সবাই জানেনা সেই গল্পগুলো। সবাই জানেনা সেই আধপাগলা লোকটাকে। তখন শীতকাল। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর খেলোয়াড়রা যে যার মতো বাড়ি চলে গেছে। থাকার মধ্যে আছে একজন খেলোয়াড় এবং তার কোচ। হঠাৎ সেই আধপাগলা কোচ তার প্রিয় ওই খেলোয়াড়কে বললেন — “চল সত্য, একটু দেবদারু গাছের ছায়ায় গিয়ে শুই”। যদিও উনি কোচ কিন্তু ওই যে আধপাগলা। খেলোয়াড়টিও তখন বোধহয় পাগল ভেবেছিল লোকটাকে। এতবড় দলের খেলোয়াড় তিনি অথচ তাঁকে শুতে হবে কিনা গাছতলায়! কিন্তু কি আর করা যাবে, কোচের নির্দেশ যে, তাই বাধ্য হয়েই সে গেল কোচের সাথে দেবদারু গাছের তলায়। সেখানে গিয়েই সে বুঝতে পারল কোচের আসল উদ্দেশ্যটা। লতাপাতা আর কিছু পড়ে থাকা পাথরকুচি নিয়েই কোচ বোঝালেন এক নতুন ফুটবল সিস্টেম — ৩-২-৩-২ ছক। যেটা পরবর্তীকালে ঝলসে উঠেছিল বিখ্যাত ডায়মন্ড সিস্টেমরূপে। যাকে আধপাগলা ভাবছিলেন, পরবর্তীকালে সেই কোচেরই ফ্যান হয়ে গেলো সেই খেলোয়াড়টি।
খেলোয়াড়টির নাম সত্যজিৎ চ্যাটার্জি। আর কোচের নাম? অমল দত্ত।
ঝুম চাষ পদ্ধতিতে পাহাড়ি চাষীরা সৃষ্টির বিপ্লব এনে পাহাড়েও ফলাচ্ছে ফসল। বাগানের মালিরা তাদের সৃজনশীল নিপুণতায় বাগানে ফোটাচ্ছে নানান রঙের কসমস, ফোটাচ্ছে হলদে-কালোর সূর্যমুখী। ক্রিকেটময় এই বিশ্বে শচীন পন্টিংরা আবিষ্কার করছে নতুন নতুন শট। আর এই সৃজনশীলতার বিপ্লব থেকে ভারতীয় ফুটবল পিছিয়ে রইল ঠিক দু দুটো যুগ।আর এখানেই একটা অমল দত্তের দরকার ছিল ভারতের। এখানেই সার্থক অমল দত্তের নাম। সময়ের সারণী বেয়ে চলে যান ১৯৬৯ সালে। ভারত তথা কলকাতার ঘরে ঘরে তখন টিভি অবধি নেই। সেখানে এই ভদ্রলোক বাড়ির গয়নাগাটি বেচে চলে যান বিদেশের অচেনা জগতে। খেলা দেখতে থাকেন হাঙ্গেরি, পর্তুগাল, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্সের। শুধু দেখলেনই না, সেগুলিকে বয়ে নিয়ে এলেন সুদূর কলকাতা ময়দানে। সাইকেলে চড়ে চড়ে প্রোজেক্টারে সেইসব ভিডিও দেখিয়ে ভারতের সাথে পরিচয় করালেন বিদেশি ফুটবলের। ভারতের প্রথম প্রফেশনাল বাঙালী কোচ। আনতে চাইলেন ফুটবল বিপ্লব।
