আমাদের ষোলো জনের ছোট্ট দলটি যেন মিনি ভারতবর্ষ। আসাম থেকে তামিলনাড়ু অবধি তার বিস্তার। কুর্গের কফিবাগানের মেয়ে সোনার সঙ্গে রাঁচির মঞ্জু মহানন্দে শপিং করে। কট্টর নিরামিষাশী গুজরাটি মেয়ে শীতল চকলেট আর জ্যাম খেতেও ভয় পায়, “নন্দিনী ইস মে আন্ডা নেহি হ্যায় না?” এই সফরে আমার রুমি পরমা। গতবছর কেনিয়া বেড়াতে গিয়ে আলাপ। আমার ভাঙাচোরা ইংরিজিতে তাপ্পী লাগাতে, ইওরো-ক্রোণা-টাকার গরমিলে পরমাই ভরসা।
দুপুরে দুটি ভাত ডাল খাওয়াতে আমাদের ট্যুর ম্যানেজার বিরাজ নিয়ে যায় ভারতীয় রেস্তোরাঁয়। অনেকটা পথ উজিয়ে। মহারাজা, কৃষ্ণা, রঙ্গোলী এমনি সব নামের হোটেলে পাকিস্তানি, বাংলাদেশি এবং আমাদের কোলকাতার লোক বেশ ব্যবসা করছে।
সেইসব রেস্তোরাঁয় তন্দুরি রুটি, নান আর বাটার চিকেন ভালোবেসে খেতে আসে ওদেশের মানুষ। তন্দুরি রুটি, নান, কুলচার প্রেমে অনেকেই বাড়িতে তন্দুর কিনে ফেলেছে।
আমাদের রাতের খাবার আর ব্রেকফাস্টে হোটেলই ভরসা। সেসব ঢালাও আয়োজনের অধিকাংশ পদ অজানা। খাবারের নামের ট্যাগ লাগানো আছে তাদের ভাষায়। ফলে ভয়ে ভয়ে রাজপ্রাসাদের গুপী বাঘার মত চেনা খাবারই আমরা প্লেটে তুলে নিয়েছি। রঙচঙে বিদেশী পদ বেশিরভাগ বিস্বাদ লেগেছে আমাদের দেশী রসনায়। তবে কেক, পাই, কুকিজ, মুস আর চকলেটে ডুবে ছিলাম ক’দিন। ভালোবাসার ছাঁচে গড়া আলুটিকিয়াও দেখলাম দেশি বিদেশি সবার পছন্দ। গোরা মানুষগুলো আমাদের মতই আলুভক্ত।
সুইডেনের মিড সামার ডে’র উৎসবে নাকি নতুন আলুর পদ রাখতেই হয়। সঙ্গে নানারকম বেরী। জুন মাসে সবথেকে লম্বা গরমের দিনটা পরিবার, বন্ধু-বান্ধব সুইডিশ পরিবারের সবাই আঞ্চলিক পোশাক পরে একসঙ্গে নাচে গায়। লম্বা লাঠি বা মে-পোলের সঙ্গে লাগানো থাকে নানা রঙের রিবন। সেই রিবন ধরে চলে — সুইডেন মানে আমার এতদিন ধারণা, বড় লোকেদের সুন্দর দেশ। ছোটোবেলার টেনিস হিরো বিয়র্ন বর্গ। মাম্মা মিয়া খ্যাত আব্বা মিউজিকাল ব্যান্ড আর নোবেল প্রাইজ। দেশটার সঙ্গে সামান্য পরিচয়ের পর তার ওড়না ধীরে ধীরে সরল।
বাসে নরওয়ে থেকে সুইডেন যেতে রাস্তার ধারে ধারে দেখছি সবুজের উদার বিস্তৃতি। বাড়িঘর কম। বার্চ আর পাইন গাছেরা তাই সানন্দে বেড়ে উঠেছে। সত্তর শতাংশ অরণ্যে ঢাকা সুইডেন শান্তি ভালোবাসে। বিশ্ব রাজনীতিতে তার নিরপেক্ষতার ঐতিহ্য বেশ পুরনো। ইউরোপে সুইডেনকে একসময় শরণার্থীদের অন্যতম আশ্রয়দাতা বলে মনে করা হত।
রবিবার ছুটির দিনে স্টকহোমের রাস্তায় সেদিন ট্রাফিক জ্যাম। ঘর ছেড়ে সবাই বাইরে। স্টকহোমের নির্মল আকাশে, বন্দরে, জাহাজে, বাড়িঘরে সাজো সাজো রব। যেন রঙ মিলান্তি খেলায় মেতেছে গোটা শহর। সাদা, কালো, খয়েরি ঝুপসি লোমের আদুরে ল্যাপডগরাও বেড়াতে বেরিয়েছে তাদের কেয়ার গিভারের সঙ্গে।
এই দেশগুলোতে ঘুরতে ঘুরতে আমাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার একটা ট্রেনিং হয়ে যায়। তবে সুইডেন এর এক কাঠি ওপরে। সমস্ত বর্জ্য পদার্থ থেকে তারা বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। রিসাইক্লিংয়ের নতুন দরজা খুলে দিয়েছে সুইডেন। নিজের আবর্জনা যথেষ্ট নয় বলে প্রতিবেশী নরওয়ে থেকে তারা আবর্জনা কেনে। আমাদের দেশটা কাছাকাছি হলে সবটাই পাঠিয়ে দিতাম, ফ্রীতে।
