লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা আজ খুব মনে পড়ছে। ড্যানি বয়েল দেখিয়েছিলেন ব্রিটেনের ভিলেজ ক্রিকেটের ছোটো ছোটো কোলাজ। সবুজ মাঠে সাদা পোশাক পরে ক্রিকেট খেলছে ব্রিটেনের গ্রাম্য বালকেরা। আহা! কি নয়নাভিরাম সে দৃশ্য। বিশ্বের বৃহত্তম ক্রীড়া অনুষ্ঠানে উইলো-কোকাবুরার দ্বৈরথ যদি সত্যি সত্যি হতো! ভাবলেই কেমন কাঁটা দেয়। কপিল দেব নীলরঙা কোর্ট প্যান্ট পরে হেঁটে চলেছেন লন্ডন কিংবা বেজিং এর কোনো অলিম্পিকের মাঠে। হাতে গেরুয়া-সাদা-সবুজ পতাকা। কেউ জোরে জোরে ঘোষণা করছে, “কপিল ডেভ্, দ্য ফ্ল্যাগ বিয়ারার ফ্রম ইন্ডিয়া…”।
অলিম্পিকে ক্রিকেট খেলা কেনো হয়না, তার অনেক কারণ আছে, অনেক ব্যাখ্যাও আছে। কিন্তু সেসব পরে হবে। এখন বলতে এসেছি অন্য কথা। বিশ্বের বৃহত্তম এই ক্রীড়া অনুষ্ঠানে কিন্তু সত্যি সত্যিই একবার ক্রিকেট খেলা হয়েছিলো। সেটাই প্রথমবার, সেটাই শেষবার। সে আজ থেকে একশো কুড়ি বছর আগেকার ঘটনা।
মডার্ন অলিম্পিক শুরু হয়েছিলো ১৮৯৬ সাল থেকে। ১৮৯৫ সালে, প্যারিসে ঠিক হয় ১৮৯৬ সালের এথেন্স অলিম্পিকে ক্রিকেট খেলা হবে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড, বেলজিয়াম — এই চার দল যে ১৮৯৬ এর এথেন্স অলিম্পিকে ক্রিকেট খেলবে তা ঠিকও হয়ে যায়। কিন্তু ইয়ান বুকাননের রিপোর্ট অনুযায়ী “Owing to Insufficient Entries”-এর জন্যে ১৮৯৬ এথেন্স অলিম্পিকে ক্রিকেট খেলা আর হয়ে ওঠেনি। যদি তা হতো, তাহলে ক্রিকেটই হয়ে উঠতো মডার্ন অলিম্পিকে খেলা প্রথম টিম স্পোর্টস।
১৮৯৬ অলিম্পিকে ক্রিকেট খেলা না হয়ে উঠলেও ১৯০০ সালের প্যারিস অলিম্পিকে কিন্তু ক্রিকেট খেলা হয়েছিলো। অনেক রিপোর্টে বলা আছে অলিম্পিকের প্রথম এবং শেষ এই ক্রিকেট ম্যাচটি হয়েছিলো ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের মধ্যে, কিন্তু এই তথ্যটি আদতে ভুল। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের দুটি ক্রিকেট ক্লাবের মধ্যে এই খেলাটি হয়। আজব ঘটনা এই যে এই ক্রিকেট ম্যাচে প্রতিটি দলের খেলোয়াড় সংখ্যা ছিলো বারো জন, অর্থাৎ এই ক্রিকেট খেলাটি ছিলো টুয়েলভ-সাইড-গেম। আজ অবধি এরকম ক্রিকেট খেলা আর হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।
এবার সরাসরি চলে আসি ম্যাচটির ব্যাপারে। ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয় মিউনিসিপ্যাল ভেলড্রোম অফ ভিনসেন্নেস-এ। এটি মূলত একটি সাইক্লিং স্টেডিয়াম। এই স্টেডিয়ামের মাঠেটির চারিদিকে রয়েছে একটি সাইক্লিং ট্র্যাক। এই সাইক্লিং ট্র্যাকটিকেই সেবার ক্রিকেটের বাউন্ডারি হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিলো। ফ্রান্স সেই সময় ছিলো ক্রিকেট খেলায় অনেক পিছনে থাকা একটি দেশ। সত্যি বলতে কি ফরাসীরা ক্রিকেটই খেলতোনা। ফ্রান্সে ক্রিকেটটাই আমদানি হয়েছিলো ইংরেজদের হাত ধরে। ফ্রান্স থেকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলো ইউনিয়ন ক্লাব এবং স্ট্যান্ডার্ড অ্যাথলেটিক ক্লাব। এই ক্লাবটি কিন্তু কোনো একক ক্লাব ছিলোনা, ক্লাবটি ছিলো মূলত দুটি ক্লাবের মিশ্রণ — ইউনিয়ন ক্লাব আর স্ট্যান্ডার্ড অ্যাথলেটিক ক্লাব। ১৮৯০ এর দিকে প্যারিসে আইফেল টাওয়ার নির্মাণের কাজে বেশ কিছু ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়োগ করা হয়। মূলত তারাই এই স্ট্যান্ডার্ড অ্যাথলেটিক ক্লাবটি তৈরী করে। আগেই বলেছি, ফরাসী ক্রিকেটে ইংরেজদের প্রাধান্যই ছিলো বেশী। ফ্রান্সের এই ইংরেজরাই এই ম্যাচটি আয়োজনে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলো। ফ্রান্স থেকে প্রতিনিধিত্বকারী ক্রিকেট দলটির তিনজন খেলোয়াড় ছিলেন অর্গ্যানাইজিং কমিটির মেম্বার। এদের মধ্যে ছিলেন ফিলিপ টমলেইন, যিনি ফ্রেঞ্চ দলটির অধিনায়কত্ব করেছিলেন, আর বাকী দুজন হলেন টি.এইচ.জর্ডন এবং এ. ম্যাকেভয়।
অপরদিকে ইংল্যান্ড থেকে যে ক্লাবটি খেলতে আসে, তার নাম ছিলো ডেভন অ্যান্ড সমারসেট ওয়ান্ডারার্স ক্রিকেট ক্লাব। ১৮৯৪ সালে ইংল্যান্ডের একটি ছোট্ট দ্বীপ আইল অফ উইটে ক্রিকেট সফরের জন্য উইলিয়াম ডানে এই ক্রিকেট ক্লাবটি তৈরী করেন। সমারসেটের ক্যাসল ক্যারি ক্লাবের ক্রিকেটারদের নিয়ে মূলত এই ক্রিকেট ক্লাবটি গঠিত ছিলো। এছাড়াও এই ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট খেলতেন ওয়ান্ডারার্সের কিছু ক্রিকেটার এবং ডেভন পাবলিক স্কুলের (ব্লান্ডেলের একটি স্কুল) কিছুজন প্রাক্তনী। তাই সব মিলিয়েই ক্লাবটির নাম দেওয়া হয় — ‘ডেভন অ্যান্ড সমারসেট ওয়ান্ডারার্স ক্রিকেট ক্লাব’। ১৮৯৪ থেকে ১৯০০ সাল অবধি এই দলটি প্রায় ছয়টি ক্রিকেট সফর করেছিলো। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে প্রফেশনাল ক্রিকেটারদের অভাবের যুগে এই ক্রিকেট ক্লাবটি মোটের উপর বেশ কিছুটা প্রফেশনাল ক্রিকেট ক্লাব ছিলো। এর আরও একটা প্রমাণ রয়েছে। ১৯০০ সালের প্যারিস অলিম্পিকে এই দলটি যখন ক্রিকেট খেলতে এলো তখন সেই দলে দুইজন এমন খেলোয়াড় ছিলেন যাঁদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা ছিলো। তখনকার দিনে এ এক বিরাট ব্যাপার। এই দুইজন ছিলেন — মন্টেগ টোলার এবং অ্যালফ্রেড বাওয়ারম্যান। মন্টেগ, সমারসেটের হয়ে ছয়টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছিলেন আর বাওয়ারম্যান খেলেন একটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। অবিশ্যি ১৯০৫ সালে বাওয়ারম্যান সমারসেটের হয়ে আরেকবার প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলতে মাঠে নেমেছিলেন। ১৯০০ প্যারিস অলিম্পিকের এই ‘ডেভন অ্যান্ড সমারসেট ওয়ান্ডারার্স’ ক্রিকেট দলটির বাকী নয়জন খেলোয়াড়ের পাঁচজন ছিলেন ক্যাসল ক্যারি ক্লাবের খেলোয়াড় এবং চারজন ছিলেন ডেভন পাবলিক স্কুলের প্রাক্তনী।
১৯ শে আগস্ট, ১৯০০। রোববারের দুপুরবেলায় মিউনিসিপ্যাল ভেলড্রোম অফ ভিনসেন্নেসে ম্যাচ শুরু হয়। প্রথমে ব্যাট করতে নামে ডেভন অ্যান্ড সমারসেট ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। তাদের ইনিংস শেষ হয় ১১৭ রানে। এফ.ডব্লিউ কামিং দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৩৮ রান করেন। ফ্রান্সের দলটির হয়ে সর্বোচ্চ চারটি উইকেট নেন অ্যান্ডারসন। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ইউনিয়ন ক্লাব অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অ্যাথলেটিক ক্লাবের ইনিংস শেষ হয় ৭৮ রানে। ডেভন অ্যান্ড সমারসেট ওয়ান্ডারার্স দলের হয়ে ক্রিশ্চিয়ান সাতটি উইকেট দখল করেন। এমতাবস্থায় প্রথম দিনের খেলার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় (বিকাল পাঁচটা নাগাদ)।
