তখন পাখীদের নীড় বাঁধবার সময়। চঞ্চল পাখীগুলো খড়ের কুটি, ছেঁড়া পালক, শুকনো ডাল মুখে করে উৎকণ্ঠিত হয়ে ফিরছে।
তাদের বিয়ে হ’ল।-দুটি নেহাৎ সাদাসিদে ছেলেমেয়ের।
ছেলোটি মার্চেন্ট আফসের কেরানী-বছরের পর বছর ধরে বড় বড় বাঁধানো খাতায় গোটা গোটা স্পষ্ট অক্ষরে আমদানি-রপ্তানির হিসাব লেখে। মেয়েটি শুধু একটি শ্যামবর্ণ সাধারণ গৃহস্থঘরের মেয়ে-সলজ্জ সহিষ্ণুত মমতাময়ী।
আফ্রিকা জুড়ে কালো কাফ্রী জাতের উদ্বোধন — হুঙ্কারে সাদা বরফের দেশের আকাশ কেমন করে শিউরে উঠছে, সে খবর তারা রাখে না। হলুদবরণ বিপুল মৃতপ্রতিম জাতি একটা কোথায় কবরের চাদর ছুড়ে ফেলে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে তাজা রক্তের প্রমাণ দিতে, সে খোঁজ রাখবার তাদের দরকার হয় না। তারা বাঙলার নগণ্য একটি কেরানী আর কেরানীর কিশোরী বধূ। আসন্ন যৌবনা মেয়েটি স্বজনহীন স্বামীর ঘরে এসে গৃহিনী হ’ল। প্রেমের কবিতা তারা লেখে না, পড়বার ফুরসৎ বা সুবিধাও বড় নেই। দুজনে দুজনকে সম্বোধন করতে নব নব কল্পনা-লোকের সম্ভাষণ চয়ন করে না। শুধু এ ওকে বলে — ‘ওগো’।
সকাল বেলা স্বামীকে খাইয়ে-দাইয়ে হাতে পানের ডিবেটি দিয়ে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে মেয়েটি একটি দরজার আড়াল থেকে ঈষৎ মুখ বার করে সলজ্জ একটু করুণ হাসি হাসে : — ছেলেটিও ফিরে চেয়ে হাসে। কোনো দিন বা মেয়েটি বলে মৃদু মধুর স্বরে, ‘ওগো তাড়াতাড়ি এসো, কালকের মতো দেরী কোরো না।” ছেলেটি হয়ত অনুযোগের স্বরে বলে, “বাঃ! কাল ‘ত মোটে আধঘন্টা দেরি হয়েছিল ; বললুম ত রাস্তায় ট্রামের তার খারাপ হয়ে গিয়ে-ছিল ব’লেই…একটু দেরি হ’লেই বুঝি অমনি অস্হির হয়ে উঠতে হয়?’ মেয়েটি লজ্জিত হয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, আমি বুঝি অস্থির হই!’
সন্ধ্যায় দরজায় একটি টোকা পড়তে না পড়তেই দুটি উৎসুক হাতে দরজাটি খুলে যায় : সারাদিনের পরিশ্রম-শ্রান্ত ছেলেটি ধীরে ধীরে গিয়ে পরিচ্ছন্ন বিছানায় একটু ব’সে আপত্তি করে বলে, ‘না গো, তোমায় জুতোর ফিতে খুলে দিতে হবে না।’ মেয়েটি প্রতিবাদ করে বলে, ‘তা দিলেই বা তাতে দোষ কি” ছেলেটি একটু রাগ দেখিয়ে বলে, ‘ওটা কি আমি নিজে পারিনে?’ মেয়েটি খুলতে খুলতে বলে, ‘তা হোক — তুমি চুপ করো দেখি।’
ছুটির দিন তাদের আসে। সেদিন একটু ভালো খাবার দাবারের আয়োজন হয়, কোনদিন দুটি একি বন্ধু আসে নিমন্ত্রিত হয়ে। মেয়েটি সলজ্জ-সঙ্কোচে আপাদমস্তক অবগুন্ঠিত হয়ে পরিবেষণ করে। সে-দিন বিছানায় আলস্যে হেলান দিয়ে গল্প করবার দুপুর। জ্ঞানাভিমানহীন কেরানী আর কেরানী-
