“শালফুল এল/ করম এল/ আমাদের করম এল রে/ বীজ বুনেছি সারাদিন/ সন্ধ্যাবেলায় গান/ বীজ বুনব চিরদিন/ সন্ধ্যাবেলায় গান/ বীজ আমাদের ছায়া দেয় সন্তানের মতো/ বীজ আমাদের শত শত।”
নাগরিক কোলাহল থেকে বহুদূরে পুরুলিয়ার প্রকৃতির কোলে বসে প্রতিদিন তিনি লিখেছিলেন জীবনের কথা। সরষে ফুলে আধার ঘুচিয়ে দেবেন তিনি, ফুলে ফুলে ভরে দেবেন, ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবেন জীবন। ধানই তো মা, ধানই কন্যা, ধানের ভিতর কী যে থাকে, কী যে মায়া — দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়। ভাত আর ভালোবাসা দুই-ই সমান এই কবির কাছে। রুখা-শুখার দিনে তাঁরও চোখের জল শেষ হয়ে যায়। অন্ধকারের ভিতর চাঁদ থাকে তাঁর কাছে, বনে-বাদাড়ে গাছের মাথায় জোনাক উড়তে থাকে — তার আলোয় আঁধার সরে যায়। একের পর এক কাব্যগ্রন্থে ধরা পড়ে চলমান বেঁচে-থাকার মুহূর্ত। ‘পৃথিবী গ্রহের পুরুলিয়া’য় বসে সাদা পাতায় ফুটিয়ে তোলেন — অস্ত্রের নীরবতা, পুরনো এ জীবন আমাদের নয়, সীতা, মৃত্যুঞ্জয়, বিবাহ-মঙ্গল, ধান ও জলের ধ্বনি, আমার চোখের জল হয়ে যায়, খোলামকুচি, আরেক ভুবন, ক্ষুধাহরণের খেলা, পুরানো আখরগুলি, তমোঘ্ন, মাঝপথে নেমে রান্নাবান্না, নদীপাড়ের প্রভাতবেলা, পাতারা কাঁপে, সবুজ থেকে হলুদ, মলিন মর্ম মুছায়ে, তালপাতার পাখা, গরমথান, হেই বাবা মারাংবুরু, বি.পি.এল-এর কবিতা, শূন্যতা আমার মুকুট,হেঁতালের লাঠি।
“এক-একটা বাদল দিনে যেমন বৃষ্টি আর নদীকে আলাদা করে চেনা যায় না, নির্মল হালদারের জীবন আর কবিতা তেমনই মিলেমিশে গিয়েছে কবে। কবিতা রচনা আর বন্ধুত্ব অবলম্বনে অমল ফকিরের মতো তাঁর বেঁচে থাকা। গত শতকের সাতের দশকের অন্যতম শক্তিশালী কবি তিনি। রুক্ষ লাল মাটির বুকে যেমন প্রাণের জোরে উদ্ভাসিত হয় পলাশ, বঞ্চিত-প্রান্তিক-ক্ষুধার্ত আদিবাসীর মনে খেলা এনে দেয় মহুয়া-হাঁড়িয়া, তেমনই নিজস্ব জীবনে এই কবি ভালবাসার শক্তিতে কবিতায়-কবিতায় ধারণ করে থাকেন অবহেলিত এক জনপদের অন্তর। নির্মল হালদারের কবিতা বলতেই পাঠকের মনে আসে পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার কথা। ক্ষয়িষ্ণু পাহাড়, অজস্র টিলা, অবহেলিত আদিবাসী, কষ্টসহিষ্ণু চাষি ইতিহাস-চিহ্ন, গভীরে শিকড়-নামানো লোকজ সংস্কৃতি আর জঙ্গল-ঝরনা-একচিলতে নদীর আবহে জেগে ওঠে তাঁর কবিহৃদয়। কখনও তীব্র, কখনও বিষণ্ণ, কখনও কান্নামাখা, কখনও মেজাজি অন্তগামী কবিতাগুলি যেন প্রান্তিকের একান্ত স্বর, অবহেলিতের দিনলিপি — যার আড়ালে বেজে চলে এক পাগল প্রেমিকের নাছোড় বাঁশি। নগরলালিত কবিতার ব্যক্তিগত বাহানা বিপরীতে এই সব কবিতায় আছে দুঃখী পৃথিবীর মস্ত আকাশ।”
