যাত্রা পথের শেষের গান
শুরুরও শেষ হয় একদিন। পিছিয়ে গিয়েও সামনে ফিরতে হয়। ইউরোপের একদম উত্তরতম প্রান্তে ফিনল্যান্ড। আমাদের শেষ গন্তব্য। অনেকটা পিছিয়ে সেখান থেকেই ফেরার পথ ধরতে হবে আমাদের।
এতদিন বড় জ্ঞান ফলিয়েছি। এবার একটু হাল্কা কথায় যাই। পন্ডিতপ্রবর, সুরসিক মুজতবা আলীকে ভর করে একটা ফিনিস গল্প বলা যাক।
ফিনিসরা নাকি বেজায় লম্বা (নানা মানুষের মেলায় আলাদা করে তেমন কিছু বুঝিনি)। ছয়, ছয় তিন, ছয় ছয় হামেশাই। তাই তারা অন্য দেশের মানুষকে হাইজাম্পে সহজে হারায়। সেখানকার মেয়েরাও দৈর্ঘ্যে কম যায় না।
আনিকি নামের এক লম্বা ফিন মেয়েকে দেখে এক ডেঁপো বেঁটে ঠাট্টা করে, “মাদমোয়াজেল, ওপরের হাওয়াটা কি ঠান্ডা?”
হাজির জবাব আনিকি বলে, “পরিষ্কার তো বটেই! তোমার বোটকা প্রশ্বাস সেখানে নেই যে!”
এ দেশের এক মজার খেলা wife carrying race. দম লাগাকে হেঁইসা ছবিটি যারা দেখেছেন, মনে করুন সেই মোটাসোটা বৌকে বস্তার মত কাঁধে নিয়ে ছোটা! ফিনল্যান্ডে যে স্বামী এই খেলায় জেতে, সে তার স্ত্রীর ওজনের বীয়ার পুরস্কার হিসেবে পায়। বীয়ারপ্রেমীরা এমন অভিনব গেমের আয়োজন এদেশেও করতেই পারেন!
ফিনল্যান্ডের আরো একটি অদ্ভুত ব্যাপার হেলসিঙ্কির ফ্লাইং সিনেমা হল। উড়ন্ত সিনেমা ব্যাপারটা কি ঠিক বোধগম্য হয়ে ওঠেনি। তবে সেখানকার মানুষ বড় গানবাজনার সমঝদার। একটি কনসার্ট হলে ঢোকার জন্যেই দেখলাম রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথা লম্বা লাইন। জনবিরল দেশে এমন দৃশ্য খুব একটা দেখা যায় না।
আমাদের স্টকহোম থেকে হেলসিঙ্কির জাহাজেও নাচগানের আয়োজন। সেখানেও আব্বার গান মামা মিয়ার ছন্দে সবাই শরীর দোলাচ্ছে।
জাহাজের ছোট্ট কেবিনে বড্ড গা ঘেঁষাঘেঁষি হলেও বাইরে ফূর্তির নানা আয়োজন। সাজানো গোছানো ব্র্যান্ডেড শপে লোকে কিনছে কম। দেখছে বেশি। মদ আর খাবারের সম্ভার রয়েছে থরে থরে। অন্ধকার নেই বলে উর্বশীর মত রাত চিরযৌবনা। তাই পার্টি আর নাচা গানা চলতেই থাকে।
এসব এড়িয়ে অবশ্য নিঃশব্দে জাহাজের ডেকে বসে থাকা যায় সারারাত। প্রকৃতি আর প্রশান্তি সেখানে হাত ধরাধরি করে আছে। আমাদের ফেরার পথে হাওয়াও কি মনখারাপে শান্ত হয়ে গেল! জলের বুকে দ্বীপের ভেসে ওঠা, তীরের সবুজ, আকাশের নীল আর গাংচিলের ওড়াউড়িতে এক অভিমানী গান মনের মধ্যে বেজে চলেছে,
“আমি শুনেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউয়ে চেপে
নীলজল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছো
আমি শুনেছি সেদিন তুমি নোনা বালি তীর ধরে
বহু দূর বহু দূর হেঁটে এসেছ
আমি কখনো যাই নি জলে
কখনো ভাসিনি নীলে
কখনো রাখিনি চোখ ডানা মেলা গাংচিলে
আবার যেদিন তুমি সমুদ্র স্নানে যাবে
আমাকেও সাথে নিও
নেবে তো আমায় বলো
নেবে তো আমায়!”
