রবিবার | ৮ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | দুপুর ২:০৪
Logo
এই মুহূর্তে ::
গাছে গাছে সিঁদুর ফলে : দিলীপ মজুমদার ভালো থাকার পাসওয়ার্ড : বিদিশা বসু সলিমুল্লাহ খানের — ঠাকুরের মাৎস্যন্যায় : ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা : মিল্টন বিশ্বাস নেহরুর অনুপস্থিতিতে প্যাটেল, শ্যামাপ্রসাদও ৩৭০ অনুমোদন করেছিলেন : তপন মল্লিক চৌধুরী সিঁদুরের ইতিকথা আর কোন এক গাঁয়ের বধূর দারুণ মর্মব্যথা : দিলীপ মজুমদার সাহিত্যিকদের সংস্কার বা বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষে শ্রীপাণ্ডবা বা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত দশহরার ব্যুৎপত্তি ও মনসাপূজা : অসিত দাস মেনকার জামাই ও জামাইষষ্ঠী : শৌনক ঠাকুর বিদেশী সাহিত্যিকদের সংস্কার ও বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ভক্তের ভগবান যখন জামাই (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য-এর ছোটগল্প ‘সময়ের প্ল্যাকটফর্ম’ গুহাচিত্র থেকে গ্রাফিটি : রঞ্জন সেন জামিষষ্ঠী বা জাময়ষষ্ঠী থেকেই জামাইষষ্ঠী : অসিত দাস কার্বাইডে পাকানো আম দিয়ে জামাইষষ্ঠীতে জামাই খাতির নয়, হতে পারে ক্যান্সার : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ভক্তের ভগবান যখন জামাই (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত কাশ্মীর নিয়ে বিজেপির নেহরুকে দোষারোপ ধোপে টেকেনা : তপন মল্লিক চৌধুরী রবীন্দ্র নাটকের দুই ট্র্যাজিক রাজা : শৌনক দত্ত কবির মৃত্যু : দিলীপ মজুমদার শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের সপ্তসঙ্গিনী : স্বামী তেজসানন্দ মহারাজ দীঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাস্টার স্ট্রোক : সন্দীপন বিশ্বাস সিঁদুরে মেঘের গর্জন : অসিত দাস শতবর্ষে অন্য বিনোদিনী — তৃপ্তি মিত্র : শৌনক দত্ত আমার প্রথম অভিনয় দেখে সত্যেন বসুই বলেছিলেন— তোর হবে : জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ইন্দ্রজিৎ আমাকে ক্লান্ত করে কেবলই ক্লান্ত : তপন মল্লিক চৌধুরী মনোজ বসু-র ছোটগল্প ‘বাঁশের কেল্লা’ গ্রেস কটেজ বুলেটিন প্রকাশ : দীপাঞ্জন দে অথ ওয়াইন কথা : রিঙ্কি সামন্ত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিকিৎসাবিভ্রাট : অসিত দাস বাংলা ইসলামি গান ও কাজী নজরুল ইসলাম : আবু বকর সিদ্দিকি
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা (গুরু পূর্ণিমা) আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

কবি কুসুমকুমারী দাশ ও পরাবাস্তবতার কবি জীবনানন্দ : বিজয়া দেব

বিজয়া দেব / ৪৫৭ জন পড়েছেন
আপডেট শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪

মেয়েরা লেখে, কিন্তু তাঁকে লেখার সময় খুঁজে বের করে নিতে হয়। ভারতীয় ঘরানার রান্নাঘরের এবং গৃহের অন্তর্গত ব্যবস্থাপনায় এমন কিছু আছে যা সারাদিন আটকে রাখার জন্যে যথেষ্ট।

আমরা যদি কিছুটা পেছনের দিকে হাঁটি আর খুঁজে পাই এক একান্নবর্তী পরিবারের রান্নাঘর ও এক কবিকে, অবশ্যই সেসময়কার ভাষ্যে মহিলা কবিকে, তাহলে রান্নাঘরটিই সেই কবির কবিসত্তাকে ছাপিয়ে যায়। মনে হয় ভারতীয় ঘরানার রান্নাঘর নিয়েই নাহয় একখানা দীর্ঘ আলোচনায় বসি। কবে থেকে কর্মবিভাজন হয়েছিল মেয়েদের জন্যে রান্নাঘর আর ছেলেদের জন্যে আলো হাওয়ার উন্মুক্ত পৃথিবী কে জানে!

