চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের আগেই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সদর্পে ৪০০ আসন জয়ের ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সাত দফার মধ্যে দু’দফা ভোট শেষ হতে না হতেই গেরুয়া শিবিরে সেই প্রত্যয় আর নেই বরং কিছুটা হতাশার সুর শোনা যাচ্ছে। প্রথমত; এবারের লোকসভা নির্বাচনে ভোটারদের উৎসাহ ও উপস্থিতি আশানুরূপ নয়। দীর্ঘ ৭৫ বছরের গণতান্ত্রিক শাসনে থাকা দেশটিতে ভোটের হার বেশ কয়েক শতাংশ কম। এই ভাবে ভোটের শতাংশ কমে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতাদের বলিরেখায় চিন্তার স্পষ্ট ছাপ হয়ে উঠেছে। যদিও নির্বাচন কমিশন ভোটের শতাংশ কমে যাওয়ার জন্য অসহ্য গরম আবহাওয়াকে কারণ হিসাবে ব্যাখ্যা করছে কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত, ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে টেনে আনার মতো কোনো ইস্যুকেই কোনো রাজনৈতিক নেতা বা দল মানুষের সামনে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রশ্ন; লোকসভা নির্বাচনের আগে ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারে এমন কোন ইস্যু আছে যা বিজেপির পক্ষে যেতে পারে? বরং এমনটাই বলা যায়, বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল বেকারদের কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কিন্তু পরপর দুটি মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পরও দেখা যাচ্ছে, বেকারত্ব ভারতীয় অর্থনীতির একটি বড় সমস্যা। ২০২২ সালের বিশ্বব্যাংকের একটি রিপোর্ট অনুসারে, ভারতের যুব বেকারত্বের হার ২৩.২%। ২০২৩ সালে ভারতে স্নাতক বেকার ছিল ৪২.৩%। মোদী কোটি কোটি চাকরির মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছাতি ফোলালেও বেকার যুবসমাজকে ভোট কেন্দ্রে হাজির করতে পারেননি। সারা দেশে হিন্দুত্বকে চাঙ্গা করতে রামমন্দির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য ব্যাপক প্রচার চালানো হল, মোদী সরকারের নীতি ও হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের জয়গান গেয়ে বলিউড কত সিনেমা বানিয়ে মুক্তি দিলো — এসবই তো আসলে বিজেপির নির্বাচনের সাফল্যের জন্য। কিন্তু মোদী ও শাসক দলের নীতি প্রণেতারা ব্যাপক মানুষকে ভোটে উৎসাহিত করতে পারলো না কেন?
তবে কি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শাসনে জনগণের একটি বড় অংশ হাঁপিয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, জনগনের একাংশের মোহভঙ্গ ঘটায় তারা অনেকেই ভোটের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। মানুষ হয়তো বুঝতে পেরেছে, মোদী সরকার ভারতের বেকারত্ব, দুর্বল অর্থনীতি ইত্যদি নিয়ে যত না চিন্তিত তার থেকে অনেক বেশি সক্রিয় ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধন সংশোধন করে দেশটিকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে। দেশে প্রকট বেকার সংকট, জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে, ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতি, পশ্চিম উত্তর প্রদেশে ভোটারদের একটা বড় অংশ কৃষিজীবী এবং জাঠ, সেই বলয়ের অনেকগুলো আসনে ভোট হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী মোদী সরাসরি হিন্দুত্বের লাইনে প্রচার করলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে হিন্দু ও মুসলিম পরিচয়ের এই মেরুকরণ চূড়ান্ত রূপ নিয়ে ফেলেছে। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে হিন্দুদের সব সম্পদ তারা মুসলিমদের হাতে তুলে দেবে। মহিলাদের মঙ্গলসূত্র পর্যন্ত ছাড়বে না। এই ধরনের ঘৃণ্য প্রচারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের কাছে নালিশ পৌঁচেছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেই হিন্দুদের কাছে মুসলিমদের ইস্যু বানিয়ে ভোট চাইছেন, এই যদি বিজেপির রণকৌশল হয় তাহলে তার পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী? গুজরাটে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গার সময়ও কিন্তু এইরকম প্রচার হয়েছিল।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যাচ্ছে, এবার ২৬৬টি আসনে ভোটের হার কম। এর মধ্যে ২১৫টি গ্রামীণ আসন আর ৫১টি শহুরে আসন। প্রচণ্ড গরমের জন্য মানুষ ঘর থাকে বেরিয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে চাইছে না, এটা একটা কারণ হতে পারে। কিন্তু ভোটের প্রতি যে মানুষের একটা অনীহা এসেছে, সেটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে নতুন ভোটারদের জন্য বহু রকম প্রচার করার পরও কিন্তু তাদের উৎসাহিত করা যায়নি। তারা ভোট দেওয়া থেকে নিজেদের বিরত রেখেছে। বোঝা যাচ্ছে নতুন ভোটারদের যেমন উৎসাহিত করা যায়নি তেমনি যারা ভোটের প্রতি আস্থা হারিয়েছে তারা ভোটের প্রক্রিয়ায় শামিল হচ্ছে না। ভারতের মতো একটা বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশের পক্ষে এই অনীহাটা একেবারেই ভালো নয়। অন্যদিকে প্রথম ধাপের পর দ্বিতীয় দফাতেও কম ভোট শতাংশ মোদীকে যে উদ্বিগ্ন এবং বিভ্রান্ত করে তুলেছে সেটা স্পষ্ট হচ্ছে। বিজেপি দল থেকে নির্বাচন প্রচারের একমাত্র মুখ নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্যেও সেই বেপরোয়া ধরনের ভারসাম্যহীনতা ফুটে উঠতে শুরু করেছে। তিনি নির্বাচনী সভায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে যেভাবে কথা বলেছেন, তাতে গোটা দলটির হতাশাই বেপরোয়া বক্তব্যে রূপ নিচ্ছে। মোদী সমালোচনা আর মিথ্যাচারের মধ্যে পার্থক্য গুলিয়ে ফেলেছেন।
বিজেপির হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে মন্দির এবং মসজিদ ইস্যু ব্যবহার করাটাই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেকারত্ব এবং ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির মতো আসল সমস্যাগুলো থেকে ভোটারদের দৃষ্টি সরাতেই তারা লাগাতার ধর্ম বিভাজন করছে। হয়ত মানুষ তা বুঝতে পারছে, ভোটদানের হারেও তা প্রতিফলিত হচ্ছে। মোদী সরকারের জনকল্যাণ নীতির বদলে রাজনৈতিক অভিসন্ধির তরজায় ঢুকে সাধারণ মানুষের কোনো লাভ নেই, তাই আম-জনতা কষ্ট করে ভোটকেন্দ্র থেকে মুখ ফেরাচ্ছে। যদিও ভোট কম পড়া মানেই যে তা শাসক দলের জন্যই দুশ্চিন্তার এমন সরল সিদ্ধান্তে আজ আর পৌঁছানো যায় না। এবার সেই অর্থে ভোটের কোনো হাওয়া নেই, কারও পক্ষেও নেই। মোদীর পক্ষে যেমন বিরাট কোনও ইস্যু নেই বিপক্ষেও নেই। দু’দফার ভোট হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী দেশজুড়ে গড় ভোট পড়েছে ৬১ শতাংশ। এর মধ্যে হিন্দি বলয়ের রাজ্য উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশে ভোটের হার বেশ কম। এই রাজ্যগুলিতে বিজেপির সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি। যেখানে রামমন্দিরের পর ঢেলে ভোট হওয়ার কথা, সেখানে ভোট কম পরাটা কিন্তু একটা প্রশ্ন।