ঝরঝর বর্ষণের বিরামহীন বর্ষাকাল প্রেম, বিরহ, সুখ-দুঃখ, সংকট সবই একসঙ্গে নিয়ে হাজির হয়। ভ্যাপসা গরম থেকে মুক্তি দিতে বর্ষা যেমন শান্তির বারি বর্ষণ করে তেমনি ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া পরজীবী অন্যান্য জীবানুদেরও অ্যাকটিভ বাজার গড়ে তোলে। এক পেয়ালা গরম চা, সঙ্গে পাড়ার দোকানের চপ-পিঁয়াজি আর গল্পের বই নিয়ে ‘শ্রাবণ সন্ধ্যা’ যদি জমে ক্ষীর হয় তবে মন্দ কি! কিন্তু এখানেই সমস্যা। বিশেষজ্ঞরা বলেন বর্ষাকালে হজম শক্তি এবং দেহের সামগ্রিক প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে একটু অসতর্ক হলেই ডায়রিয়া, ডিসেন্ট্রি, জন্ডিস, টাইফয়েড নিউমোনিয়া,সর্দিকাশি ইত্যাদি অসুখ-বিসুখ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, বেড়ে যায়। এনার্জি লেভেলেও ঘাটতি থাকে এসময়ে। দাদ-হাজা-চুলকানি থেকে চুল পড়া বা কনজাংটিভিটিস এর সমস্যাও দেখা যায়। এসব সমস্যার সমাধান পেতে গেলে সঠিক ডায়েটই হলো একমাত্র সমাধান। আসুন জেনে নিই বর্ষার জন্য স্বাস্থ্যকর ডায়েট টিপস —
১) আপনার বয়স, ওজন, উচ্চতা ও শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী বর্ষাকালে হালকা সহজপাচ্য ব্যালেন্স ডায়েট নিন। ছোলা-মুড়ি, দুধ-খই, ছাতু পপকর্ন, আদা-সহ সবুজ মুগের চাট, ডালিয়া বা ওটসের খিচুড়ি, রুটি তরকারি ইত্যাদি টিফিনে খেতে পারেন।
২) সবুজ শাকপাতা : অনেকেই বলে থাকেন বর্ষাকালে শাক খেতে নেই কারণ তাতে ব্যাকটেরিয়া ও কৃমি সংক্রমণের ভয় থাকে। কিন্তু জানবেন সবুজ শাক ছাড়া সুষম আহার হয়না। তাই লাউ, কুমড়ো, নটে, পুঁই ইত্যাদি যে কোন শাক খেতে পারেন। তবে রান্নার আগে খুব ভালোভাবে ঝেড়ে বেছে ধুয়ে নিতে হবে যাতে কাদামাটি বা পোকামাকর সংক্রমণের আশঙ্কা না থাকে। যদি সম্ভব হয় তাহলে শাককে রকসল্ট বা ভিনেগারের জলে ভিজিয়ে রাখতে পারেন। তারপর পরিষ্কার করে কেটে রান্না করুন। তবে যাদের ডায়রিয়া বা হজম সংক্রান্ত সমস্যায় ভুগছেন তারা শাকপাতা ডায়েট চার্ট থেকে বাদ দিন।
৩) হলুদ, মেথি, গোলমরিচ, দারচিনি, বড় এলাচ ইত্যাদি রান্নায় রাখা গেলে দেহের সামগ্রিক রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ায়। হলুদে থাকা কার্কিউমিনে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য থাকায় বর্ষাকালের জন্য খুব উপকারী।
৪) বর্ষাকালে যেহেতু ঘামের হাত থেকে কিছুটা মুক্তি মেলে তাই দেহে জল ও ইলেকট্রোলাইসিসের সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে বিভিন্ন তাজা ফল বা ফলের রস ডায়েটে রাখতে পারেন। তবে জুসে চিনি মেশাবেন না।
৫) এইসময় যারা জ্বর বা অন্যান্য সংক্রমণে ভুগছেন তারা আদা, তুলসী, লবঙ্গ, গোলমরিচ, দারচিনি, এলাচের মত ঔষধি মসলা দিয়ে ক্বাথ বানিয়ে খেতে পারেন। এছাড়া ত্রিফলা বিশেষত হরিতকী বর্ষাকালে জ্বর, হাঁচিকাশি জাতীয় সংক্রমণকে প্রতিরোধ করে।
৬) মাছ প্রিয় বাঙ্গালীর এই সময় নদ-নদী পুকুর বা সমুদ্রের মাছ না খাওয়াই ভালো। এটি মাছেদের প্রজননের সময়। বর্ষার সময় এরা জল দূষিত করে এবং জলে থাকার জন্য মাছের শরীরে বিভিন্ন রকমের বর্ষাকালীন ব্যাকটেরিয়া বাসা বাঁধে। তাই মাছ থেকে আমাদের শরীরেও নানান রোগের সংক্রমণ হতে পারে। এর পরিবর্তে চিকেন বা বয়েল্ড/পোচ এগ খেতে পারেন।
৭) বর্ষাকালে উচ্ছে, কাঁকরোল, করলার মতো সামান্য তেতো খাবার এবং পিয়াজ, রসুন, আদা, টমেটো, লঙ্কা ইত্যাদি ঝাঁজালো স্বাদের খাবার ডাইজেস্টিভ এনজাইম কে সক্রিয় রাখে।
৮) বৃষ্টিতে ভিজতে বাধ্য হলে বাড়ি ফিরে এক বাটি পাতলা ডাল, সবজি বা গরম চিকেন সুপ পারলে খেতে পারেন। এতে ঠান্ডা লাগার ভয় থাকে না, দেহে জল ও এনার্জির সাম্যবস্থাও বজায় থাকে।
৯) ফারমেন্টেড ফুড বা গেঁজিয়ে ওঠা খাবার যেমন দই, মশলা বাটারমিল্ক, ছাঁচ ইত্যাদি খাবার খেতে পারেন। দই প্রোবায়োটিক যা অন্ত্রের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সহায়তা করে।
১০) এই সময় ডায়াবেটিস রোগীরা পায়ের প্রতি বিশেষ যত্নবান হবেন। পায়ে সামান্য হাজা,চুলকানি, ফুসকুড়ির মত সামান্য সমস্যাও ভয়ঙ্কর বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে। বাইরে থেকে ঘুরে এসেই তাই সাবান দিয়ে ভালো করে পা ধুয়ে মুছে শুকনো করে অ্যান্টিসেপটিকক্রিম লাগাতে পারেন। সর্বোপরি রক্তের শর্করা মাত্রা নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করুন।
১১) এই বর্ষায় পেটের অসুখের সংক্রমণই সবচেয়ে বেশি ভয় থাকে। তাই যে জল আপনি খাচ্ছেন তা ১০০% বিশুদ্ধ কিনা তা লক্ষ্য করুন। দরকার পড়লে জল ফুটিয়ে ঠান্ডা করে ফিল্টার করে খেতে পারেন।
১২) মাছ মাংস সবজি বাজার থেকে আনার পর ভালো করে জল দিয়ে ধুয়ে শুকিয়ে এয়ারটাইট কন্টেনারে ফ্রিজে রাখবেন। কাটার আগে সবজি অবশ্যই ভালোভাবে ধুয়ে নেবেন।
১৩) ফ্রিজে সংরক্ষিত সামান্য নষ্ট হয়ে যাওয়া, বাসি পচা খাবার দীর্ঘদিন মায়া করে না দেখে ফেলে দিন। এই সময় অতিরিক্ত প্রসেসড বা প্রিজার্ভ খাবার এভোয়েড করে চলুন।
১৪) রাস্তার ধারের কাটা ফল,ফলের রস, রঙিন পানীয় থেকে শতহাত দূরে থাকুন। কারণ এগুলিই পেট খারাপের আঁতুর ঘর।
১৫) কাঁচা সালাড বা কাঁচা শাকসবজির জুসের পরিবর্তে স্টিম সালাড বা রান্না করা আনাজপাতি খান।
১৬) সন্ধ্যায় বাঙালির জাতীয় খাবার রাস্তার তেলভাজা এন্ড মুড়ি– থেকে বিরত থাকুন। ইচ্ছে করলে ঘরেই বানিয়ে নিন।
১৭) বৃষ্টিতে ভিজে গেলে অনেকেই ঠান্ডা লাগার বা হাঁচি-কাশির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অতিরিক্ত চা কফি খেয়ে ফেলেন। যা শরীরকে শুষ্ক করে দেয়। অতিরিক্ত মাত্রায় কফি/চা পান মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়।এছাড়াও কোল্ড্রিংস বা চকলেটও প্রচুর ক্যাফিন থাকে যা অতিরিক্ত খাওয়ার স্বাস্থ্যকর নয়।
১৮) অ্যাভয়েড করুন অতিরিক্ত তেল মশলা জাতীয় গুরুপাক খাবার।আপনি যদি অ্যালার্জি প্রবণ হন তবে মশলাদার খাবার এড়িয়ে চলুন কারণ এটি শরীরের তাপমাত্রা বাড়ায় এবং রক্ত সঞ্চালনকে উদ্দীপিত করে যা অ্যালার্জির দ্রুত বিস্তার ঘটায়।
১৯) মৌসুমী ফল শশা আপেল পেঁপে নাশপাতি পেয়ারা কলা জাম বরই চেরি পীচ জামরুল ডালিমের মতো ফল আপনার ডায়েটে রাখুন।
২০) বাড়ন্ত বাচ্চাদের স্নাক্স হিসেবে ফাস্টফুডের বদলে অল্প শুকনো ফল আমন্ড আখরোট পেস্তা ইত্যাদি দিতে পারেন।
বর্ষাকালে বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় খাবার খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা। ইলিশের যা দাম তা প্রায়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায় ।তাতে যদিও বা বাঙালি ডরায় না। ইলিশ মাছ ভাজার বদলে আপনি যে কোন মাছ ভাজা বা ডিমভাজা, বেগুনি ফুলুরি আলুরি পাপড় ভাজা সহযোগে খেতে পারেন। খিচুড়ি রান্নার সময় চালের অর্ধেক পরিমাণ ডাল এবং কম তেল মশলা দিয়ে রান্না করবেন।
বর্ষার সময় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টিতে চপ ঝালমুড়ি পিঁয়াজি খাওয়ার টান অন্তরে অনুভব করতেই পারেন। স্বাদে অতুলনীয়,স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী মিষ্টি ভুট্টা হোক বা দেশি ভুট্টা খাদ্য তালিকায় অবশ্যই রাখতে পারেন।তবে যাই খান না কেন আপনি আপনার পছন্দের মতই খাবেন কারণ কথায় আছে না, “আপরুচি খানা”, সে যাই হোক অবশ্যই খান। এই বর্ষায় শরীর বুঝে স্বাস্থ্যসম্মত ডায়েট করুন।।
বিধিসম্মত সতর্কীকরণ : এই প্রতিবেদনে উল্লেখিত টিপসগুলি সাধারণ তথ্যের জন্য। বিশেষ সমস্যার জন্য বিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।