পরের দিন দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নামে ডেভন অ্যান্ড সমারসেট ওয়ান্ডারার্স। প্রথম ইনিংসে ১১৭ রানে অল-আউট হয়ে গেলেও দ্বিতীয় ইনিংসে তারা তাদের প্রফেশনাল ক্রিকেট দক্ষতার ঝলক দেখায়। সি.বি.কে. বিচক্রফট সমারসেটের দলটির হয়ে অর্ধশতরান পূর্ণ করে রান-আউট হন। ৫ উইকেট খুইয়ে ১৪৫ রান তুলে সমারসেট ইনিংস ডিক্লেয়ার করে। ১৮৩ রানের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ২৬ রানেই গুঁড়িয়ে যায় ফ্রেঞ্চ দলটির ইনিংস। ইংল্যান্ডের দলটির হয়ে মন্টেগ টোলার মাত্র নয় রান দিয়ে সাত উইকেট তুলে নেন। আশ্চর্যের কথা হলো এই সাতটি উইকেটের মধ্যে সবগুলিই ছিলো ক্লিন-বোলড। প্রফেশনাল ক্রিকেট সফরের সুফল হাতেনাতে পায় ডেভন অ্যান্ড সমারসেট ওয়ান্ডারার্স ক্রিকেট ক্লাব। অলিম্পিকের প্রথম এবং একমাত্র ক্রিকেট ম্যাচটিতে জয়লাভ করে তারা।
এ তো গেলো অলিম্পিকের একমাত্র ক্রিকেট ম্যাচটির কাহিনী। এর ঠিক নব্বই বছর পরে ১৯৯০ সালে অলিম্পিকের একমাত্র ক্রিকেট ম্যাচটির নব্বই বর্ষপূর্তি উদযাপন করা হয়।সেই উপলক্ষে ওল্ড বান্ডেলিয়ানস ক্লাবের (নব্বই বছর আগের ডেভন অ্যান্ড সমারসেট ওয়ান্ডারার্স ক্রিকেট ক্লাবটিতে ডেভন স্কুল থেকে যে ক্রিকেটারেরা খেলতেন, সেই ডেভন স্কুল ছিলো বান্ডেলেরই একটি স্কুল) সাথে স্ট্যান্ডার্ড অ্যাথলেটিক ক্লাবের একটি ক্রিকেট ম্যাচ খেলা হয়। ম্যাচটি ড্র হয়। ম্যাচটি শেষ হবার পরে নৈশভোজের সময় অনেকে মজার ছলে দাবি তোলেন — “England retained the Olympic title! “।
ভাবতেই অবাক লাগে ১৯০০ সালের পর থেকে আজ প্রায় ১২০ বছরেরও বেশী সময় ধরে ক্রিকেট ব্রাত্য অলিম্পিক থেকে। অলিম্পিকে কেনো ক্রিকেট খেলা হয়না তার বিবিধ কারণ আছে। কেউ বলেন অলিম্পিকের নীতি যেহেতু ‘ফাস্টার, হায়ার, স্ট্রংগার’, তাই তুলনামূলক কম অ্যাথলেটিক এবং বেশী সময় ধরে হওয়া স্পোর্টস ক্রিকেট নাকি অলিম্পিকে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। কেউ বলে আই.সি.সি. নিজেই কোনোদিনও আই.ও.সি.-কে অনুরোধ করেনি অলিম্পিকে ক্রিকেট অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে। কেউ বলেন ক্রিকেটের মাঠ, পিচ পরিচর্যার ঝামেলা অনেক, কেউ বলেন বিশ্বের খুব কম দেশে ক্রিকেট জনপ্রিয় হওয়াটাও একটা বড়ো কারণ। অনেকে আবার এটাও বলেন, ইংল্যান্ড তার পার্শ্ববর্তী ঔপনিবেশিক দেশগুলিকে একত্রে নিয়ে ‘গ্রেট ব্রিটেন’ নাম নিয়ে অলিম্পিকে নামে।কাজেই অলিম্পিকে ক্রিকেট খেলা হলে তারা তো আর ‘গ্রেট ব্রিটেন নাম’ নিয়ে মাঠে নামতে পারবে না, তাই সেই ব্যাপারটিও নাকি একটা বড়ো কারণ হতে পারে।
কারণ যাই হোক না কেনো, আশা তো চিরকালই খেলাঘর বেঁধে গেছে। তাই হয়তো আগামীদিনে ক্রিকেটকে অলিম্পিকে অন্তর্ভুক্ত হতে দেখবো। হয়তো সেদিন ইডেন বা লর্ডসের মাঠে অলিম্পিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চাপ দাড়ির ভদ্রলোকটি নীল ব্লেজার পরে আর জাতীয় পতাকা নিয়ে গটগট করে হেঁটে যাবে….আর আলগোছে মাইকে কেউ হয়তো ঘোষণা করে যাবে, “হেয়ার কামস ভিরাট কোহলি, দ্য ফ্ল্যাগ বিয়ারার ফ্রম ইন্ডিয়া…”।
কি জানি, দেখবো হয়তো কোনোদিন।