রবিবার | ৮ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | দুপুর ১:৩৩
Logo
এই মুহূর্তে ::
গাছে গাছে সিঁদুর ফলে : দিলীপ মজুমদার ভালো থাকার পাসওয়ার্ড : বিদিশা বসু সলিমুল্লাহ খানের — ঠাকুরের মাৎস্যন্যায় : ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা : মিল্টন বিশ্বাস নেহরুর অনুপস্থিতিতে প্যাটেল, শ্যামাপ্রসাদও ৩৭০ অনুমোদন করেছিলেন : তপন মল্লিক চৌধুরী সিঁদুরের ইতিকথা আর কোন এক গাঁয়ের বধূর দারুণ মর্মব্যথা : দিলীপ মজুমদার সাহিত্যিকদের সংস্কার বা বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষে শ্রীপাণ্ডবা বা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত দশহরার ব্যুৎপত্তি ও মনসাপূজা : অসিত দাস মেনকার জামাই ও জামাইষষ্ঠী : শৌনক ঠাকুর বিদেশী সাহিত্যিকদের সংস্কার ও বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ভক্তের ভগবান যখন জামাই (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য-এর ছোটগল্প ‘সময়ের প্ল্যাকটফর্ম’ গুহাচিত্র থেকে গ্রাফিটি : রঞ্জন সেন জামিষষ্ঠী বা জাময়ষষ্ঠী থেকেই জামাইষষ্ঠী : অসিত দাস কার্বাইডে পাকানো আম দিয়ে জামাইষষ্ঠীতে জামাই খাতির নয়, হতে পারে ক্যান্সার : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ভক্তের ভগবান যখন জামাই (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত কাশ্মীর নিয়ে বিজেপির নেহরুকে দোষারোপ ধোপে টেকেনা : তপন মল্লিক চৌধুরী রবীন্দ্র নাটকের দুই ট্র্যাজিক রাজা : শৌনক দত্ত কবির মৃত্যু : দিলীপ মজুমদার শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের সপ্তসঙ্গিনী : স্বামী তেজসানন্দ মহারাজ দীঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাস্টার স্ট্রোক : সন্দীপন বিশ্বাস সিঁদুরে মেঘের গর্জন : অসিত দাস শতবর্ষে অন্য বিনোদিনী — তৃপ্তি মিত্র : শৌনক দত্ত আমার প্রথম অভিনয় দেখে সত্যেন বসুই বলেছিলেন— তোর হবে : জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ইন্দ্রজিৎ আমাকে ক্লান্ত করে কেবলই ক্লান্ত : তপন মল্লিক চৌধুরী মনোজ বসু-র ছোটগল্প ‘বাঁশের কেল্লা’ গ্রেস কটেজ বুলেটিন প্রকাশ : দীপাঞ্জন দে অথ ওয়াইন কথা : রিঙ্কি সামন্ত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিকিৎসাবিভ্রাট : অসিত দাস বাংলা ইসলামি গান ও কাজী নজরুল ইসলাম : আবু বকর সিদ্দিকি
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা (গুরু পূর্ণিমা) আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

