গত রবিবার দেশের নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত হল। তৃতীয় বারের জন্য নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার পর একে একে মন্ত্রিসভার ৩০ জন পূর্ণমন্ত্রী এবং ৪১ জন প্রতিমন্ত্রী (৫ জন স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত-সহ) শপথ নেন। তবে এবার মোদীর ৭১ জন মন্ত্রীর মধ্যে মহিলা মন্ত্রীর সংখ্যা মাত্র সাত। আগের মোদী মন্ত্রিসভার তুলনায় সংখ্যাটি কম। ২০২১ সালে মোদী মন্ত্রিসভায় ১১ জন মহিলা সাংসদ মন্ত্রী হয়েছিলেন। সেবার মন্ত্রিসভার সদস্য সংখ্যা ছিল ৭৮। অর্থাৎ, মহিলা অংশগ্রহণের হার ছিল ১৪ শতাংশ। এ বার হল ১০ শতাংশেরও কম। এবার মহিলা মন্ত্রী সাতজন। তাঁদের মধ্যে দু’জন ক্যাবিনেট মন্ত্রী। হিসাব অনুযায়ী মোদীর গত মন্ত্রিসভা থেকে এবার মহিলা মন্ত্রীর সংখ্যা ৪ কম। তবে কী এবার মোদী মন্ত্রিসভায় মহিলাদের গুরুত্ব কমলো?
এমনটা মনে হতেই পারে কারণ, গত দশ বছর দেশের শাসন ক্ষমতায় বিজেপি কী মহিলাদের ন্যুনতম সুরক্ষা বা নিরাপত্তা দিতে পেরেছে? বিজেপি-শাসিত রাজস্থান এবং উত্তরপ্রদেশে দেশ নারী ধর্ষণে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে। গুজরাত দাঙ্গায় বিলকিস বানোর ধর্ষক ও তাঁর শিশুকন্যার খুনিদের জেল থেকে ছাড়িয়ে এনে সে রাজ্যের বিজেপি সরকার রীতিমতো মিষ্টিমুখ করিয়ে সংবর্ধনা দিয়েছে। অন্য ধর্মের মহিলাদের সম্পর্কে যোগী আদিত্যনাথ-সহ বিজেপির বিভিন্ন নেতামন্ত্রীরা যেসব বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করেছেন তাকে ভয়াবহ বললেও কম বলা হয়। হাথরসে নির্যাতিতার দেহ পুড়িয়ে, তাঁর পরিবারের উপর নির্যাতন চালিয়ে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা হয়েছে, কাঠুয়ায় আসিফার ধর্ষক-খুনিদের সমর্থনে বিজেপি বিধায়কেরা মিছিল করেছে। কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি যৌন হেনস্থায় অভিযুক্ত ব্রিজভূষণ সিংয়ের শাস্তির দাবিতে পদকজয়ী মহিলা কুস্তিগিরেরা রাস্তায় ধরনা দিলে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের পুলিশ তাঁদের টেনে হিঁচড়ে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু কোনো ঘটনাতেই বিজেপি সরকারের মহিলা মন্ত্রীরা প্রতিবাদ তো দূরের কথা দুঃখপ্রকাশ করেন নি। বরং বিজেপির মতাদর্শগত অভিভাবক সংগঠন আরএসএস-এর প্রধান মোহন ভাগবত বলেন, ‘মহিলাদের কাজ শুধু গৃহকর্ম করা’। এমন বৈষম্যমূলক সামন্ততান্ত্রিক মন্তব্যের পরও নির্মলা সীতারমন, অন্নপূর্ণা দেবী, শোভা করন্দলাজে, রক্ষা খড়সে, সাবিত্রী ঠাকুর, নিমুবেন বামভানিয়া প্রমুখেরা বিজেপি রাজনীতি করেন কীভাবে আর মন্ত্রীসভায় যোগ দেন কোন মুখে?