১৯৬৯ সালে ভবানী রায়কে করলেন ভারতের প্রথম ওভারল্যাপিং সাইডব্যাক।প্রিয়লাল মজুমদারকে করেদিলেন ভারতের প্রথম ফিফ্থ ফরোয়ার্ড। ডিফেন্স থেকে মিডফিল্ডে এনে জীবন বদলে দিলেন ভারতের অন্যতম সর্বকালীন সেরা মিডিও সুদীপ চ্যাটার্জির। হাঙ্গেরির হিদেকুটির মতো হাবিবকে কখনও ওপরে কখনও নীচে খেলালেন, যেটাকে আজকে বলা হয় রোমিং মিডিও। কত সব অভিনবত্ব। কত সব আধুনিকতা বয়ে আনলেন সেই আধপাগলা কোচটাই। বেলুড়ের একটুকরো জমি কিনে নিজের হাতে তৈরী করলেন অসীম মৌলিককে, সেইসময়ের টপ স্কোরার। বস্তিতে থেকে ওড়িশার কোচ হিসাবে ওড়িশাকে তুলে আনলেন ভারতীয় ফুটবলের রোডম্যাপে। আজকে স্প্যানিশ ফুটবলের পাসের মন্ত্র কত আগে যে ভদ্রলোক ভেবেছিলেন তার ইয়ত্তা নেই। তিনি ছিলেন সৃষ্টির দূত। মাথা থেকে বেরোতো অনবদ্য সব চিন্তাধারা। কার্লো আনসেলোত্তির বিখ্যাত ডায়মন্ড ৪-১-২-১-২ সিস্টেমের অনেক আগেই চালু করলেন ৩-২-৩-২ ছক। আবার যখন তিনি ছোটো টিমের কোচ যেখানে জিম নেই সেখানে নিজের তাঁর সৃজনশীল মস্তিষ্কপ্রসূত বুদ্ধি দিয়ে নিয়ে এলেন অভিনবত্ব। স্পটজাম্প ট্রেনিং করালেন গাছের ডালপালার উপর দিয়ে লাফানোর মাধ্যমে। ওয়েট ট্রেনিং করালেন ভারী ফুটবলারদেরকে রোগা ফুটবলারদের কাঁধের উপর চড়িয়ে। পিঠে টায়ার বেঁধে দৌড় করালেন, সেটাই হয়ে গেল প্যারাসুট ট্রেনিং। বিদেশী কোচদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি একবার বলেছিলেন — “বিদেশী কোচগুলো বলবে চ্যাং চুং চ্যাং। আর আমাদের কম শিক্ষিত ফুটবলাররা সেসব ভাষা না বুঝেই উত্তর দেবে ফ্যাং ফুং ফ্যাং। লাভের লাভ কিছুই হবেনা।”
এটাই অমল দত্ত। একদিকে যেমন বোহেমিয়ান তার জীবন, জীবনের কঠোর দারিদ্রেও কারোর থেকে এক পয়সা নেননি। অন্যদিকে তেমনি সুরপ্রেমী সঙ্গীতপ্রেমি, যেকোনো সময়েই লুঙ্গি পড়ে উচ্চাঙ্গ রাগে “ধিন তা ধে রে কে টে ধিন তা” করে ধরতেন সুর। আবার অন্যদিকে এক ছুচোলো সত্যের তলোয়ার, যে তলোয়ারের ছুঁচে বিদ্ধ করেছিলেন তিনি প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সীকেও। আর সর্বোপরি ভারতের ফুটবলের কয়লাখনিতে তিনি একটুকরো হীরকখণ্ড, যিনি তার ছটি ধার দিয়ে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন ভারতীয় ফুটবলের ছয়টি ঋতু।
