মাদুরাই থেকে রামেশ্বরম যাওয়ার একমাত্র রেলপথ ছিল পাম্বান ব্রিজ। কিন্তু কয়েক বছর আগে সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছাসে সেই ব্রিজ নষ্ট হয়ে গেছে। তাই বর্তমানে একমাত্র ভরসা পাম্বান ব্রিজ সড়ক পথ। মাদুরাই থেকে রামানাথাপুরম প্যাসেঞ্জার ট্রেনে সোয়া দুঘন্টার জার্নি। রামানাথাপুরম থেকে সড়ক পথে রামেশ্বরম যেতে হয়। ট্রেনে ভিড় তেমন কিছু নেই। জানলার ধারের সিট অনায়াসে দখল করে গুছিয়ে বসা যায়। সকাল ছটা পঞ্চাশে ট্রেন ছাড়ে। মাদুরাই ছেড়ে বেরোনোর কিছুক্ষণ পর থেকে দুপাশের দৃশ্যপট সুন্দর হতে থাকে। নারকেল গাছের সারি, তালগাছের সারি, বড় বড় বিল, চাষের জমি চোখের আরাম দেয়।
ঘন্টা খানেকের মধ্যেই পৌঁছে যায় মানামাদুরাই জংশন। এখান থেকে একদিকের লাইন গেছে কন্যাকুমারী অভিমুখে, আর এক দিক গেছে রামেশ্বরম। বর্তমানে রামানাথাপুরম অবধি। রামানাথাপুরমে নেমে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে চললাম। এই রামানাথাপুরমেই স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো ধর্মমহাসভা থেকে দেশে পদার্পণ করার পর সর্বপ্রথম সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেই স্থানেই বর্তমান রামকৃষ্ণ মিশনটি অবস্থিত। আমাদের গন্তব্য পঞ্চান্ন কিলোমিটার দূরে রামেশ্বরম। রাস্তা মসৃণ, ট্রাফিকও কম। সোয়া ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায়। তবে সকলেই পাম্বান ব্রিজে গাড়ি থামিয়ে অনেকক্ষণ সময় কাটায়। ব্রিজের ওপর থেকে দুপাশের সমুদ্রের রূপ অসাধারণ। পাম্বান ব্রিজ ক্রস করার একটু পরেই বাঁদিকে আসবে এ পি জে আব্দুল কালাম মেমোরিয়াল। উনি এখানকার ভূমিপুত্র।
আমাদের কোন হোটেলে বুক করা না থাকায় আমরা প্রথমে ভারত সেবাশ্রম সংঘে এগারোটা নাগাদ গিয়ে মহারাজের সঙ্গে দেখা করলাম। উনি জানালেন এখন কোন রুম নেই, তবে বিকেল পাঁচটার পর রুম খালি হবে। তারপর উনি নিজে হাতে আমাদের জন্য লাল বারান্দার একপাশে একটি মাদুর পেতে দিলেন। বললেন, “আপনারা বিশ্রাম নিন, বাথরুমে স্নান সেরে নিন, তবে রান্নার লোক ছুটিতে গেছে তাই খাবার বাইরে খেতে হবে।” আমরা ওনার আতিথেয়তায় সত্যিই আপ্লুত হয়ে গেলাম। অফিস ঘরে ব্যাগ রেখে আমরা স্নান সেরে সংঘের মন্দিরে আরতি দর্শন করে রামানাথাস্বামী মন্দিরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।
ভারত সেবাশ্রম সংঘ সমুদ্র এবং রামানাথাস্বামী মন্দির থেকে দু-কিলোমিটার দূরে। অটো ভাড়া অন্ততপক্ষে একশো টাকা। সমুদ্রের কাছাকাছি ছাড়া ভাল খাবার জায়গাও নেই। অটো একদম মন্দিরের সাউথ গোপুরমের সামনে নামিয়ে দিল। আমরা মন্দিরে ঢুকে ফ্রিতে শিব দর্শন করলাম ঘন্টা খানেকের মধ্যেই। তেমন ভিড় কিছু ছিল না। মন্দির থেকে বেরিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সেরে ইষ্ট গোপুরমের দিকে গেলাম। সামনেই সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। সবুজ রঙের অল্প ঢেউ, যেন বিরাট সরোবর। আর প্রচুর মাছ ধরার নৌকো জলের ওপর স্থির হয়ে আছে।