কাঙাল হরিনাথ মজুমদার : জীবন ও কর্ম : দীপাঞ্জন দে

দীপাঞ্জন দে / ৩৮১২ জন পড়েছেন
আপডেট শুক্রবার, ২ জুন, ২০২৩

কাঙাল হরিনাথ মজুমদারকে আমাদের বাংলার ‘গ্রামীণ সাংবাদিকতার জনক’ বললে অত্যুক্তি হবে না। অবিভক্ত বাংলায় কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্গত কুমারখালিতে এক দরিদ্র তিলি পরিবারে তাঁর জন্ম। দিনক্ষণ যা জানা যায়— ১২৪০ বঙ্গাব্দের ৫ শ্রাবণ (ইং ১৮৩৩ সাল)। হরিনাথ মজুমদারের পিতার নাম হলধর মজুমদার এবং মাতার নাম কমলিনী দেবী। হরিনাথের পিতা হলধরের ঊর্ধ্বতন আট পুরুষের নাম যথাক্রমে— রাজকিশোর, রামচন্দ্র, কুঞ্জবিহারী, মুকুন্দরাম, সদারাম, অখিলচন্দ্র ও গৌরসুন্দর। হরিনাথের জন্মের পরের বছরই অর্থাৎ ১৮৩৪ সালে তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। কয়েক বছরের মধ্যে তাঁর পিতাও মারা যান— ১৮৪০ সাল। শৈশবেই পিতা-মাতার মৃত্যু হওয়ায় অসহায়, অনাথ হরিনাথ তাঁর বৃদ্ধ খুল্লপিতামহীর কাছে আশ্রয়লাভ করেন। হরিনাথের জীবন খুবই সংগ্রামশীল। ১৮৪১ সালে অল্প কয়েকদিনের জন্য তিনি গ্রামের পাঠশালার পাঠ গ্রহণ করেন। অতঃপর হরিনাথ তাঁর খুল্লতাত নীলকমল মজুমদারের সহায়তায় ও আর্থিক আনুকূল্যে ১৮৪৪ সালে কুমারখালিতে একটি ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এটি ছিল কৃষ্ণধন মজুমদার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়। কিন্তু নীলকমল মজুমদারের ভাগ্য বিপর্যয়ের কারণে হরিনাথের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটে। অন্ন সংস্থান, বস্ত্র, বইপত্রের অভাবে তাঁর সেই বিদ্যালয় ত্যাগ ও পড়াশোনা বন্ধ করতে হয়। এরপর হরিনাথ মজুমদার ১৮৪৫ সালে কুমারখালি বাজারে দৈনিক দু’পয়সা বেতনে একটি কাপড়ের দোকানে চাকরি করতে থাকেন। সেখানেও সমস্যা হয়। হরিনাথের নৈতিকতা ও সত্যনিষ্ঠার কারণে অল্প দিনের মধ্যেই তাঁকে সেই চাকরি ছাড়তে হয়।

হরিনাথ ১৮৪৯ সাল নাগাদ বিদ্যাশিক্ষার উদ্দেশে একবার কলকাতায় গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও তিনি ব্যর্থ হন এবং শীঘ্রই কুমারখালিতে ফিরে আসন। তারপর ১৮৫০ সালে তিনি ৫১টি কুঠির হেডঅফিস কুমারখালির নীলকুঠিতে শিক্ষানবিশির কাজে যোগদান করেন। তবে সেখানেও পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে তিনি মানিয়ে নিতে পারেননি। সে কারণে সেখানেও বেশিদিন কাজ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। ১৮৫৪ সালের ১৭ জানুয়ারি হরিনাথ কুমারখালিতে একটি বাংলা পাঠশালা স্থাপন করেন এবং সেখানেই বিনা বেতনে শিক্ষকতা করতে থাকেন। হরিনাথের সেই বিদ্যালয় অল্পদিনেই বেশ সুনাম অর্জন করে। উড্রো, মার্টিন প্রমুখ বিদ্যালয় পরিদর্শকের বিশেষ সুপারিশে ব্রিটিশ সরকার সেই বিদ্যালয়ের জন্য অনুদানও মঞ্জুর করেন। সেই সময় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হরিনাথের মাসিক বেতন কুড়ি টাকা নির্ধারিত হয়েছিল। গুপ্তকবি ঈশ্বর গুপ্ত হরিনাথের জীবনে বড় প্রভাব ফেলেছিলেন। তাঁকে হরিনাথের সাহিত্য ও সাংবাদিকতার গুরু বলে অভিহিত করলে ভুল হবেনা। ঈশ্বর গুপ্ত হরিনাথের লেখা কবিতা ও রচনাগুলি সংশোধন করে দিতেন। কাঙাল হরিনাথ ঈশ্বর গুপ্তের প্রেরণাতেই কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন বলা যায়। ১৮৫৭ সালের ২১ অক্টোবর কবি ঈশ্বর গুপ্ত সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় হরিনাথ মজুমদারের একটি প্রাথমিক রচনা প্রকাশিত হয়েছিল, যার শিরোনাম ছিল ‘টাকা’। এটি ছিল হরিনাথের একটি দীর্ঘ নীতিকবিতা।

