গিরিডি, মধুপুর, দেওঘর ও শিমুলতলা … বাঙালির হাওয়াবদলের প্রিয় জায়গা। এখানকার ইঁদারার জল খেলে পেটের অসুখ ভালো হয়ে যায় এবং মুক্ত আলোবাতাসে শরীর ভালো থাকে — এরকম বিশ্বাস থেকে টাকাপয়সাওয়ালা বাঙালিরা দলে দলে পাড়ি দিতেন বিহারের এই রুক্ষ অঞ্চলে। তাঁরা বলতেন, “পশ্চিমে চেঞ্জে যাচ্ছি।” কলকাতার ডাক্তারেরা রোগীকে উপদেশ দিতেন, “চেঞ্জে যান, সুস্থ হয়ে উঠবেন।” চেঞ্জে যাওয়া মানে বিহারের এই অঞ্চলে কয়েক মাস কাটিয়ে যাওয়া। বহু মানুষ এখানে বাড়ি বানিয়ে ছুটি উপভোগ করতেন।
আহা, জিনিসপত্রের দাম কী সস্তা ছিলো! ১ টাকায় ১৬ সের দুধ পাওয়া যেত। সস্তা শাকসব্জি, দেশি মুরগির ডিম ও মাংস, বাঙালিবাবুরা বলতেন, ড্যাম চিপ Damn cheap — তাই স্থানীয় গরিব অশিক্ষিত বিক্রেতারা বিস্ময়ে হাঁ হয়ে বাঙালিবাবুদেরকে দেখত ও বলত, ড্যাঞ্চিবাবুরা কতো ভালো লোক।
শিমুলতলায় একটি বাড়ি খুব জনপ্রিয়। সেটার নাম মুখার্জি ভিলা। বাড়িটি বানিয়েছিলেন সেকালের সুবিখ্যাত শিল্পপতি স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জি। তাঁর নামে কলকাতার বিবাদি বাগ এলাকায় একটি রাস্তা আছে — আর এন মুখার্জি রোড।
রাজেন্দ্রনাথের পুত্রবধূ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয়পাত্রী লেডি রাণু মুখার্জি।
কিন্তু এই মুখার্জি পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কোনও রকম ঘনিষ্টতা ছিলো না। বরং রাণু অধিকারীর সঙ্গে বীরেন্দ্রনাথ মুখার্জির বিয়ের সময়, এই মুখার্জি পরিবার রবীন্দ্রনাথকে রীতিমতো অবজ্ঞা করেছিল। লেডি রাণুর স্বামী স্যার বীরেন কবিতা-গান-সাহিত্যের ধার ধারতেন না, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেও আগ্রহী ছিলেন না। ফলে মুখার্জি পরিবারের সঙ্গে যথেষ্ট দূরত্ব ছিলো রবীন্দ্রনাথের। স্নেহভাজন রাণুর বিয়ের পরে, রাণুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগও প্রায় ছিন্ন হয়ে যায়।
কেউ কেউ রটান, শিমুলতলার এই মুখার্জি ভিলায় রবীন্দ্রনাথ এসে উঠেছিলেন। একেবারে ভিত্তিহীন বাজে কথা। রবীন্দ্রনাথ কখনও শিমুলতলা আসেননি। এই বাড়িতে ওঠার কথা একেবারেই অবাস্তব।
গুগল সার্চ করলে বেশ কিছু বালখিল্য লোকের ব্লগ চোখে পড়বে। সেইসব লোকেদের দাবি, রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র শিমুলতলা এসেছিলেন স্বাস্থ্যোদ্ধার করতে। এক ব্লগ-লেখক তো লিখেই বসেছেন, শিমুলতলায় রবীন্দ্রনাথের বাড়ি ছিলো।
রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র কেউই শিমুলতলা আসেননি। শরৎচন্দ্র একবার দেওঘর এসেছিলেন বটে, পশ্চিমের জলে তাঁর পেটের পীড়া সারবে ভেবে, যদিও সেটা সারেনি (যেমন স্বামী বিবেকানন্দ দেওঘরে চেঞ্জে এসেছিলেন, কিন্তু তাঁরও পেটের অসুখ সারেনি, বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিলেন)।
