১৯৭১ সাল। দুই বাংলাই অশান্ত। মুক্তিযুদ্ধ আর নকশাল ঘুম কেড়েছে দুই বাংলার জনসাধারণের। ইয়াইয়া খান, টিক্কা খানের পরিকল্পিত গণহত্যা প্রাণ কেড়েছে পূর্ব পাকিস্তানের বহু মানুষের। ১৯৭১-এ স্বাধীনতা পাবার বেশ কিছুমাস আগেই (সম্ভবত ৭১’ এর জুন মাসের দিকে) নিজেদেরকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসাবে ঘোষণা করে পূর্ব পাকিস্তান। ৭১’ এর ১৩ই জুন তারা গঠন করে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। এই ফুটবল দলের উদ্দেশ্য ছিলো — বিভিন্ন চ্যারিটি ম্যাচে অংশগ্রহণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা, মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে জনমত তৈরি করা। এই স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ছিলো পৃথিবীর প্রথম যুদ্ধকালীন ফুটবল দল।
সেই সময় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকা তানভীর মাজহার তান্না-র স্মৃতিচারণ — নানা চরাই উতরাই পেরিয়ে যুদ্ধের মাঝে ভারতে আসার পর আগরতলায় পৌঁছাই। পরে বালুরঘাটে আসি। সেখানেই বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা তাজউদ্দীন আহমদের চিঠি পাই। সেই চিঠিই ছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের জন্মসূত্র।
‘একদিন দেখি জাকারিয়া পিন্টু (স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক) ভাই এসে হাজির। এসে আমাকে বলেন এই যে চিঠি , তোমাকে যেতে হবে। তাজউদ্দিন সাহেবের চিঠি। বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি বানিয়েছি। ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, সব টিমের খেলোয়াড়রা চলে আসুক এটাই আমরা চাচ্ছি।’
‘প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ সাহেবের চিঠিতেই উল্লেখ ছিল, আমি দলের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবো। সরকার থেকেই আমাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।’
‘আমি তো কলকাতায় ছিলাম না। তাই জানতাম না কীভাবে বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি গঠিত হয়েছিল। সংগঠনটির প্রথম সভাপতি ছিলেন আশরাফ আলী চৌধুরী। উনি ঢাকার এমপি ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন লুৎফর রহমান। শাফায়েত জামিলের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে কলকাতা গেলাম। যেয়ে দেখি ২০-৩০ জন খেলোয়াড় ছিল। আমি সবাইকেই চিনি।’
‘বাংলাদেশ সরকারই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সব ফুটবলারকে ভারতে আসার ঘোষণা দিয়েছিল। বেতারের মাধ্যমেই খেলোয়াড়দের বলেছিল, আপনারা চলে আসেন। প্রতিদিন ছোট করে একটা বিবৃতি দিতো। খেলোয়াড়রা যারা চলে এসেছিল। সাতারু অরূপ নন্দীও চলে এসেছিল। আমরা বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির অধীনে ছিলাম।’
‘আমাদের দারুণ একটা স্পোর্টসম্যান ছিল। নাম ছিল মিরাজ। ওকে মেরে ফেললো পাকিস্তানি আর্মিরা। সে তখন পাকিস্তানের এক নম্বর পোলভল্টার ছিল। অধিকাংশ খেলোয়াড় চলে আসে। বর্ডারের ওইদিকে চলে আসে, আগরতলা চলে আসে।’
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যানেজার তানভীর মাজহার তান্না।
‘উত্তেজনার মাত্রা মারাত্মক উঁচুতে ছিল। খেলোয়াড়দের তো আরও বেশি ছিল। ২০ হাজার লোক হাজির। এরকম বিশাল সংখ্যক দর্শক আসবে, ভাবতে পারিনি। কোনো একটা জায়গা খালি ছিল না। উল্টো শুরুর একাদশ সাজানো নিয়ে ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিলাম। কারণ আমার হাতে তো সব ভালো ভালো খেলোয়াড়। স্ট্রাইকিংয়ে আমার শাহজাহান ভাই, সালাউদ্দিন, নওশের, এনায়েত, তসলিম ছিল। ফ্রস্ট আর মিডফিল্ড সাজাতে অনেক ঝামেলা হয়েছিল। আশরাফকে পরে ডিফেন্সে নিলাম। আসলে আশরাফ ফরোয়ার্ড ছিল। তখনকার দিনে পাঁচটা ফরোয়ার্ড খেলতো। ইনসাইড ফরোয়ার্ড, রাইট ইনসাইড ফরোয়ার্ড, লেফট উইং, রাইট উইং আর স্ট্রাইকার। শুরুর একাদশ বানানো আসলেই কঠিন ছিল।’
‘বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে যখন তারা দৌড়াল পুরা মাঠ, দর্শকদের যে পরিমাণ উল্লাস সেটা অবিশ্বাস্য ছিল। এটা আমরা জীবনেও ভুলতে পারবো না। আমরা সবাই কাঁদছিলাম। আসলে কেউ জানতাম না, কবে দেশে ফেরত আসব। পরিবারের অবস্থা ভালো থাকলেও দেশের বাইরে পকেটে টাকা-পয়সা তেমন ছিল না। ভিক্ষুকের মতো অবস্থায় ছিলাম। বন্ধুবান্ধব না থাকলে, ফুটবল না থাকলে দেশের বাইরে টিকে থাকাটা অসম্ভব ছিল। ২০ টাকা করে সবাইকে হাত খরচের জন্য দিতো। আমি অবশ্য নিতাম না। টাকাটা সালাউদ্দিনকে দিয়ে দিতাম।’
‘ভারতের মাটিতে ১৭টা ম্যাচ খেলেছি। প্রথম ম্যাচটা ইন্টারেস্টিং ছিল। কারণ আমরা বুঝি নাই এতো লোক হবে। স্টেডিয়াম পরিপূর্ণ, পাশের বাড়ির ছাঁদ ভরে গিয়েছিল । মাঠে ঢুকে দেখলাম একটা সুবিধাজনক অবস্থা আমাদের জন্য হয়ে গেছে। আমরা নিজেরা আলোচনা করে আয়োজকদের বললাম, পতাকা উড়াও। পতাকা না উড়ালে আমরা খেলবো না। এত লোক হয়ে যাওয়ায় ওরা চাপে পড়ে যায়। পরে নদীয়ার জেলা প্রশাসক এসে নিজেই সাহস নিয়ে বললেন আপনারা এটা করেন। তারপর ফুটবলাররা জাতীয় পতাকা নিয়ে সারা মাঠ ঘুরল। আমরা জাতীয় সঙ্গীত গাইলাম, তারপর খেলা শুরু হল।’
বিদেশের মাঠে বাংলাদেশ তখনো স্বীকৃতি পায়নি। তাই এমন ম্যাচ আয়োজনের কারণে ফিফাতে পাকিস্তান অভিযোগ জানাল। ফিফা আবার অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনকে বিষয়টি অবহিত করে। অফিসিয়াল একটি দল নামানোয় অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন নদীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগী পদ সাসপেন্ড করে দিল। জেলা প্রশাসককে ভারত সরকার সাসপেন্ড করেছিল। যদিও পরে চাকরি ফিরে পেয়েছিলেন।
নদীয়ায় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল
‘একটা দল নাম পাল্টে হয়ে যায় বোম্বে ইলেভেন। আমাদের বিপক্ষে খেলেছিলেন ভারতের তারকা ক্রিকেটার নবাব মনসুর আলী খান পতৌদি। তিনি বোম্বে দলের অধিনায়ক ছিলেন। ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হলেও ফুটবলও খেলতেন। খুব ভালো খেলতেন। আমরা আসলে তাকে দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সিনেমা জগতের অনেক তারকারা সেদিন উপস্থিত ছিল। দেব আনন্দ, দিলীপ কুমার, সায়রা বানু, জনি ওয়াকার, শর্মিলা ঠাকুর, তখনকার সেরা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অনেকেই ছিলেন।’
সে ম্যাচটিতে তূর্য হাজরা নাম নিয়ে খেলেছিলেন কাজী সালাউদ্দিন।
সে যাক সেই সময় অধিনায়ক ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু। এছাড়া ছিলেন আইনুল, সুভাষ, খোকনদের মতো বহু প্রতিভাবান ফুটবলার। এদের মধ্যে অনেকের আবার বিদেশে ফুটবল খেলার অভিজ্ঞতাও ছিলো। গোলরক্ষক নরুল নবীর ইরান এবং তুর্কীতে খেলার অভিজ্ঞতা ছিলো। অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টুর অভিজ্ঞতা ছিলো রাশিয়াতে খেলার। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠনে সহায়তা করেছিলো ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনও। সত্যি বলতে কি, এই দলটির গঠন হয় কলকাতাতেই। সূচনালগ্নে তাদের নাম ছিলো বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি। কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে তারা প্র্যাক্টিস করতো। এই স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ভারতবর্ষে এলো ম্যাচ খেলতে। তাদের প্রথম ম্যাচ ছিলো নদীয়া জেলা একাদশের বিরুদ্ধে, ২৫ শে জুলাই ১৯৭১ তারিখে। কিন্তু ম্যাচটিতে বিভিন্ন কারণে সমস্যার সূত্রপাত হয়।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল চাইলো ম্যাচের আগে তাদের লালসবুজ পতাকা উত্তোলন করতে, এমনকি ম্যাচ শুরুর আগে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিও বাজাতে চাইলো ঘোষিত স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসাবে। তৎকালীন নদীয়া জেলার জেলাশাসক দীপক কান্তি ঘোষ আবেগে বশবর্তী হয়ে বাংলাদেশ ফুটবল দলকে অনুমতি দিলেন এসব করার। মাঠে উড়লো লাল সবুজ পতাকা, বাজলো জাতীয় সঙ্গীত। কিন্তু মনে রাখতে হবে সময়টা ১৯৭১ সালের জুলাই মাস। বাংলাদেশ তখনও স্বাধীনতা লাভ করেনি। ভারতবর্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন করলেও বিদেশের মাটিতে একটা পরাধীন দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনে একটু অস্বস্তিতেই পড়লো সরকার। জেলাশাসক দীপক কান্তি ঘোষকে উক্ত ঘটনার জন্য পদ থেকে বহিষ্কার অবধি করা হয়। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল বনাম নদীয়া জেলা একাদশের ম্যাচটি ২-২ গোলে ড্র হয়। ম্যাচটি দেখতে ভিড় করেছিলেন প্রায় দশ হাজার দর্শক। ম্যাচটির চার মিনিটের মাথায় তুষার গুণ গোল করে এগিয়ে দেন নদীয়াকে। বাংলাদেশ ফুটবল দলটি দ্বিতীয়ার্ধের পাঁচ মিনিটের মধ্যেই গোল শোধ করে। এরপর নদীয়াকে আবারও এগিয়ে দেন তুষার গুণ। পরে এনায়েত গোল করে ম্যাচের সমতা ফেরান। ম্যাচটি দেখতে কাতারে কাতারে লোক জমা হয়েছিলো।
সেদিন দুই দলের খেলোয়ারেরা ছিলেন।
বাংলাদেশ ফুটবল একাদশ : নরুল নবী; মোমিন, হাবুল, বিমল ও পিন্টু; আইনুল ও খোকন; কেকোবাদ, আলি ইমাম, আমিনুল ইসলাম ও প্রতাপ হাজরা।
নদীয়া একাদশ : গোবিন্দ গুহ ঠাকুরতা; বিভূতি কুণ্ডু, শিবেন রুদ্র, শান্তনা রায় ও সুশান্ত সরকার; অসিত ঘোষ ও অজিত সাহা; অমল সরকার; তুষার গুণ, কৃষ্ণ মিত্র ও রমেশ মণ্ডল।’
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের দুই সদস্য প্রতাপ শংকর হাজরা ও আইনুল হক
এরপর আসি আসল কথায়। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ঠিক পরবর্তী ম্যাচটিই ছিলো মোহনবাগানের বিপক্ষে। কিন্তু নদীয়া জেলা একাদশের বিরুদ্ধে ম্যাচটিতে বিভিন্ন বিতর্কের কারণে মোহনবাগান-স্বাধীন বাংলা ফুটবল ম্যাচটিকে ঘিরেও নানা জটিলতা শুরু হয়। এমতাবস্থায় এগিয়ে আসেন এই চ্যারিটি ম্যাচটির জন্য মোহনবাগানের ঘোষিত অধিনায়ক চুনী গোস্বামী। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে কিছুই কি করতে পারেনা মোহনবাগান? দোলা দিলো চুনী গোঁসাইয়ের মন। কিছুটা তাঁরই দেওয়া প্রস্তাবে নিজেদের নাম পরিবর্তন করে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সাথে ম্যাচ খেলতে রাজি হলো মোহনবাগান। মোহনবাগানের পরিবর্তিত নাম হলো ‘গোষ্ঠ পাল একাদশ’। ১৯৭১ এর ৮ ই আগস্ট ম্যাচ শুরু হয় গোষ্ঠ পাল একাদশ বনাম স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের। যুগান্তর জানাচ্ছে, ম্যাচ শুরুর আগে বৃষ্টি হয়, মাঠ কিছুটা পিচ্ছিল হয়ে যায়। কিন্তু সেই পিচ্ছিল মাঠেই অসাধারণ ড্রিবলিংয়ে শিল্পের জাল বুনে গেলেন বছর দুই আগে অবসর নেওয়া চুনী গোস্বামী। ম্যাচটিতে অবশ্য প্রথমে লিড পায় বাংলাদেশের ফুটবল দলটি, তুর্ষ হাজরা গোল করেন। এরপরে চুনী গোস্বামীর অ্যাসিস্টে গোল শোধ করেন প্রণব গাঙ্গুলী। সুকল্যাণ ঘোষদস্তিদারের গোলে এগিয়ে যায় বাগান, অ্যাসিস্ট করেন সেই চুনী গোস্বামীই। প্রণব গাঙ্গুলী ৩-১ এ এগিয়ে দেন বাগানকে। ম্যাচে মোহনবাগানের চতুর্থ গোল করেন চুনী গোস্বামী। দলের দ্বিতীয় ও ম্যাচের শেষ গোল করে ফলাফল ৪-২ করেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের নওসের। মোহনবাগান ওরফে গোষ্ঠ পাল একাদশ ম্যাচ জেতে ৪-২ গোলে।
সেদিন নদিয়া স্টেডিয়ামে খেলার একটি দৃশ্য
পরিসংখ্যান নয়, ম্যাচটির তাৎপর্য লুকিয়ে আছে তার গুরুত্বে। পরাধীন দেশের স্বাধীনতাকামী সেনাদের সাহায্যার্থে সমস্ত জটিলতা দূরে সরিয়ে রেখে তাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ের সাথী হতে চাইছে একটি ফুটবল দল,এমন নিদর্শন ভারতবর্ষে ক’টাই বা আছে। বল পায়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার মন্ত্র এনেছে যারা, এ-তো তারাই পারে।খান সেনাদের অত্যাচার, শরণার্থী ক্যাম্পে পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় মানুষদের ভিড়, মুক্তিযুদ্ধ — এককালে ইংরেজদের টক্কর দেওয়া ফুটবল দলটির মনে দাগ কেটেছিলো বইকি। নাহলে কেনোই বা নাম পরিবর্তন করবে, কেনোই বা অধিনায়ক চুনী গোঁসাইয়ের হাতে হাত রেখে বাংলাদেশ ফুটবল দলটির অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু দাঁড়িয়ে থাকবে মোহনবাগান মাঠে… আর মোহনবাগান মাঠজুড়ে কেনোই বা উচ্চারিত হবে বাংলাদেশের অমোঘ বাণীটি —”জয় বাংলা”। ম্যাচের দিন মোহনবাগান মাঠে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং গোষ্ঠ পাল। সেই দিন গোষ্ঠ পালের সাথে দুইদলের খেলোয়াড়দের পরিচয়ও করিয়ে দেওয়া হয়। ম্যাচশুরুর আগে পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচারী জঙ্গীশাহী আয়ুব সেনানীর হাতে বাংলাদেশের যাঁরা মৃত্যুর কোলে পড়েছেন তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে দুমিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
মোহনবাগান মাঠে বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা
বাঙাল-ঘটি-অবাঙালী এই সবকিছু নিয়েই মোহনবাগান। ফরিদপুরের ‘বাঙাল’ গোষ্ঠ পাল, ময়মনসিংহের ‘বাঙাল’ চুনী গোস্বামী সেই তো কবেই মিশে গেছেন মোহনবাগানে। এমনকি সেদিনের বাংলাদেশ দলটির জাকারিয়া পিন্টুরা, ওঁরাও কি মিশে যাননি মোহনবাগানের এই বিশুদ্ধতম আত্মার সাথে। ম্যাচটিকে নিয়ে যুগান্তর প্রতিবেদন লিখেছিলো —”ভাঙছে আর ভাঙছে; বিচ্ছেদের বিরাট প্রাচীরটা শুধু ভাঙছে আর ভাঙছে। ওপার বাংলা আর এপার বাংলার মাঝখানে ব্যাবধানের ওই নোনাধরা দুর্বল প্রাচীর, সীমান্তের দাগগুলি প্রাণ বন্যায় ধ্বসে যাচ্ছে।”
যুগান্তর ছারাও আর একটা প্রতিবেদন এখানে দিলাম—
মারদেকা কাপ খেলতে জাতীয় দলের সবাই তখন মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে। মোহনবাগানের যেসব খেলোয়াড় ভারতের হয়ে খেলেন, তাঁরাও নেই। তাঁদের ছাড়াই দল করেছে মোহনবাগান। তাতে কী? চুনী গোস্বামী তো আছেন! একাই এক শ। তবে নদীয়ার অনুমোদন বাতিল হওয়ার খবর কানে কানে এখানেও পৌঁছেছে। স্বাভাবিকভাবেই ‘মোহনবাগান’ নামে ম্যাচটা খেলতে পারছে না দলটা। খেলবে দলের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় গোষ্ঠ পালের নামে—‘গোষ্ঠ পাল একাদশ’ হিসেবে।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছের নদীয়ার জেলা প্রশাসক
নিজের সময়ে তুখোড় ডিফেন্ডার ছিলেন এই গোষ্ঠ পাল। সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন মোহনবাগানে। দেশের কিংবদন্তি ফুটবলার জাদুকর সামাদ একবার বলেছিলেন, বল নিয়ে সবাইকে কাটাতে তাঁর কষ্ট না হলেও এই গোষ্ঠ পালকে কাটাতে তাঁরও ‘খবর’ হয়ে যায়!
সেই দাপুটে ডিফেন্ডার এখন সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ। ধুতি মালকোঁচা মেরে চলে এসেছেন এই বৃষ্টির মধ্যে, খেলা দেখতে। প্রধান অতিথি করে আনা হয়েছে তাঁকে। তাঁর আরও একটা পরিচয়, চুনী গোস্বামীর মতো তিনিও বাংলাদেশের সন্তান। দেশের টানে ছুটে এসেছেন তিনিও। তাঁর উপস্থিতিতে যদি টিকিটের বিক্রিবাট্টা একটু হলেও বাড়ে আরকি!
গোষ্ঠ পাল একাদশের আরেক চমক, মোহনবাগানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গলের কিংবদন্তি তারকা পরিমল দে খেলবেন এই ম্যাচে। চুনী-পরিমলকে একই দলে দেখার আজন্ম সাধ পূরণ হবে অনেকের।
চুনীর অধিনায়কত্বে মাঠে নামল গোষ্ঠ পাল একাদশ। মূল একাদশে আরও ছিলেন বলাই দে, ভবানী রায়, কল্যাণ সাহা, নিমাই গোস্বামী, কাজল ঢালী, প্রবীর মজুমদার, সুকল্যাণ ঘোষ দস্তিদার, পরিমল দে, প্রিয়লাল বিশ্বাস ও প্রণব গাঙ্গুলী।
ওদিকে আগের ম্যাচের একাদশ থেকে দুটি পরিবর্তন নিয়ে মাঠে নামে স্বাধীন বাংলা একাদশ। গোলকিপার অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জির সামনে এস এম আইনুল হক, জাকারিয়া পিন্টু, আলী ইমাম, ফজলে সাদাইন খোকন, মোহাম্মদ কায়কোবাদ, প্রতাপ শংকর হাজরা, শাহজাহান আলম, এনায়েতুর রহমান খান, কাজী সালাউদ্দিন ও মোহাম্মদ তসলিম উদ্দিন শেখ। শাহজাহান ও সালাউদ্দিন যথারীতি ছদ্মনামে খেলেছিলেন। সালাউদ্দিনের ডাকনাম তূর্য, সঙ্গে দলের সহ-অধিনায়ক প্রতাপ শংকর হাজরার উপনাম মিলিয়ে এই স্ট্রাইকার তূর্য হাজরা রেখেছিলেন নিজের নাম। ওদিকে শাহজাহান খেলেছিলেন সাগর নামে।
ভারতীয় ফুটবল কিংবদন্তি গোষ্ঠপাল সে ম্যাচে হাজির ছিলেন। তাঁর আদি বাড়ি বাংলাদেশে
চুনী গোস্বামীর ঝলক আর কাদামাটিতে দেশীয় তারকাদের অনভ্যস্ততার মাশুল হিসেবে সেদিন ৪-২ গোলে হেরে যায় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। অবশ্য, ম্যাচের ফলাফল এখানে মুখ্য ছিলই না!
পরাধীন বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও মোহনবাগান—ফুটবল ইতিহাসের এই অমূল্য ত্রিভুজকে নিয়ে গবেষণা খুব কমই হয়েছে। মোহনবাগানের ফুটবল ইতিহাসের এই অসামান্য দিকটির অবশ্যই স্বীকৃতির প্রয়োজন আছে। ‘মোহনবাগান’ এই বিরাট নামের বাঁধে আটকে গেছে দলাদলি, হানাহানি ও সাম্প্রদায়িকতার নোনা জল। ভাগাভাগির খেলাকে আজকাল বড়োই ঠুনকো মনে হয় মোহনবাগানের সুবিশাল ইতিহাসের সামনে।
মনে হয়, কতকিছু ভাঙে আজকাল, তবু যুদ্ধ কেনো ভাঙেনা, হিংসা কেনো ভাঙেনা, সীমানা কেনো ভাঙেনা!
তথ্যঋণ- (১)’প্রহর’ অনলাইন পোর্টাল/ওয়েবসাইট, (২)’যুগান্তর’ পত্রিকা ডিজিটাল আর্কাইভ (ইন্টারনেট)