আমার পাসপোর্টে যে দেশের ছাপটা সবচেয়ে বেশি তা হল বাংলাদেশ। সোজা কথা, আমি বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি গিয়েছি। ঘটনাচক্রে আমরা দু দেশ আলাদা হয়েছি কিন্তু আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসীরা সে দেশকে বিদেশ মনে করিনা। ভাষা আমাদের এক সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। এই বন্ধনহীন গ্রন্থিকে ওপর থেকে বোঝা যায় না, এ টান আঁতের টান। তবে একথা মানতেই হবে ভাষার জন্য আবেগ, উত্তাপ, উষ্ণতা এবং লাগাতার আত্মবলিদান ওপার বাংলায় অনেক বেশি। ভাষাকে ভালবেসে মৌলবাদের বিরোধিতা করে এখনও সেখানে শহীদ হন অভিজিৎ রায়ের মত ব্লগাররা।
আমাদের এখানকার কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, লেখক, সাংবাদিকদের অবদান ও কৃতিত্বকে কোনরকম খাটো না করেও বলা যায় এপার বাংলায় বাংলা ভাষা নিয়ে মাতামাতি, চর্চা, বাংলা দেশের তুলনায় অনেক কম। বাংলা ভাষার প্রতি টান যেন ওদের অস্থিমজ্জায় মিশে আছে। দুই বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতির খবর ওরা অনেক বেশি রাখেন। শুধু রাখেন বললে ভুল হবে, ওরা তার নিয়মিত চর্চা করেন। এই চর্চা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের শিল্পীদের রবীন্দ্রসঙ্গীত আর নজরুলগীতিতে কিংবা ঐশী, অর্ণব, আর জেমসের গানে এবং বাংলার শিল্প সংস্কৃতি বিষয়ে নানা গবেষণা ও সৃজনশীল সাহিত্যকর্মে।
বাংলাদেশে এমনকি বিদেশে গিয়েও দেখেছি বাঙালি, বাংলাভাষী মনে হলেই ওদের উচ্ছ্বাস ও আতিথ্য, দেশকাল, পরিস্থিতি, পরিবেশ কোনকিছুর ধার না ধেরে সপাটে বেরিয়ে আসে। এব্যাপারটা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে নেই তা বলব না, তবে ওপার বাংলার তুলনায় তা কিছুই নয়। ঢাকা ক্লাব, প্রেস ক্লাব-সহ নানা জায়গায় কর্মসুত্রেই বহুবার যেতে হয়েছে আমাকে। প্রতিবারই একই অভিজ্ঞতা। বাংলা বলতে শুনেই যেচে এসে আলাপ করেন ওখানকার মানুষজন, এরপর বাড়িতে নেমন্তন্ন করেন। কেউ বা সোজা এসে বলেন, কেন তাদের সঙ্গে কথা বলছি না? জিজ্ঞেস করেন দেশ কোথায় বা বাবা-মা কোথায় থাকতেন। সত্যি, স্নেহ-ভালবাসার এই প্লাবনে স্রেফ ভেসে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। সবকিছুই ঘটে ভাষার টানে। দেখেছি ওরা আমাদের খবর অনেক বেশি রাখেন। আমরা কিন্তু সে তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে আছি। রাস্তাঘাটে যেদিকে তাকাই বিজ্ঞাপন ও দোকানের সাইনবোর্ডের ভাষা বাংলা। আমাদের এখানে এ চেষ্টা মাঝে হয়েছিল কিন্তু তা কোন পরিণতি পায়নি। ওরা এ জিনিসটা করতে পেরেছে ভিতরের আবেগ আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে। আর আমাদের এখানে তা খবরের কাগজে ছবি ছাপানো আর সাইনবোর্ডের গায়ে নিছক আলকাতরাবাজিতেই শেষ হয়ে গেছে। কারণ আমরা কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে এগোতে পারিনি।
ভাষা মানে শুধু কোন দিবসের উদযাপন নয় বরং প্রতিটি মুহূর্তেই তাকে নিয়ে বাস করা। বাংলা এমন একটি ভাষা যাকে ভালবেসে দুদেশের মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। আমাদের দেশের অন্য কোন ভাষার এই গৌরব নেই। আরেকটা বড় কথা হল আমাদের এই ভাষাটির চরিত্র মোটেই ঘরকুনো নয়। অপরের যা ভাল গুণ তাকে আত্মস্থ করাতেই তার আনন্দ। এই সত্যটা ইদানিং আমরা ভুলে গিয়েছি। কর্মসংস্থান, উচ্চশিক্ষা আর প্রতিযোগিতার বাজারে টিঁকে থাকার দোহাই দিয়ে পড়াশুনা মানেই ইংলিশ মিডিয়াম এই সরল সত্যে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছি। আমাদের ছেলেমেয়েরাও এখন বাংলাকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে শিখেছে। আদতে ভাল বাংলা বা ইংরেজি কোনটাই তারা শিখছে না। বাংলাদেশে কিন্তু এ ঘটনাটা ঘটেনি। বাংলার পাশাপাশি অন্য ভাষাতেও সাবলীল দ্বিভাষিক বাঙালির সংখ্যা এখন কমছে। এই অবস্থা বদলাতেই হবে।
আমাদের হীনমন্যতার কোন কারণ নেই। ভাষাই আমাদের শক্তি। পৃথিবীর চারজন নোবেল জয়ী মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। দুই বাংলার অসংখ্য মানুষের আত্মবলিদান পৃথিবীতে একটি বাংলাভাষী রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। ভাষা দিবসের প্রাক্কালে এই বিশ্বাস আমাদের রাখতেই হবে যে আমরাই এ অবস্থাটাকে বদলে দিতে পারি। কিন্তু তার আগে একাজটাকে একটা সবসময়ের কাজ বলে ভাবতে হবে।
জীবনে এগোনোর প্রয়োজনে আমাদের অন্য ভাষা শিখতে হবে। এটা একটা অনিবার্য ব্যাপার। তাই বলে মাতৃভাষাকে অবহেলা করলে চলবে না। তাহলে আমাদের আত্মপরিচয়টুকু লোপ পাবে। রবীন্দ্রনাথ থেকে সত্যেন বোস প্রমাণ করে দিয়েছেন বাংলা ভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞানের সবরকম চর্চাই সম্ভব। এই ভাষাতেই চমৎকার ছবি করেছেন সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল সেনেরা। এখন তো দেখছি গুগুলও কিছুদিন পরপরই স্মরণ করছে মহাশ্বেতা দেবী কিংবা অসীমা চ্যাটার্জির মত কৃতী বাঙালিদের। বাংলায় সৃষ্টিকর্মের ধারাটি এখনও সচল। আসুন, সেই ধারাটিকে আমরা আরও এগিয়ে নিয়ে যাই।
আ মরি বাংলা ভাষা।