রবীন্দ্রনাথ একাধিকবার এসেছেন গিরিডি, এসেছেন মধুপুর, দেওঘর। গিরিডিতে এক বাঙালি জজসাহেব অমৃতনাথ মিত্রের বাড়িতে তিনি তিনবার এসেছিলেন।
দেওঘর থেকেই তাঁর ভাগ্নী সরলা দেবীর বিয়ে দেওয়া হয়েছিল গান্ধিজির প্রিয়পাত্র এক পাঞ্জাবি তরুণ রামভুজ দত্ত চৌধুরীর সঙ্গে। সেই বিয়েতে দেওঘরে হাজির ছিলেন ঠাকুর পরিবারের অনেক মানুষজন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এসেছিলেন মেজদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ মধুপুর স্টেশনে নেমে গাড়িতে হাজারিবাগ গেছেন, এমন প্রমাণও আছে।
এখন মুখার্জি ভিলার মালিক এক সাধু। তিনি থাকেন হরিদ্বারে । একজন কেয়ারটেকার আছেন, তিনিই টুরিস্টদেরকে থাকতে দেন।
কেয়ারটেকার বললেন, “আমি ৪০ বছর ধরে এই বাড়িতে আছি।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “মুখার্জি পরিবারের লোকেরা কি এখানে আসতেন? ”
কেয়ারটেকার উত্তর দিলেন, “আমি ৪০ বছরে মুখার্জিদের কাউকে এখানে আসতে দেখিনি। তাঁদের কাউকেই আমি চিনি না।”
শিমুলতলার রাজবাড়ি
ব্রিটিশদের হাত দিয়ে যখন রেলের লাইন পাতা শুরু হলো, তখন নব্য বাঙালির “পশ্চিম” ভ্রমণের হিড়িক ওঠে। সমাজের বিশিষ্ট বাঙালিরা মধুপুর-শিমুলতলা, দেওঘর, গিরিডি-বারগাণ্ডাতে বাড়ি করতে থাকেন।
সুতরাং এই বাড়িটির বয়স ১৫০ বছরও নয়। যাঁরা বিহারের শিমুলতলা বেড়াতে যান, তাঁদের কাছে এই ভগ্নপ্রায় রাজবাড়ি বেশ কৌতূহলের সৃষ্টি করে। … বিশাল প্রাঙ্গণের চারপাশ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিলো, এখন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। শুধু গেটের দুটি স্তম্ভ এখনও ভগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। চোরেরা ছাদ থেকে কাঠের কড়ি-বর্গা খুলে নিয়ে যায়, তার ফলেই ছাদ ধসে পড়েছে। প্রতিটি জানলা-দরজাও নিয়ে গেছে তস্করের দল।
বর্তমান বাংলাদেশের নাটোর জেলার অন্তর্গত নলডাঙা এখন একটি উপজেলা। সেখানে রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মাত্র ৫০০ বছর আগে।
সেখানকার জমিদার রাজা রামশঙ্কর মারা যান ১৮১২ সালের ৯ নভেম্বর, আর তাঁর চিতায় সহমরণে যান রানি রাধামনি।
তাঁদের মৃত্যুর এক বছর আগেই তাঁদের পুত্র মোহনচাঁদ মারা যান ও রয়ে যায় মোহনচাঁদের ১০ মাসের পুত্র শিশু শশীভূষণ ও স্ত্রী তারামনি দেবী।
ফলে জমিদারি চলে যায় জেলা-কালেক্টর বা কোর্ট-অফ-ওয়ার্ডস-এর হাতে।
১৮৩০ সালে শশীভূষণ সাবালক হলে বংশের জমিদারি ফেরত পেলেন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, জমিদারি ভোগ করা আর তাঁর হলো না। চার বছরের মধ্যেই তিনি অকালে মারা গেলেন।
