আপনি যদি বাঙালির ধৈর্য প্রদর্শন দেখতে চান তবে আপনাকে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ফুটবল টিকিটের লাইনে, উজ্জ্বলা চানাচুরের দোকানের সামনে আর কলকাতা বুকফেয়ারের সময় সরকারি মাছভাজার দোকানের লাইনে দাঁড়ালে দেখতে পারবেন। শুধু ধৈর্য্য নয়, উজ্জ্বলা চানাচুরের লাইনে দাঁড়ালে আপনি জানতে পারবেন মুদ্রাস্ফীতি কি হারে বাড়ছে এই শহরে… আজ্ঞে ঠিকই বুঝেছেন — দোকানের কাউন্টারে টাঙিয়ে রাখা মূল্য তালিকা নমুনার কথা বলতে চাইছি।
উজ্জ্বলা চানাচুরের আশে পাশে অসংখ্য সস্তাদরের চানাচুর কেন্দ্র আছে, তবু ট্যাঁকের তোয়াক্কা না করে ২৫ গ্রাম থেকে হাজার গ্রামের দামের ঘোষণা শুনে, নামকরা ডাক্তারের জাঁদরেল প্রেসক্রিপশন পকেটে করে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন অসংখ্য চানাচুর প্রেমী।
কারন, পিতৃদত্ত হজমশক্তির উপর ভরসা করে অবুঝের মতো ভাজাভুজি খেয়ে, ঝালের প্রকোপে হাঁসফাঁস করতে অনেকেই চান না। তাই তাঁরা আসেন — খেলে ঢেঁকুর ওঠেনা, অতি সহজেই হজম হয়ে যায় এমন গরম চানাচুর খেতে। এমনকি “মুচমুচে গরম চানাচুর চিবোবার সময় শুধু জিভ নয়, সমস্ত শরীরের ইন্দ্রিয়গুলি মহানন্দে এক অব্যক্ত সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা শুরু করে দেয়। ‘জগতের আনন্দ যজ্ঞে আপনাকে সসম্মানে সামনের সিটে বসিয়ে দেবার জন্য যেন উজ্জ্বলা চানাচুরের টিকিট আপনাকে দেওয়া হয়েছে।’
হাজরা থেকে রাসবিহারী মোড়ের দিকে এগিয়ে গেলে, ডান ফুটপাথে উজ্জ্বলা সিনেমা। এখনো টিমটিম করে জ্বলছে। কালীঘাট মন্দিরের রাস্তায় ঠোকার ঠিক আগে গুরুপদ হালদার সরণি ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডের মুখেই উজ্জ্বলা সিনেমাহল যেখানে এক বছরেরও বেশি চলেছিল উত্তমকুমারের ‘অমানুষ’। তবে আজও রমরমিয়ে বিক্রি হয়ে চলেছে উজ্জ্বলার চানাচুর। বিখ্যাত এই দোকানের চাকচিক্য সেরকম কিছু নেই, নেই ইন্টেরিয়র ডিজাইনের গ্ল্যামার… রয়েছে কাঁচের আলমারির ভিতর দাম আটকানো চানাচুর, বাইরে কোম্পানির একটি বড় সাইনবোর্ড আর বিকেল হতেই অসংখ্য মানুষের ভিড়।
কালীঘাটে বহু বহিরাগত দূর দূরান্ত থেকে ট্রাম, বাস, ট্যাক্সি, রিকশো এবং হাওয়া গাড়ি চড়ে এখানে এসে প্রতিদিন এই দোকানে আক্রমণ করেন। ভুলেও ভাববেননা তীর্থযাত্রীদের একমাত্র লক্ষ্য কালীঘাট কালী মন্দির। মাকালী কোনদিন চানাচুর খেতে নিষেধ করেননি। উজ্জ্বলা চানাচুরের প্যাকেট ব্যাগে পুরে কত অনাবাসী ভারতীয় যে ইউরোপ আমেরিকা, কানাডায় নিয়ে যান তাই নিয়ে আলোচনা না করাই ভালো, কারণ ঐসব দেশের এয়ারপোর্ট বেরসিক কাস্টমস অফিসারের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। তাঁদের ধারণা আছে ইন্ডিয়ার যে কোনও খাবার নিজের দেশে ঢুকলে জনস্বাস্থ্যের সর্বনাশ হয়ে যাবে।
সে যাই হোক, জেনে নিই বিখ্যাত এই চানাচুরের জন্মকথা। পিছিয়ে যাই ১৯২৮ সালের কিছু আগে। উজ্জ্বলা হলের উল্টোদিকে এক নিমগাছের তলায় হিম্মতভাই প্যাটেল নামে এক ব্যক্তি রোজ মাটির উনুন, কড়াই, হাতা, খুন্তি নিয়ে হাতে গরম চানাচুর তৈরি করেই বিক্রি করতেন। গুজরাট থেকে আসা হিম্মতভাই প্রথমে হাতেঠেলা গাড়ি নিয়ে এই দোকান খোলেন। সেই আমলে বিক্রেতার সংখ্যাও ছিলো বেশ কম। উজ্জ্বলা হলে সিনেমা দেখতে আসা মানুষজনই আসতো এই দোকানে।
সিনেমার মাঝখানে ‘বিরাম’ কালে চা, চপ, কাটলেট ছাড়াও লোকে কিনত অল্প পয়সার চিনেবাদাম ও পাপড়ি মেশানো একটু মোটা গোছের কুড়মুড়ে গরম ডালমুট। সঙ্গে লঙ্কা অথবা আমের থেঁতো করা বিটনুন মাখানো চাটনি। শুধু তাই নয়, এহেন স্বাদু চানাচুরের মোহজালে আবদ্ধ হয়ে চানাচুর নিজেরাও খেতেন এবং বাড়িতেও নিয়ে যেতেন।
সেই আমলে দোকানের নাম কিছু ছিলো না, হয়তো উজ্জ্বলা সিনেমা হলে আসা লোকজনই এই চানাচুরের নাম দেন উজ্জ্বলা চানাচুর। ক্রমশঃ পপুলার হতে থাকে এখানকার চানাচুর/পাপড়ি/ডালভাজা। ষাটের দশকের শেষের দিকে ‘উজ্জ্বলা চানাচুর’ নিমগাছের তলা থেকে উল্টোদিকের গুরুপদ হালদার সরণি ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডের মোড়ের মুখেই একফালি পাকা দোকানে স্থানান্তরিত হয়। দোকানের পিছনে একটি ছোট্ট জায়গায় ময়দা, বেসন, আটা, বাদাম, কর্নফ্লেক্স, ছোলা পাপড়ি মিশিয়ে তৈরি হয় চানাচুর। স্বাদ বাড়ানোর জন্য মশলানুন ছাড়া আর সেরকম কিছু মেশানো হয় না। খরিদ্দাররা বলে থাকেন মিক্সিংয়ের কায়দাতেই লুকিয়ে আছে এখানকার চানাচুরের প্রাণভ্রমরা।
“উজ্জ্বলা চানাচুরের কর্ণধাররা সেলস কাউন্টারে কেন হাঁড়িমুখ করে বসে থাকেন তা এক দুর্জ্ঞেয় রহস্য। এমন সাফল্যের পরেও কোথায় দুঃখ লুকিয়ে আছে কে জানে। কাউন্টারে তাদের একটিই কাজ, চানাচুর ওজন করা, মশলা মেশানো এবং দাম গুনে নেওয়া। মুখে একটিও রা নেই। পৃথিবীর সেরা জিনিস এভাবেই বোধ হয় বিক্রি হয়। ফেরিওয়ালার মতন হড়বড় করে আত্মপ্রশংসায় খরিদ্দারকে হাজার কথা বলতে নেই। আসলে উজ্জ্বলা চানাচুরের দোকান নয়, চানাচুরের বুটিক। দূর থেকে প্রতিটি খরিদ্দারের মুখের দিকে তাকিয়েই মালিক অদৃশ্য শক্তিবলে বুঝতে পারেন কোন মশলা কোন ঠোঙ্গায় কতটা দিতে হবে।”
চানাচুর হচ্ছে চর্ব। নিজের আকর্ষণ বা নামডাক/ টানাটানি কেবলই মসলার জন্য যার মধ্যে রয়েছে বিটনুন — প্রাচীন ভারতে যাকে বলতো কুরুবিন্দ বা কালানুন। আর আছে সন্ধৈব লবণ যা অস্থিমজ্জা দৃঢ় করে, খেলে গলাক্ষত রোগের আশঙ্কা থাকে না।
বৈদিক যুগ থেকেই ঋষি মুনিদের দানাশস্যের উপর ঝোঁক ছিল। বিভিন্ন উৎসবে অষ্ট দেবতাকে খুশি করার জন্য তারা অষ্টকলাই বা আট রকমের দানাশস্য উৎসর্গ করতেন। সেই থেকেই বাংলায় চানাচুরের উদ্ভাবন। এই চানাচুরই যুগে যুগে নতুন রূপ ও কলেবর ধারন করে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে ধনী গরিবের অবসরের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে, কালীঘাটে তীর্থ করতে বা প্রয়োজনে গেলে অতি অবশ্যই রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্বাদ নিতে ভুলবেন না উজ্জ্বলা চানাচুরের।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : বঙ্গীয় রসনার রসলো কাহিনী শঙ্করের ‘রসবতী’ এবং অন্যান্য।
দু:খের কথা চানাচুরের এমন উজ্জ্বল প্রশংসা ও বিষয় ওদের নজরেও আসবেই না, তাতে আসে যায়, উপভোক্তাদের জিভে জল এসে যায়, দুর্দান্ত রচনা।
খুউব খুশি হলাম এত সুন্দর একটি কমেন্ট পেয়ে। থ্যাঙ্ক ইউ ❤️
ভীষণ ভালো লাগলো অনেক কিছু জানতে পেরে। এমন আরও কিছু জানবার অপেক্ষায় রইলাম।
থ্যাঙ্ক ইউ গো