সব অভিমানের মালা আর আব্দারের পালা নীল জলে ভাসিয়ে আবার ডাঙায় পা রাখি। সেখানে অপেক্ষা করে আছে এক নতুন দেশ ফিনল্যান্ড। তার রাজধানী হেলসিঙ্কি। তার রাস্তায় গটগটিয়ে পার হচ্ছে বার্ণাকল হাঁস। গাছের পাতায় পাতায় লাল ফুলের হাতছানি। শহরের বুকে রাশিয়ার ছোঁওয়া লাগা অর্থোডক্স চার্চ সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকে। সিবেলিয়াস পার্কের বিমূর্ত শিল্পকলা দেখতে পর্যটকরা ছুটে আসছে।
বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ সিবেলিয়াস ফিনদের জাতীয় সংগীতের জনক। তাঁর নামেই এই পার্ক।
ইউরোপের অপেক্ষাকৃত নতুন দেশ ফিনল্যান্ড। তাই সে দেশের পথঘাট, সরকারি বিল্ডিং, ব্রীজ গড়ার কাজ প্রায় সর্বত্র চোখে পড়ে। গাইডের কথায় বোঝা যায়, প্রতিবেশী রাশিয়া জুজুর ভয় তাদের যায় নি।
অসংখ্য হ্রদ, অরণ্য দিয়ে সাজানো এই সুন্দর দেশটার সবথেকে চেনা মানুষ স্যান্টাক্লস। তার অফিসিয়াল বাড়ি ফিনল্যান্ডের রোভানিমি গ্রামে। বড়দিনের সময় সে সাজাগোজা গ্রামে নাকি নানা হৈচৈ আর মজা ।
সাজানো গোছানোর কথায় মনে পড়ল আবুধাবির কথা। পরের খবর একটু আগে দিই। আমাদের ফেরার পথটি ছিল হেলসিঙ্কি-মিউনিখ-আবুধাবি-কোলকাতা। আবুধাবি যাবার ফ্লাইটটিতে কিছু সমস্যার ফলে মিউনিখ থেকে সেটি দেরী করে ছাড়ল। অবধারিত ফল কোলকাতা যাবার পরের প্লেনটি আমাদেরকে না নিয়েই উড়ে গেল। তবে ইথিয়াড এয়ারলাইন্সের সৌজন্যে আমাদের মরুশহর আবুধাবি আর তার রাজকীয় হোটেলে থাকার অভাবিত সুযোগ হয়ে গেছিল। সবটা যে বড় মসৃণভাবে হয়েছে এমন নয়। মাঝখানের সময়টাতে একলা তরুণী মা তার কোলের বাচ্ছা নিয়ে হিমশিম খেয়েছে। আমরা দুই বাঙালিনী আশংকা আর ক্লান্তিতে অর্ধেকরাত এয়ারপোর্টে কাটিয়েছি। ট্রান্সিট ভিসা পেতে পেতে আমাদের প্রায় রাত কাবার। শেষমেষ ফ্রীতে গোলাপের সুগন্ধে ভরা, দামি কার্পেট আর সোনালি রঙে সাজানো আবুধাবির হোটেলে কয়েক ঘন্টা থাকলাম। তারপরে কোলকাতার ফ্লাইট। হোটেলটি রাজপ্রাসাদের থেকে কিছু কম ছিল না।
এর আগে আমাদের গোটা সফরে বেশ কয়েকটি রাজপ্রাসাদের সামনে গিয়েও সেখানে ঢোকার সুযোগ হয় নি। ফিনল্যান্ডে সে সুযোগ হল। এদের ড্রোটিংহোম প্যালেসটি অতুল রাজৈশ্বর্যে ভরা। ফিন ভাষায় ড্রোটিং মানে রাণী। রাণীর নামেই দ্বীপ। সেই দ্বীপটা জুড়ে রাজপ্রাসাদ। যতই আমরা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র গালভরা শব্দের জয়গান গাই না কেন রাজারাণীর প্রতি মোহ আমাদের যাবার নয়। আমাদের দলের বয়োজ্যেষ্ঠ ডাক্তার মানুষটি ছোটদের মত প্রশ্ন করেন, রাজবাড়িতে কি রাজা রাণীর সঙ্গে আমাদের দেখা হবে?
রাজবাড়ির রাজপথ ছেড়ে আমাদের একবেলার অখন্ড অবসর। আমরা সেদিন একদল উচ্ছল কলেজ তরুণীর মত হাসলাম, ওপেন মার্কেটে দরাদরি করলাম, কফি খেলাম, ছবি তুললাম। বিদায়বেলা যে আগত প্রায়। তার আগে প্রতিটা মুহূর্ত ভীষণ দামী হয়ে উঠল।
শহরের বুক দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল ভ্যান্টা নদী। সে নদীর ব্রীজ পায়ে হেঁটে পার করতে করতে আমার চোখ আটকে গেলে ব্রীজের রেলিঙে লাগানো গুচ্ছ গুচ্ছ তালায়। ব্রীজের নাম লাভ ব্রীজ। তালাগুলো নাকি ভালোবাসাকে আটকে রাখে। যে কোনো কাপল, বিবাহিত বা অবিবাহিত তাদের ভালোবাসার নামে শপথ নিয়ে তালাবন্ধ করে চাবিটা জলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কি অদ্ভুত না! আমরা স্বামী, সন্তানের মঙ্গল কামনায় দরগায়, বট গাছে সুতো বাঁধি। হয়ত অন্য মনোস্কামনাও থাকে। কিন্তু জোড়ায় জোড়ায় এমন প্রেমের তালা লাগানোর জোয়ার এদেশে এখনো আসে নি।
একটি ইংরিজি তালাচাবি কবিতার অনুবাদের চেষ্টা করলাম।
যখন আমি তোমাকে দেখি,
তোমার দৃষ্টি তখন কোন সুদূরে…
তুমি যেদিন আমায় দেখলে
আমার চোখ তুলে তাকানোই হয় নি!
হঠাৎ একদিন, এই তো কিছুদিন আগেই
তুমি আমায় তালাবন্ধ করে
চাবি নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলে।
এখন কোথায় আমি তোমায় খুঁজি!
এমন লাভলকের প্রয়োজন নেই বাপু! তার থেকে খুলে দাও ডোর। পালে লাগুক হাওয়া!
সমাপ্ত