অন্যদিকে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র সংসদীয় দলের নেতা নরেন্দ্র মোদী জোটের আদর্শ ও নীতি নিয়ে যিনি বললেন, ‘সর্বপন্থা সমভাব’, কিন্তু তাঁর ওই আশ্বাসবাণীর ৪৮ ঘণ্টা পর যে ৭২ জন সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠিথল, সেখানে একজন মুসলমানেরও জায়গা হল না। হিসেব অনুযায়ী, মোট ভোটারের ১৪ শতাংশ ভোটার মুসলিম। কিন্তু মোদীর নতুন মন্ত্রিসভায় সংখ্যালঘু প্রতিনিধি কোথায়? এমনকি শরিক দল তেলেগু দেশম বা জনতা দল ইউনাইটেডও কী কোনো মুসলিম প্রার্থীকে মন্ত্রী করা হল? অথচ মোদীর প্রথম মন্ত্রিসভাও এমন মুসলমানশুণ্য ছিল না। ২০১৪ সালের লোকসভায় একক ক্ষমতা লাভের পরও মোদী মন্ত্রিসভায় নিয়েছিলেন নাজমা হেপতুল্লাহকে, তাঁকে সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে বিজেপির রাজ্যসভার সদস্য মুস্তাক আব্বাস নাকভিকেও দেওয়া হয়েছিল একই মন্ত্রণালয়ের ভার। যদিও ২০২২ সালের ৬ জুলাই নাকভির রাজ্যসভার মেয়াদ শেষ হলে বিজেপি তাঁকে আর সদস্য করেনি। সেই থেকে মোদীর মন্ত্রিসভায় মুসলমানদের জন্য দরজা বন্ধ।
মোদীর বিজেপিতে মুসলমানদের যে স্থান নেই, তা সর্বজনবিদিত। এবারের নির্বাচনী প্রচারে বিভিন্ন জনসভায় কংগ্রেস ও মুসলিমদের তিনি যে কীভাবে সমার্থক করে ঘৃণ্য বক্তৃতা করেছেন সেকথাও সবার জানা। কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশতেহারে তিনি মুসলিম লিগের ছায়া দেখেছেন। কংগ্রেস অন্যদের সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করবে, সেকথাও বলেছেন। কিন্তু তখনও তিনি জানতেন না, তাঁর দল নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা থেকে ৩২ ধাপ দূরে থমকে যাবে। বাধ্য হয়েই সরকার গড়ার তাগিদে তিনি ‘সর্বপন্থা সমভাব’–এর কথা বললেও মন্ত্রিসভায় জায়গা দেননি একজন মুসলমানকেও। অথচ এবারের ভোটেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ৭৮ জন মুসলমান প্রার্থী। তাঁদের মধ্যে জিতেছেন ২৪ জন, যাদের মধ্যে ২১ জনই ‘ইন্ডিয়া’ জোটের। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে মন্ত্রী হয়েছেন পাঁচজন। তাঁদের মধ্যে হরদীপ পুরী ও রবনীত সিং বিট্টু শিখ ধর্মাবলম্বী। জর্জ কুরিয়েন খ্রিষ্টান। রামদাস আটওয়ালে ও কিরেন রিজিজু বৌদ্ধ। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন বিজেপির শাহনাওয়াজ হুসেন ও ন্যাশনাল কনফারেন্সের ওমর আবদুল্লাহ। ২০০৪ ও ২০০৯ সালে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারেও মুসলিম মন্ত্রীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে চার ও পাঁচজন। অর্থাৎ মোদী মিথ্যাই ‘সর্বপন্থা সমভাব’–এর কথা বলেছেন।
১৮তম লোকসভা নির্বাচনের আগেও বাংলায় শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদাররা প্রায়ই দাবি করতেন, সংখ্যালঘু মুসলমানদের একাংশও নাকি এখন তাদের ভোট দিচ্ছেন। এটাই কী তার প্রতিফলন? বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর থেকে বিশেষ করে গোধরা কাণ্ডের পর সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিজেপিকে ভোট না দেওয়ার যে প্রবণতা তৈরি হয় ভারেতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীও তা বুঝতেন। তিনি জানতেন যে, মুসলিমদের আস্থা অর্জন করা বিজেপির পক্ষে কঠিন। তিনি মোখতার আব্বাস নকভিকে ১৯৯৮ সালে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী করেছিলেন। বাজপেয়ীর পর বিজেপির সভাপতি লালকৃষ্ণ আদবানি ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হতে তিনি দেশের সংখ্যালঘুদের বার্তা দিতে পাকিস্তান সফরে গিয়ে ‘কায়েদ এ আজম’ মহম্মদ আলি জিন্নাহর প্রশংসা করে বলেছিলেন, জিন্নাহ ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন। সেই মন্তব্যের জন্য তাঁকে দলের সভাপতির পদ ছাড়তে হয়। ১৪০ কোটি মানুষের দেশে মুসলমান জনসংখ্যা প্রায় ২০ কোটি। হিন্দু জনসংখ্যার তুলনায় তা যথেষ্ট কম হলেও পৃথিবীর অনেক দেশের মোট জনসংখ্যা ২০ কোটির কম। কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক মানুষের কোনো প্রতিনিধি এবার যে কেন্দ্রীয় সরকারে নেই তা অত্যন্ত চিন্তার বিষয়।