প্রিয়ার সাধারণ আনন্দ আলাপ। জটিল তর্কের দুরূহ সমস্যার গোলকধাঁধায় তারা ঘুরে ঘুরে হয়রান হয় না, সহজেই সেসব মীমাংসা করে ফেলে। মেয়েটি হয়ত জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা, ‘মশা মারলে পাপ হয় ত?’ ছেলেটি হয়ত বলে, নিশ্চয়ই আর মেরো না।’ মেয়েটি বলে, ‘বেশ! কিন্তু রোজ যে মাছগুলো
মেরে খাও, পাঁঠার মাংস খাও, তার বেলা?’ ছেলেটি একটু বিব্রত হয়ে বলে,’বাঃ! ও যে আমাদের আহার। যা আমাদের আহারের তা খেলে কি পাপ হয়? তা হ’লে ভগবান আমাদের আহার দেবেন কেন?’ মেয়েটি বলে, ‘ও।’ মেয়েটি হয়ত বলে. ‘ওদের বাড়ির বৌরা কাল বেড়াতে এসেছিল, ওরা বলছিল কোন্ গণৎকার নাকি গুনে বলেছে আর দশদিন বাদে পৃথিবীটা চুরমার হয়ে যাবে একটা ধূমকেতুর সঙ্গে ধাক্কা লেগে, সত্যি?’ ছেলেটি হেসে বলে, ‘মেয়েদের যেমন সব আজগুবি কথা! চুরমার হয়ে গেলেই হ’ল কিনা!’
‘মেয়েটি গম্ভীর হয়ে বলে, আমিও বিশ্বাস করিনি। আর একবারও অমনি গুজব উঠেছিল, তখন আমাদের বিয়ে হয়ানি।’ এমনিতর তাদের ছুটির আনন্দগুঞ্জন।
একদিন ছেলেটি ট্রামের পয়সা বাঁচিয়ে হেঁটে এল। সেই পয়সায় রাস্তার মোড়ে একটি গোড়ের মালা কিনলে। ঘরে এসে হঠাৎ মেয়েটির খোঁপায় জড়িয়ে দিয়ে বললে, ‘বলো দেখি কেমন গন্ধ? মেয়েটি বিস্মিত আনন্দে মালা দেখতে দেখতে একটু ক্ষুন্নস্বরে বললে, ‘কেন আবার তুমি বাজে পয়সা খরচ করতে গেলে বলোত?’ ছেলেটি বললে, ‘বাজে পয়সা খরচ বুঝি! ট্রামের পয়সা আজ বাঁচিয়ে তাইতে কিনেছি।’ এবার মেয়েটি সত্যি রেগে বললে, ‘এই ছাই ফুলের মালা কেনবার জন্যে তুমি এই পথটা হেঁটে এলে?
যাও, চাইনে আমি তোমার ফুলের মালা!’ ছেলেটি ক্ষুব্ধস্বরে বললে, ‘বাঃ-অমনি রাগ হয়ে গেল, সব কথা আগে শুনলে না কিছু না, অমনি রাগ! আজ অফিসে বড্ড মাথাটা ধরেছিল, ভাবলম মাঠের ভিতর দিয়ে হাওয়ায় হেঁটে গেলে ছেড়ে যাবে। তার উপর সকাল সকাল ছুটি হ’ল; একি এতই অন্যায় হয়ে গেছে? বেশ যা হোক্।’ মেয়েটি একটু কাতর হয়ে বললে, ‘আমি রাগ করলুম কোথায়? তুমি মিছিমিছি ফুলের মালা কেনবার জন্যে হেঁটে এসেছ ভেবে —।’ ছেলেটি বললে, ‘দাও, ফুলের মালাটা ফেলে দাও তাহ’লে।’ — এবার মেয়েটি পরম আনন্দে ফুলের মালাটি খোঁপায় জড়াতে জড়াতে বললে, ‘হুঁ ফেলে দিচ্ছি এই যে! বাবা! একটা ভালো কথা যদি তোমায় বলবার জো আছে।’
একদিন একটু বেশি জ্বর হ’ল মেয়েটির। তার পরদিন আরো বাড়ল। তার পরদিনও ক’মল না। অফিস যাবার সময় উৎকণ্ঠিত হয়ে ছেলেটি বললে,‘এখানে এমন করে কি ক’রে চলবে। দেখবার একটা লোক নেই-এই বেলা তোমার বাপের বাড়ি যাবার বন্দোবস্ত করি। মেয়েটি বললে, ‘না না, ও কালকেই
সেরে যাবে…তুমি অফিস যাও, ভাবতে হবে না।’ ছেলেটি উদ্বিগ্ন হৃদয়ে কাজে গেল উপায় ভাবতে ভাবতে। তার পরদিনও জ্বর বাড়ল দেখে বললে,’না, আমার আর সাহস হচ্ছে না। আমি সমস্ত দিন অফিসে থাকি, জ্বর বাড়লে কে তোমায় দেখে! তোমায় রেখে আসি চলো ওখানে।’ মেয়েটি করুণ-চোখে তার দিকে চেয়ে রইল, তারপর মুখ ফিরিয়ে বললে, ‘আমার সেখানে ভালো লাগে না।’