প্রিয় কবি নির্মল হালদারের ‘কবিতা সংগ্রহ ২’ গ্রন্থের ব্লার্বে লেখা এই বাক্যগুলি কবি নির্মল হালদার জীবন এবং তাঁর কবিতার জগতকে খুব সহজেই চিনিয়ে দেয়। তাঁর কবিতা পাতায় জীবনের ছবি — চলমান মানুষের দিনযাপনের চালচিত্র যেন তাঁর কবিতা। যিনি নিজেই বলেন — “কবিতা লিখি। অথবা নিজেকে লিখি। এ বাদে আমার কোনও কাজ নেই। মৌমাছিরা এই ফুল থেকে ওই ফুলে, প্রজাপতিও এক গাছ থেকে আরেক গাছে, ওদের আল্লাদ ছুঁতে পারি না। কবিতাও ছুঁতে পারিনা, তবু কবিতার দিকে চেয়ে থাকি।…. মানুষের দিকে চেয়ে থাকি। কাঁসাই-কুমারী-হনুমাতা নদীও আমাকে ঋণী করে। ছো-ঝুমুর-টুসু-ভাদু-করমে আমায় ঋদ্ধ করে। আমার কবিতা। আমার অন্নজল প্রাণ।”
তাই বোধহয় কবি নির্মল হালদার ধান ও জলের ধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন। উপলব্ধি করেছিলেন ‘মহাপ্রলয় পরেও ধান ও জলের ধ্বনি আমদের আশ্রয়।’ সমস্ত সরলরেখা হয়ে আনন্দরেখা হয়ে তাকে আনন্দ দেয়। কোনও রেখাই কোনদিনও দরিদ্র নয়, কোনও কোনও লোককে দরিদ্র করেছি বলে দারিদ্ররেখা শুধু তাঁর কথা। ‘অন্নকথা’য় কবি লিখেছিলেন—
“যদি কথা ওঠে/ সব কথা চলে যাক ক্ষুধার দিকে/ যদি কথা ওঠে সব কথা চলে যাক খাদ্যের দিকে/খিদে ও খাদ্য ছাড়া গড়ে ওঠে না কোনও জনপদ।”
তাঁর সমস্ত কবিতা আমার কাছে জীবনের মহাকাব্য। জীবন কত সুন্দর! আলো হাওয়া নদী পাহাড় তাকে জড়িয়ে ধরে সবসময়, রুক্ষ বাস্তবের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে সেই প্রকৃতিই তাকে আলিঙ্গন করে, শুশ্রূষা দেয়, বাঁচতে প্রাণিত করে।কোলে-কাঁখে কাঁদছে ছেলে, গাছ থেকে পড়ে যায় ডিম,মরা ফড়িং নিয়ে পিঁপড়েদের টানাটানি — দৃষ্টি এড়ায় না তাঁর। ফড়িঙের সঙ্গে বন্ধুতা করবেন বলে সারাদিন ফড়িঙের পেছনে ছোটেন, ফড়িঙের পিছনে ছুটে ছুটে বেলা বয়ে যায়, ফড়িঙের পিছনে ছুটে ছুটে পথ চেনা হয়ে যায়, সারা পথেই ফড়িঙের ওড়াউড়ি, সারা পথই ফড়িঙ হয়ে ওড়ে। কত সহজ চলনে কত গভীর কথা। আবার ‘শ্রম’ কবিতায় লেখেন —
“কাগজে-কলমে আমি কতটুকু শ্রমিক
মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে চষে ফেলেছে মাটি
ফসলের ক্ষেতে কেঁচোরাই যথার্থ শ্রমিক।”