রাস্তার ধারে অনেক গেস্ট হাউস রয়েছে। আমরা দু-তিনটি গেস্ট হাউস খোঁজাখুজি করে তেমন ঘর পেলাম না। এবার একেবারে সমুদ্রের গায়ে একটি মঠের বেশ সুন্দর গেস্ট হাউসে ঢুকে মধ্যপ্রদেশ থেকে আগত একজনের সঙ্গে আলাপ হল। আমরা ঘর পাচ্ছি না শুনে উনিই জোর করে গেস্ট হাউসের অফিসে পাঠালেন। আর অদ্ভুত ব্যাপার ঠিক তখনই একটি ঘর খালি হয়েছে জানা গেল। সেটি পরিষ্কার করার জন্য একটু সময় চাই ওনাদের। আমাদেরও লটবহর আনতে ভারত সেবাশ্রম যেতে হবে। সুতরাং কোন অসুবিধা নেই। আমরা ভেবেছিলাম যেমন তেমন কিছু একটা ঘর পাবো কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখি একেবারে জানলা দিয়ে সমুদ্র ঘরে উঁকি দিচ্ছে।
একদিকে রামানাথাস্বামী মন্দির আর একদিকে পান্না সবুজ সমুদ্র নিয়ে দেড়দিনের রামেশ্বরম বাস। এই শিবমন্দিরের পুরো নাম অরুলমিগু রামানাথাস্বামী মন্দির। এটি দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম শিবমন্দির এবং চারধামের এক ধাম। কথিত আছে যে শ্রীরামচন্দ্র সমুদ্র অতিক্রম করে লঙ্কায় যাবার আগে নিজের বিজয় প্রার্থনা করে বালি দিয়ে এখানে শিবলিঙ্গ তৈরি করে পুজো করেছিলেন এবং রামায়ণ অনুসারে লঙ্কায় জয় লাভের পর ফেরার সময়ও এখানে শিবপুজো করেছিলেন। এই মন্দিরেই শিব দর্শন করে মা সারদা বলেছিলেন, “ঠিক যেমনটি রেখে গেছিলাম তেমনটিই আছে।” মন্দির দর্শনের সময় মায়ের এই কথাটি বারেবারে মনে হতে থাকে। এই মন্দিরের করিডোরটি বিশ্বের দীর্ঘতম করিডোর।এই করিডোরের কাছেই বাইশটি কুন্ড আছে। কথিত আছে যে শ্রীরামচন্দ্রের তীরের আঘাতে এগুলি সৃষ্ট। এই কুন্ডের জল মিষ্ট।
এখানে দুটি শিবলিঙ্গ আছে। শ্রীরামচন্দ্র নির্মিত শিব হলেন রামানাথাস্বামী জ্যোতির্লিঙ্গ আর পবনপুত্র হনুমান কৈলাস থেকে যে শিবলিঙ্গ এখানে এনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার নাম বিশ্বলিঙ্গ। এই মন্দির শৈব এবং বৈষ্ণবদের আরাধ্য মন্দির। এখানে প্রতিদিন ভোরে স্ফটিক নির্মিত মণি দর্শন করা যায়। কথিত আছে এটি শেষনাগের মাথার মণি, যে শেষনাগের উপরে স্বয়ং বিষ্ণুর অবস্থান। তাই এটি বৈষ্ণবদের প্রিয় তীর্থস্থান। বৈষ্ণবদের মতে বিষ্ণু রামেশ্বরমে স্নান করে পুরীতে খাবার খেয়ে বদ্রীনাথে গিয়ে ধ্যান করেছিলেন এবং তারপর দ্বারকায় যান।
রামেশ্বরম মন্দিরের পাশে সারি সারি দোকান অগণিত তীর্থযাত্রীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। নানান পশরা সাজিয়ে দোকানগুলি মানুষের মন কেড়ে নেয়। তীর্থ থেকে কিছু স্মৃতি মানুষ নিয়ে আসার জন্য উদগ্রীব থাকেন। সুতরাং দুইয়ের মেলবন্ধন ঘটে। রামেশ্বরম থেকে গাড়ি নিয়ে অ্যাডমস ব্রিজ বা রামসেতু ও ধনুষ্কোডি যাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে ভারতের রামেশ্বরম ও শ্রীলঙ্কার মান্নার দ্বীপের মধ্যবর্তী অংশে অনেকগুলি চুনাপাথর নির্মিত শৃঙ্খল অগভীর সমুদ্রে দেখা যায়। আটচল্লিশ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুই হল রামসেতু।
