ট্রেড এন্ড কমার্সিয়াল অর্গানিজেশন ইন বেঙ্গল ১৬৫০-১৭২০, উইথ স্পেশাল রেফারেন্স টু দ্য ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
সপ্তম অধ্যায়
বাঙলার ব্যবসা জগতে কোম্পানি
কোম্পানি ও দেশিয় ব্যবসা (কান্ট্রি ট্রেড)
বাংলা কুঠিয়ালদের জাপানে ব্যবসা করার তীব্র উতসাহ সত্ত্বেও ১৬৭৩ সালে ডায়রেক্টরেরা লেখেন সাম্প্রতিককালের ইওরোপের সমস্যার জন্যে তারা জাপানে জাহাজ পাঠাতে অপারগ, যদিও তারা ভবিষ্যতে এই বিষয়টি ভেবে দেখার প্রতিশ্রুতি দেন (ডিবি, ৩১ অক্টো, ১৬৭৩, ৮৮ খণ্ড, ৭৬)। আমরা যে সময়কাল নিয়ে আলোচনা করছি, সে সময় অবদি বাংলা থেকে সরাসরি কোম্পানি জাপানে ব্যবসা করে উঠতে পারে নি। অষ্টাদশ শতকের শুরুতে বাঙলার কুঠিয়ালেরা লন্ডনের কর্তাদের জাপান ব্যবসার জন্যে চাপ দিতে থাকেন, কিন্তু তারা ব্যর্থ হন। তাদের যুক্তি ছিল চিন ব্যবসায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ লভ্যাংশ আসা সত্ত্বেও (পিট, ১৭০০ সালে জন বেয়ার্ডকে লেখেন, চিনের জাহাজ সেন্ট ফোর্ট জর্জে ঢোকার আগেই ৩০-৪০ শতাংশ লাভ করে, দেখুন বিএম, আডি ম্যানু, ২২,৮৪২, ৭১), উপযুক্ত মরশুমে পুঁজি জোগাড় করা সমস্যা রয়েই যায়। কর্তাদের কাছে তাদের অনুরোধ ছিল, কর্তারা যেন মরশুমের শুরুতেই চিনের ব্যবসায় অন্তত ৪০ হাজার পাউণ্ডের বিনিয়োগে টুটেনাগ, তামা, পারদ, সিঁদুর, চিনামাটিরপাত্র ইত্যাদি কেনার এবং বাকি অর্থ সোনা কিনে সেই পণ্য জাহাজ ভরে ফেব্রুয়ারির মাঝবরাবর সময়ের মধ্যে বাংলার বন্দরে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করুক, যেগুলি ঠিক সময়ে বিক্রি করলে বাঙলা ব্যবসার বিনিয়োগ উঠে আসবে (ওসি, ৮ জানুয়ারি ১৭০২, ১১ প্যারা, ৬৩)।
ডাচেরা বাংলা থেকে এশিয়ার বিভিন্ন অংশে উচ্চলাভের ব্যবসা করত। লভ্যাংশ ছিল আকাশছোঁয়া। তাদের আন্তঃএশিয় ব্যবসার লাভ বিনিয়োজিত হত বাঙলার পণ্য কিনে ইওরোপে পাঠানোর কাজে। ডচেরা বাংলায় এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানান ধরণের পণ্য আমদানি করত এবং বাংলায় উচ্চলাভে সেগুলি বিক্রি করত। আমাদের বক্তব্য প্রমান করার জন্যে ১৬৭০ সালে এশিয়ার বিভিন্ন অংশ থেকে বাংলায় আমদানি করা পণ্যের বৈচিত্র, পরিমান, দাম, এবং বিক্রয়মূল্য উল্লেখ করা গেল নিচের তালিকায় (কেএ, ১১৬৪ খণ্ড, ৩৯৭ভিও, আমি ভগ্নাংশ বাদ দিয়েছি)
পণ্য পরিমান(পাউন্ডে) খরিদ দাম(ফ্লোরিন) বিক্রি দাম(ফ্লোরিন) লাভ্যাংশ%