স্টকহোমের ভ্রমণসূচীতে আমাদের প্রথম দ্রষ্টব্য ছিল বিখ্যাত বাসা মিউজিয়াম। ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে ৬৯ মিটার লম্বা ভাইকিংদের যুদ্ধ জাহাজটি স্টকহোম বন্দর থেকে রওনা হয়ে মাঝ সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিল। ৩৩৩ বছর পরে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে অনেক কসরত করে প্রায় অবিকৃত অবস্থায় সেটি উদ্ধার করা হয়। অপূর্ব সুন্দর সূক্ষ্ম কারুকার্য করা বিশাল জাহাজটি যথেষ্ট দৃষ্টিনন্দন। তার উদ্ধারকার্য ততটাই চমকপ্রদ। এই ঘটনা কোনো মুভির আকার নিয়েছে কিনা জানা নেই। তেমনটি হলে টাইটানিকের থেকে তার গুরুত্ব কম হবে না।
বাসার থেকেও মহৎ, এক অনন্য অনুভূতি আমাদের জন্যে অপেক্ষা করেছিল। স্টকহোমের নোবেল মিউজিয়াম। সমস্ত নোবেল বিজেতাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো সেই মিউজিয়াম। আমরা খুঁজে খুঁজে বার করলাম দালাই লামার চশমা, ইউসুফ মালালার শাল, অমর্ত্য সেনের একটি সংস্কৃত বই, সর্বোপরি রবিঠাকুরের হাতে লেখা একটি নোটবুক। স্টকহোম শহরে সেদিন শাড়িপরা সম্ভবতঃ একমাত্র এই বাঙালিনী ভাবাবেগে তার চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি ।
পরমার উৎসাহে আমরা দুজন গিয়েছিলাম স্টকহোমের ডাউন টাউনের আব্বা মিউজিয়ামে। সেখানে বাজছে আব্বার জনপ্রিয় গান, ফ্যানেদের জন্যে সাজানো নানা স্যুভেনির।
সেই যাত্রায় আমাদের প্রাইভেট ট্যাক্সির চালকটি ছিল সোমালিয়ার। যদিও মুলুক ছেড়ে অনেককাল এখানেই আছে। সংসার পেতেছে। সন্তানরাও বড় হচ্ছে সুইডেনেই। ভদ্রলোক খুব আলাপী। কোভিডের আগে মাত্র দু-তিন দিনের জন্যে ব্যাঙ্গালোর গিয়ে সে উচ্ছ্বসিত। বারবার সেখানকার মানুষের ব্যবহার, ক্লাইমেটের প্রশংসা করছিল। তার ছেলেটিকে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়াতে সে ব্যাঙ্গালোরেই পাঠাতে চায়।
গাড়ি চালাতে চালাতেই সে এক অদ্ভুত গল্প বলল। আমেরিকান এক ভদ্রলোক স্টকহোম পৌঁছে তার ট্যাক্সিতেই শহর পরিক্রমা করছিল। এদিক ওদিক ঘুরছিল। একদিন অনুরোধ করল স্টকহোমের উডল্যান্ড কবরখানায় নিয়ে যেতে। সেটি নাকি বড় সুন্দর একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টার। ট্যাক্সিচালকটির সেখানে যাবার দুর্ভাগ্য অথবা সৌভাগ্য কখনো হয় নি। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে ছিল বেড়াতে এসে কেউ এমন জায়গায় যায়? হোক না সে বিখ্যাত স্থান।
আমেরিকান পর্যটকটি একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, ওখানে তার কোনো প্রিয়জন শুয়ে আছে। এ দেশ ছেড়ে চলে যাবার আগে কবরে শায়িত সেই মানুষটিকে একবার শেষ শ্রদ্ধা সে জানিয়ে যাবে।
পৃথিবীর কোন প্রান্তে কার মাটি কেনা থাকে কেউ বলতে পারে না! আমরা মিছেই আমার দেশ, তোমার দেশ বলে ঝগড়া করে মরি! (ক্রমশ)
Tomar lekhaar ei kotha ta amar khub mone dhoreche – amra parle sob aborjonar free te pathie debo Sweden e .
Japan er eto extra money je tara without interest o loan dey. R amra parbo free te aborjona supply korte .
nandiniadhikari678@gmail.com
Ki darun lekha gulo tomar
হা হা একশ শতাংশ সত্যি কথা
সুন্দর বর্ণনা, পরবর্তী অধ্যায়ের অপেক্ষায়।
খুব খুব খুউব ভালো লাগলো…!!!!