জ্বরের মধ্যে রাঁধারাঁধি নিয়ে দুজনের রাগারাগি হয়। মেয়েটি বলে,’আমি খুব পারব- তোমার না খেয়ে অফিসে যাওয়া হবে না।’ ছেলেটি বলে, ‘তুমি পারলেও আমি রাঁধতে দেব না। আমি না-হয় হোটেলে খাব।’ মেয়েটি বলে, হ্যাঁ ভদ্রলোকে বুঝি হোটেলে খেতে পারে!’ ছেলেটি বলে, ‘দরকার হ’লে সব পারে।’ মেয়েটি তবু বলে, ‘তোমার এখনো ত দরকার হয়নি। ‘
তারপর জোর করে মেয়েটি রাঁধতে যায়। ছেলেটি এবার খুব রাগ করে, ভীষণ এক দিব্যি দিয়ে বলে, ‘যে আজ রাঁধবে সে আমার মরা মুখ দেখবে।’মেয়েটি দিব্যি শুনে স্তম্ভিত হয়ে বিছানায় শুয়ে কাঁদতে থাকে। ছেলেটি অনুতপ্ত হয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করবার চেষ্টায় বলতে থাকে, ‘তুমি অবুঝের মত জেদ করলে, তাই না আমি দিব্যি দিলুম; লক্ষ্মীটি, রাগ কোরো না। আচ্ছা ভেবে দেখ দেখি আগুন-তাতে রেঁধে যদি তোমার জ্বর বেশি বাড়ে তখন ত আমারই কষ্ট বাড়বে। এখন ত একদিন রান্না পাচ্ছিনে,তখন ত কতদিন পাব না…সে ত আমারই কষ্ট…তুমি ভালো হয়ে যত খুশি রেঁধো না, আমি কি বারণ করেছি?’ মেয়েটি বলে, বেশ ত, খুব হয়েছে, দিব্যি দিয়েছ-আমি ত আর রাঁধতে যাচ্ছিনে!’ ছেলেটি আরো অনুতপ্ত হয়ে বোঝাতে থাকে। সেবারে জ্বর আপনা থেকেই ধীরে ধীরে সেরে গেল। তাদের রাগারাগির পালাও এমনি করে সমাপ্ত হ’ল।
নতুন নীড়ে তখন অচেনা অতিথির সমাগম হয়েছে। একটি খোকা। কিন্তু মেয়েটির আর বাপের বাড়ি থেকে আসা হয়ে উঠছে না। অসুখ আর সারতে চায় না, বাপ-মাও অসুখ-সুদ্ধ মেয়েকে ছেড়ে দিতে রাজী হয় না। ডাক্তার ধাত্রী বলে ‘সূতিকা।’
ছেলেটি বন্ধুদের কাছে উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে বেড়ায়, ‘হ্যাঁ ভাই, সূতিকা হ’লে কি বাঁচে না?’ মেয়েটি দিন দিন আরো কাহিল হয়ে যেতে লাগল — বিছানা থেকে আর ওঠবার ক্ষমতা রইল না ক্রমে। ছেলেটি রোজ অফিসে দেরি হবার জন্যে বকুনি খায়। হিসাব ভুলের জন্যে তাড়া খায়।
কিন্তু তারা সৃষ্টির বিরুদ্ধে এই অকারণ উৎপীড়নের জন্যে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে জানে না। নির্দোষের উপর এই অন্যায় অবিচারে, বিধাতার পক্ষ-পাতিত্বে ক্ষিপ্ত হয়ে অভিশাপ দেয় না সংসারকে। মানুষের কাছে তারা মাথা নিচু ক’রে চলে, বিধাতার কাছেও।
মেয়েটি কোনদিন স্বামীকে একলা কাছে পেয়ে, করুণ কাতর চোখে তার মুখের দিকে চেয়ে বলে, ‘হ্যাঁ গা, আমি বাঁচব না?’ ছেলেটি জোর করে বুক-ফাটা হাসি হেসে বলে, কি যে পাগলের মতো বলো তার ঠিক নেই। বাঁচবে না কেন, কি হয়েছে তোমার?’ মেয়েটি চোখ নামিয়ে মৃদুস্বরে বলে, আমি মরতে চাইনে কিছুতেই।’ ছেলেটি আবার হেসে বলে, ‘ওসব আজগুবি কথা কোথায় পাও বলো ত?
