শুক্রবার | ১৭ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৩:৩৫
Logo
এই মুহূর্তে ::
‘প্রাগৈতিহাসিক’-এর অনন্য লেখক মানিক : ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (একাদশ পর্ব) : আবদুশ শাকুর ভেটকি থেকে ইলিশ, চুনোপুঁটি থেকে রাঘব বোয়াল, হুগলির মাছের মেলায় শুধুই মাছ : রিঙ্কি সামন্ত দিল্লি বিধানসভায় কি বিজেপির হারের পুনরাবৃত্তি ঘটবে : তপন মল্লিক চৌধুরী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে রাখাইন — বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (দশম পর্ব) : আবদুশ শাকুর রামলোচন ঠাকুর ও তৎকালীন বঙ্গসংস্কৃতি : অসিত দাস দধি সংক্রান্তি ব্রত : রিঙ্কি সামন্ত বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (নবম পর্ব) : আবদুশ শাকুর সপ্তাহে একদিন উপবাস করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো : অনুপম পাল অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত’র ভাষা : ড. হান্স্ হার্ডার সবগুলো গল্পেই বিজয়ার নিজস্ব সিগনেচার স্টাইলের ছাপ রয়েছে : ড. শ্যামলী কর ভাওয়াল কচুর কচকচানি : রিঙ্কি সামন্ত বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (অষ্টম পর্ব) : আবদুশ শাকুর রামলোচন ঠাকুরের উইল ও দ্বারকানাথের ধনপ্রাপ্তি : অসিত দাস বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (সপ্তম পর্ব) : আবদুশ শাকুর যে শিক্ষকের অভাবে ‘বিবেক’ জাগ্রত হয় না : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ভিয়েতনামের গল্প (সপ্তম পর্ব) : বিজয়া দেব বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (ষষ্ঠ পর্ব) : আবদুশ শাকুর দিল্লি বিধানসভা ভোটেই নিশ্চিত হচ্ছে বিজেপি বিরোধি জোটের ভাঙন : তপন মল্লিক চৌধুরী দ্বারকানাথ ঠাকুরের গানের চর্চা : অসিত দাস মমতা বললেন, এইচএমপি ভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে দুষ্টচক্র হু জানাল চিন্তা নেই : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (পঞ্চম পর্ব) : আবদুশ শাকুর পৌষ পুত্রদা একাদশী : রিঙ্কি সামন্ত বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (চতুর্থ পর্ব) : আবদুশ শাকুর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজায় কবিগান ও যাত্রার আসর : অসিত দাস সসীমকুমার বাড়ৈ-এর ছোটগল্প ‘ঋতুমতী হওয়ার প্রার্থনা’ সামাজিক মনস্তত্ত্বের প্রতিফলনে সিনেমা : সায়র ব্যানার্জী নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘সুও দুও ভাসে’ বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (তৃতীয় পর্ব) : আবদুশ শাকুর
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই পৌষ পার্বণ ও মকর সংক্রান্তির শুভেচ্ছা আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

সৌমেন দেবনাথ-এর ছোটগল্প ‘মেঘলা মনের মেঘলা’

সৌমেন দেবনাথ / ২৭৮ জন পড়েছেন
আপডেট বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৩

দুজন মানুষের মাঝে ভীষণ পার্থক্য খুঁজে পায় মেঘলা। তার স্বামী তাকে বুঝতে চায় না, কিন্তু তার বন্ধু তাকে খুব ভালো বোঝে। তার স্বামী তাকে সময় দেয় না, কিন্তু অঢেল সময় ঢেলে দেয় তার বন্ধু। তার স্বামী ব্যস্ত থাকে, কিন্তু তার বন্ধুর কোনও ব্যস্ততা নেই। স্বামীকে সে বন্ধু করে তুলতে পারেনি, কিন্তু তার বন্ধুকে সে অনেক প্রিয় করে তুলতে পেরেছে। স্বামীর মস্তিষ্ক সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকে, মস্তিষ্ক ব্যস্ত থাকলে শরীরী উত্তেজনা হ্রাস পায়। টাকা-পয়সা, চাকরিক্ষেত্রের চিন্তা মস্তিষ্ককে গ্রাস করলে মস্তিষ্কে আর জায়গা থাকে না অনুরাগ রাখার। তাছাড়া দুজনের বয়সের পার্থক্যও দশ বছরের। একজন বাস্তবতা বোঝে, অন্যজন কল্পনায় ভাসে। একজনের আছে মনের ক্ষুধা, শরীরের ক্ষুধা প্রবল; অন্যজনের আছে অর্থের ক্ষুধা, ক্ষমতার ক্ষুধা প্রবল। কথা বলার তৃষ্ণা, শরীর ঘেঁষে লেপ্টে থাকার বাসনা স্বামীর অনিচ্ছার কাছে হেরে যায়। প্রচুর তৃষ্ণাতেও সে এক ফোঁটা জল পায় না। শরীর উষ্ণ হলেও সে একটু সোহাগ পায় না। সমমনস্ক না হয়ে উঠার কারণে উদ্বেলিত হৃদয়ের কথা সে ব্যক্ত করতে পারে না। ক্ষুধাতুর হৃদয়ে ক্ষুধা জমতেই থাকে। ব্যথাতুর হৃদয়ে ব্যথা জমতেই থাকে। উপশম দেওয়ার লোকটি কর্মক্লান্ত। প্রশান্তির ঘুম ঘুমায়। বয়স বাড়লে সাপের বিষ কমে না, মানুষের তেজ কমে যায়।

স্বপন অফিসে চলে গেলে মেঘলা বের হয়ে পড়ে শিমুলের উদ্দেশ্যে। এক সাথে ঘোরে, হোটেল-রেস্তোরেন্টে খায়। শিমুল দূরত্ব রেখে বসে। মেঘলা বলে, অনাঘাতের পুষ্প সবার কামনার বস্তু।

শিমুল মৃদু হেসে বলে, তুই কি আঘাতপ্রাপ্ত পুষ্প যে আমি এড়িয়ে চলবো?

মেঘলা দুজনের মাঝের দূরত্ব মেপে বলে, অন্যের এটোভাতে অনীহা জন্মানোটায় স্বাভাবিক।

শিমুল না-সূচক মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, দাহ্য বস্তু থেকে দূরে থাকা বুদ্ধিদীপ্ততার কাজ।

মেঘলা আরও কাছে সরে এসে বলে, দাহ্যতায় যৌবনের গুণ। দাহ্যতায় ভাসা সিংহের পরিচয়।

শিমুল দূরত্বটা বজায় রাখার চেষ্টা করে বলে, কামাগ্নি কেন আমার জন্য? আমি চাই হেমাগ্নি।

এই বলে শিমুল উঠে দাঁড়ায়। তা দেখে মেঘলা বলে, কী দুর্গন্ধ গেলো নাকে! পচে গিয়েছি আমি? আমার ভেতর হেমাগ্নি নেই?

শিমুল দ্বিধান্বিত হয়ে বললো, নেশা ধরানো গন্ধ কি দুর্গন্ধ হয়? তোর শরীরের ঘামগন্ধে তো আমি পতঙ্গ হয়ে ছুটি।

মেঘলা বলে, মরতে তো পারিস আমার রূপে; জ্বলিস কিন্তু মরিস না। পুড়িস কিন্তু বলিস না। আহার চিন্তায় আসিস, এসে আহার ভুলে থাকিস।

শিমুলের সঙ্গ থেকে স্বাধ আর স্বাদ মিটলো না, বাসায় ফেরে মেঘলা। ফ্রিজ ভর্তি খাদ্যসামগ্রী, আলমিরা ভর্তি পোশাক-আশাক। কোনও খাদ্যই খেতে ভালো লাগে না। কোনও পোশাকই পরতে ভালো লাগে না। নিজের পুরুষটি বাসায় এলে দৌড়ে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছা লাগে না। দ্বিধা তো ভাঙেইনি, আবার মানুষটি সহজ না। বুকের পেষণে পিষ্ট হতে মন চাইলেও বুকে টেনে নেয় না। ঠোঁটের ছোবলে বিষাক্ত, নীলাক্ত হতে চাইলেও ছোবল সে খেতে পারে না। মনের দাবি আদায়ে মেঘলা কাছে ঘেঁষতে চাইলে স্বপন বলে, দেখো, ঝোঁপঝাঁড়ে বসা প্রেমিক-প্রেমিকা নই আমরা। তোমার বাচ্চামি সহ্য হয় না আমার।

ক্ষিপ্র হয়ে মেঘলা বলে, স্ত্রীকে বঞ্চিত করায় কি স্বামীত্ব?

স্বপন শুনে বলে, অর্থ-বৈভবে থেকেও যদি বঞ্চিত বোধ হয় নিজেকে তবে বলবো পূর্ণতা পাওনি মন-মননে।

মেঘলা দ্বিধা ভেঙে বলে, অর্থ না, আমি সান্নিধ্য চাই। বৈভব না, আমি ছোঁয়া চাই। পয়সায় পুলকিত না, স্পর্শে শিহরিত হতে চাই।

স্বপন উত্তরে বলে, এই বাচ্চামো কথা বড়োই ছেলেমি। তোমার মনের বয়স বাড়লেও শরীরের বয়স বাড়েনি। নিজেকে তৈরি করো আগে।

এই বলে স্বপন অফিসার্স ক্লাবের উদ্দেশ্যে চলে গেলো। ক্লাবে না গিয়ে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসলো। পেছন পেছন সমবয়স্ক ক্লাবের এক সদস্যও এসে পাশে বসলো। স্বপন তাকে দেখে একটু হেসে বললো, ঘরের সুখের জন্য চাকরি খুঁজেছি, আজ চাকরি করি ঘরে শান্তি নেই।

লোকটি বললো, চাকরি না পাওয়ার আগের আর পাওয়ার পরের জীবনযাত্রার মান কিন্তু এক না। এখন জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। তখন থেকে এখন সুখ বেড়েছে, আশা একটু কমালেই হবে।

স্বপন দীর্ঘশ্বাস কেটে বললো, সমবয়স্কা বা শিক্ষা জীবন শেষ করা একজন মেয়েকে সংসারে আনলে সে আমার জীবন যুদ্ধের মর্ম বুঝতো। এক আনাড়ি মেয়ের ফোঁসফোঁস শুনলে ঘরে থাকতে ইচ্ছা করে না।

লোকটি বললো, আসলেই ঘরনি যদি বুঝতে না জানা হয়, তবে শান্তির দেখা মিলবে না।

স্বপন ঘরের কথা ঘুরিয়ে ফেললো। পুকুরের জলে চেয়ে বললো, পুকুর শুকিয়ে গিয়েছে, ঢেউ নেই। ঢেউ না থাকলে, স্রোত না থাকলে সাগর-নদী বা পুকুরের সৌন্দর্য থাকে না।

লোকটি হেসে বললো, বর্ষা এলে নদী গর্জন ফিরে পাবে, পুকুরেও ঢেউ বইবে। একটু ধৈর্য দরকার, একটু সহ্য দরকার। অধৈর্য হলেই পতন হবে।

স্বপন দীর্ঘশ্বাস কেটে বললো, বসন্ত এলে গাছে পাতা গজায়, গাছ সজীব হয়; কিন্তু যে গাছের বয়স বেশি সে গাছের সৌন্দর্য আর বাড়ে না।

লোকটি সহমত পোষণ করে বললো, বয়সটা আসলেই ভাবনার বিষয়। বয়স বেড়ে গেলে আফসোসের শেষ থাকে না। বয়স খুব নিষ্ঠুর, ফাঁকি দিয়ে চলেই যায়।

সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরে এলো স্বপন। স্বপনের আগমনে মেঘলার বেয়াদবিপনা বেড়ে গেলো। দুপদাপ পা ফেলে এদিক-ওদিক হাঁটছে। দেখে স্বপন বললো, আমাকে দেখলে অফিসের কর্মীরা সন্তর্পণে হাঁটে। তোমার আচরণ উদ্ধত। এত উদ্ধতপনা ভালো না।

মেঘলা বলে, কলমের খোঁচায় ক্ষতি করবেন বলে ভয় পান তাঁরা। কলমের শক্তিই দেখাতে পারবেন। আপনার নিজত্ব, নিজস্ব কোনও শক্তি নেই। ষাড়ের মতো শরীর, শরীরে নেই অনুভূতি, নেই উষ্ণতা, নেই ওম।

স্বপন কিছুক্ষণ থমকে থেকে বললো, তোমার এমন আচরণে একজন সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যাবে। তোমার আচরণে দুশ্চিন্তা বাড়ে, দুশ্চিন্তায় মানুষ নির্জীব হয়ে পড়ে। অথচ আমি তোমাকে পাশে চেয়েছিলাম আমার শক্তিবর্ধনের জন্য। তোমার ভেতরও সেই শক্তি নেই যে শক্তি দিয়ে আমাকে জাগাবে, আমাকে রাঙাবে। তোমার তৃপ্তির লাগাম টানলেই সুখ ফিরবে। যেই তৃপ্তির জন্য তুমি বিভোর, সেই তৃপ্তি মেটে না কখনো। সুখের জন্য অতৃপ্তির ডাল ছাটতে হয়।

মেঘলা বলে, আপনি কী সুখ দেবেন! আপনাকে বোঝা শেষ। আপনি পড়ন্ত বিকালের সূর্য। না পারবেন উত্তপ্ত করতে, না দেবেন আলো, না ডুববেন। শুকনো কাঠ হয়ে ভরা গাঙে ঝাঁপ দিয়েছিলেন কেন? টাকা ঢেলে মনের জ্বালা, দেহের জ্বালা নির্বাপিত করতে পারবেন? আপনার জানা ছিলো না যুবতীর খাই সম্বন্ধে?

প্রশ্নের উত্তর শোনার আগেই মেঘলা ঘরে ঢুকে দরজা এটে দিলো। শিমুলকে ফোন দিলো। নানা কথা বলতে বলতে অনেক রাত হয়ে গেলো। স্বপন ঘরে ঢুকতে পারলো না। শিমুল ফোন রাখতে চাইলেই মেঘলা বলে, তোর সাথে কথা না বললে আমি মরে যাবো। তোকে দেখলেও ভালো লাগে। তোর সাথে কথা বললেও ভালো লাগে। শরীর শীতল হয়, মন শীতল হয়।

শিমুল বলে, ডানে ঘুরলেই শীতলতার জল। বামে ধূসরতা। স্বাদুপানির জল রেখে মানুষ লবণাক্ত জলে তাকায় না। স্বাদুপানির জল এক ফোঁটা পেলেও তৃষ্ণা মেটে, লবণাক্ত জল এক সাগর থাকলেও তৃষাতুরের কাজে লাগে না।

মেঘলা রেগে বলে, তুই বেশি বলিস। স্নিগ্ধ সরসতা পেলে মানুষ কাষ্ঠ পিষে মুগ্ধতা নিতে যায় না। তোর তারুণ্যে আমি জঘন্য হবো, তবুও তাঁর জাজ্বল্যে নগণ্য হয়ে থাকবো না। তাঁর সক্ষমতার সুতো ছিঁড়ে গিয়েছে, তোর দৌরাত্ম্য দুর্দান্ত। তোর দৌর্দণ্ডপ্রতাপ ব্যতীত হবো না আমি নিমীলিত। আমি পুরুষের সাথে থাকতে চাই, আমি পুরুষ নামের কারও সাথে থাকতে চাই না।

পরেরদিন শিমুলকে বাবাংবার ডেকে তার সাথে দেখা করলো। মেঘলার সাথে দেখা করার প্রবল তৃষ্ণা ছিলো শিমুলের। কিন্তু মেঘলার ইদানীং কালের চোখের তৃষ্ণা দেখে সে ভয় পায়। সঙ্গ চাইতো যে, সে এখন কেন একান্ত ক্ষণের সঙ্গী হতে চায় তার মাথায় খেলে না। বান্ধবীর সাথে ঘোরা যায়, মনের মানুষের সাথে ঘোরা যায়, অন্যের স্ত্রীর সাথে ঘোরা যায় না। কিন্তু মেঘলা শিমুলকে ছাড়েই না। বলে, তুই খুব সাধু। বাঘ হতে পারিস না সামনে হরিণী হয়ে ঘুরি? বাসায় ফিরে আফসোস করিস, সামনে এসে শিশু সাজিস।

এসব কথা শুনে শিমুল বিভ্রান্ত হয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিতে কষ্ট হয় তার। বলে, ঠোঁট কাঁপে না বেফাঁস কথা বলতে এখন তোর?

মেঘলা বলে, অস্থির ঠোঁটকে তো ঠাণ্ডা করে দিতেও জানিস না। পুত-পবিত্র সেজে এলে কী আমার ভেতর আগুন পাবি? আগুন থেকে উত্তাপ নিতে হলে খোঁচা দিতেও জানতে হয়।

শিমুল বলে, বিয়ের আগে তো পাত্তায় দিতিস না, বিয়ের পর কেন এত গুরুত্ব দিস?

মেঘলা বিরক্ত হয়ে বললো, আমাকে সহজভাবে নিচ্ছিস না বিবাহিত বলেই? বিয়ে হয়েছে বলে কি আমি ফুরিয়ে গিয়েছি?

শিমুল বলে, তোর ঘর হয়েছে, তুই ঘর ভাঙবি কেন? একজন মানুষ তোকে বরে নিয়ে স্বপ্নজাল গড়েছেন, তুই তাঁকে ঠকাবি কেন? তোর হতাশার দিনে তোকে সঙ্গ দিয়েছি, তোর সুখের ঘর আমি বন্ধু হয়ে ভাঙি কী করে? মিশতে মিশতে তুই মিশে গিয়েছিস, আমি তো দূরত্ব রেখে মিশেছি।

মেঘলা শিমুলের সর্ব অবয়ব একপলকে দেখে বললো, তোকে দেখলে আমার ভালো লাগে। তোকে দেখলেই মনে আগুন জ্বলে। বিয়ের পরই বুঝেছি তুই-ই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরুষ। তুই ছাড়া অশান্ত মনকে আর কেউ শান্ত করতে পারবে না। ঐ লোকটি সাঁতারই জানেন না। জোয়ারে ভাসবেন কীভাবে? খরায় খাক হতে যাওয়া গাঙে তুই ছাড়া কেউ বাণ ডাকাতে পারবে না। চল আমার সাথে, তুই আমাকে পরিতৃপ্তি দিবি।

এই বলে মেঘলা শিমুলের হাত ধরে টানে। শিমুল হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, শরীরের চাহিদায় জীবনের জন্য সব না। স্বামী-শূন্যতায় কত মানুষ জীবন পার করে দিচ্ছে, কিন্তু বিবেক জলাঞ্জলি দিচ্ছে না। অল্পে তুষ্ঠ থাকলে শরীর-মন ভালো থাকে। প্রতিপক্ষ না হয়ে সহযোগী হলে জীবনের জন্য জরুরি যতটুকু তা পাবি। শত্রু না সেজে মিত্র সাজ, মিত্রের থেকে অল্প প্রাপ্তিতেও তৃপ্তি মেলে। হেয় না করে তার সাথে মিশে থাকলে তার মনোবল বাড়বে। স্বামী পেলে তার সামর্থ্যের সাথে আর কারও সামর্থ্যের তুলনা করতে নেই। তাকে সহযোগিতা করলে তার সামর্থ্য আরও বাড়বে।

শিমুল চলে গেলো। ক্ষুব্ধ হয়ে বাসায় ফিরলো মেঘলা। মেঘলার জন্য শাড়ি এনেছে স্বপন। মেঘলা দেখেও দেখলো না। শক্ত ভাষায় সে বললো, চাহিদা বুঝে যোগান দিতে হয়। চাই কী দেন কী? চাই ভাব, দেন টাকা। চাই ওম, দেন শাড়ি। চাই নরম পরশ, দেন গহনা। চাই একান্ত সময়, আর তাতেই আপনার সীমাবদ্ধতা।

স্বপন বললো, দেখো, তোমার আমার সম্পর্ক শুদ্ধতার। তুমি আমার প্রেমিকার মতো কেউ নও। তারচেয়ে বেশি, তারচেয়েও অনেক কিছু। প্রেমিকাকে গলদকরণেই প্রেমিকের প্রশান্তি। তোমার আমার সম্পর্ক শ্রদ্ধার, মর্যাদার, ভালোবাসার। তুমি চাও তোমাকে দেখলেই আমি উগ্র-উদগ্র হই, লম্পটের পরিচয় দেই, স্বামী কি কামুক, কামান্ধ? আর তুমি যে বাজখাঁই চাহিদা পেশ করো এটাও ঠিক? তোমার আমার সম্পর্ক কি দুই একটি ক্ষণের, দুই একটি দিনের? আদরে-সোহাগে বেঁচে থাকবো আমরা সারাজীবন।

মেঘলা শুনেও স্থির হয় না। অতৃপ্ত মন বাণী শুনে তৃপ্তি পায় না। সে বলে, সারাজীবন আপনার সাথে থাকতে হবে? আমার শখ নেই? ইচ্ছা নেই? সন্তুষ্টি নেই? তারুণ্যকে আমি জলাঞ্জলি দেবো? নির্জীব নদীকে মরে যেতে হয়। নির্জীব নদীতে কেউ শরীর ভাসায় না। রোজগার শিখেই যদি বিয়ে করবেন, সমবয়েসীকে বিয়ে করেননি কেন? ডাগরে নজর যায় কেবল? আপনি জানতেন না আপনার ক্ষমতার বহর? আপনি জানতেন না বিশোর্ধ্বদের স্রোতাবেগ?

স্বপন বুঝতে পারছে মেঘলার মুখে লাগাম নেই, সামাজিকভাবে মর্যাদাহানীকর মুহূর্তের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে সে। তাই মেঘলাকে না রাগিয়ে বোঝাতে ব্যপ্ত হলো। বললো, তোমাকে সুখী করার আপ্রাণ চেষ্টা আছে আমার।

রেগে গিয়ে মেঘলা বলে, আপনার চেষ্টার দৈর্ঘ্য আমার জানা। সবলতা দেখিয়ে বেড়ান, দুর্বলতা আমার জানা। নিরামিষ খেয়ে নিরাবেগের দেহ গড়েছেন। আমিষে আসক্ত আমি, আমার দরকার তারুণ্যের ঝড়।

স্বপন কখনো রাগে না, এই কথা শুনে আজ সে রেগে গেলো। পৌরষত্ব নিয়ে কথা বললে পুরুষের সহ্য হয় না। সে বললো, এই যে নিজেকে এত আবেদনময়ী দাবি করো, কেউ কখনো তোমাকে দেখে শিস দিয়েছে? স্রোতাবেগের অধিকারিণী যে তুমি, কখনো কেউ তোমাকে প্রেম নিবেদন করেছিলো? তোমার যৌবনের কী এমন ক্ষমতা আছে বলো, একটি দিন আমার মনে আগুন জ্বালাতে পারলে না। রগরগে রানি হয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঘনশ্বাসে আমাকে তো শিহরিত করতে পারলে না। তোমার দেহসৌষ্ঠবে নজর দিয়ে কি উষ্ণ হওয়া যায়? তোমার দেহবল্লরী দর্শন শেষে আসলেই কি ক্ষুধার্ত হওয়া যায়? দেহবিলাসী হয়ে কখনো কি কামোত্তেজিত করতে পেরেছো? পুরুষকে যে দোষ দাও, আমি তো তোমার ভেতর নারীত্ব পাই না। নারীর ভেতর পুরুষালী ভাব কোনও পুরুষ কি চায়? আগুন জ্বালার গুণ নেই, উত্তাপ নেওয়ার দাবি। আবেগ কখনো জাগাতে পেরেছো, নিরাবেগের মানুষ বলো যে আমায়? তোমায় দেখে শক্তির উত্থান হবে কী করে, তোমাকেই তো লাগে অরুচিকর। নিজেকে কখনো সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছো? পেরেছো কখনো ডুবিয়ে দিতে তোমার ছলাকলার জোয়ারে? উষ্ণতা যে চাও, উষ্ণতা না দিতে জানলে কি উষ্ণতা পাবে? মূর্খ।

মেঘলা থমকে গেলো স্বপনের কথা শুনে। কিছু একটা বলতে গেলেই স্বপন বললো, কোনও পুরুষই কোণঠাসা না। বাক্যবাণে পুরুষকে কোণঠাসা করে রাখে তোমার মতো নারীই। আদর্শ স্ত্রী ধৈর্যশীলা, সহনশীলা, পরিপূর্ণ ও পরিতৃপ্ত। আদর্শ নারী স্বামীত্বে সুখী, আমিত্বে নিরহংকারী।

মেঘলা এবারও কিছু বলতে গেলে স্বপনের বাধা পেয়ে বলতে পারলো না। স্বপন বললো, যদি তোমাকে বারবার বলি তোমার চোখ সুন্দর না, তোমার নাক সুন্দর না। বারবার শুনলে চোখ সুন্দর না, নাক সুন্দর না-ই মনে হবে। এক সময় আত্মবিশ্বাস হারা হয়ে পড়বে। ভাবতে ভাবতে মারা পড়বে।

মেঘলা চুপ করে বসে থাকলো। স্বপন পাশে বসে আদরকণ্ঠে বললো, ডাক্তারের কাছে যাবো কেন? তুমিই তো আমার ডাক্তার। আমাতে তোমার অসন্তুষ্টি প্রকাশ কেন? তোমাতে আমার তো কোনও অসন্তুষ্টি নেই! তোমার সন্তুষ্টিতেই তো আমার সক্রিয়তা বাড়বে।

এরপর কয়েকটি দিন শান্ত থাকলো মেঘলা। তারপর যেই মেঘলা সেই মেঘলাতেই রূপ নিলো। ভেতর থেকে সে যে তাড়না অনুভব করে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তার অতৃপ্তির কারণ যেন কেবল স্বপনই। বলে, আমি ক্ষুধার্ত, কিন্তু আপনি আমার মনের ক্ষুধার নিয়ন্ত্রণ জানেন না।

স্বপন অসন্তুষ্টচিত্তে বললো, তুমি ক্ষুধার্ত না, তুমি পাগল। আমাকে সহ্য হয় না তোমার, তাই আমার থেকে যা পাও ঠুনকো ভাবে নাও। একটি সন্তান হওয়ার পর যখন তোমার শরীর ভেঙে যাবে তখন দেখবো তো আমার ন্যূন চাহিদাও কীভাবে মিটাও। কেবল জৈবিক চাহিদার জন্য মানুষ ঘর বাঁধে না, ভালো হয়ে যাও।

মেঘলা ক্ষিপ্ত হয়ে বললো, অতিরিক্ত কথা বলেন, ঢোরা সাপের চন্দ্রবোড়া সাপের মতো ফোঁসফোঁস বেমানান।

স্বপন বলে, তোমার অতিরিক্ত বিষ না? বিষদাঁত ভেঙে দিলেই খেলনা হয়ে যাবে।

মেঘলা বলে, পুড়ে মরি, জ্বলে মরি; ভাগের পুরুষ থাকতে আমায় ভাড়ায় পুরুষ আনতে হবে?

স্বপন বড়ো আক্ষেপ করে বলে, শরীর জুড়ে উল্লম্ফন না? ভাটায় পড়লে হাঙরও নিরীহ হয়ে যায়।

স্বপন অফিসে চলে গেলো। সেজেগুজে, সুন্দর একটা শাড়ি পরে শিমুলের কাছে গেলো মেঘলা। মেঘলাকে দেখে আগের মতো খুশি হয় না আর শিমুল। মেঘলা বলে, তোকে আমি অনেক সময় দিয়েছি, আজ আমাকে খুশি করবি। আজ আমার অহংকার ভাঙবি তুই। তোকে বীরপুরুষ উপাধি দেবো।

স্বপন পড়ে গেলো বিড়ম্বনায়। সে বললো, তুই একটি লক্ষ্মী মেয়ে, এমন বেখেয়ালি কথা বলিস না। আমাকে অসম্মানিত করিস না।

মেঘলা বলে, আমার সাথে ঘুরলে অসম্মানিত হোস না, আমার সাথে খাওয়া-দাওয়া করলে অসম্মানিত হোস না। আমার সাথে একান্ত সময় কাটালে অসম্মানিত হবি কেন? আমার অঙ্গার অঙ্গে জল ঢালবি কিনা বল? আমাকে সন্তুষ্ট করতে তুই ঘাম ঝরাবি। আমি তোর ঘামে ভিজবো।

শিমুল বিব্রত হলো, একজন বিভ্রান্ত মেয়ের পাল্লায় যেন পড়েছে সে৷ বন্ধুত্বে একটু ফাঁক রাখতে হয়। নতুবা এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। সে বলে, তোর ঘর আছে, সংসার আছে। আমার কাছে এসে তৃষ্ণার জল চাস কেন? তোকে আদর দেওয়ার মানুষ আছে। আমাকে পাপে ডাকিস কেন? তুই তো ঠক না, একজন ভালো মেয়ে। রৌদ্রের তেজ সারাবছর থাকে না, যৌবনের ঝড় অনাদিকাল বয় না।

মেঘলা বিরক্ত হয়ে বলে, সে রোজগার করতে পারে, কিন্তু কাজ করতে পারে না। সে কথা জানে, কিন্তু কৌশল জানে না। তার ওজন আছে, কিন্তু পদার্থ নয়। আমায় সে পারে না পড়তে; হেরে থাকে সারাক্ষণ। সতত নত একটি পুরুষের সাথে আমি কেন থাকবো? আমাকে গ্রহণ কর, নতুবা শান্ত কর।

অবস্থা অত্যন্ত বেগতিক দেখে শিমুল অন্য ফন্দি আটলো। সিন ক্রিয়েট করে অন্য কাউকে অবগত হওয়ার সুযোগ না করে দিয়ে সে শান্ত করার চেষ্টা করলো। বললো, তুই তবে আমায় সময় দে।

কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে মেঘলা চলে গেলো। বাঁচলো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শিমুল। আর ভাবলো, আর বাইরে যাবো না। নতুবা দূরে কোথাও ঘুরতে চলে যাবো।

মেঘলা বাসায় ফিরে আজ বেশ উৎফুল্ল। সহজ-সরল-শান্ত মেঘলাকে দেখে স্বপনের আনন্দ লাগলো। তার কাঁধ ধরে বললো, তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। রেগে থাকলে বিশ্রী লাগে।

মেঘলা বলে, বিয়ের পর মেয়েদের সৌন্দর্য বাড়ে, সুখ ঢেলে দিতে কার্পণ্য করেন বলেই তো সৌন্দর্য বাড়ছে না। চেহারা দিয়েই কি সুপুরুষ হয়ে উঠা যায়? ভেতরটা তো অসাড়, মাকাল ফল একটা।

একথা শুনতেই মেঘলার কাঁধ ছেড়ে দিলো স্বপন। আর বললো, তুমি আসলে কামনাতাড়িত না, তুমি বোধহীন। তুমি ক্ষুধাতাড়িত না, বিভ্রান্ত। তুমি আবেগতাড়িত না, উন্মাদিনী। পাও, কিন্তু পায় না পায় না চিন্তায় থাকো। তোমাকে তৃপ্ত করা যায় না। আমার জীবনে আসার পর তোমাকে খুশি দেখলাম না। তোমাকে খুশি করতে পারি না। তোমার চিত্তই সুস্থ না, অসুস্থ চিন্তার মানুষ তুমি। সংসারে কত কাজ, সারাক্ষণ কানের কাছে একই প্যানপ্যানানি করো। একজন মানুষকে কামনা-বাসনা এমনভাবে গ্রাস করতে পারে কী করে? ন্যূনতম সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারলাম না।

এসব কথা শুনে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলো মেঘলা। সে ঘরে ঢুকে শিমুলকে ফোন দিলো। কিন্তু শিমুলের ফোন বন্ধ। সে আরও বেশি বিক্ষুব্ধ হলো। দুটি পুরুষের সংস্পর্শ পেয়েছে সে, কিন্তু কেউ তাকে সন্তুষ্ট করেনি, সন্তুষ্ট করতে চায়নি। মনে মনে অজস্র বার বলার পর এবার সে উচ্চারণ করে বলতে থাকলো, দুটোই নপুংসক।

নারায়ণগঞ্জ, বাংলাদেশ থেকে


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন