শুক্রবার | ১লা নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৬ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৮:০০
Logo
এই মুহূর্তে ::
মীনাক্ষী সেন-এর বড়োগল্প ‘একটি ভূতের বাড়ির আজগুবি গল্প’ অজ্ঞানতার আঁধার পেরিয়ে আলোর উৎসব : সন্দীপন বিশ্বাস রায় ভিলা ও বিশ্বরূপ মহারাজ (শেষ পর্ব) : কৌশিক মজুমদার ভূত চতুর্দশী — নেত্যকালীর মিরর ইমেজ ও প্রেতলোকের চোদ্দকাহন : প্রলয় চক্রবর্তী কালীপূজার আগের দিনটি চোদ্দবাতি জ্বালানো ও চোদ্দশাক খাওয়ার জন্যে নির্দিষ্ট : অসিত দাস পেঁয়াজের ঝাঁজে গৃহস্থের চোখে জল, সংরক্ষণ কেন্দ্র গড়বে রাজ্য : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ধনং দেহী ধনতেরাস অ্যান্ড পুরুষালী গয়না : রিঙ্কি সামন্ত এ উৎসবের লগনে : নন্দিনী অধিকারী রায় ভিলা ও বিশ্বরূপ মহারাজ (দ্বিতীয় পর্ব) : কৌশিক মজুমদার কাশীপুরে নয়, দক্ষিণেশ্বরেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে চেয়েছিলেন ছোট ভট্টাচার্য (শেষ পর্ব) : শংকর ধনতেরাস এখন বাঙালিরও : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ডাক্তারদের আন্দোলন উপনির্বাচনে ইস্যু নয়, জয় নিয়ে শাসকদল নিশ্চিত : তপন মল্লিক চৌধুরী রায় ভিলা ও বিশ্বরূপ মহারাজ (প্রথম পর্ব) : কৌশিক মজুমদার কাশীপুরে নয়, দক্ষিণেশ্বরেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে চেয়েছিলেন ছোট ভট্টাচার্য (তৃতীয় পর্ব) : শংকর সেকালের প্রেতচর্চা — শিক্ষিত জনের কাছে থিওসফি : প্রলয় চক্রবর্তী মা কালী যখন মহালক্ষ্মী : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী কাশীপুরে নয়, দক্ষিণেশ্বরেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে চেয়েছিলেন ছোট ভট্টাচার্য (দ্বিতীয় পর্ব) : শংকর মহাকাব্যে ভেড়ার উল্লেখ : অসিত দাস কাশীপুরে নয়, দক্ষিণেশ্বরেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে চেয়েছিলেন ছোট ভট্টাচার্য (প্রথম পর্ব) : শংকর রমা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও একাদশী পালনের নিয়মাবলী : রিঙ্কি সামন্ত আশাপূর্ণা দেবী-র ছোটগল্প ‘চাবি’ একে দানা-য় রক্ষা নেই তারওপর ডিভিসি-র ৪২ হাজার কিউসেক জল : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (নবম পর্ব) : বিজয়া দেব চেতনার সমস্যা, সামাজিক অবকাঠামো এবং বলপ্রয়োগ : এরিক ফ্রম, অনুবাদ ফাতিন ইশরাক বারবার ভিলেন সেই বঙ্গোপসাগর : তপন মল্লিক চৌধুরী নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রাখাইন পরিস্থিতি ও বাংলাদেশের উদ্যোগ : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন ‘দানা’ থেকে ভয় পাবেন না, সতর্ক থাকুন, মোকাবিলায় রাজ্য সরকার প্রস্তুত : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সই বা বন্ধুত্ব স্থাপনের উৎসব সয়লা : রিঙ্কি সামন্ত প্রথম পাঠ — “নিশিপালনের প্রহরে” নিয়ে, দুয়েকটি কথা : সোনালি চন্দ বৃহন্নলার অন্তরসত্তা : নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই দীপাবলি এবং কালীপুজোর আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

রাজার খেলায় রায়বাড়ি, দুই পরিবারের ক্রীড়াপ্রেম : যীশু নন্দী

যীশু নন্দী / ৪৪৬ জন পড়েছেন
আপডেট মঙ্গলবার, ৫ মার্চ, ২০২৪

অনেকদিন ধরেই শখ ছিলো বাংলার দুই বিখ্যাত রায়বাড়ির ক্রিকেটপ্রেম নিয়ে কিছু লেখার। এই দুই রায়বাড়ির একটি হলো সত্যজিৎ রায়ের পরিবার এবং অপরটি হলো পঙ্কজ রায়ের পরিবার। এই দুই রায়বাড়িকে নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখলাম, কি সুন্দর সমান্তরালভাবে এগিয়ে চলেছিলো এই দুই পরিবারের ক্রীড়াপ্রেম। তবে এই পুরো লেখার সিংহভাগ কৃতিত্ব তাঁদের, যাঁদের রায়বাড়ির উপর গবেষণামূলক প্রবন্ধ, ইন্টারভিউ পড়ে আমি সমৃদ্ধ হয়েছি। লীলা মজুমদারের ‘পাকদন্ডী’, অজয় বসুর ‘ফিরে ফিরে চাই’, সত্যজিৎ রায়ের ‘যখন ছোটো ছিলাম’, পুরোনো ‘খেলার পাতা’, ‘খেলার আসর’ ম্যাগাজিন — এসব তো আছেই, এর উপর আছে ক্রিকেট লিখিয়ে সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়, অভিষেক মুখার্জির মহামূল্যবান রচনা। আমি শুধু এই সবকিছুকে একত্রিত করে বাংলার দুই রায়বাড়ির ক্রিকেট ও অন্যান্য ক্রীড়াক্ষেত্রে পথিকৃৎ হবার গল্প বলে গেছি শুধু….ব্যাস এইটুকুই।

সারদারঞ্জন রায়

‘রায়বাড়ির ক্রিকেট প্রেম’ শুরু করছি অস্কারজয়ী পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের ক্রিকেট-সম্বন্ধ উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে। সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের ক্রিকেট সম্বন্ধের পথিকৃৎ ছিলেন সারদারঞ্জন রায়। শুধু রায়বাড়ি নয়, তিনি ছিলেন সারা বঙ্গদেশের ক্রিকেট জনক। ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার কটিয়াদি থানার মসুয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এই গ্রামের আগের নাম ছিলো খুকুরপাড়া। গ্রামের দোর্দন্ডপ্রতাপ জমিদার ছিলেন রামনারায়ণ রায়। রামনারায়ণ রায়ের বংশধর কালীনাথ রায়, যাঁরা ছিলেন তিন ভাই — কালীনাথ রায়, হরিকিশোর রায়, শিবেন্দ্রকিশোর রায়। আর এই কালীনাথ রায়েরই পুত্র হলেন সারদারঞ্জন রায়। সারদারঞ্জন রায়েরা আবার পাঁচ ভাই, তিন বোন — সারদারঞ্জন রায়, মুক্তিদারঞ্জন রায়, কুলদারঞ্জন রায়, প্রমদারঞ্জন রায়, কামদারঞ্জন রায়, গিরিবালা দেবী, ষোড়শীবালা দেবী, মৃণালিনী দেবী। সারদারঞ্জন রায়ের ব্যাপারে পরে আসছি। আগে বাকীদের ক্রিকেট প্রেম ও ক্রিকেট সম্বন্ধ নিয়ে আলোকপাত করি। প্রমোদারঞ্জন রায় ছিলেন বাংলার প্রথম ফাস্ট বোলার। কুলদারঞ্জন রায়ও দুর্ধর্ষ ক্রিকেটার ছিলেন। মুক্তিদারঞ্জন রায় নিজে ক্রিকেটার ছিলেন এবং ওনার পাঁচ সন্তানও ক্রিকেটের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত ছিলেন — শৈলজা, নিরোজা, নীরদা, ক্ষীরদা, হৈমজা। এদের মধ্যে নিরোজা ১৯৩২-এর ইংল্যান্ড সফরে ভারতের জাতীয় দলে ডাক পান, কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষার জন্যে যেতে পারেননি।

সারদারঞ্জন রায়

কামদারঞ্জন রায়কে কাকা হরিকিশোর রায় দত্তক নেন এবং তাঁর নাম পরিবর্তন করে হয় উপেন্দ্রকিশোর। হ্যাঁ, ইনিই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। এনার সরাসরি ক্রিকেট খেলবার কোনো প্রমাণ এখনও অবধি পাওয়া যায়নি, কিন্তু রঞ্জিকে নিয়ে প্রথম প্রবন্ধ লেখেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীই।