রামেশ্বরম দ্বীপের একেবারে শেষপ্রান্তে বঙ্গোপসাগর ও মান্নার সাগরের মিলনস্থলে ধনুষ্কোডির অবস্থান। ১৯৬৪ সালের আগে ধনুষ্কোডি একটি জনবহুল শহর ছিল কিন্তু সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছাসে শহরটি জনশূন্য হয়ে যায়। বর্তমানে ওই স্থানে কোন নির্মাণ কাজ নিষিদ্ধ। রামেশ্বরমের ওল্ড ধনুষ্কোডি ও শ্রীলঙ্কার তালাইমান্নার পক প্রনালী দ্বারা বিচ্ছিন্ন। এর মধ্যের দূরত্ব তিরিশ কিলোমিটার। তাই খালি চোখে শ্রীলঙ্কা দেখা প্রায় অসম্ভব। লোকালয় না থাকায় প্রচুর পাখি ও ময়ূরের বিচরণভূমি এই ধনুষ্কোডি। গাড়ি গিয়ে যেখানে দাঁড় করায় সেখানে নেমে তিনদিকে শুধু সমুদ্রের গর্জন আর ঢেউয়ের ধাক্কা। দূরের দিকে তাকিয়ে মানুষ শ্রীলঙ্কা দেখার চেষ্টা করেন।
ধনুষ্কোডি দেখার পর আমাদের সারথি কার্তিক আমাদের নিয়ে চলল ওল্ড ধনুষ্কোডি। সেখানে একটি চার্চ রয়েছে যেটি প্রায় ক্ষয়প্রাপ্ত। কয়েকটি দেয়াল শুধু বালির ওপর এখন ও দাঁড়িয়ে আছে। সেখানেই বিভিন্ন পোজে ভ্রমণার্থিরা সেলফি নিচ্ছেন। ভগ্নপ্রায় পাঁচিলের ওপর ময়ূর বসে আছে নিজের মনে। এই ভাঙা গির্জা পেরিয়ে হেঁটে গেলে পড়ে ওল্ড ধনুষ্কোডি বীচ। জনমানবহীন নির্জন সৈকত। সমুদ্র এখানে প্রবলভাবে আছড়ে পড়ছে। তটভূমিতে কয়েকটি জেলেদের ঝুপড়ি আর দু একটি কাঠের নৌকো ছাড়া কেউ নেই, কিছু নেই। শুধু অনন্তের সামনে নিজেকে নিয়ে বেশ সময় কাটে। এটাই ধনুষ্কোডিতে এলে প্রাপ্তি। এছাড়াও পঞ্চমুখী হনুমানের মন্দির, বিভীষণের মন্দির দেখার তালিকায় রাখা যেতে পারে। কথিত আছে রাম এখানে বিভীষণের রাজ্যাভিষেক করেছিলেন। এখন মন্দিরের সামনে শুধু ডাবের দোকান। এক একটি ডাব ষাট টাকা। তবে সত্যিকারের প্রাপ্তি ওই ওল্ড ধনুষ্কোডি বীচ।
ধনুষ্কোডি ছেড়ে কার্তিক আমাদের নিয়ে চলল তার নিজের গ্রামে। মহান ব্যক্তিত্ব এ পি জে আব্দুল কালাম যেখানে জন্মেছেন সেখানেই কার্তিকের গ্রাম। এ গলি সে গলি পেরিয়ে কার্তিক গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমার মন ছটফট করছে কতক্ষণে সেই মহান মানুষের গ্রাম দেখতে পাবো। গ্রাম এখন ঝকঝকে। মাটির বাড়ি সব পাকা। অনেক বাড়ির সামনে বাইক, গাড়িও আছে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির বাড়িটি এখন মিউজিয়াম করা হয়েছে। রয়েছে তাঁর ব্যবহার্য সমস্ত জিনিসপত্র, অগুন্তি বই, পুরস্কার। এছাড়া তাঁর এই বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওপরতলায় রয়েছে স্যুভেনির শপ। স্যুভেনির হিসাবে সংগ্রহ করা যেতে পারে এ পি জে আব্দুল কালামের বাণী, যেগুলি ছোট ছোট কাঠের তৈরি। আব্দুল কালামের নানা ধরনের ছবি, এছাড়া মুক্তোর গহনা, ঝিনুকের নানান সামগ্রী, বিভিন্ন ধরনের শঙ্খ ইত্যাদি।
রামেশ্বরম ছেড়ে বেরিয়ে আসার পথে সারথি কার্তিক আরও দুটি মন্দির দেখালো। একটি নটরাজের অপূর্ব মন্দির, অন্যটি কাচের অপরূপ কাজ করা কৃষ্ণ মন্দির। এখান থেকে লক্ষণ মন্দির খুবই কাছে। কিন্তু আমাদের দেখা হয়নি রাত হয়ে যাওয়ায়। [ক্রমশ]