গোলমরিচ ৩১৩৭০৮ ৪৮২৪২ ৮৬০৮ ৭৮
টিন ২০০৯৩৭ ৬৯১৪৮ ১১৬৪৮২ ৬৮
তামা ৬৭৩৮৬ ২৬৮৩৫ ৭১৮৯৭ ১৬৮
দস্তা(স্পেলটার) ১৫০৬৫ ৪৯৫০ ১২৪০০ ১৭০
গ্যান্স(কাঁসা/বেলমেটাল) ৮৪০০ ৩৯০৭ ৭০৬৩ ৮০
Bitgans? ১৮৪১০ ৩০৭৬ ৫৮৭৪ ৯১
সীসা ১০২৬২৫ ১৩৯৩ ২৪১৯৮ ৮৪
পারদ ১৫২৬ ৩০৫৮ ৪৭৫৩ ৫৫
সিঁদুর ৪২৯২ ৭০০৫ ১৩১২৭ ৮৭
চন্দনকাঠ ৯৩০২ ৩৪৪৮ ৫৪২০ ৫৭
লবঙ্গ ৭৫১৬ ৫০৪০ ৩৫৪২৭ ৬০২
জায়ফল ৫৪৮৫ ৬৩৯ ৭৭৪৮ ১১১২
দারুচিনি ৩৮৬৩ ২১৮৮ ৯৩২৬ ৩২৬
শ্রীলঙ্কার আরক ৩৪৪৫১৮ ২০৩৩২ ৪৫৮৬৮ ১২৫
হাতি ৬ ১১৪৩৯ ১৫২০৪ ৩৩
জয়িত্রী ১০৪৩ ১০০৯ ৫২৩৪ ৪২১
আমরা যে সময় নিয়ে আলোচনা করছি, সেই সামগ্রিক সময় ধরেই ডাচেরা আন্তঃএশিয় ব্যবসায় জড়িয়েছিল। ১৭১৬-তে তারা এশিয়ার বাজারগুলো থেকে বাংলায় ১,৬৯,২৭৪ টাকার (২,৫৩,৯১২ ফ্লোরিন) নানান বৈচিত্রের পণ্য আমদানি ক’রে ৪,০৭,০৩৭ টাকা(৬,০১,৫৫৬ ফ্লোরিন) দামে বিক্রি করে ২,৩১,৭৩৬ টাকা (৩,৪৭,৬৪৪ ফ্লোরিন) লাভ করে (K.A., Vpl. 1776, pt. I, f. 217)।
আন্তঃএশিয় ব্যবসা ছাড়াও ইওরোপিয় কোম্পানিগুলি, বিশেষ করে সুরাট এবং পারস্য থেকে বাংলায় পণ্যপরিবহনের (ফ্রেটের) ব্যবসা করত। এই ব্যবসাটা বেশ ভাল পরিমান লাভের ছিল এবং এশিয়ায় আসা জাহাজের যে ক্ষয়ক্ষতি হত, সেটা কোম্পানি পূরণ করে নিত এই দেশিয় ব্যবসার লাভ থেকে। ব্রিটিশ কোম্পানি দেশিয় ব্যবসায়ীদের মালপত্র সুরাট বা পারস্যে পৌঁছে দিত। কোনও কোনও সময় ব্যবসায়ীরা নির্দিষ্ট মূল্যে জাহাজ ভাড়া করত। যারা এই জাহাজ ভাড়া নিত, বা কোম্পানির জাহাজে পণ্য পাঠাত, তাদের অধিকাংশ ছিল আর্মেনিয় বণিক, এছাড়া অন্যান্য ব্যবসায়ীও একই কাজে জাহাজ ভাড়া করেছে (যে সব আর্মেনিয় ব্যবসায়ী কোম্পানি জাহাজে পণ্য পরিবহন করত, তাদের নামের জন্যে দেখুন, বিপিসি, রেঞ্জ ১, খণ্ড ২, ২৬৮-২৬৮-এ। শেঠেরাও কোম্পানি জাহাজে পণ্য পরিবহন করত। বিষ্ণুদাস শেঠ ১৭১৫-তে বোভারি জাহাজ বয়ে সুরাটে মাল পরিবহনের উদ্দেশ্যে ২৬,২৮৩টাকা দেন, (দেখুন বিজিএল এন্ড জে, রেঞ্জ ১৭৪, ৯২ খণ্ড, ১২৪)। ১৭১৪-তে আবার বিষ্ণুদাস শেঠ, যদু শেঠ এবং কিশোর শেঠ ২৯,৪৯২ টাকা দেন সুরাট থেকে হ্যানোভার জাহাজে করে তুলো নিয়ে আসার জন্যে, (দেখুন, বিজিএল এন্ড জে, রেঞ্জ ১৭৪, ৯২ খণ্ড, ২৮)। এমন কি সুরাটি ব্যবসায়ী হাজি মহম্মদ এবং মহম্মদ বাকেরও ব্রিটিশ জাহাজে পণ্য পরিবহন করতেন, (দেখুন, ফ্যাক্ট্রি রেকর্ডস, কলকাতা, খণ্ড ১, অংশ ২, ১২-১৩)। কোম্পানি অধিকাংশ সময়, জাহাজ ভাড়া দেওয়ার থেকে পণ্য পরিবহন করতে বেশি আগ্রহী ছিল কারণ সেটা অনেক বেশি লাভের ব্যবসা ছিল। ১৬৯৯-তে সে ৩৫,০০০টাকায় খাজা সরহুদের ইস্ট ইন্ডিয়া মার্চেন্ট জাহাজটি তার অধীনে দেওয়ার প্রস্তাব নাকচ করে দেয় কারন এই ধরণের যাত্রা থেকে ৩৬,০০০ টাকা মাল পরিবহনে লাভ করা যায়, এছাড়াও ২০,০০০ মণ চাল নেওয়া যায় জাহাজে ব্যালাস্ট (kinteledging) হিসেবে ব্যবহারের জন্যে, এছাড়া আরও ২০,০০০ মণ বেশি নেওয়া যায় পারস্যে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করার জন্যে, এছাড়াও নুন, তামাক, ঘোড়া, মদ্য ইত্যাদি সেখান থেকে আমদানি করা যায় (ফ্যাক্ট্রি রেকর্ডস, কলকাতা, খণ্ড ৩, অংশ ২, ২২৫)।
ব্রিটিশ কোম্পানির মাল পরিবহনের উচ্চলাভের ব্যবসার মূল প্রতিবন্ধকতা ছিল এই ব্যবসায় থাকা ইওরোপিয় প্রতিদ্বন্দ্বী। এই ব্যবসায় তাদের আগে থেকে ডাচেরা জড়িয়ে ছিল। আর ছিল দেশিয় ব্যবসায়িরাও। ১৬৮৪তে সোয়ালি মেরিনের কুঠিয়াল জানাল যে দুবছর আগে যে জাহাজ ১৮,০০০টাকা লাভ করেছে, সে জাহাজ আজ ৮,০০০টাকা লাভ করে কারণ ডাচেরা এই ব্যবসায় তাদের নিজেদের মালিকানার এবং ভাড়া করেও বহু জাহাজ নামিয়ে দিয়েছে (ওসি, ২৬ এপ্রিল, ১৬৮৪, ৫১৫৩, ৪৪ খণ্ড)। দেশিয় ব্যবসায়িদের থেকে প্রতিযোগিতা এতই বেশি ছিল যে, কোম্পানির জাহাজগুলো আর জাহাজ ভর্তি পণ্য নিয়ে অন্য বন্দরে যেতে পারত না। ১৬৯০-তে সুরাট কুঠিয়ালেরা লিখছেন, পারস্য আর বসরার পানে যাওয়ার জন্যে রয়্যাল জেমস এবং মেরি নামক জাহাজের জন্যে ৪০ হাজার এবং ৪০ হাজার টাকা অফার পেলেও তারা কেম্পথ্রোন জাহাজের জন্যে চাহিদা মত ভাড়া পেতে ব্যর্থ হয়, কারণ বহু মুসলমানের জাহাজ ব্রিটিশদের অর্ধেক টাকায় পণ্য পরিবহন করতে রাজি হয়ে যায় (ওসি, ২৮ এপ্রিল, ১৬৯০, ৫৭০৯, ৪৮ খণ্ড)। ১৬৯৯-তে কোম্পানি ইস্ট ইন্ডিয়া মার্চেন্ট জাহাজটি ৮টাকা প্রতি মণ ভাড়ায় দিতে রাজি হয়ে যায় কেননা বহু আরব ব্যবসায়ী ৬টাকা মণে পণ্য পরিবহন করে এবং পারস্যে পণ্য পাঠাবার জন্যে আরও তিনিটে জাহাজ তৈরি হয়ে আছে (ফ্যাক্ট্রি রেকর্ডস, কলকাতা, ৩ খণ্ড, অংশ ২, ২২৫)। ১৭১৮-তে কলকাতা কুঠিয়ালেরা লিখছেন, বোভেরি জাহাজটি পারস্যের দিকে পাঠানো হয়েছে মাত্র ৯টাকা প্রতি মনে ৫১৫ বেল কাপড় নিয়ে রওনা হয়ে গিয়েছে কারণ একটি আরব জাহাজ মাত্র ৬ বা ৭টাকা প্রতি মণে পণ্য পরিবহনের জন্যে অপেক্ষা করে আছে (সি এন্ড বি এবস্ট্রাক্টস, খণ্ড ২, ১৪৪)। (চলবে)