হরিনাথের সাহিত্য জীবনের অন্যতম স্মরণীয় কীর্তি হল ‘বিজয়-বসন্ত’, যেটি ১৮৫৯ সালে (১৭৮১ শকাব্দ) প্রকাশিত হয়। এই ‘বিজয়-বসন্ত’-ই বাংলা সাহিত্যে ‘নীতিগর্ভ উপাখ্যান’ হিসেবে চিহ্নিত। উল্লেখ্য, ‘বিজয় বসন্ত’ প্রথমে পদ্যে রচিত হয়েছিল, কিন্তু সেটি প্রকাশ পায়নি। কাঙাল হরিনাথের যৌবনকালে এই গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। এটি তাঁর সাহিত্যকীর্তির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বললে ভুল হবে না। হরিনাথের শিষ্য ও প্রথম জীবনীকার জলধর সেন ‘বিজয়-বসন্ত’ প্রসঙ্গে বলেছেন— “যখন দয়ারসাগর পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্ত মহাশয় সুললিত বাঙ্গলা গদ্যে পুস্তকাদি প্রণয়ন করেন, সেই সময়ে হরিনাথ নদীয়া জেলার একখানি ক্ষুদ্র গ্রামে বসিয়া বিজয়বসন্ত রচনা করেন। হরিনাথ ইংরাজী জানিতেন না, ইংরাজী গ্রন্থের কোন ভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া পুস্তক লেখা তাঁহার ঘটিয়া উঠে নাই; তিনি স্বীয় প্রতিভাবলে সেই সময়ে বিজয়বসন্ত প্রকাশিত করিয়া পাঠকসমাজের মনোরঞ্জনে সমর্থ হইয়াছিলেন।” বাংলাসাহিত্যের প্রথম উপন্যাস হিসেবেও ‘বিজয়-বসন্ত’-কে চিহ্নিত করা হয়। প্রসঙ্গত লেখক শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে লিখেছেন— “কুমারখালীর হরিনাথ মজুমদারের প্রণীত ‘বিজয়বসন্ত’ ও টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাঙ্গালার প্রথম উপন্যাস। তন্মধ্যে বিজয়বসন্ত তৎকাল-প্রচলিত বিশুদ্ধ সংস্কৃতবহুল বাঙ্গালাতে লিখিত।”

১৮৫৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি পত্রে হরিনাথের প্রতিষ্ঠিত বাংলা পাঠশালার সাফল্য সংবাদ পরিবেশিত হয়েছিল। ১৮৬০ সালে হরিনাথের ভদ্রাসনের চণ্ডীমণ্ডপগৃহে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয় এবং সেখানে তিনি শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৬২ সালে (১২৬৯ ব.) তাঁর বালকপাঠ্য পদ্যপুস্তক ‘পদ্যপুণ্ডরীক’ প্রকাশিত হয়। ১২৬৯ সনের মাঘ মাসে হরিনাথ রচনা করেন ‘দ্বাদশ শিশুর বিবরণ’, এটি ছিল ছোটদের বই, যাতে ছিল ছন্দে শিশুপাঠ্য মনীষীদের জীবনকথা।

হরিনাথ মজুমদারের জীবনে ১৮৬৩ সাল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সেই বছর এপ্রিল মাসে (১ বৈশাখ ১২৭০ বঙ্গাব্দ) কলকাতা থেকে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ নামে মাসিক পত্রিকা প্রথম প্রকাশ পায়। ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ মাসিক, পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে কয়েকটি পর্যায়ে মোট ২২ বছর চলেছিল। ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ প্রথমে কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্নের বিদ্যারত্ন যন্ত্রে মুদ্রিত হত। ১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৬ বৈশাখ হরিনাথের বালকপাঠ্য পদ্যপুস্তক ‘চারুচরিত্র’ প্রকাশিত হয়। ‘দ্বাদশ শিশুর বিবরণ’-এর নাম পরিবর্তন করে পুনর্মুদ্রণ ছিল এটি। ১৮৬৫ সাল (আষাঢ় ১২৭১ বঙ্গাব্দ) থেকে পাক্ষিক ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ প্রকাশ পেতে শুরু করে। ১৮৬৬ সালে (মাঘ, ১২৭২) হরিনাথের বালকপাঠ্য কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতাকৌমুদী’ প্রকাশিত হয়। এরপর ১৮৬৭ সালে হরিনাথের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘কুমারখালী সভা’। কৃষক ও পল্লীবাসীর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এই সভা স্থাপিত হয়েছিল। ১৮৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর ‘বিজয়া’ (পাঁচালি) গ্রন্থটি প্রকাশ পায়। ১৮৭০ সালে (বৈশাখ ১২৭৭) সাপ্তাহিক ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ ভূমিষ্ট হয়। একই বছরে তাঁর দক্ষযজ্ঞ বিষয়ক কাহিনী ‘কবিকল্প’ প্রকাশ পায়। ১৮৭৩ সালের ১৬ এপ্রিল (বৈশাখ, ১২৮০ বঙ্গাব্দ) হরিনাথের ‘অক্রুরসংবাদ’ (গীতাভিনয়) প্রকাশিত হয়। হরিনাথ ১২৮০ বঙ্গাব্দে কুমারখালিতে রাজীবলোচন মজুমদারের সহায়তায় ‘মথুরানাথ যন্ত্র’ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। অতঃপর এই প্রেস থেকেই ‘গ্রামবার্ত্তা’ মুদ্রণের ব্যবস্থা হয়।

১৮৭৩ সালে সিরাজগঞ্জের প্রজাবিদ্রোহে তিনি প্রজা-পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন এবং ‘গ্রামবার্ত্তা’ পত্রিকাটির মাধ্যমে সেই প্রজাবিদ্রোহে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। ‘গ্রামবার্ত্তা’ ছিল ভূস্বামী জমিদারদের অত্যাচার ও উৎপীড়নের বিপক্ষে দরিদ্র কৃষকদের হয়ে কথা বলার একক মুখপত্র। ১৮৭৪ সালে দেশে দুর্ভিক্ষের সময় তিনি ‘গ্রামবার্ত্তা’য় গদ্য ও পদ্য রচনার মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। ১৮৭৬ সালে (বৈশাখ ১২৮৩) হরিনাথ রচিত অন্যতম উপন্যাস ‘চিত্তচপলা’ প্রকাশ পায়। ১৮৭৮ সালে (১২৮৫ ব.) হরিনাথের ‘সাবিত্রী নাটিকা’ (গীতাভিনয়) প্রকাশ পায়। উল্লেখ্য, ১২৮৫ সনের ২১ চৈত্র হরিনাথ তাঁর সাহিত্যশিষ্য ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়কে লিখিত পত্রে শিলাইদহের ঠাকুর জমিদারদের প্রজাপীড়নের কথা বলেছিলেন। সাহসী সাংবাদিক হরিনাথ ‘গ্রামবার্ত্তা’য় সে বিষয়ে লিখেও ছিলেন। ১৮৭৯ সালে হরিনাথের জীবনে আরেকটি সংকট দেখা দেয়। ১২৮৬ সনের বৈশাখ মাসে সাপ্তাহিক ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ বন্ধ হয়ে যায়। আর মাসিক ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’-র শেষ সংখ্যা প্রকাশ পেয়েছিল ১২৮৮ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে। এই সংখ্যায় কাঙাল হরিনাথ ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ বন্ধের কারণ স্পষ্ট ভাষায় লেখেন— “গ্রাহকগণ রীতিমত সময়ে গ্রামবার্ত্তার দেয় মূল্য না দেওয়াই যে ইহা বন্ধ হইবার প্রধান কারণ, তাহা, বোধহয়, কাহাকেও বুঝাইয়া দিতে হইবে না।”