শশীভূষণ দেবরায় যখন মারা গেলেন, রেখে গেলেন পত্নী জয়দুর্গা ও একমাত্র নাবালিকা কন্যাকে । তাই রানি জয়দুর্গা দেবী দত্তকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন ইন্দ্রভূষণকে। ১৮৩৭ সালে রানি জয়দুর্গা চলে গেলেন পরপারে। শুধু রাজত্ব নিয়ে টিকে রইলেন পালিত পুত্র ইন্দ্রভূষণ দেবরায়।
কিন্তু ইন্দ্রভূষণ নাবালক হওয়ায় তাঁর সম্পত্তি ছিলো কোর্ট-অফ-ওয়ার্ডস-এর হাতে।
১৮৫৩ সালে তিনি সাবালক হওয়ার পরে, রাজত্ব ফিরে পেলেন।
ইন্দ্রভূষণ ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে ব্যবহারের জন্য অনেকগুলি হাতি উপহার দিয়েছিলেন। তাই ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ১৮৬০ সালে তাঁকে ‘রাজা’ উপাধি প্রদান করে।
ইন্দ্রভূষণ দুই রানি ও নাবালক পুত্র প্রমথভূষণকে নিয়ে হুগলির ত্রিবেণীতে গঙ্গাতীরে বিশ্রাম করতে এলেন। কিন্তু ভাগ্যের বিপর্যয়ে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে হুগলির ত্রিবেণীতে পরলোক গমন করেন।
নলডাঙ্গা রাজবাড়ির শেষ রাজা ছিলেন ইন্দ্রভূষণের পুত্র প্রমথভূষণ দেবরায় বাহাদুর।
তাঁর পিতা যখন মারা যান তখন তিনি নাবালক, বয়স মাত্র সাড়ে ১১ বছর। ব্রিটিশ কালেক্টার তাঁর সম্পত্তির দেখভাল করতেন ও রাজাকে কলকাতার মানিকতলার ওয়ার্ড ইন্সটিটিউশনে লেখাপড়ার জন্য ভর্তি করে দেন। তারই মধ্যে তাঁর ঠাকুরমা গভর্নমেন্টের অনুমতি নিয়ে প্রমথভূষণের বিয়ে দিলেন। তখন প্রমথভূষণের বয়স সাড়ে ১৪ বছর।
১৮৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি সাবালক হলে জমিদারি হাতে পান।
তিনি বেশ কৃতবিদ্য মানুষ ছিলেন। নিজের সম্পত্তির পরিমাণও অনেকটা বাড়িয়েছিলেন। নানা জায়গা ঘুরেছেন। তিনি অত্যন্ত বিদ্যোৎসাহী পুরুষ ছিলেন। চতুষ্পাঠী, একটি ইংরেজি স্কুল ও চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন। তাঁর পিতার নামে যশোর স্কুলে একটি বৃত্তি এবং দর্শনচর্চার জন্য তাঁর মায়ের নামে আরেকটি বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন।
ইনি পিতার নামে নলডাঙায় দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন এবং সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করতেন। রাজপথ-নির্মাণ, সেতু-নির্মাণ, জলাশয়-স্থাপন ইত্যাদি সমস্ত জনদরদী কাজে বিপুল অর্থ দান করতেন।
প্রমথভূষণ বিহারের শিমুলতলায় এই প্রাসাদ বানিয়েছিলেন, হাওয়াবদলের উদ্দেশ্যে।
কিছু নির্বোধ ব্লগার, ভ্লগার ও ইউটিউবারদের দৌরাত্ম্যে এই সুকৃতী মানুষটি পরিণত হয়েছেন মদ্যপ ও বিলাসী পুরুষে।
“কথিত আছে” — এই বলে তাঁরা জুড়ে দেন, এই প্রাসাদ ছিলো নাচমহল, এখানে মদ্যপ রাজা বাইজির নাচ দেখতেন। রানি এখানকার কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন, সেই কারণে রাজা এই প্রাসাদ ত্যাগ করে চলে যান।… খুবই নিম্নরুচির গল্প।
প্রমথভূষণ খুবই সাত্ত্বিক ও ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। নলগণ্ডার মন্দিরগুলো তার প্রমাণ। নলগণ্ডায় তিনি একাদশ শিবমন্দির নির্মাণ করেছিলেন। প্রমথভূষণ দেবরায় ১৯৪১ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি ভারতের কাশীতে মারা যান।
কুমার পন্নগ ভূষণ দেবরায় ও কুমার মৃগাঙ্কভূষণ দেবরায় নামে তাঁর দুই পুত্র এবং আরও চার কন্যা ছিল। পন্নগভূষণ ১৮৯৭ সালে বীরভূমের হেতমপুরের রাজকুমারীকে বিয়ে করেছিলেন।
১৯৫৫ সালে সরকারি আদেশে অন্যান্য জমিদারির মতো এই জমিদারিও সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং রাজত্ব শেষবারের মতো লোপ পায়।
এইসব প্রাসাদ রক্ষণাবেক্ষণে যা খরচ, তা ব্যয় করার সামর্থ্য না থাকার কারণেই এই প্রাসাদগুলি বংশধরদের দ্বারা পরিত্যক্ত হয়। ভারতের যে কোনও রাজবাড়ি সম্পর্কে একই কথা প্রযোজ্য।
তাঁদের বংশধরেরা এখন কলকাতাতেই আছেন। বাংলাদেশে নলডাঙায় তাঁদের রাজবাড়ি ভেঙে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন রাজপ্রাসাদ না থাকলেও সাতটি মন্দির আজও রাজবাড়ির সাক্ষী হয়ে আছে।
রাজবংশের এক উত্তরসূরী প্রণবভূষণ দেবরায় ১৯৯০-এর দিকে কলকাতা থেকে নলডাঙ্গা দর্শনে গেছিলেন, সেই খবর বাংলাদেশের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
সম্প্রতি নলডাঙায় রাজাদের সাতটি মন্দিরের মধ্যে তিনটি মন্দির স্থানীয় মানুষেরা অপটু হাতে সংস্কার করেছেন ও পূজা-অর্চনা শুরু হয়েছে।
রাজাদের এক পূর্ববঙ্গীয় ভৃত্যের বংশধর রাজাদের নাম স্মরণীয় করে রাখার জন্য নলডাঙায় “নলডাঙা রাজবাড়ি রিসর্ট” নামে একটি বিনোদন পার্ক চালু করেছেন।
বি এন সরকারের বাড়ি, শিমুলতলা
বীরেন্দ্রনাথ সরকারকে আমরা বি এন সরকার নামেই বেশি চিনি। নিউ থিয়েটার্সের মালিক ও চলচ্চিত্র নির্মাণের জগতে প্রবাদপুরুষ। তিনি দাদাসাহেব ফালকে এ্যাওয়ার্ড এবং পদ্মভূষণ খেতাব পেয়েছিলেন।
তাঁর পিতা ছিলেন নৃপেন্দ্রনাথ সরকার, যিনি ভারত সরকারের এ্যাডভোকেট জেনারেল ছিলেন। ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলায় ঢাকা কোর্টে তিনিই ছিলেন সরকার তরফে এ্যাডভোকেট ।
দার্জিলিংয়ে নৃপেন্দ্রনাথ সরকারের তিনটি বাড়ি ছিলো, যার একটি হলো স্টেপ এ্যাসাইড। সেখানেই ভাওয়ালের রাজার ”মৃত্যু” হয়। সেই বাড়িতেই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন প্রয়াত হন।
বি এন সরকারের প্রপিতামহ ছিলেন প্যারীচরণ সরকার, যাঁর লেখা ‘ফার্স্ট বুক’ পাঠ্যপুস্তক পড়েই সেকালে বাঙালি ছেলেমেয়েরা ইংরেজি শিখত।
মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’, বিদ্যাসাগর মশাইয়ের ‘বর্ণপরিচয়’ এবং প্যারীচরণের First Book of Reading for Native Children — এগুলোই ছিলো সেকালের শিশুদের পাঠ্যপুস্তক।
শিমুলতলায় বি এন সরকারের বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, সম্ভবত তাঁর উত্তরসূরীরা এখনও এখানে আসেন।