অন্য একটি কবিতায় লিখেছিলেন—
“পাতাল থেকে মাটি নিয়ে এল/ কেঁচো রাজা/ মাটিতে মাটিতে ভরে উঠলো সোনার থালা/ মাটিতে মাটিতে তৈরি হলো পৃথিবীরলোক।/ জয় কেঁচো রাজার জয়।/ জয় জয়…/ঈশ্বর তাকে অর্ধেক রাজত্ব দিল রাজকন্যা দিল/ কেঁদ-পিয়াল-বট-অশথ কুশ-কাশের জন্ম হল/ দুব্বাঘাসেরও জন্ম হল/ আমারও জন্ম হলো ভিটেমাটি হলো।”
রাস্তা ঝাঁট দেয় যে ময়নামতী,সে ধুলোবালি চেনে, পায়ের ছাপ চেনে, পায়ের ছাপ বুকে রেখে রাস্তা ঝাঁট দিয়ে যায় সে। অনেক দূরের রাস্তা অনেক কাছের রাস্তা ময়নামতী কোলে তুলে নেয়। তিনি জানেন বেঁচে থাকতে হলে একটা কিছু বেছে নিতে হয়, তাই তিনি বেছে নিয়েছেন নরককে। নরকেই আছে অপমান অবজ্ঞা ও হতাশা এবং ভয় পেতে পেতে তিনি আঁকড়ে ধরেন মানুষকেই, কারণ স্বর্গে কোনও মানুষ থাকে না। সভ্যতা আজ নিজেই ছিন্নমস্তা হয়েছে,পান করছে নিজের রক্ত নিজের আহ্লাদ। সেইসঙ্গে নাচছে চ্যালা চামুণ্ডা, নাচছে রাজা-প্রজা, ছিঁড়ে কামড়ে খাচ্ছে প্রকৃতি, এই মানব প্রকৃতি। ছিঁড়ে কামড়ে খাবে আরো নক্ষত্রমণ্ডলী। সভ্যতা কী দেখাবে কী দেবে আর কবি লেখেন — “আমার রক্ত হয়েছে গোধূলি শিশুর রক্তে ভোর।”
কবি নির্মল হালদারের কবিতা আমার কাছে এক আলোকিত ভোর, সকালের ফুরফুরে বাতাস, ভালোবাসার উষ্ণতা। তাঁর কবিতা আমাকে চিনিয়ে দেয় পথ। তাঁর কবিতা আমাকে চিনিয়ে দেয় ফসল মাঠ, মানুষ। তাঁর মতো বলতে ইচ্ছে করে — “যে বৃক্ষে বসেছে পাখি/ তাকে রক্ষা করো/ জলে থাকে মাছ জলকে রক্ষা করো/ হে প্রেম, আমার অন্ধকার ঘুচাও।”তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে আমিও পথিক হয়ে যাই, সামনে আকাশ রেখে শুধুই হেঁটে যাওয়া। সেই পথে সারাদিন সারারাত পিদিম জ্বলে, সেই পথে দেবদূতী পথিককে রঙ মাখায়।
পথ হাঁটতে হাঁটতে শহর কোলকাতায় পৌঁছে যান কবি। মিষ্টির দোকানে গিয়ে এক গেলাস জল চান,মুখ উঁচু করে জল খেতে গিয়ে দেখেন কোলকাতার ঘোলাটে আকাশ — ‘আমার চোখের জল লোহা হয়ে যায়’। শহর কলকাতায় এসে মনে হয় “এখানে পাতা মলিন হয়ে যায়, এখানে আকাশ অস্পষ্ট, মানুষও ভিতরে ভিতরে কালো হয়ে যায়, দুচোখ ভরে ওঠে জলে, মনে হয় এখানে এক ফোঁটা জল ফেললে কালো হয়ে লোহা হয়ে যাবে।”ঝুপড়ির শিশুর কান্না বহুতল বাড়িতে ধাক্কা খেয়ে ছড়িয়ে যায় চারিদিকে, ছড়ানো কান্নাগুলি কবি কুড়িয়ে নেন নি, তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেছেন। বস্তির ঘরে ঘরে কত বড়ো প্রাণ,সেই প্রাণস্পন্দন তাঁর বুকে লেগে থাকে। যে শিকড় তাঁর শিরা হয়ে তাঁকে মানুষের দিকে প্রবাহিত করেছিল, কংক্রিটের শহরে সেই শিরা শুকিয়ে যায়।মেস বাড়ির বারান্দায় বসে লিখে চলেন —
“যে মেয়েটির দুধের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে
তার তো এখন চুল বাঁধার সময়
বিকেলের আলো ম্লান হয়ে এলে মেয়েদের কপালের টিপ
আলো হয়ে দাঁড়ায়
খোকনের মনে পড়ে ছোটবেলার কথা
বাগালকাকা ঘরে ঢুকেই হাঁক পাড়ত; খোকন…
সে-ও ছুটে যেত গোয়ালঘরে
বাছুরের কান ধরে দাঁড়াত দুধ দুইত পাগাল কাকা
দুধে ভরে উঠত বালতি, ফেনা উঠছে পড়ত
খোকনের ইচ্ছে করত, দুধের ফেনার নিয়ে
খেলা করতে
খোকন বিষণ্ণ হয়ে যায়
মেসবাড়ির বারান্দায় আলো পড়ে।”
আর তাই বোধ হয় কবি ছটফট করেন সেই মুখগুলো দেখবার জন্য, যে মুখ ‘দেশগাঁয়ের মুখ’, যারা সেই মেসেই থাকে।
কবি নির্মল হালদারের কবিতা আমার কাছে শালগাছের ছায়া, মহুল গাছের বন — যার নিচে বসে গত জন্মের গল্প শোনা যায়। তার কবিতা আমার কাছে ‘তুপুন নদী’, শান্তির নদী, যে নদী বয়ে গেছে দেশে দেশে, যে নদীর জলে চাঁদের ছায়া সূর্যের কিরণ। এই নদীর জলে মেঘ নেমে যায়। আমিও মারাংবুরুর নামে ডুব দিই… ‘শান্তি শান্তি শান্তি’। যাবতীয় হিংসা পার হয়ে হাতে হাত ধরে নাচতে ইচ্ছে করে আবার মাদলের তালে। মারাংবুরুকে বলি —
“এই বাবা মারাংবুরু/
আমাকে একটি পুত্র আরেকটি কন্যা এনে দাও/
কন্যাও যে ঘরের শোভা /
আমাকে কন্যা এনে দাও। /
শালুক ফুটলে যেমন জলের শোভা/
তারা ফুটলে যেমন আকাশের শোভা /
কন্যাও যে মাথার শোভা /
হেই বাবা মারাংবুরু, আমাকে আলোর উৎস এনে দাও।”
গাছ পাহাড় নদী শস্যক্ষেত অরণ্য জল মাটি ফুল পাখি ভালবাসতে ইচ্ছে করে আমারও। জানি একটা গাছ লাগালে ঈশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে আমার মাটির সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে আমার। লাঙ্গল ফেলে অন্য কাজে জড়িয়ে পড়েছি বলেই আমাদের কষ্ট বাড়ে রোজ, রোদের সময় রোদ নেই জলের সময় জল নেই, আমাদের লব-কুশ ধান নেই। আমরা মারাংবুরুর গা থেকে কেটে নিচ্ছি গাছপালা, মারাংবুরুর হাসি-কান্নার ঝরনাও বেঁধে ফেলেছি, আমাদের দেবতা মারাংবুরুর অভিশাপ লাগবে জানি, ‘আকাশে উঠবে না একটি তারাও।’কবি নির্মল হালদারের কবিতা আমাদের শিকড়ের দিকে নিয়ে যায়, চিনতে শেখায় বাংলার লোকজসংস্কৃতিকে।কবি নির্মল হালদার আমাদের জন্য নিয়ে আসেন —