১৮৮০ সালে বাউলসাধক লালন সাঁই কুমারখালিতে কাঙাল কুটিরে এসেছিলেন বলে জানা যায়। সে বছরই ‘ফিকিরচাঁদ ফকির’-এর বাউল গানের দল গঠিত হয়। ১৮৮২ সালে হরিনাথের জীবনে আরেকটি পর্যায় দেখতে পাওয়া যায়। ১২৮৯ সনের বৈশাখ মাসে সাপ্তাহিক ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পুনরায় প্রকাশ পায়। ১৮৮৪ সালে (১১ মাঘ ১২৯১) হরিনাথ ‘ফিকিরচাঁদ ফকিরের দল’ নিয়ে কলকাতায় সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের উৎসবে যোগদান করেছিলেন। সেখানে তিনি সাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সাহচর্য ও আতিথ্যলাভ করেছিলেন। ১৮৮৪ সালের ২ ডিসেম্বর ভারতের বড়লাট লর্ড রিপনের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রাক্কালে হরিনাথ রিপন-প্রশস্তি রচনা করেছিলেন। এমনকি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের জন্য ‘ফিকিরচাঁদ দল’ নিয়ে পোড়াদহ রেল-স্টেশনে উপস্থিত পর্যন্ত হয়েছিলেন। কাঙাল হরিনাথ ১৮৮৫ সালে (মাঘ ১২৯২ ব.) সাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর আমন্ত্রণে ‘ফিকিরচাঁদ ফকিরের দল’ নিয়ে ঢাকা ব্রাহ্মসমাজের মাঘোৎসবে যোগদান করতে গিয়েছিলেন। বঙ্কবিহারী করের ‘পূর্ব্ব বাঙ্গালা ব্রাহ্মসমাজের ইতিবৃত্ত’ থেকে জানা যায় যে, সে সময়ে ফিকিরচাঁদ দলের ভক্তিভাবপূর্ণ কীর্তন ও সঙ্গীত নাকি ঢাকার নরনারীর উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। ফিকিরচাঁদ দলের কীর্তন ঢাকার মানুষদের মধ্যে ভক্তিস্রোতের প্রবাহ ঘটিয়েছিল। কাঙাল হরিনাথের জীবনে ১৮৮৫ সালেই এক বড় আঘাত নেমে আসে। ১২৯১ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে সাপ্তাহিক ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ মুদ্রণ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।

১৮৮৬ সালে অর্থাৎ ১২৯৩ বঙ্গাব্দে ‘কাঙাল-ফিকিরচাঁদ ফকিরের গীতাবলী (১ম খণ্ড)’ প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, প্রথমে ১২৯৩ থেকে ১৩০০ সন পর্যন্ত কাঙাল-ফিকিরচাঁদ ফকিরের গীতাবলী ১২ পৃষ্ঠা করে ১৬ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে এর এক থেকে বারো খণ্ড একসঙ্গে ‘প্রথম ভাগ’ হিসেবে প্রকাশিত হয় ১২৯৪ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে। অবশিষ্ট তেরো থেকে ষোলো খণ্ড আবার ‘দ্বিতীয় ভাগ’ হিসেবে প্রকাশিত হয় ১৩০০ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে। ১৮৮৭ সালে (১২৯৪ ব.) কাঙাল হরিনাথের ধর্ম ও সাধনতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ ‘ব্রহ্মাণ্ডবেদ’ প্রথম খণ্ড বা ভাগটি প্রকাশিত হয়। তাঁর ‘ব্রহ্মাণ্ডবেদ’ ১৩০২ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত ছয়টি ভাগে বা খণ্ডে প্রকাশিত হয়। যার প্রত্যেকটি খণ্ড বারোটি সংখ্যায় বিভক্ত। ১৮৯০ সালে (১৫ বৈশাখ ১২৯৭ ব.) মীর মশাররফ হোসেনের ‘হিতকরী’ (পাক্ষিক) পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকা প্রকাশের পশ্চাতে কাঙাল হরিনাথের প্রেরণা ও সহযোগিতা ছিল। ১৮৯২ সালে হরিনাথের (১২৯৯ ব.) ‘কৃষ্ণকালী-লীলা’ (পাঁচালি) প্রকাশিত হয়। এছাড়াও কাঙাল হরিনাথ একাধিক পাঁচালি রচনা করেছিলেন, যার মধ্যে অন্যতম হল— কংসবধ পাঁচালি, প্রভাসমিলন পাঁচালি, নন্দবিদায় পাঁচালি, পাষাণোদ্ধার পাঁচালি, রামলীলা পাঁচালি, শিববিবাহ পাঁচালি, নিমাই সন্ন্যাস পাঁচালি, শুম্ভ-নিশুম্ভ বধ পাঁচালি, অশোক পাঁচালি প্রভৃতি। ১৮৯৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর (১৩০২ ব.) হরিনাথের ‘অধ্যাত্ম-আগমনী’ (সঙ্গীত) প্রকাশ পায়। তাঁর সাধনতত্ত্বের ইতিবৃত্ত ‘মাতৃ-মহিমা’ গ্রন্থটিও সে বছরই রচিত হয়, যেটি প্রকাশ পায় ১৩০৪ বঙ্গাব্দে। কাঙাল হরিনাথ তাঁর ‘মাতৃ-মহিমা’ গ্রন্থে একটি গানে তাঁর পিতৃমাতৃহীন অসহায় অবস্থার কথা এভাবে লিখেছিলেন—

মাতা পিতা ও হারায় শিশুকালে।

ও তার দুঃখে দিন গত, চিরদিন সে ত,

দীনহীন কাঙ্গাল ও মহীমণ্ডলে॥…

মা গো, নিজ মুখে আমার নাম রেখে হরি,

শিশুকালে আমায় গেলে পরিহরি,

মা গো, তার পরে পিতা, হরিলেন বিধাতা,

দুঃখের কথা স্মরি, ভাসি নয়নজলে॥…

১৩০২ বঙ্গাব্দের ২২ চৈত্র (ইং ১৮৯৬ সাল) কাঙাল হরিনাথ গুরুতর অসুস্থ হন। এমনকি হরিনাথের মৃত্যুআশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। যদিও সে যাত্রায় তিনি সাময়িক রক্ষা পান। কিন্তু শেষ হতে দেরি ছিল না। ঠিক তার পরের মাসেই কাঙাল হরিনাথ ইহলোক ত্যাগ করেন। ১৩০৩ বঙ্গাব্দের ৫ বৈশাখ (ইং ১৮৯৬ সালের ১৬ এপ্রিল) বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে তিনটেয় কুমারখালির কাঙাল কুটিরে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেইদিন সন্ধ্যায় কুমারখালি শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। মৃত্যুকালে কাঙাল হরিনাথের বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। কাঙাল হরিনাথের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে শ্রীশরৎচন্দ্র শর্ম্মা ‘হরিনাথ মজুমদার’ নামে একটি চতুর্দশপদী কবিতা রচনা করেছিলেন, সেটি এখানে লিপিবদ্ধ করা হল—

যখন বঙ্গের গ্রামের দীন প্রজাগণ

উৎপীড়ন অত্যাচার নীরবে সহিত;

না জানিত রাজদ্বারে করিতে রোদন,

নিজের অভাব নিজে বুঝিতে নারিত;

সে সময়ে হরিনাথ বীরের মতন,

অনন্য-সহায়, ঘোর যুদ্ধে দাঁড়াইলা;

