‘ময়নামতীর চরে’ ‘সোনার তরী-র কবি
পাবনা জেলার রাধানগর গ্রামের মুনশি উমেদ আলির ছেলে বন্দে আলি মিয়া ম্যাট্রিক পাশ করে কলকাতা এসেছেন। কলকাতা আর্ট একাদেমিতে ভর্তি হয়েছেন। কবিতা লেখার হাত ছিল। সেই ক্লাশ নাইন থেকে তার শুরু। বছর কয়েক বাদে প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘অনুরাগ’। ততদিনে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। কবিতার বই যখন বেরিয়েছে তখন তা কবিগুরুকে না দিলে নয়।
‘অনুরাগ’ হাতে নিয়ে বন্দে আলি চলে এলেন বরানগরে। এখানে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের বাসায় আছেন কবি। সেখানে গিয়ে বন্দে আলি শুনলেন রবীন্দ্রনাথ ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাশয়ের সঙ্গে কথা বলছেন। শীল মহাশয় নেমে আসতে বন্দে আলি উঠলেন দোতলায়। সিঁড়ির মুখে উত্তরদিকের বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বন্দে আলি কদমবুশি করে ‘অনুরাগ’ হাতে দিলেন কবির। কবি বইটির পাতা উল্টাতে লাগলেন। বারান্দার ওপাশে ছিল একটা টেলিফোন। সেটা বেজে উঠল। কবি নিজে গিয়ে ধরলেন টেলিফোন। সেই দীর্ঘ সুঠাম দেহ দেখে বন্দে আলির মনে হল তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন যিশুখ্রিস্ট।
‘অনুরাগ’ প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। ওই সালেই প্রকাশিত হল বন্দে আলির ‘ময়নামতীর চর’। এই কাব্যটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। গ্রামবাংলার অপরূপ ছবি ফুটে উঠেছে সেখানে : —
বর্ষার জল সরিয়া গিয়াছে জাগিয়া উঠেছে চর,
গাঙ শালিখেরা গর্ত খুঁড়িয়া বাঁধিতেছে সবে ঘর।
গহিন নদীর দুই পাড় দিয়া আঁখি যায় যত দূরে
আকাশের মেঘ অতিথি যেন গো তাহারি আঙিনা জুড়ে।
মাছরাঙা পাখি একমনে চেয়ে কঞ্চিতে আছে বসি
ঝাড়িতেছে ডানা বন্য হংস , পালক যেতেছে খসি।
বন্দে আলি তাঁর এই বইটাই রবীন্দ্রনাথের হাতে তুলে দিতে চান। সোনার বাংলার রূপে বিভোর কবির এ কাব্য সম্পর্কে অভিমত চান ‘ময়নামতীর চরে’র কবি।
একদিন দুপুরবেলা শিল্পীবন্ধু ধীরেন্দ্রনাথ বলকে সঙ্গে নিয়ে বন্দে আলি চললেন বোলপুরের উদ্দেশ্যে। রবীন্দ্রনাথ তখন বোলপুরে ছিলেন। বোলপুরে তাঁরা পৌঁছালেন রাত তিনটেয়। মাইল দেড়েক দূরে শান্তিনিকেতন। ম্লান আলো আছে চাঁদের। যেতে পারেন হেঁটে। কিন্তু এত রাতে গেলে সেখানকার মানুষকে বিব্রত করা হবে। তাই তাঁরা শুয়ে পড়লেন ওয়েটিং রুমে। সকালে বেরিয়ে পড়লেন শান্তিনিকেতনের দিকে।
সুধাকান্তবাবু তাঁকে জানালেন, বিকেলে দেখা হবে কবির সঙ্গে।
বিকেলে তাঁরা হাজির হলেন উত্তরায়ণে। রবীন্দ্রনাথ ইজি চেয়ারে শুয়ে কি একটা বই পড়ছিলেন। তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে বসলেন তাঁরা। কাগজের মোড়ক খুলে ‘ময়নামতীর চরে’র ছাপানো ফর্মাগুলো রবীন্দ্রনাথের হাতে তুলে দিলেন বন্দে আলি। রবীন্দ্রনাথ পাতা উল্টাচ্ছেন ফর্মাগুলির, ময়নামতীর চরে ঘুরছে তাঁর চোখ : —
এই চরে ওই হালটার কোণে বিঘে দুই খেত ভরি
বট ও পাকুড়ে দোঁহে ঘিরে ঘিরে করি আছে জড়াজড়ি।
গাঁয়ের লোকেরা নতুন কাপড় তেল ও সিঁদুর দিয়া
ঢাক ঢোল পিটি গাছ দুইটির দিয়ে গেছে না কি বিয়া।
নতুন চালুনি ভেঙে গেছে তার , মুছি আর কড়িগুলা
রাখাল ছেলেরা নিয়ে গেছে সব ভরি গামছায় ঝুলা।
চড়কের মেলা এই গাছতলে হয় বছরের শেষে
সে দিন যেন গো সারা চরখানি উৎসবে ওঠে হেসে।
বন্দে আলির কবিতার ভাব ও ভাষা ভালো লেগেছিল রবীন্দ্রনাথের। তিনি বন্দে আলি মিয়ার কাব্য সম্পর্কে লিখলেন : —
“তোমার ‘ময়নামতীর চর’ কাব্যখানিতে পদ্মাচরের দৃশ্য এবং তার জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ ছবি দেখা গেল। তোমার রচনা সহজ এবং স্পষ্ট , কোথাও ফাঁকি নেই। সমস্ত মনের অনুরাগ দিয়ে তুমি দেখেছ এবং কলমের অনায়াস ভঙ্গিতে লিখেছ। তোমার সুপরিচিত প্রাদেশিক শব্দগুলি যথাস্থানে ব্যবহার করতে তুমি কুণ্ঠিত হও নি, তাতে করে কবিতাগুলি আরও সরস হয়ে উঠেছে। পদ্মাতীরের পাড়াগাঁয়ের এমন নিকট স্পর্শ বাংলাভাষায় আর কোন কবিতায় পেয়েছি বলে আমার মনে পড়ে না। বাংলা সাহিত্যে তুমি আপন বিশেষ স্থানটি অধিকার করতে পেরেছ বলে আমি মনে করি। ২৬ জুলাই, ১৯৩২”।
এই কাব্যগ্রন্থে ‘কলমিলতা’ বলে একটা কবিতা আছে। এ সম্পর্কে একটি নতুন তথ্য পাওয়া যাবে ‘সাহিত্যবার্তা’ পত্রিকায় প্রকাশিত মুরশাদ সুবহানির ‘ময়নামতীর চর খ্যাত কবি বন্দে আলি মিয়া একজন সব্যসাচী ‘লেখক’। তিনি জানিয়েছেন, “কবি বন্দে আলি মিয়া ‘ময়নামতীর চর’ কাব্যগ্রন্থ বিষয়ে কবিগুরুর অভিমত সংগ্রহ করে বিদায় নেবার আগে বলেছিলেন, তাঁর ‘কলমিলতা’ বইটি প্রেসে আছে এবং সেখানা তিনি কবিকে উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, ‘কলমিলতা’ বইটি পাওয়া যায় নি। প্রশ্ন জাগে সেটি কি প্রকাশিত হয় নি? না কি প্রেস থেকে এর ছাপালিপি রবীন্দ্র-বিদ্বেষী কেউ সরিয়ে ফেলেছেন? নানা কর্মে ব্যস্ত বন্দে আলি মিয়া জানতে পারেন নি”।
আমরা জানি রবীন্দ্র-বিদ্বেষ প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়েছিল লাহোর প্রস্তাবের পরে, হুমায়ুন আজাদ কথিত ‘পাকিস্তানবাদী সাহিত্যতত্ত্বের’ উদ্ভবের মাধ্যমে। মুরশাদের লেখা থেকে জানা যাচ্ছে , ১৯৩২ সালেও ছদ্মবেশী রবীন্দ্র-বিদ্বেষ ছিল।
বন্দে আলির স্মৃতিকথায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের আর একটি বিবরণ পাওয়া যায়। এই সাক্ষাৎকার হয়েছিল বরানগরে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ‘শশিভিলায়’।
দোতলার প্রশস্ত হল ঘরের এক প্রান্তে টেবিলের সম্মুখে বসে রবীন্দ্রনাথ লিখছিলেন। বন্দে আলি তাঁকে প্রণাম করে বসলেন। কবি বললেন, ‘অনেক দিন পরে এলে। খুব লিখছ আজকাল। কাগজ খুললে প্রায়ই তোমার লেখা চোখে পড়ে। লজ্জিত হয়ে বন্দে আলি হাসলেন একটু। বিনীতভাবে বললেন, ‘লেখা ছাড়া কোন কাজ করতে ইচ্ছা হয় না। একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে এসেছিলুম’।
—‘বলো। ‘
—‘বাড়ির মেয়েরা আপনাকে দেখতে চায়। কখন তাদের আনতে পারি, কখন আপনার সময় হবে?’
—‘পরশু ইউনিভার্সিটিতে যেতে হবে। কাল আনতে পারো। দুপুরের দিকে।
পরের দিন দুপুরবেলায় বন্দে আলি ও তাঁর এক বন্ধু সস্ত্রীক উপস্থিত হলেন শশিভিলায়। কবি উপরের ঘরে ছিলেন। তাঁরা গিয়ে কবিকে প্রণাম করলেন। কথা প্রসঙ্গে কবি বন্দে আলির স্ত্রীকে বললেন, ‘তুমি শান্তিনিকেতন যেয়ো। সেখানকার শিক্ষাপদ্ধতি দেখলে খুশিই হবে। মুসলমান ছেলে-মেয়ে আশানুরূপ পাচ্ছি না। তোমার ভাই-বোনেদের এখানে পড়তে দিতে পারো’।
শুনে বন্দে আলির স্ত্রী মাথা নাড়লেন।
রবীন্দ্রনাথ বন্দে আলিকে বললেন, ‘দেখো, শিলাইদহের কাছারিবাড়ির কিছুটা দূরে একজন খোঁয়াড়ালা ছিল। তার জীবনকথা আমি জানি। কাহিনিটা লিখবার জন্য মনের মধ্যে আমার লোভ এখনও আছে। কিন্তু মুসলমান পরিবারের খুঁটিনাটি খবর আমার জানা নেই। অথচ গল্প লিখতে ওটা নিতান্ত অপরিহার্য। লিখলে কোথায় কি ত্রুটি থেকে যাবে, যার জন্য সমালোচকদের তীক্ষ্ণ আক্রমণ আমার ওপর হতে থাকবে। এই বুড়ো বয়েসে সেটা মোটেই প্রীতিকর নয়। সুতরাং কাহিনিটা তোমাকে বলছি, তুমি এ বিষয়ে চেষ্টা করো’।
ঋণ :
বাংলা সাহিত্যে বন্দে আলি / রশিদুল আলম। অন্তরঙ্গ আলোকে কবি বন্দে আলি মিয়া / মানসুর আল ফারুকি। কবি বন্দে আলি মিয়াকে যেভাবে চিনেছি / মির্জা আবদুর রশিদ
লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক
এই প্রবন্ধগুলো দ্রুত গ্রন্থবদ্ধ হওয়া দরকার। গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হলে কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখ না থাকা উদ্ধৃতিগুলোর সূত্র উল্লেখ করাও জরুরি।
গ্রন্থ হয়ে বের হলে আমি প্রথম ক্রেতা হতে চাই।
রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ নিয়ে বিদ্বেষজীবীদের একটি অংশের ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচার আছে। এই প্রবন্ধগুলো সংকলিত আকারে প্রকাশিত হলে সংকলন গ্রন্থটি সেই অপপ্রচারের সমুচিত জবাব হবে।
সেই গ্রন্থে ‘বন্দেমাতরম’, শ্রদ্ধানন্দ হত্যা ও ‘লোকহিত’ এবং এ জাতীয় রবীন্দ্রনাথের আরও বক্তব্য পৃথক প্রবন্ধ আকারে গ্রন্থিত হতে পারে।
অনল আবেদিন ,
আমি আসলে লিখতে চাইছি :’ রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ : গ্রহণ বর্জনের ইতিবৃত্ত’ । এতদিন যা লিখলাম সেটা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মুসলমান লেখক ও সাধারণ মানুষের সম্পর্ক । এর পরে আসবে লাহোর প্রস্তাবের পরে ‘পাকিস্তানবাদী সাহিত্যতত্ত্বের’ ( হুমায়ুন আজাদ কথিত) প্রবক্তাদের চেষ্টা , রবীন্দ্রবর্জনের চেষ্টা এবং বাংলাদেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মুসলমানদের প্রতিরোধ । রবীন্দ্রনাথের সীমাবদ্ধতা , দ্বিধাগ্রস্ততার প্রসঙ্গও আসবে । তুমি বইএর কথা বলছ , চেষ্টা করব । তবে আমার সাধের সঙ্গে সাধ্যের অসঙ্গতি আছে । তবু দেখব ।