“নিয়ে এসেছি/রক্ত-মাংসের উত্থান/ নিয়ে এসেছি মাটির নম্রতা থেকে/ আমাদের বিনয়/ অক্ষরে অক্ষরে আমার ঘাম আমার জীবন/ আমার স্বর আমার নদী/ কলম ডুবিয়ে উদ্ধার করি আমার লিপি/এখানে পিপাসা বললে পাতাবাহারে ফুটে ওঠে আমার ভাষা/ এই আমার পরিচয়, উড়িয়েছি মেঘের ধ্বজা।”
কবি নির্মল হালদারের কবিতাপাতা থেকে আমিও সংগ্রহ করি সৃজনের দিনগুলি, যা পড়ে আছে নদীর ধারে। ভাতের চূড়ার দিকে চলে যায় আমি। ভাতের চূড়ায় উঠে দেখব কি তরিতরকারিময় দেশ? নাকি ভাতের চূড়ায় উঠে শুধুই দেখতে পাবো ক্ষুধার্ত মুখ। আমিও যে ক্ষুধার্ত, ভাতের চূড়া ভেঙে দিয়ে একই সঙ্গে আমিও খেতে পারি ভাত। “আমিও ঝরাতে চাই শরীরের নির্যাস/ কোথায় আমার দেশের মূল, কোন মূলে/ ঢোল বাজছে, আমারও দেখা আছে বাকি।”
কবি নির্মল হালদার নির্মাণ করেন মানুষের মূর্তি অক্ষরে অক্ষরে। বর্ণমালার ভিতরে হাঁটতে হাঁটতে আমিও হারিয়ে যায় কখন সবুজ অরণ্যের ভিতর। পৌঁছে যায় মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যে। খুঁজে পাই ‘হেঁতালের লাঠি। ‘দেখতে পাই চাঁদ সওদাগরকে, যিনি উচ্চারণ করেন —
“আমার সঙ্গে আছে সৃষ্টির দেবতা
আমার সঙ্গে আছে রহস্যময় সুর
আমি লালন করি না বিষের নির্মমতা
আমার সঙ্গে খেলা করে মেঘ ও রোদ্দুর
আমার সপ্তডিঙায় চাঁদ আর তারা
সোহাগে কেঁপে ওঠে সাগরের জল
আমাকে কে করবে সর্বহারা
আমার অনুরাগ আমার সম্বল।”
এরকম পঙক্তি পড়তে গিয়ে চমকে উঠি। একসময় শম্ভু মিত্রের ‘চাঁদ বণিকের পালা’ পড়তে পড়তে শিহরিত হয়েছি। চাঁদের বিদ্রোহ, চাঁদের প্রতিবাদ, চাঁদের একাকী লড়াই সাহস যুগিয়েছে সবসময়। কবি নির্মল হালদার-এর ‘হেঁতালের লাঠি’ কাব্যগ্রন্থ পড়তে পড়তে বুকের ভেতর জমে উঠছে সাহস। এই গ্রন্থের শুরুতেই কবি লিখেছেন, “মনসা পুজোর ঢাক-ঢোলে চাঁদবেনে আড়ালে থেকে যায়। যার চারিত্রিক দৃঢ়তা আমি নড়েচড়ে উঠেছি।
আমরা যখন প্রতিমুহূর্তে আপস করেই চলেছি, তখন এই বাংলায় চাঁদবেনে এক উদাহরণ। এক মেরুদণ্ড। যিনি মনসার আধিপত্যের বিরুদ্ধে সন্তান ও সম্পদ খুইয়েও এক দ্রোহ। যা আমাকে সাহস যুগিয়েছে লেখার জন্যে। “কবির চাঁদ সওদাগর উচ্চারণ করে—
“তুমি আমাকে ডুবিয়েছ জলে
ভাসিয়েছ পদ্ম, তা ব’লে
পদ্ম আঁকড়ে আমি উঠব পাড়ে
এত দুর্বল আমি যে নই
আমি উঠেছি আমার শক্তি বলে।”
একেবারেই অভিনব নির্মাণ এই কাব্যগ্রন্থের। শুরুর কবিতার শিরোনাম ‘চম্পক নগরবাসী’। যেখানে চম্পকনগরের সকলে মিলে একসঙ্গে বলে ওঠে—
“যায় গো যায় সপ্তডিঙা যায়
বাণিজ্য জয়ে সরল হাওয়ায়
লবঙ্গ এলাচ দারুচিনির গন্ধ নিয়ে আসবে
নুন লঙ্কা গোলমরিচের ঘ্রাণে হৃদয় ভাসবে…”
তারপরেই বেশ কিছু কবিতার শিরোনাম ‘চাঁদ সওদাগর’, তারপর আবার শিরোনাম পাল্টে ‘কবি’, ‘মনসা’, ‘চম্পক নগরবাসী’, ‘চাঁদ সওদাগর’। যেন এক নতুন মঙ্গলকাব্যের পাঠ নিচ্ছি আমরা। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের এক নতুন নির্মাণ। আমিও তো বিশ্বাস করি, মধু থাকতে কখনোই বিষের জয় হতে পারে না, মানুষ তো নশ্বর, মানুষ গড়েছে মানুষের ভগবান, চাঁদ জানে ‘পালাবে আঁধার’। পরপর কবিতায় যেন চাঁদ আর মনসার কথোপকথন চলতে থাকে অদ্ভুত শব্দবন্ধে, স্পষ্ট লৌকিক উচ্চারণে, জীবনের ছোঁয়ায়।
“বাঁচবো রে বাঁচবো নিজের জোরে
আমি আছি সুন্দরের সঙ্গে সততায়
আমার পূজা পেতে আসতে হবে দোরে
শেষ করতে পারবিনে তোর জাঁতায়।”
চাঁদ তাঁর কর্মকে মানেন।কবি বলে—”গোলমরিচ -ঝালের মতো চাঁদবেনের ক্রোধ/ তাই দেখে ভয় পায় গরমকালের রোদ।”ওদিকে একদিন পুত্র এল সোনার চাঁদ। গাঁয়ে গাঁয়ে সবার আনন্দিত মন।চাঁদ আর সনকার মিটিল মনের স্বাদ।সেই সন্তানকে চোখে চোখে রাখা হয় সর্বক্ষণ। কিন্তু আড়ালে আড়ালে হাসে দেবী বিষহরী।
কবি বলে —
“শুয়ে শুয়ে হাত-পা ছড়িয়ে আকাশের দিকে
হাসে কাঁদে ঘুমিয়ে পড়ে লখিন্দর
আলো-বাতাস তার কপালে চুম্বন যায় লিখে তাকে ভালোবাসে মাটির অন্দর।”
এরকম উচ্চারণেই কবি নির্মল হালদার হয়ে ওঠেন সবার থেকে আলাদা। মাটির কাছাকাছি থাকা,জীবনের কাছাকাছি থাকা,খেটে খাওয়া মানুষের কাছাকাছি থাকা এই মানুষটি প্রতিদিন যেটুকুই লেখেন, তাই তাঁর ‘যাপন’। “পুরুলিয়ার রুখা-শুখা মাটিতে জলসিঞ্চন তাঁর কবিতায়।”সনকা যখন চাঁদ সওদাগরকে বলে ওঠেন ছটা ছেলে গেছে এই একটাকে বাঁচাও, ফুল বেলপাতা দিয়ে মনসার কাছে বর চাও, তখন চাঁদ সওদাগর কী বলে ওঠেন —”….তোমার ছেলে হাওয়ার সঙ্গে পাতার সঙ্গে দোলে/হয়ো না অস্থির।”
“শিব থেকেই সৃষ্টি, সত্য ও সুন্দর
শিবের কোলে বেড়ে ওঠে আমার লখিন্দর।”
কবিও দেখেন,’লখিন্দর খেলা করে ধুলায় ধুলায়।’চম্পকনগরবাসী বলে ওঠে—
“ঝড়ের কোলেও লখাই নাচে
বৃষ্টির কোলেও লখাই নাচে
লখাই যে দেবতার আশীর্বাদ
লখাই যে চাঁদের জিহাদ।”
গ্রামবাসীরা ছুটে আসে। সমস্ত ফুলের গন্ধ তাকে ছুঁতে চায়। গ্রাম সম্পর্কে কেউ কাকি, কেউ জেঠি, কেউ বা মাসি। আদরে-আহ্লাদে তাকে সকলে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
বইটির চতুর্থ কভারে লেখা রয়েছে — “মঙ্গলকাব্য বাংলা সাহিত্যের তথা বাংলা জীবনের এক ঐতিহাসিক দলিল। তৎকালীন বাংলার সমাজ-সংস্কৃতি,জীবনযাপনের এক চিত্রিত আখ্যান ‘মঙ্গলকাব্য’। এমনই এক কাব্য মনসামঙ্গল।কবি নির্মল হালদার সেই ‘মনসামঙ্গল’-কে দেখেছেন গ্রামীণ সাধারণ জীবনের মধ্যে।এ আখ্যান তাই নির্মাণ নয়। পুনর্নির্মাণ। ফিরে দেখা আমাদের তৎকালীন সময়কে এই সময়ের নিরিখে।”
কেমন অদ্ভুত শব্দবিন্যাস একটু খেয়াল করুন —
“কোথায় যে লুকিয়ে আছে যমরাজা
কখন কোনপথে যে আসবে মরণ
যদিও সকালটা ফসলেই তাজা
ভালো থাকবে সুখে থাকবে আমার কোলের ধন।”
বেহুলা হয়ে ওঠে মাটির মেয়ে। চম্পকনগরবাসী কথায়—
“সেই মেয়ে মরা মাছও বাঁচায়
সেই মেয়ে আমাদের বেহুলা
সে ভেঙে ফেলে লোহার খাঁচা
জানে কেবল মাটি আর ধুলা।”
আর চাঁদ সওদাগরের ভাষায়— “বট-অশথের এই দেশ জলে ও মাটিতে অক্ষয়/ বেহুলা ও লখাই আমাদের পরিচয়।”
কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় নির্মল হালদার লিখেছিলেন— “ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি মনসাপুজো। আমাদের সামনেই জেলেপাড়া বাউরিপাড়ার জাঁকজমক করে পুজো, প্রতিবছর শ্রাবণ সংক্রান্তিতে। আমাদের পাড়ায় এক ময়রা-ঘরেই মনসা হয়ে থাকে, তবে মাটিতে গড়া সাপের পুজো। পুরুলিয়ার গ্রামে গ্রামে মনসা পুজো ঘিরে শুরু হয় উন্মাদনা। মনসার নামে হাঁস বলি,পাঁঠা বলি। মঞ্চ বেঁধে মনসার জাত গাইছে মানুষ। আবেগে ভেসে যায় কয়েকটা রাত। গ্রামজীবনে অথবা শ্রমজীবনে তৈরি হয় ভক্তিরসের আবহ। বিনোদনও বটে। আর পাঁচটা পালা-পার্বণের মতো নিখাদ বিনোদন।
ওই সময় ধান রোয়ার কাজও চলে।”
খুব কাছ থেকে এসব দেখেছেন বলেই ‘হেঁতালের লাঠি’ হয়ে ওঠে এক নতুন কাব্য, সময়ের স্বর—শাশ্বত জীবনভাষ্য।
কবির চোখে —
“মনসা তো আজও আছে ঘরের বিটি ঘরে
প্রতিষ্ঠান আর পূজা দুটোই কঠিন
জল-জঙ্গলের অভাবেতে সাপখোপও মরে
সাপুরিয়া বাজায় না বীণ।
বেউলা সে মেয়ে এক নিত্যই নবীনা
চিরপ্রেমে সবুজ লখিন্দর
চরাচরে বেজে যায় বাঁশি আর বীণা
ঘুম-ভাঙানিয়া যেন চাঁদ সওদাগর।”
কৃতজ্ঞতা : লাইফpeg পত্রিকা, সম্পাদকের অনুরোধে লেখা
কবি নির্মল হালদারকে চিনিয়ে দিয়েছেন আর এক কবি অমৃতাভদে। সুন্দর বিশ্লেষণ। ঝরঝরে ভাষা।। পড়তে ভালো লাগে। অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