প্রাসঙ্গিক আলোচনায় আসছি কবি কুসুমকুমারী দাশকে নিয়ে। কবি কুসুমকুমারী দাশের একটি কবিতা আমরা মোটামুটি সবাই জানি —

“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে

কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে…. “ইত্যাদি

নি:শব্দেই যেন কবি জীবনানন্দ দাশ মায়ের এই উচ্চারণকে গ্রহণ করেছেন, যাঁকে কথায় পাই কম, কবিতায় পাই বেশি। এবং তাঁর কবিতাপাঠে যে aesthetic পরিশুদ্ধি চেতনাকে পরিশ্রুত করে তার পেছনেও রয়েছে এক দীর্ঘ ছায়া, সেটি তাঁর মায়ের।

কুসুমকুমারী দাশ (১৮৭৫-১৯৪৮) জন্মেছিলেন অবিভক্ত ভারতের বরিশাল শহরের গৈলা গ্রামে। তাঁর বাবা চন্দ্রনাথ দাশ ও মা ধনমণি দাশ। চন্দ্রনাথ দাশ ছিলেন কবি। চন্দ্রনাথ দাশ প্রসঙ্গে জীবনানন্দ লিখছেন —

“মা-র বাবা চন্দ্রনাথ দাশও গান ও কবিতা লিখেছেন অনেক। এঁরও দেখেছি অব্যর্থ স্বভাব রয়েছে যা বিশেষভাবে শিক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত হলে কাব্যে প্রকাশিত হয়ে উঠতে পারে — না হলে অশিক্ষিতপটুত্ব উল্লেখ্য পদ্যে — কোনও কোনও লাইনের বা উপমার উল্লেখযোগ্যতা আরও কিছু প্রগাঢ় হলেও দাদামশায়ের অনেক লেখা মধুসূদন, ঈশ্বর গুপ্ত, হেম, রঙ্গলালকে মনে করিয়ে দিলেও, তাঁর সফলতর লেখা — বিশেষ করে কয়েকটি গানে, লোকগাথায় ও লোককবিতায় খানিকটা সার্থক উত্তরসাক্ষ্য হিসেবে টিঁকে থাকবে বলে মনে হয়।”

সুতরাং এটি ভাবা যেতেই পারে যে, জীবনানন্দ মাতৃকুলের ধারাবাহিকতার সূত্র ধরে বাংলা কবিতায় নতুনত্বের স্বাক্ষর দিলেন এবং তার বীজের সূত্রপাত দাদামশাই থেকে মা হয়ে তাঁর মধ্যেই সফলতরভাবে উপ্ত হলো।

বরিশালের গৈলা গ্রামে কুসুমকুমারীদের পুরো পরিবার ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলে সামাজিক বিরূপতার কারণে বাধ্য হয়েই তাঁদের গ্রাম ছেড়ে বরিশাল শহরে চলে আসতে হয়।

১২৯৬ বঙ্গাব্দে বরিশালে একটা মেয়েদের ইশকুল স্থাপিত হয়। কুসুমকুমারী সেই ইশকুলে ভর্তি হন। কিন্তু কিছুদিন পর সেই ইশকুল উঠে গেলে কুসুমকুমারী কলকাতার বেথুন ইশকুলে ভর্তি হন। কিছুদিন “প্রবাসী” সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেন, তারপর ব্রাহ্মবালিকা বোর্ডিং এ চলে যান। কুসুমকুমারী কবিতা প্রবন্ধ ইত্যাদি ছোটবেলা থেকেই লিখতেন, পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলেন, কিন্তু প্রবেশিকা পরীক্ষার আগে, বয়েস যখন তাঁর মাত্র উনিশ, বরিশালের সত্যানন্দ দাশের সাথে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। সত্যানন্দ দাশ ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ও প্রচারক এবং বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক।

কুসুমকুমারীর জীবন তখন থেকে অন্য খাতে বইতে শুরু করে। সেইসময়, বিয়ে মানে এক বিশাল একান্নবর্তী পরিবারের একজন হয়ে যাওয়া এবং সবার সুখদু:খের মাঝে এবং উনকোটি ঘরোয়া কাজের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া, এককথায় এতটাই আত্মত্যাগ যেখানে ‘আমি’ বলে কিছু নেই, যেন অলিখিত এক নির্দেশনামায় বাধ্যতামূলক স্বাক্ষর দিয়ে শ্বশুরবাড়ির দুয়ার পেরোনো।