ফুটবলার জীবনে অমল দত্ত ছিলেন লেফট হাফের খেলোয়াড়। ইস্টবেঙ্গল যেবার রাশিয়া সফর করেছিলেন সেইবার লোনে ইস্টবেঙ্গলে খেলোয়াড় হিসাবে যোগ দেন অমল দত্ত। রাশিয়া সেই সময় বিশ্বফুটবলে ক্রমশ এক ফুটবল জাতি হিসাবে নিজেদের তুলে ধরছে। শোনা যায় রাশিয়ায় খেলতে গিয়ে সেখানকার আধুনিকতার সংস্পর্শে এসে ফুটবল কোচিংয়ের ভূত মাথায় চাপে অমল দত্তের। সেই শুরু, তারপর ফুটবল কোচিংয়ের জন্য জীবনে যে পরিমাণ ঝুঁকি এবং আত্মত্যাগের নিদর্শন রেখেছেন অমল দত্ত, তা বোধহয় ভারতীয় ফুটবলে আর কোনো কোচ দেখাতে পারেননি। স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে ইংল্যান্ড এবং ব্রাজিলে গিয়েছিলেন কোচিং শিখতে। পরে দেশে ফিরে সাইকেলে করে প্রোজেক্টারের মাধ্যমে গ্রামে গঞ্জে বিদেশী খেলার ক্লিপিং দেখাতে আরম্ভ করলেন তিনি। ফুটবলকে নিয়ে যে পরিমাণ স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন এবং যেভাবে ভারতীয় ফুটবলে তিনি আধুনিকতার পরশ নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন তা বোধহয় ভারতীয় ফুটবলে বিরল।
এ প্রসঙ্গে ভারতীয় ফুটবলে প্রথম ওভারল্যাপিং রাইট ব্যাক ভবানী দত্তের মুখেই শোনা যাক। কাহিনিটা হল, — ছেষট্টিতে আমার ইস্টার্ন রেল দলের গোলকিপার নারায়ণ মণ্ডল দক্ষিণেশ্বরে আমাদের পৈত্রিক বাড়ির কাছেই থাকত। তো একদিন ও আমাকে খবর দিল, অমল দত্ত পাড়ায় আসছেন তাঁর সেই প্রোজেক্টর নিয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ দেখাতে। সে দিন উনি দেখিয়েছিলেন স্ট্যানলি ম্যাথেউজের ফেয়ারওয়েল ম্যাচের ফিল্ম। ম্যাথেউজ ইলেভেন ভার্সাস ওয়ার্ল্ড ইলেভেন। আর তাঁর সেই নিজস্ব কমেন্ট্রিতে অমলদা বারবার বুঝিয়েছিলেন, কী ভাবে বিশ্ব একাদশের আইরিশ সাইড ব্যাক সুযোগ পেলেই ওভারল্যাপে আক্রমণ করছে, আবার পরক্ষণে নীচে নেমে সঠিক পজিশন নিচ্ছে। বলেছিলেন, ‘‘এ জিনিস কেউ আগে দেখেনি এ দেশে।’’ ব্যাপারটা আমার মনে সেই সময় ভীষণ ছাপ ফেলেছিল। বলা যায়, উনসত্তরের তিন বছর আগেই অমলদা আমাকে ওভারল্যাপিং রাইট ব্যাক খেলতে শিখিয়েছিলেন!
