তিনি দেশেও নেই, রাত আটটায় তাঁকে টিভিতেও দেখা যায়নি, জাতির উদ্দেশে ভাষণও দেননি পরিবর্তে ২ হাজার টাকার নোট তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানালো রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া বিজ্ঞপ্তি দিয়ে। সাড়ে ছ’বছর আগে কালো টাকা হটানোর নামে দামামা বাজিয়ে ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে তার বদলে বাজারে আনা হয়েছিল ২০০০ টাকার নোট। নাজেহাল হতে হয়েছিল দেশবাসীকে। তাহলে আবার কেন তা বাজার থেকে তুলে নেওয়া? তার মানে কালো টাকা, দুর্নীতি কোনও কিছু থেকেই ভারত এই সাত বছরে মুক্তি পায়নি। এবার হয়তো সেই কারণেই সেদিনের মতো ঘটা করে প্রকাশ না করে যেন বেশ নিচু স্বরেই আরবিআই বিজ্ঞপ্তিতে সিলমোহর দেওয়া হল। এবার গোটা জাতিকে আর তিনি ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড় করাচ্ছেন না, ২ হাজার টাকার নোট থাকলে, তা ২৩ মে থেকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ব্যাঙ্কে জমা করা যাবে।
প্রসঙ্গত, আরবিআই আইন ১৯৩৪ সালের ২৪ (১) ধারা অনুসারে ২০১৬ সালে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিলের পরেই চালু করা হয়েছিল ২০০০ টাকার নোট। সেই সঙ্গে দাবি করা হয়েছিল, এই নোটের নকশা খুবই সুক্ষ্ম ও অতিরিক্ত সুরক্ষিত, যা নকল করা খুব কঠিন। বস্তুতপক্ষে সেই থেকে বাজারে নকল দু হাজার টাকার নোটের সন্ধান মিলেছে কী? জানা নেই। বরং বাজারে খুচরো টাকা মাঝে মধ্যেই অমিল হয়েছে, সেই কারণে দু হাজার টাকার নোট নিয়ে সাধারণ মানুষকে সমস্যায় পড়তে হয়েছে ফলে ওই নোটের জনপ্রিয়তা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ফলে সাত বছর পেরতে না পেরতেই ২০০০ টাকার নোটের যাত্রা শেষ করতে হল। অথচ বহু সাধারণ মানুষ বাতিল নোট জমা দেওয়ার লাইনে মারা গিয়েছিলেন। ছোটখাট ব্যবসায়ীরা পথে বসেছিলেন। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছিলেন। ২০১৭ সাল থেকে দেশটির প্রবৃদ্ধির হারও কমতে শুরু করে। এই সব কারণে অনেক অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, নোট বাতিলের কারণে দেশের অর্থনীতি গতি হারিয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে নোট বাতিলের নোট বাতিলের পর বিরোধীরা মোদীর ওই পদক্ষেপকে তীব্র সমালোচনার পাশাপাশি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। কেন্দ্র সরকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ৫৮টি আবেদন করা হয়েছিল। আবেদনকারীদের যুক্তি ছিল, এই ধরণের সিদ্ধান্তে পৌঁছানর আগে ভবিষ্যতের স্বার্থে এই ধরনের প্রক্রিয়ার ত্রুটি বিচ্যুতি দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। অন্যদিকে কেন্দ্র সরকারের যুক্তি ছিল, ঘড়ির কাঁটা পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়া যায় না। আদালত মোদীর ওই সিদ্ধান্তের যাবতীয় বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছে চলতির বছরের শুরুতে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সেই সময়ের নোট বাতিলের সিদ্ধান্তকে বৈধ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এবারের নোট বাতিল নিয়ে রাজনৈতিক নেতারা তীব্র সমালোচনা (বিরোধীরা) করলেও অধিকাংশ অর্থনীতিবীদরা মনে করছেন দু-হাজার টাকার নোট বাতিল হলেও তার চাপ সাধারন মানুষের উপর সেই ভাবে পড়বে না৷ কারণ, দু-হাজার টাকার নোট সাধারণ মানুষের কাছে খুব বেশি নেই। কারণ আরবিআই ইতিমধ্যেই ২০০০ এর নোট ছাপা বন্ধ করে দিয়েছে। যা ছাপা হয়েছিল সেই নোট ইন সার্কুলেশন ধীরে ধীরে অবলুপ্তির পথেই গিয়েছিল। ব্যাঙ্কে বা এটিএম কিংবা কাউন্টারেও পাওয়া যাচ্ছিল না। তাঁরা জানাচ্ছেন, এই মুহূর্তে দেশের বাজারে থাকা ২০০০ টাকার নোটের মোট আর্থিক পরিমাণ ২১, ৪২০ লক্ষ কোটি টাকা৷ কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, জাল রুখতে নতুন নোটে যদি চিপ লাগানোই থাকে তাহলে আচমকা তা কাদের স্বার্থে বাতিল করা হচ্ছে?
আর্থিক সংস্থা এলঅ্যান্ডটি ফাইন্যান্স জানাচ্ছে, আরবিআই ২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ঝামেলায় পড়বেন যারা অনেক বেশি বড় টাকার নোট জমিয়ে রেখেছেন তারা। যদিও জমানো নোট তারা আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ব্যাংকে জমা করতে পারবে। এই সংস্থার কথা অনুযায়ী বাজার থেকে দুই হাজার টাকার নোট সরিয়ে নিলে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। কিন্তু গবেষণা সংস্থা কুয়ান্টইকো মনে করছে, নতুন করে নোট বাতিল হলে ছোট ছোট ব্যবসায়ী, কৃষক, নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে জড়িত নিত্য রোজগেরে মানুষ নগদ লেনদেনে জড়িত থাকার কারণে সমস্যায় পড়তে পারেন। অর্থনীতিবিদরা গত ৬-৭ বছরে ডিজিটাল লেনদেন ও ই-কমার্সের পরিধি অনেক বেড়েছে বলে যতই চেঁচান না কেন দেশের সর্বত্র ডিজিটাল লেনদেন সেভাবে জনপ্রিয় হয়নি। যে কারণে কাগজের টাকার চাহিদা বা ব্যবহার এখনও রোয়ে গিয়েছে। হতে পারে ২০০০ টাকার নোটের ব্যবহার কম এবং এই নোট মজুদ রাখার কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে, কিন্তু মজুত রাখছে কারা? তাছাড়া ঠিক কি কারণে আরবিআই খুব ক্ষীণ ভাবে দু-হাজার টাকার নোট বাতিলের পদক্ষেপ করল সেটাও স্পষ্ট করলো না।