একটা হাসি আছে কান্নার- চেয়ে নিদারুণ, কান্নার চেয়ে হৃৎপিন্ড নেংড়ান।
রোগ কিন্তু ক্রমশ বেড়েই চলল। মেয়েটি আর স্বামীর কাছে জিজ্ঞাসা, করে না, ‘হ্যাঁ গা, আমি বাঁচব না?’ বরঞ্চ তার সামনে প্রফুল্ল মুখ দেখিয়ে হাসতে চেষ্টা ক’রে বলে, ‘তুমি ভাবছ কেন, আমি ত শীগগীরই সেরে উঠছি।’ তারপর ঘরকন্না পাতবার নব নব কল্পনার গল্প করে, কেমন করে ছেলে মানুষ করবে, তার নাম কি রাখবে, এইসব। ছেলেটিও তার শিয়রে ব’সে করুণ হেসে তার শীর্ণ হাতটি নিজের হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে শোনে। মেয়েটি বলে, তুমি ভেবে ভেবে মন খারাপ কোরো না, আমি ঠিক সেরে উঠব।’ ছেলেটি বলে, ‘কই, আমি ভাবিনে ত! সেরে উঠবে না ত কি, নিশ্চয়ই উঠবে।’ কিন্তু তারা বুঝতে পারে, এ ছলনা দুজনের কারুরই বুঝতে বাকি নেই। তবু তারা পরষ্পরকে সান্ত্বনা দিতে এই করুণ ছলনার নিষ্ঠুর মর্মান্তিক অভিনয় করে। তারপর লুকিয়ে কাঁদে।
তবু ছেলেটির নিত্যনিয়মিত অফিস যেতে হয়। বড় বড় বাঁধানো খাতা-গুলোর নির্ভুল গোটা-গোটা অক্ষরগুলো নির্বিকারভাবে চেয়ে থাকে। তেমনি হিসাবের পর হিসাব নকল করতে হয়।
তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরবার জন্যে প্রাণ আকুল হয়ে উঠলেও ছেলেটি হেঁটে আসে-ট্রামের পয়সা বাঁচিয়ে ফুলের মালা কেনবার জন্যে নয় — অসুখের খরচ যোগাতে।
কোনো সময় হয়ত একবারটি মনে হয় যদি সে এমন গরীব না হ’ত, আরো ভালো করে ডাক্তার দেখিয়ে আর একটু; চেষ্টা করে দেখত।
শুধু সেদিন জ্ঞান হারাবার আগে মেয়েটি একটি বারের জন্যে এতদিন-কার মিথ্যা করুণ ছলনা ভেঙে দিয়ে কেঁদে ফেলে বললে, ‘আমি মরতে চাইনি, — ভগবানের কাছে রাতদিন কেঁদে জীবন ভিক্ষা চেয়েছি, কিন্তু —’
সব ফুরিয়ে গেল।
তখন কাল-বোশেখীর উন্মত্ত মসীবরণ আকাশে নীড়ভাঙার মহোৎসব লেগেছে।
আহ..!