প্রত্যেকটি পাঠের রয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্য। প্রথম ভাগের প্রত্যেকটি টেক্সটে কোনো না কোনো স্বরচিহ্ন (কার) সহযোগে যুক্ত শব্দ এবং তার ব্যবহার দেখানো হয়েছে। একটি ছকের সাহায্যে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করলাম।
‘সহজ পাঠ’ (প্রথম ভাগ)
পাঠ | শুরু হয়েছে যেভাবে | শব্দ বা পদ | কী শেখানো হয়েছে(উদ্দেশ্য) |
প্রথম পাঠ | ‘বনে থাকে বাঘ’ | বনে,বাঘ,পাখি,মাছ,পাখা,মৌমাছি,মধু,ওড়ে,আলো, দীননাথ | ‘আ’ কার,’ই’ কার,’ঈ’ কার,’উ’ কার,’এ’ কার,’ও’ কার,’ঔ’ কার |
তৃতীয় পাঠ | ‘’ওই সাদা ছাতা। দাদা যায় হাটে। গায়ে লাল জামা।‘’ | সাদা, ছাতা, দাদা, হাটে, যায়, গায়ে, লাল, জামা, মামা, খাতা,হাতে, সাদা, শাল, চাল, ডাল, শাক, আটা,পাকা, আতা,জাম, চার, কাকা, কাজ, বাবা, টাকা, খাজা, গজা,থানা, আশা, ঢাকা, বাসা, ভাই, কালা,কাল ইত্যাদি | ‘আ’ কার |
চতুর্থ পাঠ | “বিনিপিসি বামি আর দিদি ওই দিকে আছে।“ | বিনিপিসি, বামি,দিদি,তিন,দিকে, ঘটি,মাটি, দিয়ে, নিজে,রাণী, দিন,কাশি, মাসি,কিনি, নীলু,তিল, তিসি,দিঘি,নীল, ঝিলিমিলি, বাড়ি, মিটিমিটি, ফিরে, ঘড়ি, দেখি, দেরি, তুমি, পিছে, পাখি, টিয়ে, হরি, বাটি, দাসী, বেড়ি, নদী,দীনু। | ‘ই’ কার
‘ঈ’ কার। |
পঞ্চম পাঠ | “চুপ করে বসে ঘুম পায়।চলো ঘুরে আসি।“ | চুপ,ঘুম, ঘুরে, ফুল, তুলে, কচুপাতা, টুপ, দুখী, বুড়ি, উনুন, উবু, আগুন, গুনগুন, গুপী, টুপি, খুলে, মুড়ি,শুয়ে, চুপিচুপি, কুল, টুনটুনি,কিছু, বুধবার, নটু, ছুটি, খুব, খুশি,নুন,মুড়ি, ঝুড়ি, ধুলো, চুনি,কুয়ো,ঘুঘু ইত্যাদি। | ‘উ’ কার। |
সপ্তম পাঠ | “শৈল এল কৈ?ঐ যে আসে ভেলা চড়ে বৈঠা বেয়ে। ওর আজ পৈতে।” | শৈল,কৈ, বৈঠা, পৈতে, কৈলাস, দৈ,ভৈষা, বৈকালে, মৈনিমাসি, বৈশাখ, নৈনিতাল, চৈবাসা, গৈলা, বৈরাগী, নৈহাটি। | ‘ঐ’ কার। |
অষ্টম পাঠ | “ভোর হল।ধোবা আসে। ঐ তো লোকা ধোবা।” | ভোর, ধোবা, লোকা, গোরাবাজারে, খোকা, মোটা, ফোলা, পোষা, বোঝা, দেখো, মোজা, আরো, খুড়ো, সুতো, মেসো, তোড়া, ডোবা,ঘোলা, ছোলা, ভালোবাসে, ঘোড়া, খোলা, কোঠাবাড়ি, জোড়া, বুড়ো, কালো, ডোরা, ফোড়া, জোরে, ঢোল, ঘোর। | ‘ও’ কার |
নবম পাঠ | ‘’এসো, এসো, গৌর এসো। ওরে কৌলু দৌড়ে যা।” | গৌর, কৌলু, দৌড়ে,চৌকি, কৌটো, মৌরি, নৌকো, গৌরীপুর, পৌষমাসে, গৌহাটি, বৌ কথা কও, পানকৌড়ি, সৌরিদিদি, মৌরলা | ‘ঔ’ কার |
দশম পাঠ | “বাঁশগাছে বাঁদর। যত ঝাঁকা দেয়, ডাল তত কাঁপে।” | বাঁশ,বাঁদর, ঝাঁকা,কাঁপে, পাঁচু, আঁচড়, চাঁপাগাছে, ঝাঁপ, ভোঁদা, খাঁদু, ছুঁড়ে, পাঁচটা, ঝাঁকায়, কাঁচা, হেঁকে, আঁধার, ফাঁকে, বাঁকা, চাঁদ, হাঁস, ঝাঁকে, শাঁক, কাঁসি, বাঁশি, কাঁদে, পেঁচা। | চন্দ্রবিন্দু |
‘সহজ পাঠ’ (দ্বিতীয় ভাগ)
‘সহজপাঠ’ ( দ্বিতীয় ভাগের) মূল উদ্দেশ্য হল শিশুদের যুক্তবর্ণ সম্পর্কে ধারণা গঠন ও যুক্তবর্ণের ব্যবহার সম্পর্কে অবহিত করানো। কোন কোন পাঠে মূলত কোন কোন যুক্ত বর্ণের ব্যবহার শেখানো হয়েছে তা কিছুটা তুলে ধরলাম।
পাঠ | শুরু হয়েছে যেভাবে | শব্দ বা পদ | কী শেখানো হয়েছে (উদ্দেশ্য) |
দ্বিতীয় পাঠ | “আজ আদ্যনাথ বাবুর কন্যার বিয়ে।“ | আদ্যনাথ, কন্যার, শল্যপুরের,শ্যামা, বৈদ্যনাথ, অহল্যাপাড়ায়, সৌম্য,ব্যবসা, ধৌম্যনাথ, রম্যনাথ,ধ্যান, পুণ্য,জন্য, ধন্য,ভৃত্য, সত্য,অবশ্য, বাদ্য, শস্য,সাধ্য, অগত্যা,নৃত্য,ব্যাটবল,নিত্যশরণ, ক্যাপটেন।
|
য ফলা |
তৃতীয় পাঠ | ‘আজ মঙ্গলবার।“ | মঙ্গলবার, জঙ্গল, দঙ্গল, রঙ্গলাল, বঙ্গ বাবু, সিঙ্গি, অনঙ্গদাদা, সঙ্গে, ডিঙ্গি, পঙ্গপাল, সাঙ্গ, ভঙ্গ, ইঙ্গিতে।
|
ঙ+গ=ঙ্গ |
চতুর্থ পাঠ | “চন্দননগর থেকে আনন্দবাবু আসবেন।“ | চন্দননগর, আনন্দবাবু, নিন্দা, ইন্দুকে, সুন্দর, কুন্দফুল, আকন্দ, বন্ধ, সন্ধ্যা, গন্ধ, দীনবন্ধু, সিন্ধুবাবু, বিন্দুকে, মালাচন্দন,
বন্দেমাতরম, নন্দী, অন্ধ, মন্দ।
|
ন+দ=ন্দ
ন+ধ=ন্ধ |
পঞ্চম পাঠ | “বর্ষা নেমেছে।গর্মি আর নেই।” | বর্ষা, গর্মি, গর্জন, পর্বতে, কর্ণফুলি, সর্ষেখেত, দুর্গানাথের, দর্মার, দুর্গতি, কাজকর্ম, সর্দি, কর্তাবাবু, বর্ষাতি, আর্দালি, তুর্কি, গর্ত, নর্দমাগুলো।
|
রেফ্ এর ব্যবহার। |
ষষ্ঠ পাঠ | “উস্রি নদীর ঝরনা দেখতে যাব।” | উস্রি, বিশ্রী, বজ্রের, শ্রাবণ, স্রোত, যাত্রা, মাত্র, ছাত্রেরা, ত্রিবেণী, আত্রাই, মিত্র, শ্রান্ত, মিশ্রদের, আশ্রয়, শীঘ্র, আগ্রহ।
|
‘র’-ফলার ব্যবহার। |
সপ্তম পাঠ | “শ্রীশকে বোলো, তার শরীর যদি সুস্থ থাকে…” | খাস্তা, পেস্তা, আস্ত, রাস্তা, বস্তা, সস্তা, ব্যস্ত, আস্তে।
|
স+ত=স্ত |
এর পরের পাঠগুলো মোটামুটি অন্যান্য যুক্তবর্ণগুলি মিলিয়ে মিশিয়ে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রত্যেকটা পাঠই যুক্তবর্ণ গুলিকে মাথায় রেখে নির্মাণ করা হয়েছে সন্দেহ নেই।এবার আমরা আসব ‘সহজপাঠ’ প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাগের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য, যার জন্য আপামর বাঙালির কাছে ‘সহজপাঠ’ নস্টালজিয়া।
‘সহজপাঠ’ প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাগের টেক্সট্ গুলি বেশিরভাগই ছোটো ছোটো কাহিনীর গ্রাফিক্স চিত্র। অনেকটা গল্প বলার ধাঁচে রবীন্দ্রনাথ পাঠগুলি নির্মাণ করেছিলেন। তবে রবীন্দ্রনাথের মূল উদ্দেশ্য ছিল গল্প বলা ও একই সঙ্গে বহুবিধ উদ্দেশ্য সাধন করা। শিশুর স্বভাবতই গল্প শুনতে ভালোবাসে। তাই তাদের মনের মত করে রবীন্দ্রনাথ গল্পগুলি নির্মাণ করেছেন এবং আশেপাশের সমস্ত চেনা ছবিগুলোই এই বইতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
সহজ পাঠের বৈশিষ্ট্যসমূহঃ
শব্দ ভান্ডারের উন্নতিঃ
আমাদের যাবতীয় অভিজ্ঞতার একটা বোধাত্মক প্রতিমূর্তি হল শব্দভাণ্ডার বা Vocabular। শিশুরা নানান নতুন শব্দ শুধু চারপাশ থেকে শেখেই না, সেগুলি নিবিড় অনুভূতি হয়ে তাদের অন্তরের মূল সঞ্চিত থাকে। কোনো একটা শব্দ যখন শিশুরা শেখে, তার অনুসঙ্গে আর কোন কোন শব্দ তাদের মনে আসছে সেটাও ভাবতে শেখানো জরুরী। যেমন- ‘মেলা’ নামটির সঙ্গে যখন শিশুদের পরিচিতি ঘটানো হবে তার সঙ্গে সম্পর্কিত আর কোন কোন শব্দ তাদের মনে আসে সেগুলোর সাথেও তাদের পরিচয় ঘটাতে হবে। তবেই শিশুর শব্দ ভান্ডার বৃদ্ধি পাবে। একে বলে ‘Mind Maping Game’ বা মানস মানচিত্রের খেলা। যেমন—
এভাবে সে প্রচুর শব্দ শেখে। ‘সহজ পাঠ’ এর একটা উদ্দেশ্য শিশুদের শব্দ ভান্ডারের নতুন নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচয় ঘটানো। তাদের সামনে শব্দ ভান্ডারের একটা বিশাল জগৎ খুলে যাবে। অনেক নতুন নতুন শব্দের সাথে তাদের পরিচয় ঘটবে। যেমন —
“রাম বনে ফুল পাড়ে। গায়ে তার লাল শাল।”
প্রথম ভাগের দ্বিতীয় পাঠে ফুল শব্দটির সঙ্গে যেমন তাদের পরিচয় ঘটবে, তার পাশাপাশি জবা,বেল ফুল সম্পর্ক তাদের ধারণা জন্মাবে। তাদের রংটাও তারা জানবে। ফুল কী কাজে লাগে সেটা যেমন জানবে, ঠিক তেমনি পূজার সঙ্গে ঢাক,ঢোল, ধুপ,ধূনা এগুলোর একটা সম্পর্ক তারা তৈরি করে নেবে। এখানেই সেলফ্ লার্নিং এর একটা ভিত্তি তৈরি হবে।
তেমনি ষষ্ঠ পাঠের কবিতাটির দিকে আমরা তাকাই —
“এসেছে শরৎ,হিমের পরশ
লেগেছে হওয়ার ‘পরে,
সকালবেলায় ঘাসের আগায়
শিশিরের রেখা ধরে।”
এই পাঠের মূল বিষয় শরৎ। এই কবিতাটির পাঠের সঙ্গে সঙ্গে তাদের শরৎ ঋতুর সাথে একটা পরিচয় ঘটবে।কী কী বিষয়ে তাদের ধারণা জন্মাবে তা মানস মানচিত্রের সাহায্যে দেখানো হল—
এসব পাঠ যখন তারা পড়বে,তাদের কল্পনাশক্তির বিকাশ যেমন হবে তেমনি বৃদ্ধি পাবে শব্দভান্ডার। তাই গল্প পাঠের মূল উদ্দেশ্য শিশুদের শুধুমাত্র আনন্দ দেওয়ায় নয়, শব্দভান্ডারের উন্নতি ঘটানো। ‘সহজ পাঠ’ সেই দিকের বিকাশ ঘটাতে একশ শতাংশ সাহায্য করেছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। (ক্রমশ)