“কুসুমকুমারী দাশের দিনলিপি” বইটির ভূমিকায় বইটির সংকলক ও সম্পাদক ভূমেন্দ্র গুহ লিখছেন — “বিয়ের পর তাঁর জীবন দু’টি খাতে বইতে শুরু করল। সে কালের মধ্যবর্তী একান্নবর্তী একটা বহু মানুষের বিমিশ্র সংসারে নিয়ত ঘূর্ণায়মান কাজের চাকায় অচ্ছেদ্যভাবে সংলগ্ন হয়ে গেলেন, আলাদাভাবে ব্যক্তিগত জীবনের অন্যতর কোনও সার্থকতার ধারণা তাঁর মনে প্রশ্রয় পেল না।”

কুসুমকুমারী নিজের লেখালেখির ব্যাপারে আলাদাভাবে কিছু ভাবতে পারেননি, তার সহজাত সৃজনসত্তার তাগিদ নিরন্তর কাজের ফাঁকে ফাঁকে সময়ে অসময়ে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছে কলম, তিনি লিখেছেন এবং তা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। জীবনানন্দ দাশ “আমার মা” স্মৃতিচারণায় লিখছেন —

“সংসারের কাজকর্মে খুব ব্যস্ত আছেন এমন সময়ে “ব্রহ্মবাদী”-র সম্পাদক আচার্য মনোমোহন চক্রবর্তী এসে বললেন — এক্ষুনি “ব্রহ্মবাদী”র জন্যে তোমার কবিতা চাই, প্রেসে পাঠাতে হবে, লোক দাঁড়িয়ে আছে। শুনে মা খাতাকলম নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে একহাতে খুন্তি, আর একহাতে কলম নাড়ছেন, দেখা যেত যেন চিঠি লিখছেন, বড় একটা ঠেকছে না কোথাও, আচার্য চক্রবর্তীকে প্রায় তখনই কবিতা দিয়ে দিলেন। স্বভাবকবিদের কথা মনে পড়ত আমার, আমাদের দেশের লোককবিদের সহজতাকে।”

তবে ভূমেন্দ্র গুহ লিখছেন — কুসুমকুমারীর স্বামী সত্যানন্দ দাশ কুসুমকুমারীকে চিঠিতে লিখেছিলেন — সন্তানপালন ব্যতীত একটা কিছু ব্রত গ্রহণ কর — একখানা কিছু লিখিতে আরম্ভ কর। (খ্রি ১৯০০, জুলাই ১৯।)

সংসারের কাজকর্ম সন্তানপালন লেখালেখি ছাড়াও সামাজিক কাজেও নিজেকে লিপ্ত রেখেছিলেন কুসুমকুমারী। তখনকার সময়ের ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বীদের পরার্থে কাজ করার যে মূল্যচেতনা তা কুসুমকুমারীর মধ্যে ছিল। কী করে যে এত দু:সাধ্য কাজ তিনি একসাথে চালিয়ে যেতেন ভাবলে চমকিত হয়। জীবনানন্দ “আমার মা” স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, খুব সকালবেলায় এমনকি শীতকালেও কুসুমকুমারী ঘুম থেকে উঠতেন আর কাজকর্ম সেরে অনেকরাতে ঘুমাতে আসতেন। “আমার মা” স্মৃতিকথার পরাবাস্তব পৃথিবীর আলোছায়ার ছোঁয়া পাঠককে মুগ্ধ করে। এমন কি তিনি তাঁর মা-র সম্পর্কে যে অসামান্য বর্ণনা দিয়েছেন তা-ও পাঠককে ভাবায়, ভাবিয়ে তুলতে বাধ্য করে।

জীবনানন্দ লিখছেন —

“মনে পড়ে বরিশাল-এর সেই রাতগুলো; যখন খুব ছোট ছিলাম, প্রথম রাতেই চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে যেত। আমাদের পড়াশোনা খাওয়াদাওয়া শেষ হত। বাবা বাতি জ্বালিয়ে অনেক রাত অবদি লিখতেন। টের পেতাম মা রান্নাঘরে আছেন।”