লেখনী সম্বলমাত্র, নির্ভীক হৃদয়ে,

জীবনের দীর্ঘকাল একাকী যুঝিলা।

বারেক কর্ত্তব্য-বোধ, নরপ্রীতি আর,

মানবহৃদয়ে মূল করিলে বিস্তার,

একক দরিদ্র কেহ কি করিতে পারে,

হরিনাথ ‘গ্রামবার্ত্তা’ নিদর্শন তার

শিক্ষক, রক্ষক, যোগী, ত্রিকালে ত্রিবেশ,

যৌবনে, বার্দ্ধক্যে, প্রৌঢ়ে, দীপ্ত উপদেশ।

১৩০৮ বঙ্গাব্দে বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে ‘হরিনাথ গ্রন্থাবলী (১ম খণ্ড)’ প্রকাশিত হয়। যার অন্তর্ভুক্ত গ্রন্থগুলি ছিল— পরমার্থ-গাথা, বিজয়-বসন্ত, দক্ষযজ্ঞ, বিজয়া, অক্রুর সংবাদ, ভাবোচ্ছ্বাস এবং ফিকিরচাঁদের বাউলসঙ্গীত। কাঙাল হরিনাথের অধিকাংশ রচনাই এযুগে দুষ্প্রাপ্য। তিনি প্রায় চল্লিশটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সবকটি যদিও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। তাঁর একাধিক অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি ছিল। যেমন তিনি শেষ জীবনে একটি সুবৃহৎ ‘আত্মচরিত’ লিখেছিলেন। যেখানে তাঁর ব্যক্তি জীবনের বহু তথ্য, সাংবাদিক জীবনের কথা, ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’-র কথা, কুমারখালির ইতিবৃত্ত সহ বহু বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ ছিল। কিন্তু সেটি প্রকাশিত হয়নি। তাঁর পুত্রের কাছে সেটি সযত্নে ছিল। কাঙাল হরিনাথের বেশ কয়েকটি রচনা ধারাবাহিকভাবে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল, যেগুলিও অগ্রন্থিত রয়ে যায়। তিনি একাধারে যেমন নীতিশিক্ষামূলক রচনা লিখেছিলেন, তেমনি একাধিক সামাজিক বিষয়ে রচনা, শিশুপাঠ্য বিষয়ক রচনা, ধর্ম বিষয়ে বিনোদনমূলক রচনা, সাধনতত্ত্বের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং সাহিত্য-রসাশ্রিত রচনা লিখেছিলেন। ইতিপূর্বে কাঙাল হরিনাথ সম্পর্কে এপার বাংলা ও ওপার বাংলায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ মুদ্রিত হয়েছে। তবুও তাঁর সম্পর্কে ও তাঁর রচনাগুলি নিয়ে আরো অনেক বিশ্লেষণাত্মক চর্চা বিশেষ প্রয়োজন বলে মনে করি। এই নিবন্ধে যুগপুরুষ কাঙাল হরিনাথের জীবন ও কর্ম নিয়েই মূলত আলোকপাত করার চেষ্টা করা হল।

লেখক: আঞ্চলিক ইতিহাস লেখক, নদিয়া।


আপনার মতামত লিখুন :

5 responses to “কাঙাল হরিনাথ মজুমদার : জীবন ও কর্ম : দীপাঞ্জন দে”

  1. বিশ্বজিৎ রায় says:

    অসাধারণ তথ্য সমৃদ্ধ একটি লেখা। সাথে দুষ্প্রাপ্য ছবিগুলির ব্যবহার সমগ্র লেখটিকে সংগ্রহযোগ্য একটি রচনায় পরিণত করেছে উন্নীত করেছে।
    লেখাটির বহুল প্রচলন কামনা করি।
    আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।
    শেয়ার করছি।

  2. Roshni says:

    এত তথ্যবহুল নিবন্ধ, সত্যিই প্রসংশনীয়।

  3. Dipankar Das says:

    কাঙাল হরিনাথকে নিয়ে তোমার এই প্রবন্ধ খুবই মনোগ্রাহী হয়েছে, দীপাঞ্জন..

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন