় করেননি। আর্থিক সাফল্যও পেয়েছিল এই ছবিটি চূড়ান্তভাবে।১১ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অনুষ্ঠানে এই ছবিটি শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র বিভাগে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার অর্জন করে।
১৯৬৪ সালের ২০ শে মার্চ উত্তম কুমার ফিল্মস প্রাঃ লিঃ ব্যানারে মুক্তি পেয়েছিল জতুগৃহ। সুবোধ ঘোষের জতুগৃহ উপন্যাসের অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছিল। সন্তানহীন দম্পতি হৃদয় নিচোড় করা যন্ত্রণার গল্পের চিত্ররূপ দিলেন তপন সিংহ। এই কাহিনীর উপর ভিত্তি করে ১৯৮৭ সালে মুক্তি পায় গুলজার পরিচালিত ‘ইজাজাত’ ছবিটি। চলচ্চিত্রের মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন– উত্তম কুমার, অরুন্ধতী দেবী,অনিল চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ রায়।এই চলচ্চিত্রটি সংগীত পরিচালনা করেছিলেন আশীষ খাঁ।
উত্তমকুমার গল্পটি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং এতে টাকা লগ্নি করতে চান। এটি ছিল উত্তম প্রযোজিত পঞ্চম চলচ্চিত্র এবং তার নিজস্ব ব্যানার উত্তম কুমার ফিল্মস প্রাইভেট লিমিটেডের অধীনে তৃতীয় চলচ্চিত্র। উত্তম অনন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন এবং জতুগৃহ নিখুঁতভাবে তার উদ্দেশ্য পূরণ করেছিল। শতদলের চরিত্রে উত্তম কুমার আর মাধুরীর ভূমিকার অরুন্ধতী দেবী অসাধারন অভিনয় করলেন।ছবিটি পরিবেশন করেছে ছায়াবানী প্রাইভেট লিমিটেড। ছবিটি বক্স অফিসে ভালো পারফর্ম করেনি।
ছবির নাম গৃহদাহ। প্রমথেশ বড়ুয়ার পর্দায় রূপ দেওয়ার প্রায় ৩১ বছর পরে,১৯৬৭ সালে উত্তম তার ক্যারিয়ারের মধ্যপর্বে করলেন এ সিনেমা। প্রমথেশের মত তিনিও এই ছবিতে মহিমের চরিত্রটি করলেন। তবে এই ছবিটি পরিচালনা করে যতটা আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছিলেন, ততটা অভিনয় গুনে হয়তো নয়। তিন দশক পর এই ছবিতে একটা নিজস্বতা আনতে পেরেছিলেন কুমার। তাই হয়তো বিকল্প পথে হেটে এই সিনেমায় অভিনয়। প্রমথেশের মহিম ছিল কিছুটা উদাসীন, দ্বিধাগ্রস্ত, বেদনাতুর সেখানে উত্তমের মহিম বেশ গম্ভীর কিন্তু দৃঢ়।তার চরিত্রও ট্র্যাজেডির শিকার কিন্তু সে আত্মগতভাবে দুর্বল নয় বরং পরিবারকে ধরে রাখতে মরিয়া।
ছবিতে উত্তম কুমারের সঙ্গে তার সেরা দুই নায়িকা সুচিত্রা সেন ও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একসঙ্গে, ছিলেন বম্বে প্রত্যাগত প্রদীপকুমার। তবু এই ছবি তুলনামূলকভাবে মাঝারি হিট ছিল। প্রায় পাঁচ বছর বাদে উত্তম সুচিত্রা জুটি ফিরে এসো সেইভাবে হিট করাতে পারেনি।
ছোটি সি মুলাকাত –উত্তম কুমার প্রযোজিত শেষ হিন্দি ছবি। আশাপূর্ণা দেবীর বিখ্যাত উপন্যাস অগ্নিপরীক্ষা কাহিনী অবলম্বনে রচিত চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন আলো সরকার। ১৯৬৭ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমার সংগীত পরিচালনা করেছিলেন শংকর জয়কিষান। চলচ্চিত্রটির মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন উত্তমকুমার ,বৈজয়ন্তীমালা রাজেন্দ্রনাথ, শশীকলা। উত্তম ও বৈজয়ন্তীমালা দুজনেরই দারুণ আশা ছিলো ছবিটি নিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্য সে ছবি বক্স অফিসে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়ে। ফলে প্রবল আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়েন তিনি। সবসময় অতিরিক্ত পরিশ্রম করতেন, যার কুফল পরিণাম ১৯৬৭ সালের শুরুতে সত্যজিৎ রায়ের চিড়িয়াখানা ছবির শুটিংয়ে তার প্রথম হার্ট অ্যাটাক ।
পরবর্তীকালে তিনি আর কোন ছবি প্রযোজনা করেননি তবে প্রযোজক হিসেবে যে ছবিগুলি তৈরি করেছেন তা বাংলা ছবির সম্পদ এবং বাঙালির গর্ব।।
তথ্যঋণ : উইকিমিডিয়া এবং অন্যান্য।