উনসত্তরে মরসুমের আগাগোড়া পুরো স্বাধীনতা দিয়েছিলেন আমাকে ওভারল্যাপ করার। কেবল বলতেন, ‘‘শুধু একটা কথা মাথায় রেখো। তুমি যখন উঠে যাচ্ছ, তোমার রাইট ব্যাকের জায়গা নিচ্ছে রাইট স্টপার। তাই তুমি যখনই নীচে নামবে সব সময় কাট করে ভেতর ঢুকে রাইট স্টপারের জায়গায় আসবে।’’
ভবানী রায়
ওভারল্যাপের সময় আর একটা দারুণ বোঝাপড়া ছিল আমার আর লেফট আউট প্রণব গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে। উনসত্তরের শিল্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলকে ৩-১ হারানোর দিন গাঙ্গুলির দু’টো গোলের একটা ঠিক ওই বোঝাপড়ার রেজাল্ট। আমি ওভারল্যাপে যেতেই ও কাট করে ভেতরে ঢুকে এসেছিল। আমার পঁচিশ-তিরিশ গজের থ্রু পাস পৌঁছে গিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল গোলের সামনে ঠিক ওর পায়ে। সে বছরই মারডেকায় যখন যাই, ভারতীয় দলের কোচ জার্নাল সিংহ-ও আমাকে ওভারল্যাপ করার পুরো স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।
অমল দত্তকে নিয়ে আলোচনা করতে এলে যে নামটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে সেটি হলো পিকে ব্যানার্জি। অমল-পিকে ডুয়েট অসামান্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার সাক্ষর বহন করেছে ভারতীয় ফুটবলে। হেড টু হেড ডুয়েলে হয়তো পিকে ব্যানার্জি অনেকটা এগিয়ে কিন্তু অমল দত্ত অমূল্য হয়ে রয়ে গিয়েছেন তাঁর অভিনবত্বে৷ একসময় অমল দত্ত এবং পিকে ব্যানার্জি উভয়ই ছিলেন এরিয়ানের খেলোয়াড়। আনন্দবাজার পত্রিকায় দেওয়া পিকে ব্যানার্জির সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় পিকে ব্যানার্জি যখন প্রথম প্রথম এরিয়ানে খেলতেন তখন তাঁকে মানসিকভাবে যথেষ্ট সাহায্য করেন অমল দত্ত। এমনকি পিকে ব্যানার্জির বাড়ি ফেরার ট্রামের খরচাটাও অমল দত্ত দিয়ে দিতেন অনেক সময়। আবার অনেক সময় অমল দত্ত পিকে ব্যানার্জিকে নিয়ে আসতেন নিজের বাড়িতে। অমল দত্তদের পশুপাখি বিক্রির পৈতৃক ব্যবসা ছিলো। বাড়িতে নিয়ে এসে পিকে ব্যানার্জিকে অনেক সময়ই বিভিন্ন বিদেশি পশুপাখির সাথে পরিচয় করাতেন অমল দত্ত। দুজনের এহেন বন্ধুত্ব পরবর্তীকালে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতায় পর্যবসিত হয়েছিলো কোচিং জীবনে। কখনও অমল দত্ত জিতেছেন, কখনও পিকে ব্যানার্জি জিতেছে। কিন্তু আসলে জিতেছিলো ভারতীয় ফুটবল যার জন্য আজও পিকে-অমল ডুয়েল তুফান ওঠায় চায়ের আড্ডায় কিংবা সংবাদপত্রের পাতায়।
আজকাল গ্রুমিংয়ের অভাবে রাম, অবিনাশ, আজহার ফৈয়াজরা, তলিয়ে গেছে অতলে,হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালী খেলোয়াড়, ঠিক এইসময়েই দরকার ছিল একটা অমল দত্তের, নতুন ফুটবলার গড়ার কারিগর। কিন্তু তিনি যে আর নেই।
বোহেমিয়ান অমল সেই রোনালদোদের ইউরো জয়ের রাতেই চলে গেছেন সেই সুদূর অমর্ত্যলোকে। ইউরো জয়ের রাতে তাঁর চলে যাওয়াটা ঠিক যেন বহির্বিশ্বের সাথে ভারতের সর্বকালের সেরা যোগাযোগসেতুটির ছিন্ন হওয়ার পরোক্ষ প্রমাণ। বৃষ্টিভেজা দুপুরবেলায় মোহনবাগান লনে বসে একাকী ভেবে চলি — “কি জানি, আকাশের ওপারেও অমলবাবু নতুন সৃষ্টির উল্লাসে মেতে উঠেছেন হয়তো। সৃষ্টিপাগল মানুষতো। ভারতীয় ফুটবলের আইনস্টাইন”। এসব ভাবি আর পাশে পড়ে থাকে কিছু বৃষ্টিভেজা কয়লা, আর একটুকরো হীরকখণ্ড…
কৃতজ্ঞতা : আনন্দবাজার পত্রিকা