এরপর আসি বাংলার ক্রিকেটজনক, বাংলার ডব্লিউ.জি.গ্রেস, বাংলার ক্রিকেট পথিকৃৎ সারদারঞ্জন রায়ের কথায়। সারদারঞ্জন রায় জন্মগ্রহণ করেন ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার মসুয়া গ্রামে, যে গ্রামের উল্লেখ রচনার প্রথমেই করেছি, যে গ্রামটিই বাংলার ক্রিকেটের জন্মস্থান কিংবা কারো কারোর মতে উপমহাদেশীয় ক্রিকেটের জন্মস্থান। সারদারঞ্জন রায়ের কথায় আসার আগে একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। ১৮৭৭ সালে প্রথম আন্তর্জাতিকভাবে ক্রিকেট খেলা অনুষ্ঠিত হয়। ভারতবর্ষে ঐ সময়টাকে যদি ব্যাখ্যা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে সিপাহী বিদ্রোহের আঁচ বহুকাল আগে স্তিমিত হয়ে গেলেও ইংরেজি বিরোধী আন্দোলন ছিলো ক্রমবর্ধমান, ভারতে মূলত ইংরেজরা ক্রিকেট খেলা নিয়ে এলেও তা ছিলো শুধুমাত্র ব্রিটিশদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর মধ্যে বঙ্গক্রিকেটের পথিকৃৎ হয়ে উঠলেন সারদারঞ্জন রায়। ১৮৮০ সালে তাঁরা পাঁচ ভাই মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা কলেজ ক্রিকেট ক্লাব। পরবর্তীকালে তাঁরা কলকাতায় টাউন ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। এই দুই ক্লাবের সাথে ব্রিটিশদের বেশ অনেকগুলো ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজিত হয়েছিলো, আর এভাবেই ক্রিকেট খেলাকে ব্রিটিশদের থেকে সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যে ছড়িয়ে দেন সারদারঞ্জন রায় ও তাঁর ভাইয়েরা।

১৮৮৪ সালে ঢাকা কলেজ ক্রিকেট ক্লাব,ক্যালকাটা প্রেসিডেন্সি ক্লাবের বিরুদ্ধে একটি ক্রিকেট ম্যাচে জয়লাভও করে। সেই সময় সাধারণ ভারতীয়দের পক্ষে ক্রিকেট সরঞ্জাম হাতের নাগালে পাওয়া ছিলো দুঃসাধ্য ব্যাপার। এই সমস্যা মেটাতে ১৮৯৫ সালে সারদারঞ্জন রায় এস. রয় অ্যান্ড কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, যারা সেইসময় সারাভারতে ক্রিকেট সরঞ্জামের যোগান দিত। ক্রিকেটকে জাতীয়বাদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত করার ব্যাপারেও সারদারঞ্জন রায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। সবমিলিয়ে বলা যায় বাংলা ক্রিকেটের জনক সারদারঞ্জন রায়ের হাত ধরেই বঙ্গপ্রদেশ ক্রিকেটের পীঠস্থানে পরিণত হয়। শুধু তাই নয়, ১৯২০ সালে পূর্ববাংলার ফুটবলার শৈলেশ বসুকে অন্যায়ভাবে বাদ দেবার অভিযোগে শৈলেশ বসু, সুরেশচন্দ্র চৌধুরীরা মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। আর এই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রথম সভাপতি কে ছিলেন? — এই সারদারঞ্জন রায়ই।

রায়বাড়ির মহিলারাও কিন্তু ক্রিকেটের ব্যাপারে অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। রায়বাড়ির মেয়েরা কাঠের তক্তা ও কুমড়ো দিয়ে ক্রিকেট খেলতেন। তাই দেখেই সুকুমার রায় লিখেছিলেন — “কুমড়ো নিয়ে ক্রিকেট খেলে কেনো রাজার পিসি?”। সারদারঞ্জন রায়ের বোন তথা সত্যজিৎ রায়ের পিসিঠাকুমা মৃণালিনী দেবীর পাঁচ সন্তানই ছিলেন ক্রিকেটের সাথে যুক্ত—নৃপেন্দ্রমোহন বসু (কার্তিক বসু), হিরেন্দ্রমোহন বসু (গণেশ), শৈলেন্দ্রমোহন বসু (বাপী), বাবু ও হিতেন। ক্রিকেটক্ষেত্রে এরমধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নাম হলো কার্তিক বসু অর্থাৎ নৃপেন্দ্রমোহন বসু৷ কার্তিক বসু বাংলার ক্রিকেটের এক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলার হয়ে ৪৪টি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছেন। ১৯৩৮-৩৯ মরশুমের বাংলার প্রথম রঞ্জিজয়ী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। মুম্বইতে তিনি আজও ‘বাবুজি’ নামে খ্যাত। তিনি ক্রিকেট ক্লাব অফ ইন্ডিয়ার কোচ ছিলেন ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫২ সাল অবধি। ভারতীয় ক্রিকেটে কার্তিক বসুর অবদান অতুলনীয়।তাঁর হাত দিয়ে তৈরি হয়েছেন একের পর এক দিকপাল ক্রিকেটার। কার্তিক বসুর আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়ি সংলগ্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে প্র‍্যাক্টিস করতেন বিজয় মার্চেন্ট, লালা অমরনাথ, পঙ্কজ রায় প্রমুখ। ৪৪টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে কার্তিক বসু ১,৬৭৯ রান করেছেন। তাঁর ব্যাটিং এভারেজ ছিলো ২৪.৭৬। এছাড়া তিনি ছিলেন একজন দক্ষ পিচ কিউরেটর। কটকের বরাবটি স্টেডিয়ামের পিচ তৈরিতে তিনি ছিলেন মুখ্য ভূমিকাগ্রহণকারী। দুঃখের বিষয় এটাই, কার্তিক বসুর আর্মহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িটার সেই ক্রিকেটগ্রাউন্ড একদা গাড়ি পার্কিং-এর জায়গা হয়ে উঠেছিলো!

সত্যজিৎ রায়ের ক্রিকেট খেলার ব্যাপারে বেশ অনেকজন লিখেছিলেন যে উনিও নিয়মিত ক্রিকেট খেলতেন এবং একজন লেগ স্পিন বোলার ছিলেন, তথাপি ক্রিকেট লিখিয়ে সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে সত্যজিৎ রায় কোনো ভারী খেলা খেলতেন না, ওনার আত্মজীবনীতে উনি এরকমই লিখে গেছেন। যদিও সত্যজিৎ রায় যে বহুলভাবে ক্রিকেট অনুরাগী ছিলেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

এ তো গেলো সারদারঞ্জন রায়, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত রায়বাড়ির ক্রিকেট-সম্পর্কের কথা। বাংলার অপর এক রায়বাড়ি অর্থাৎ প্রবাদপ্রতিম ভারতীয় ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব পঙ্কজ রায়ের পরিবারও ক্রিকেটের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত ছিলেন। এই অপর রায় পরিবারটির ক্রিকেট সম্পর্কের কথা আমি জানতে পেরেছিলাম ‘খেলার আসর’ (১৯৮২ সংখ্যা) পত্রিকায় অতুল মুখার্জির লেখা একটি প্রবন্ধ থেকে।

প্রথমেই চলে আসি পঙ্কজ রায়েদের পারিবারিক ইতিহাসের ব্যাপারে। ভাগ্যকুলের রায় পরিবারের আদি নিবাস ছিলো অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা জেলার শ্রীনগর গ্রামে। আসলে, রায় পরিবারের আসল পদবী ছিলো ‘কুণ্ডু’; কিন্তু একবার স্বয়ং আলিবর্দি খাঁ এই বাড়িতে এসে আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন এবং তখনই নবাবী পাঞ্জায় এই পরিবারের সাথে ‘রায়’ উপাধি যোগ করা হয়। আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে, গঙ্গাপ্রসাদ রায়ের হাত ধরে বাংলাদেশ থেকে এই রায় পরিবার কুমোরটুলির কাছে নিবাস গড়ে তোলে। উত্তর কলকাতার অভয় মিত্র স্ট্রিটে এখনও রায়েদের বেশ কিছু বাড়ি আছে। রায়বাড়িতে প্রথম ক্রিকেট প্রবেশ করে কলকাতায় বসবাসকারী পঞ্চম পুরুষের সময় থেকে, রঙ্গলাল রায়ের হাত ধরে। রঙ্গলাল রায় প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন। এই রঙ্গলাল রায়কেই বলা যায় রায়বাড়ির প্রথম এবং আদিতম ক্রিকেটার।

একটু পিছনের দিকে চলে যাই। গঙ্গাপ্রসাদ রায়ের হাত ধরে কুমোরটুলিতে আস্তানা গড়ে তোলে রায় পরিবার। গঙ্গাপ্রসাদের বংশধর ছিলেন পিয়ারী মোহন রায়, তাঁর চার ছেলে — গুরুপ্রসাদ রায়, হরিপ্রসাদ রায়, চৈতন্যদাস রায় ও প্রেমচাঁদ রায়। চৈতন্যদাস রায়ের দত্তক পুত্র বনোয়ারীলাল রায়ই আমাদের এখন মুখ্য আলোচ্য ব্যক্তিত্ব। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সৃষ্টির কথা আগেই বলেছি। তিরিশ দশকে বনোয়ারীলাল রায়ের বাড়িতেই ইস্টবেঙ্গল ক্লাব বহুযত্নে লালিত হয়েছিলো। সেইসময় দক্ষিণ ভারতের নামকরা সব ফুটবলাররা, যেমন — লক্ষীনারায়ণ, মুর্গেশরা সবাই বনোয়ারীলালের বাড়িতেই থাকতেন এবং কুমোরটুলি পার্কে প্র‍্যাক্টিস করতেন। সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের সারদারঞ্জন রায় ছিলেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রথম প্রেসিডেন্ট, আবার পঙ্কজ রায়ের পরিবারের বনোয়ারীলাল রায় ছিলেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের একজন অভিভাবক। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব যেন মিলিয়ে দিলো এই দুই বিখ্যাত রায় পরিবারকে। তবে শুধু ইস্টবেঙ্গল নয়, পঙ্কজ রায়ের পরিবারের সাথে মোহনবাগানেরও সম্পর্ক রয়েছে, সে ব্যাপারে পরে আসছি। এখন সরাসরি চলে আসি ক্রিকেটে। এই পরিবারে রঙ্গলাল রায়ের প্রথম ক্রিকেট খেলায় মাঠে নামবার কথা বলা হয়েছে প্রথমেই। রঙ্গলাল রায়ের ভ্রাতা ক্ষীরোদলাল রায়ের তিন ছেলে — অজিতলাল রায়, পঙ্কজলাল রায় ওরফে পঙ্কজ রায়, নিমাইলাল রায়।

অম্বর রায়

ক্রিকেটার পঙ্কজ রায়ের কথা কে না জানে। ভারতবিখ্যাত ক্রিকেটার, ভিনু মানকরের সাথে সেই ঐতিহাসিক পার্টনারশিপ, রয় গিলক্রিস্টের চোখে চোখ রেখে লড়ে যাওয়া ব্যাটসম্যান এই পঙ্কজ রায়। আর পঙ্কজ রায়ের ক্রিকেট-অনুপ্রেরণা ছিলেন কার্তিক বোস, যিনি আবার সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের সদস্য। ক্ষীরোদলাল রায়ের অপর পুত্র নিমাইলাল রায়ও বেশ কয়েকটি রঞ্জি ম্যাচ খেলেছেন এবং রঞ্জিতে অভিষেক ম্যাচে সেঞ্চুরিও করেছেন। অজিতলাল রায়ও নিয়মিত এরিয়ান, স্পোর্টিং ইউনিয়নে ক্রিকেট খেলেছেন। এই অজিতলাল রায়ের পুত্রই হলেন বাংলার আরেক দিকপাল ক্রিকেটার অম্বর রায়। অম্বরলাল রায়ের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে আঠারোটি সেঞ্চুরি আছে, রঞ্জিতে সেঞ্চুরি সংখ্যা ১২টি (১৯৮২ এর রিপোর্টিং অনুযায়ী)। উনি ভারতের হয়ে মোট চারটি টেস্ট খেলেছেন, ১৯৬৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একটি টেস্ট ইনিংসে ৪৮ রান করেন। আবার পঙ্কজ রায়ের রঞ্জিতে সেঞ্চুরি সংখ্যা ২১ টি। আবার পঙ্কজ-পুত্র প্রণবলাল রায় ১৯৮২ অবধি চারটি সেঞ্চুরি করেছিলেন। এরপরের সময়কালে তাঁর কোনো সেঞ্চুরি ছিলো কিনা এ বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন এখনও অবধি আমার কাছে নেই।

কার্তিক বোস

তাহলে ১৯৮২ এর রিপোর্টিং অনুযায়ী রায় পরিবার থেকেই রঞ্জিতে বাংলার পক্ষ থেকে মোট ৩৮টি সেঞ্চুরির অবদান আছে… অনবদ্য! এছাড়া পঙ্কজ রায়ের ওরকম দুর্ধর্ষ ইন্টারন্যাশনাল কেরিয়ার, প্রথম বাঙালী হিসাবে ভারতের অধিনায়কত্ব হাতে পাওয়া, পাঁচটি ইন্টারন্যাশনাল সেঞ্চুরির কথা কে না জানে। এছাড়া এই পরিবারের আরেক সদস্য গোবিন্দলাল রায়ও ক্রিকেটার ছিলেন। নন্দলাল রায়ের পুত্র জলধিলাল রায়ও ভালো ক্রিকেট খেলতেন, কিন্তু অল্প বয়সে মারা যান। নন্দলাল রায়ের নাতি জাস্টিস কে.এল.রায়ও টাউন ক্লাবে ক্রিকেট খেলেছেন। আর যে কথাটি উল্লেখ না করলেই নয়, যে কথাটি পরে বলবো বলেছিলাম — এই পরিবারের রমেন্দ্রনাথ রায় ছিলেন মোহনবাগানের আজীবন সদস্য ও পঞ্চম সভাপতি। মৃত্যুর আগে অবধি একনাগাড়ে প্রায় ১৭ বছর মোহনবাগানের সভাপতি ছিলেন তিনি।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র ক্রিকেট নয়, ক্রিকেট-ফুটবল-মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল, সর্বোপরি ক্রীড়াক্ষেত্রে বাংলার এই দুই বিখ্যাত রায় পরিবারের অবাধ বিচরণ। বাংলা ক্রিকেটের বর্তমান হাল দেখে সত্যিই আফসোস হয়। কিছু বছর আগে অবধিও কার্তিক বসুর বাড়ি সংলগ্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডটি একটি গাড়ি পার্কিং-য়ের জায়গায় পরিণত হয়েছিলো। বাংলা ক্রিকেটের অলিতে গলিতে ছড়িয়ে আছে ঐতিহ্যের কণা। সেগুলির যত্নসহকারে রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত প্রয়োজন, ঠিক যেমনি প্রয়োজন নিভু নিভু বাংলার ক্রিকেটকে যথার্থ আলোকদানের।

শেষ করলাম এখানেই। কিন্তু রাজার খেলা ক্রিকেটে এই দুই রায়বাড়ি যে বেশ চালিয়ে খেললো, তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা… কি তাইতো?

তথ্যসূত্র :

(১) ‘পাকদন্ডী’ (লীলা মজুমদার), (২) ‘যখন ছোট ছিলাম’ (সত্যজিৎ রায়), (৩) ‘ফিরে ফিরে চাই’ (অজয় বসু), (৪) ‘ক্রিকেট ও রায় পরিবার’ (অতুল মুখার্জি, খেলার আসর, ১৯৮২ জানুয়ারী সংখ্যা), (৫) সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়ের রচনা, (৬) অভিষেক মুখার্জির রচনা।

কভারের ছবি কার্তিক বোসের নেট প্র্যাকটিস


আপনার মতামত লিখুন :

2 responses to “রাজার খেলায় রায়বাড়ি, দুই পরিবারের ক্রীড়াপ্রেম : যীশু নন্দী”

  1. Prasanta Lal Mukherjee. says:

    এ যেনো এক ক্রিকেটের এক ঐতিহাসিক মিনি দলিল, যেখানে জড়িয়ে আছে, কলকাতার দুই বিখ্যাত রায় পরিবারের ক্রিকেটিয় অবদান।
    যাঁরা খেলার সঙ্গে ইতিহাসে চর্চা করতে ভালোবাসেন, তাঁদের এই লেখা দারুন ভালো লাগবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
    বহু পরিশ্রম করে তৈরি এই লেখাটি আমাকে মুগ্ধ করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন