বাঙালি বাড়িতে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত সব ঋতুতেই ভাতের প্রথম পাতে শাক ভাজা বা চচ্চড়ি খাওয়ার একটা রীতি প্রচলিত আছে। এমনকি অনুষ্ঠান বাড়িতেও প্রথম পাতে নুন, লেবু, লঙ্কা আর অল্প করে শাক ভাজা দেওয়া হয়। আসলে শাক সহজেই হজম হয় ও শরীরের নানা ব্যাধিতে ওষুধের কাজ করে বলে এই পদের প্রচলন। তাইতো প্রাচীনকাল থেকে মুনি-ঋষিরা শাকাহারের কথা বলতেন। শীতকালে যেমন পালং শাক শ্রেষ্ঠ তেমনি গরম কালে ও বর্ষাকালে বাজারে প্রচুর নটে শাক পাওয়া যায়। দামে সস্তা নটে শাকের কচি পাতা সপ্তাহে তিন চার দিন ভাতের সঙ্গে ভাজা, চচ্চড়ি বা সেদ্ধ খেলে অনেক রোগের হাত থেকেই নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।
বাজারের সাধারণত দুই ধরনের নটে শাক পাওয়া যায়–সবুজ নটে আর রাঙা নটে। আর একটি ধরন হলো কাঁটা নটে। সাধারণত সব শাকেই অ্যালকালি (ক্ষারক) বা ক্ষার পদার্থ বেশি থাকে, নটে শাকেও আছে প্রচুর পরিমাণে ক্ষার। শরীরে নানান বিষক্রিয়া নাশ করতে নটে শাক অব্যর্থ ওষুধের কাজ করে, তাই জন্য একে বলা হয় ‘বিষঘ্ন।’নটে শাকের পাতা ও শেকড় নানা রোগে ওষুধ হিসেবেও পাওয়া যায়। সবুজ নটের থেকে লাল নটে বেশি উপকারী।
নটে শাকে রয়েছে-প্রোটিন, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি৬, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-কে, থায়ামিন, রিভাফ্লাভিন, নিয়াসিন, Pantothenic acid, খনিজ উপাদানের মধ্যে রয়েছে: ক্যালসিয়াম, আইরন, ম্যানেসিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, জিঙ্ক, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, সেলেনিয়াম।
রোগ সারাতে নটে শাক :
১) ত্বকের সব অসুখ এমনকি কুষ্ঠ রোগ ও চর্মরোগেও নটে শাক খেলে উপকার হয়।
২) যন্ত্রণাদায়ক প্রমেহ, যৌন ব্যাধি, প্রস্রাবের অসুখ, শরীরে ফুলে ওঠা ব্যথা ইত্যাদির উপশম হয়।
৩) যারা মা হতে চলেছেন বা সদ্য মা হয়েছেন নটে শাক খেলে তারা বিশেষ উপকৃত হন। কেননা নটে শাক স্তন্যদুগ্ধবর্ধক।
৪) চোখ জ্বালা করা, চোখ লাল হওয়া, পিচুটি জামা, চোখের পাতা জুড়ে যাওয়া, প্রভৃতি অসুখ ও অস্বস্তি দূর করতে নিয়মিত নটে শাক খেলে উপকার পাওয়া যায়।
৫) প্রচুর পরিমাণ ফাইবার থাকায় রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে নটে শাক।
৬) নটে শাকের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স খুব কম তাই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এই শাক খুবই কার্যকরী। একই সঙ্গে এটি খিদে নিয়ন্ত্রণও সাহায্য করে।
৭) কাঁটা নটে বা বুনো নটে অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতায় ওষুধের কাজ করে। গ্রামাঞ্চলে ঝোপে জঙ্গলে এই শাক প্রচুর পরিমাণে জন্মায়। গ্রামবাসীরা এই শাক ভাজা বা উচ্ছে দিয়ে চচ্চড়ি রান্না করে খেয়ে রক্তাল্পতা থেকে নিষ্কৃতি পান।
৮) আয়ুর্বেদ শাস্ত্র থেকে জানা যায় ওষুধ হিসেবে নটে শাকের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। কোষ্ঠকাঠিন্য, লিভারের দোষ, পিলে বেড়ে যাওয়া, পেটের নানাবিধ অসুখ, মুখ থেকে রক্ত পড়া (রক্ত পিত্ত), পুরনো জ্বর ইত্যাদিতে নটে শাক খুব কাজ দেয়।
৯) সুশ্রুতের মতে নটে শাক অত্যন্ত শীতল, এর রস পরিপাক মধুর, রক্তপিত্ত মদ বিষের দোষ নাশ করে।
১০) নটে শাকের রস গরুর দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে পোকামাকড়ের কামড়, বিছের কামড়, ইঁদুরের কামড়ের বিষ নেমে যায়।
১১) রক্তনালীর গঠন পেশির গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে নটে শাকের। এই শাকের মধ্যে উপস্থিত অ্যামারান্থ গ্যালিক অ্যাসিড এবং ভ্যানিলিক অ্যাসিড বার্ধক্য থেকে হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ রাখতে সাহায্য করে।
১২) এতে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। এতে উপস্থিত অ্যামাইনো এসিড, পটাশিয়াম শরীরের টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে–ফলে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ে।
১৩) আগুনে পোড়া বা ব্রণতে নটে শাকের রস লাগালে ঘা বা ব্রণ সেরে যায়।
এত উপকারী শাক, কিন্তু কি করে খাওয়া যায়? কিছু নতুন রেসিপি বলি এই শাকের।
শুধু আমাদের রাজ্যেই নয়, ভিনরাজ্যেও নটে শাক খাওয়ার রেওয়াজ চালু আছে। হিন্দিতে নটে শাককে ‘চৌলাই’ শাক বলে।
গুজরাতিরা নটে শাক ভাজায় বেসন টক দই হিং ইত্যাদি মিশে ‘কড়হি’ বা টক ঝোল ঝোল তরকারি রান্না করে। এটি গরম ভাতের সঙ্গে খেতে সুস্বাদু। এই ব্যঞ্জন শরীরের পক্ষেও যেমন উপকারী, খেলেও মুখের রুচি ফেরে ।
নটে শাক অল্প তেলে নেড়েচেড়ে নিয়ে জল ও আন্দাজ মত নুন মিশিয়ে সেদ্ধ করে নিন। নামাবার আগে কচি কাঁচা আমের কুচি একটু মিশিয়ে দিন। নতুন এই স্বাদের পদটি আশাকরি খেতে ভালোই লাগবে।
এছাড়া কালো জিরে, রসুন ফোরন দিয়ে ভাজা খেতে পারেন। অনেকেই চচ্চড়ি করে খান কিংবা উচ্ছের সাথেও ভাজা করেও খান।
সুস্থ বা অসুস্থ সকলেই নটে শাক খেতে পারেন। কারণ এই শাক খেলে কোন অপকার হয় না।
ছোটবেলায় মাকে দেখেছি সবজি কাটতে কাটতে কিম্বা শাক পাতা কাটার সময় নানান ধরনের গল্প আমাদের শোনাতো। আর সবজি কাটা শেষ হয়ে গেলেই বলতো ‘আমার গল্প শেষ হলো আর নটে গাছটি মুড়ালো’। আজকের প্রতিবেদনে আমারও নটে গাছটি মুড়ানোর সময় হয়ে এসেছে। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।