ভেলা গোয়া বা পুরনো গোয়াতে সেদিন রবিবারের অলস মেজাজ। আধডোবা জলে মোষেদের গা ভিজিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা যেমন নিশ্চিন্ত অবসর! শৌখিন মেছুড়ের ফাতনায় চোখ রেখে বেলা পড়ে যাবার মতন সেখানে ঢিলেঢালা দিনচর্যা।
একমাত্র চার্চ অফ সেন্ট ফ্রান্সিস বা ব্যাসিলিকা অফ্ বম যীশাসের খ্যাতিতে ট্যুরিস্টের উপচে পড়া ভীড়। ছুটির দিনে এখনো সেখানে লম্বা লাইন।
একটা সময় গৌরবের মহিমায় গোয়ার পুরনো রাজধানী ছিল ‘প্রাচ্যের রোম’। বিজাপুরের সুলতান আদিল শাহকে ১৫১০ সালে হারিয়ে পাহাড় আর সমুদ্র ঘেরা সুন্দরী গোয়াকে অধিকার করে নিল পোর্তুগীজরা। মান্ডবী নদীর দক্ষিণ প্রান্তে তিসওয়াদি তালুকে বণিকের মানদন্ড রাজদন্ডরূপে প্রতিষ্ঠিত হল।
পুরনো রাজধানী বা ভেলা গোয়ার অলিগলিতে রয়ে গেছে সেই প্রাচীনত্বের অহংকার। ক্ষয়িষ্ণু ইঁটে তার নীরব দীর্ঘশ্বাস।
সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চের বড় রাস্তা ছেড়ে আর একটু ভেতরে পাহাড়ের ওপর আকাশ ছুঁতে চাওয়া ভাঙাচোরা সেন্ট অগাস্টিন টাওয়ার দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশের ধ্বংসস্তূপে কোথাও ছিল চ্যাপেল, সন্ন্যাসিনীদের কনভেন্ট, পড়ুয়াদের লাইব্রেরী, মিশনারী সাধুসন্তদের সিমেট্রি। ভাঙা পাথরের সেই নিরালা নির্জনে আড়াল খোঁজে প্রেমিক জুটি। সেখানকার কবরে শুয়ে আছেন ভুলে যাওয়া কত মানুষ। তাঁদের স্মরণে আজ আর জ্বলেনা কোনো মোমবাতি ।
আর্চ অফ টাওয়ারের মাথায়, ধূপছায়ায় বসে আছেন সেই দুঃসাহসী মানুষটি। যাঁর নাম ভাস্কো ডা গামা। তাঁর হাতে খাপ খোলা তলোয়ার। তাঁকে পেরিয়ে মান্ডবী নদীর ফেরী। ওপারে দীওয়ার দ্বীপ। কোনোকালের সুন্দর নাম দ্বীপাবতী সে খুইয়ে ফেলেছে। হাজার বছর আগে দ্বীপাবতীর সপ্তকোটি তীর্থের পুকুরে স্নান করে গৃহদেবতার মন্দিরে পুজো দিত কদম্বরাজ পরিবারের রাজবধূ, রাজবালা। তাদের ভেজা পায়ের চরণচিহ্ন মুছে গেছে কবেই। মন্দির ভেঙেছে বিদেশী, বিধর্মীদের হাতে। ঘুঘু ডাকা দুপুরে সেখানে মনকেমনের ছবি। পাকা ধান কেটে নেওয়া হেমন্তের শূন্য ক্ষেতে এখন পাখিদের খুঁটে খাওয়া।
নদী পাড়ের কাদাজলে মাছ খোঁজে আরো দু’ পেয়ের দল। কাদাখোঁচা, ডাহুক, সিন্ধুসারস, বক। আকাশে সোনালী ডানার শঙ্খচিলের শ্যেন দৃষ্টি জমিতে। দ্বীপের চারধারকে সস্নেহে তার শেকড় দিয়ে আগলে রেখেছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য।
সেন্ট ম্যথায়িস গীর্জাঘরে রবিবারের প্রার্থনায় আসে গোমেজ, ফার্নান্ডেজ, রডরিগস দম্পতিরা। সাপ্তাহিক এই গেটটুগেদারের জন্যে উন্মুখ থাকে প্রৌঢ়, বৃদ্ধ মানুষগুলো। লিপস্টিক রাঙানো হাসিতে, নিভাঁজ শার্টপ্যান্টে তাঁদের সাবাথ ডে যাপন।
সপ্তাহের বাকি দিনগুলোয় সাজানো গোছানো, বাগানঘেরা বাংলোয় নিঃসঙ্গতার ছায়া। সামনে বড় দিনের পদধ্বনি। ছেলেমেয়ে, নাতিপুতি শেষ পর্যন্ত সেখানে এসে পৌঁছবে তো? নাহলে যে সব উৎসব বড় বিবর্ণ, নিরানন্দ।
গোমসের তালাবন্ধ ভিলা পড়ে আছে বিবাদিত সম্পত্তির তকমা এঁটে। জঙ্গল ঘিরেছে অ্যান্টনির কাসায়। বেঞ্জামিনের পরিত্যক্ত ভুতুড়ে বাড়ির ত্রিসীমানায় কেউ যায় না।
দ্বীপাবতীর হিন্দু তীর্থস্থান সপ্তকোটেশ্বর একদিন বিজাপুরের সুলতানের রোষে ভেঙে তছনছ হল। তাদের সে দম্ভ চূর্ণ হয়েছিল পোর্তুগীজদের বিজয় অভিযানে। কাসা, চ্যাপেল, দুর্গ, পানশালা, চার্চ, বেকারী, কবরখানা, অফিস-কাছারীতে সেজে উঠল মান্ডবীর পশ্চিমতীরে গোয়ার রাজধানী। সে রাজধানীও একদিন প্লেগ আর কলেরার মহামারীতে পরিত্যক্ত হয়ে গুরুত্ব হারাল। ভেলা গোয়া পড়ে রইল স্মারক হয়ে। গোয়ার নতুন রাজধানী পানাজীতে ভীড় করল কেজো-অকেজো সব মানুষ। মান্ডবীর বুকে ভাসমান এই দীওয়ার দ্বীপের মত অনিশ্চিত হয়ে গেল ভেলা গোয়ার ভবিষ্যৎ।