গত সোমবার থেকে লোকসভার স্পিকার নিয়ে যে নাটক শুরু হয়েছিল, তার অবসান ঘটলো বুধবার রাজস্থানের কোটা আসনের সংসদ ওম বিড়লা ধ্বনি ভোটে দ্বিতীয়বারের জন্য ওই পদে নির্বাচিত হওয়ায়। সাধারণত লোকসভার স্পিকার নির্বাচিত হয়ে থাকেন ঐকমত্যের ভিত্তিতে। কিন্তু বিজেপি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ এবার সরকারকে ডেপুটি স্পিকার পদে তাদের প্রার্থী দাঁড় করানোর শর্ত দিলে সরকারি দল বিজেপি তা মানতে অস্বীকার করে। ফলে এবার স্পিকার পদে নির্বাচনে যেতে হয়। যদিও সংখ্যার নিরিখে ওম বিড়লার জয় একরকম নিশ্চিত ছিল। কারণ, এনডিএ জোটে রয়েছেন ২৯৩ জন সাংসদ আর বিরোধী জোটে রয়েছেন ২৩২ জন সাংসদ। তার মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়াইএসআর কংগ্রেস দলের প্রধান জগনমোহন রেড্ডি জানিয়ে রেখেছিলেন তাঁর দলের চার সাংসদ লোকসভার স্পিকার পদের ভোটাভুটিতে বিজেপি প্রার্থী ওম বিড়লাকেই ভোট দেবেন।
স্বাধীনতা উত্তর ভারতে লোকসভার স্পিকার পদে নির্বাচন একটি বিরল ঘটনা। ১৯৫২ সালে প্রথম লোকসভা থেকে ২০১৯-এর লোকসভা পর্যন্ত স্পিকার পদে কোনও নির্বাচন হয়নি। বিরোধীরা সাধারণভাবে শাসক গোষ্ঠীর প্রার্থীকেই মেনে নিতেন কিন্তু এবারই সেই প্রচলিত রীতির অন্যথা হল। বিজেপি রাজস্থানের কোটার সাংসদ ওম বিড়লাকে ফের একবার স্পিকার পদে দাঁড় করায়। রাজনৈতিক বিশেষঙ্গদের মতে এটা বিজেপির কৌশলও বটে। কারণ বিজেপি দেখাতে চায় তারা ধারাবাহিকতাকে বজায় রাখতে চায়। অন্যদিকে ওম বিড়লার বিরুদ্ধে স্পিকার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য কংগ্রেস বা বিরোধী শিবির কেরালার আটবারের সাংসদ কে সুরেশকে মনোনীত করেছিল। এরপর বিজেপির ওড়িশার সাংসদ তথা লোকসভার প্রোটেম স্পিকার ভর্তৃহরি মহতাব ধ্বনিভোটের প্রস্তাব দেন। ধ্বনিভোটে ওম বিড়লার পক্ষে এনডিএ সম্মতি প্রকাশ করে এবং বিরোধীরাও মতপ্রকাশ করে। বিরোধী শিবিরের কেউ কেউ অভিযোগ তুলেছেন প্রোটেম স্পিকার তাদের স্বর গ্রাহ্য করেননি বলে।
গত কয়েকদিন ধরেই স্পিকার পদটি ঘিরে ভারতের রাজনীতির ময়দান সরগরম হয়েছিল। তবে এই পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘটনা প্রথম নয়। এই প্রক্রিয়া স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এর আগেও ঘটেছে। ১৯৫১-৫২ সালে ভারতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয়। স্বাধীন দেশের লোকসভার প্রথম স্পিকার বা অধ্যক্ষ কে হবেন, তা নিয়ে যথেষ্ট লড়াই হয়েছিল। স্পিকার পদের জন্য দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু গুজরাটের বাসিন্দা স্বাধীনতা সংগ্রামী মালবনকরের নাম প্রস্তাব করলে সমর্থন জানান তৎকালীন সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী সত্য নারায়ণ সিনহা, দারভাঙ্গার সাংসদ এস এন দাস এবং গুরুগ্রামের সাংসদ পণ্ডিত ঠাকুর দাস ভার্গব। কিন্তু সিপিআই সাংসদ এ কে গোপালন এবং তার সঙ্গে ১৬ জন সিপিআই সাংসদ মালবনকরকে সমর্থন না করে স্পিকার পদে শংকর শান্তারাম মোরের নাম প্রস্তাব করেন। শান্তারামকে সমর্থন জানান টি কে চৌধুরী, এন এস নায়ার এবং রেনু চক্রবর্তী। এর ফলে স্পিকার পদের জন্য শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়। যাতে ৩৯৪ ভোট পেয়ে জি ভি মালবনকরই স্বাধীন ভারতের প্রথম লোকসভার স্পিকার হন।
এরপরের ঘটনা ১৯৭৫ সালের। ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণার পর সংসদের পঞ্চম অধিবেশনের মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়। এর পর ১৯৭৬-এ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্পিকার হিসেবে বি আর ভগৎ-এর নাম প্রস্তাব করেন। সেই প্রস্তাবকে সমর্থন করেন তৎকালীন সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী রঘু রামাইয়া। পাশাপাশি ভাবনগরের আদি কংগ্রেস সাংসদ এম মেহতা নয়া অধ্যক্ষ হিসেবে প্রস্তাব করেন জগন্নাথ রাও যোশীর নাম। ওই প্রস্তাবে সমর্থন জানান আরেক আদি কংগ্রেস সাংসদ এন সিং। লোকসভার স্পিকারের সেই লড়াইতে অবশ্য প্রত্যাশিত ভাবে ৩৪৪টি ভোট পেয়ে জয়ী হন ভগৎ। এর আগেও ১৯৬৭ সালে লোকসভার স্পিকার পদের জন্য নীলম সঞ্জীব রেড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন টি বিশ্বনাথনের সঙ্গে। সেবার স্পিকার হিসাবে নীলম সঞ্জীব রেড্ডি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এবারের লোকসভায় স্পিকার নির্বাচনে লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, কংগ্রেস তথা বিরোধীরা শুরু থেকেই শাসক দলকে চাপে রেখেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, স্পিকার নির্বাচনে প্রার্থী দিয়ে কংগ্রেস তথা বিরোধী ইন্ডিয়া জোট বুঝিয়ে দিয়েছে এবার তাঁরা সংখ্যায় অনেক বেশি, বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারকে যে প্রতি পদেই কংগ্রেস-সহ বিরোধীরা বাধা দেবে, তা এই স্পিকার নির্বাচনে তাদের প্রার্থী দেওয়া থেকেই পরিষ্কার। বিজেপির ওম বিড়লা দ্বিতীয়বার লোকসভার স্পিকার হওয়ার পর রাহুল গান্ধী-সহ অন্য বিরোধী নেতারা অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি দলের ঊর্ধ্বে উঠে ‘সবকা সাথ’ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। রাহুল সরাসরি বলেছেন, স্পিকারকে মনে রাখতে হবে বিরোধীরাও জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। তাঁদেরও বলার সুযোগ দিতে হবে। বিরোধী নেতারা বিগত লোকসভায় ওম বিড়লার স্পিকার হিসাবে ভূমিকার সমালোচনা করতেও ছাড়েননি। রাহুল তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে স্পিকারকে একাধিকবার সংবিধান মেনে চলার কথা বলেন।