সংসারের শেষ মানুষটির খাওদাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি ফিরতেন না। শিশু জীবনানন্দ ঘুম এলেও ঘুমের প্রতি প্রতিশোধ নিয়ে জেগে থাকতেন মায়ের জন্যে।

জীবনানন্দ লিখছেন — “খুব দেরিতে আসতেন, চারিদিকে শীতের রাত তখন নিথর, নিস্তব্ধ, আমাদের বাড়ির থেকে খানিকটা দূরে বাজকুড়ুল পাখি ডাকত, প্রহরে প্রহরে সেই পাখি দুটো –বরিশাল-এর শীতের অনন্ত অন্ধকারে দেবযানী আত্মাদের সঙ্গে। মা ঘরে এসে ঘুরতেন ফিরতেন -এবং সেবা করতেন-দূরে পাখির ডাক-আমি এখনও জেগে আছি কেন-কতদূর পড়াশোনা করেছি জিজ্ঞেস করতেন। ”

এই রাতে যদি প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে সাহায্যের জন্যে ডাক আসে কবি সেই ভয়ে সহজে ঘুমোতেন না।

জীবনানন্দ লিখছেন —

“অঘ্রান পৌষের শীত, ভয় পেতাম কোনও কোনও পড়শীর বাড়ির লোক ডাকতে আসতে পারে। কারু মারাত্মক রোগ হয়েছে হয়তো, হয়তো কোনও দু:স্থ পরিবারকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের আশ্রয় থেকে, হয়তো কোনও নিম্নশ্রেণীর লোকের মৃত্যু হয়েছে, হয়তো কোনও অনাথ স্ত্রীলোক বিশেষ কারণে বিপন্ন, হয়তো কোনও প্রতিবেশীর ঘরে ছেলেপিলে হবে, মার কাছে খবর এসে পৌঁছলেই তিনি চলে যাবেন, সারারাত বাড়িই ফিরবেন না হয়তো আর। জেগে বা ঘুমিয়ে একাই পড়ে থাকতে হবে আমাদের। বাইরের থেকে এরকম কোনও ডাক না এলে মা প্রদীপের পাশে সেলাই করতে বসে গেলেন হয়তো, কিংবা সমস্ত দিনের শেষে দু-চারটে পত্র পত্রিকা বই নিয়ে বসে পড়তেন। মায়ের মুখচোখের সামনের সেই প্রদীপের দিকে তাকিয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তাম।”

কুসুমকুমারীর জীবন নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন জীবনানন্দ ভিন্নতর দৃষ্টিকোণ থেকে। কখনও কবির মনে হয়েছে এই যে সংসারের জন্যে প্রাণপাত পরিশ্রম সাধন, কর্তব্যকর্মকে সৃজনকর্ম থেকে অনেকবেশি অগ্রাধিকার দেওয়া, সামাজিক কাজে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, ব্রাহ্মধর্মের চিত্তের পরিশুদ্ধি ও জীবনের মহত্ত্বে বিশ্বাস তা হয়তো একদিক দিয়ে সঠিকই ছিল। পরার্থে কাজের শুদ্ধতা কবি কুসুমকুমারী বজায় রাখতে পেরেছিলেন এবং সাহিত্যসাধনার বিনিময়ে কিছুই চাননি।

আবার তাঁর এটাও মনে হয়েছে যে যদি সাহিত্যচর্চায় তিনি আরও সময় দিতে পারতেন তাহলে বাংলাসাহিত্যে বিশেষ কিছু সংযোজন করে দিয়ে যেতেও পারতেন।

জীবনানন্দ “আমার মা” স্মৃতিচারণায় লিখছেন —

“মা বেশি লেখবার সু্যোগ পেলেন না। খুব বড় সংসারের ভেতর এসে পড়েছিলেন যেখানে শিক্ষা ও শিক্ষিতদের আবহ ছিল বটে, কিন্তু দিনরাত্রের অজস্র কাজের ফাঁকে সময় করে লেখা — তখনকার দিনের সেই সংসারের একজন স্ত্রীলোকের শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়ে উঠল না আর। কবিতা লেখার চেয়ে কাজের ও সেবার সর্বাত্মকতার ভেতরে ডুবে গিয়ে তিনি ভালোই করেছেন হয়তো….কিন্তু তিনি আরও লিখলে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ কিছু দিয়ে যেতে পারতেন মনে হয় ”

জীবনানন্দ কবি জীবনানন্দ হয়ে ওঠার পেছনে মা কুসুমকুমারীর ভূমিকাটিও স্বীকার করেছেন —

“সমস্ত ইস্কুলের জীবন তিনি আমাদের ইস্কুলের পড়া শিখিয়েছেন সংসারের কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে। ইস্কুলি পড়া শেখাবার সুযোগে যে বুনিয়াদ গড়েছেন, সেটা ইস্কুল কলেজের ক্যারিকুলাম এর সঙ্গে খাপ খেয়ে চলে না শুধু, সদর্থ আবিষ্কার করে চলতে থাকে সংসারের, সমাজের, দেশের, জীবনের…..সাহিত্য পড়ায় ও আলোচনায় মাকে বিশেষ অংশ নিতে দেখেছি। দেশি বিদেশি কোনও কোনও কবির ও ঔপন্যাসিকের রচনায় কোথায় কী ভালো, কী বিশেষ দিয়ে গেছেন তাঁরা, এসবের প্রায় প্রথম পাঠ তাঁর কাছ থেকে শিখেছি। ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর অনেক ছোট ছোট কবিতা তাঁর মুখে শুনেছি এবং শেলি ব্রাউনিঙ এর বৈষ্ণব পদাবলী থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত আমাদের দেশের কবিতার মোটামুটি ঐতিহ্য জেনেও ভালোবেসেও বিদেশি কবিদের কাউকে কাউকে মনে রেখেও তিনি তাঁর শিক্ষিত কবিমনকে শিক্ষিত ও স্বতন্ত্র করে রেখেছিলেন।” (আমার মা, জীবনানন্দ দাশ)।

কুসুমকুমারী দাশের দিনলিপি বইটিতে ভূমিকা লেখক ভূমেন্দ্র গুহ কুসুমকুমারীর লেখালেখি সম্পর্কে যে তথ্য তুলে ধরেছেন তাতে রয়েছে তাঁর প্রকাশিত দুটো বইয়ের নাম — একটি বই কবিতার, নাম কাব্যমুকুল, যেটি রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এর উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছিল। আর দেখতে পাচ্ছি একটি গল্পের বইএর নাম — পৌরাণিক আখ্যায়িকা।

শিবনাথ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় “মুকুল ” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর অতি জনপ্রিয় ও বিখ্যাত কবিতা “আদর্শ ছেলে”। কবিতাটি “মুকুল”-এর প্রথম ভাগ পৌষ ১৩০২ সপ্তম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এরপর আরও দুটি কবিতার নাম পাচ্ছি যা মুকুলে প্রকাশিত হয় — ‘খোকার বিড়ালছানা’, ‘দাদার চিঠি’। কুসুমকুমারীর স্বামী সত্যানন্দ দাশের একটি লেখা মুকুলে পাওয়া গেছে মুকুল প্রথম ভাগ চৈত্র ১৩০২ বঙ্গাব্দের দশম সংখ্যায়। লেখটির নাম ছিল “নেপোলিয়ন ও জেকাপো।”

“ব্রহ্মবাদী” পত্রিকায় কুসুমকুমারীর অনেক কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। ভূমেন্দ্র গুহ লিখছেন — “অন্তত ষাটটি কবিতা চোখে পড়েছে। এছাড়াও, “বঙ্গের মহিলা কবি ” বইটিতে পরিচিতি সহ তাঁর কবিতা গৃহীত হয়েছে।”

কুসুমকুমারী যতদিন বরিশালে ছিলেন ততদিন নানা সমাজসেবামূলক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্টিত হয়েছিল প্রগতিশীল দৃষ্টিকোণ থেকে। বাল্যবিবাহ, মেয়েদের অশিক্ষা, কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে উদ্ধার করার পথনির্দেশ দেওয়ার কাজটি ব্রাহ্মসমাজ করে গেছে। সুতরাং ব্রাহ্মধর্মের নির্দেশে বরিশাল শহরের ব্রাহ্মিকা সমাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় কুসুমকুমারীকে। “ব্রহ্মবাদী” পত্রিকার সমাচার থেকে জানা যায়, বিশেষ বিশেষ অধিবেশনে কুসুমকুমারী আচার্যের দায়িত্বে ছিলেন। এমনকি ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ সভায় তিনি আচার্যের কাজও করেছেন।

মূলত তিনি ছিলেন বরিশাল মহিলাসমিতির সম্পাদিকা। মহিলা সভার অধিবেশনে কুসুমকুমারী ” নারীজাতির কর্মক্ষেত্র ও কার্য” বিষয়ে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন। দরিদ্র মেয়েদের শিক্ষাদান, অন্তপুরের নারীশিক্ষা, মেয়েদের ধাত্রীবিদ্যা শিক্ষা, অন্তঃপুর নারীশিক্ষা ইত্যাদি কাজে ব্রাহ্ম মহিলা সমাজ নিরবচ্ছিন্ন কাজে জড়িত ছিল। জীবনানন্দ লিখেছেন সেই মূল্যচেতনার কথা।

“সেই বয়স-তখনকার সেই মা — প্রথম মহাযুদ্ধের গোড়ার দিকে সেই অপেক্ষাকৃত নির্দোষ পৃথিবী — আজ মনে হচ্ছে কোনও পীস কনফারেন্সই মানুষের বিক্ষিপ্ত জীবনে সেই অনবতুল সমাবেশ ফিরিয়ে দিতে পারবে কি…… আজ অনুভব করি যে তাঁদের নানা বিজ্ঞানের ভূষণ ছিল না, কিন্তু মহত্তর মর্মজ্ঞান ছিল। যে বড় পটভূমি তার উচিত ছিল সংসারে, সে পটভূমি পান নি তিনি। কিন্তু তা হলে কী হবে, তিলধারণের মত তুচ্ছ ভূমিকায় দেখিয়েছেন ব্রহ্মান্ড প্রতিফলিত হয়ে উঠতে পারে।

আমরা তাঁর সন্তান — ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে বেরিয়েছি অনেক দিন হতে চলল। কিন্তু কার কাছে শিক্ষা পেয়েছিলাম আমরা? আমি অন্তত? তিনজন মানুষের কাছে। একজন বাবা, একজন মা, আর একজন ব্রজমোহন স্কুলের হেডমাস্টার আচার্য জগদীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।….. আমার জীবনের ভিত্তি এঁদের হাতে গড়া।”

“আমার মা-বাবা” স্মৃতিচারণায় জানতে পারি, কুসুমকুমারী কৃতী ছাত্রী ছিলেন। পরীক্ষায় ভালো করার করার জন্যে তিনি যে সব বই বেথুন স্কুল থেকে পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলেন ছোটবেলায় কবি সেগুলিকে খুব সমীহের চোখে দেখতেন। “প্রবাসী” সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় কুসুমকুমারীকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কুসুমকুমারীর কবিতা নিয়ে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় “কাব্যমুকুল” নামে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। জীবনানন্দ লিখছেন — সেই বইটি আজকাল আর কোথাও পাওয়া যায় না, আমাদের কাছেও নেই। শেষ সংস্করণ বিক্রি হয়ে গেলে আমাদের কাছে আর কোনও কপি ছিল না। মা-র কিছু কিছু কবিতা অনেক পুরনো ও লুপ্ত পত্রিকায় ইতস্তত ছড়িয়ে আছে ; সেসব কবিতা কোনও দিন উদ্ধার করা সম্ভব হবে কিনা বলা কঠিন….”

অনেক প্রশ্ন ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব মনের ভেতর পাক খেয়ে ওঠে। কুসুমকুমারীর ত্যাগ ও নিজের সৃজনসত্তার প্রতি নিরাবেগ থাকা ও জীবনের মর্মচেতনাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ভিত্তিতে তিনি যেভাবে পুত্রকন্যাদের গড়ে তুলেছিলেন সেজন্যেই কি আমরা পরাবাস্তববাদী কবি জীবনানন্দকে পেলাম? না কি তা না হলে আমরা আরও এক প্রাতিস্বিক কবিকে পেতাম যাঁর নাম কুসুমকুমারী দাশ? না কি দুজন কবিকে পেতাম যাঁরা ভিন্নমাত্রার স্বাক্ষর বাংলাসাহিত্যে রেখে যেতেন?

বাংলা সাহিত্য ক্ষতিগ্রস্ত হল না কি লাভবান হলো সেই প্রশ্ন থেকে গেল প্রশ্নের আকারেই।

তথ্যসূত্র : “কুসুমকুমারী দাশের দিনলিপি”। সংকলন ও সম্পাদনা — ভূমেন্দ্র গুহ।


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন