প্রথম পর্বে আমরা দেখেছি সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে ছোটবেলার ঘটনা সম্বন্ধে, নাম উল্লেখ না করে যে সুপরিচিত আশ্রমের অধ্যক্ষের সান্নিধ্যে আসার কথা লিখেছেন এবং যাঁর ব্যাবহারে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন, সেই সন্ন্যাসী ছিলেন শ্রীমৎ স্বামী ভোলানন্দ গিরি। সুভাষচন্দ্র আমাদের এও জানিয়েছেন যে সেই সাধুর দেওয়া উপদেশগুলো তিনি বেশ কিছু সপ্তাহ বা হয়তো কয়েক মাস শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করেছিলেন। সেটা ছিল খুব সম্ভবতঃ ১৯১১ কিংবা ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের কথা। অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘ভারত পথিক’ বইতে সুভাষচন্দ্র বসু ১৯২১ সালের প্রায় মাঝামাঝি তাঁর আই-সি-এস থেকে পদত্যাগ করা পর্যন্ত সময়কার কথা লিখেছেন।এই পর্বে আমরা জানবো ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর এবং ঠিক তার পরের কথা স্বামী প্রেমানন্দ গিরির লেখা থেকে।
স্বামী প্রেমানন্দ গিরি লিখেছেন : —
“১৯২৮ সালে মাঘ মাসের শেষভাগে আমার পূজ্যপাদ গুরুদেব শ্রীশ্রীস্বামী ভোলানন্দ গিরি পূর্ববঙ্গ পরিভ্রমণ শেষ করে অসুস্থ শরীর নিয়ে কলিকাতায় উপস্থিত হন। স্বামী রামানন্দ গিরি মহারাজ এবং আমিও শ্রীহট্ট হইতে আসিয়া যোগ দিলাম। পরমভক্ত অচল মিত্র মহাশয় সদ্য পরলোকগত হইলেও, ভক্তিমতী আশালতা মিত্র স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজীকে (কচি) বরিশাল পাঠাইয়া ৮১ নং ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ীতে মহারাজকে স্বাগত করিলেন।
“তখন কলিকাতাতে নিখিল ভারত কংগ্রেসের অধিবেশন চলিতেছে। এই কংগ্রেসেই সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়। কংগ্রেসের কার্যকরী সমিতির সভায় এই বৎসর মতিলাল নেহেরু ‘কনষ্টিটিউশন’ পেশ করেন যার মুখ্য আদর্শ ‘ডোমিনিয়ান স্টেটাস’ আর তার জন্য ইংরাজের কাছে আবেদন নিবেদন। মহাত্মা গান্ধী স্বয়ং প্রস্তাবক। মতিলাল নেহেরু, আজাদ প্রভৃতি নেতৃবর্গ এই দাবীর পূর্ণ সমর্থক। একমাত্র অকুতোভয়, পূর্ণ ব্রহ্মচারী, তরুণ, সর্বত্যাগী, যৌবন-দৃপ্ত সুভাষচন্দ্র প্রকাশ্য অধিবেশনে মহাত্মাজীর উত্থাপিত প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সংশোধনী প্রস্তাব নিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেনঃ —
“ডোমিনিয়ান স্টেটাস্ অথবা পূর্ণ স্বাধীনতা — এর কোনটা ভারতবর্ষ কামনা করে স্পষ্ট ভাষায় অভিমত প্রকাশের আজ সময় এসেছে। স্বরাজ শব্দের ধোঁয়াটে বা ঘোলা ব্যাখ্যা নহে।… ভারতের আদর্শের প্রতি ঐকান্তিকতা — প্রাচীন শ্রদ্ধেয় নেতাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও প্রেম থাকা সত্ত্বেও আমাকে নবীন প্রেরণায় উদ্বোধিত করিতেছে — পূর্ণ স্বাধীনতাই আমাদের দাবী হওয়া সমীচীন।”
“সুভাষচন্দ্রের এই ভাষণে সকলেই চকিত ও বিস্মিত হইয়াছিল। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় স্বয়ং জওহরলাল সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাবের সমর্থক হইয়াও গান্ধী-মতিলালের যাদুমন্ত্রে মুগ্ধ হইয়া পরে আত্মগোপন করিল। যদিও কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাব সেদিন অগ্রাহ্য হইল কিন্তু জগৎ সুভাষচন্দ্রকে চিনিবার সুযোগ পাইল। কংগ্রেস অধিবেশনের এই সংবাদ ও সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাব যখন শ্রদ্ধেয় সুধীরচন্দ্র মিত্র শুনাইতেছিলেন — বুড়িবালামের বীর বিপ্লবী বাঘাযতীনের গুরুদেব সমর্থ রামদাসের মত স্বামী ভোলানন্দ গিরিজী আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া বলিলেন, “সুভাষ জো কহতা হ্যায়, ওহী ঠিক হ্যায়”। আমি (লেখক) সেখানে উপস্থিত ছিলাম। মহারাজ পরে হিন্দীতে যাহা বলিলেন — তাহা বাংলায় লিখিতেছি — “বেদান্ত তো নিত্যমুক্ত আত্মারই উপদেশ করেন — ‘ন মে বন্ধঃ ন মে মোক্ষঃ নিত্যমুক্ত স্বভাববান্।” ক্রমমুক্তি দ্বৈতবাদের কথা — যাহারা জীব জগতকে যথার্থ বলেন। বেদান্ত জীব জগত স্বীকার করেন না। “জীবঃ ব্রহ্মৈব না পরঃ” “হরিরের জগৎ জগদেব হরিঃ”
“স্বামীজীর শৈলী ছিল সকল কথা ব্রহ্মে পর্যবসিত করা। এইভাবে সুভাষচন্দ্রের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাবকে সমর্থন করিলেন স্বামিজী — “জগৎ জালাৎ পিঞ্জরাদিব কেশরী।”
“কংগ্রেসের স্বরাজ অর্থের ধোকাজাল ছিন্ন করিয়া নরহরি সুভাষচন্দ্র যথার্থবাদী হইলেন। অলক্ষিতে মহারাজের আশীর্বাদ ও সমর্থন লাভ করিলেন।” (চলবে)
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ —
১) অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির অধিবেশন ২৯ ডিসেম্বর, ১৯২৮, থেকে ১ জানুয়ারি, ১৯২৯, পর্যন্ত কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল। গান্ধীজির ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের প্রস্তাব এবং গান্ধীজির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সুভাষচন্দ্র বসুর সংশোধনী প্রস্তাব অধিবেশনের তৃতীয় দিনে, অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর, ১৯২৮ তারিখে উত্থাপিত হয়েছিল।
২) স্বামী প্রেমানন্দ গিরির প্রবন্ধের বাংলা বানান যথাসম্ভব অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
৩) এখানে দ্রষ্টব্য এও যে আমাদের দেশের ঐতিহাসিকরা ১৯২৮ সালের শেষ দিনে জওহরলাল নেহেরুর ভোটের সময়ের অনুপস্থিতির কথা কখনও লেখেন না। খুব কম সংখ্যক লেখক একথা লিখেছেন। সেটা এই প্রবন্ধে উল্লিখিত হয়েছে।
৪) শ্রীমৎ স্বামী ভোলানন্দ গিরি মহারাজের তিরোধান দিবস হচ্ছে ১৯২৯ সালের ৮ই মে, বুধবার, বৈশাখী কৃষ্ণা চতুর্দশী। ইন্টারনেটে দুটো ভিডিও-ক্লিপে যদিও তারিখটা ৮ই মে এবং তিথিটা কৃষ্ণা চতুর্দশী বলা হয়েছে, কিন্তু ভুলে ১৯২৯-এর পরিবর্তে ১৯২৮ সাল বলে বলা হয়েছে যা সর্বৈব ভুল। ১৯২৮ সালের ৮ই মে ছিল মঙ্গলবার, কৃষ্ণ পক্ষের তৃতীয়া।
ENGLISH VERSION
SUBHAS CHANDRA BOSE AND SRIMAT SWAMI BHOLANANDA GIRI MAHARAJ (PART TWO)
In the first part, we have seen what Subhas Chandra Bose wrote in his unfinished autobiography about his coming into contact during adolescence with an old Sannyasi — a well-known Ashram head — without mentioning the Sannyasi’s name, and that he was impressed by the attitude and behaviour of the ascetic. We have also discovered that the monk was none other than Swami Bholananda Giri. Subhas Chandra Bose also told us that he reverently followed the advice given by that saint for several weeks or perhaps months. It was most probably in the year 1911 or 1912 AD. The unfinished autobiography of Subhas Chandra Bose, titled ‘An Indian Pilgrim’, covers the period till his resignation from the ICS around the middle of 1921. In this part, we shall learn from the writings of Swami Premananda Giri, a disciple of Swami Bholananda Giri, how the monk had blessed Subhas Chandra for his activities in the Calcutta Congress during December 1928 — January 1929.
Swami Premananda Giri reminisced in the article: —
“In the latter part of the month of Magha in 1928, my Reverend Gurudeva Sri Sri Swami Bholananda Giri arrived in Calcutta in a sick condition, after completing his tour of East Bengal. Swami Ramananda Giri Maharaj and I also joined him from Sylhet. Even though ardent devotee Sri Achal Mitra had just passed away, his religious wife Ashalata Mitra sent Swami Ramakrishnanandaji (Kachi) to Barisal to welcome Maharaj Bholananda Giri at their residence at 81 Lansdowne Road, Calcutta.
“At that time the session of the All-India Congress Committee was being held in Calcutta. It was at this Congress that the Volunteer Corps was formed under the leadership of Subhas Chandra. That year Motilal Nehru submitted the ‘Constitution’ in the meeting of the Congress Working Committee with the main aim of ‘Dominion Status’ and an appeal to the British for granting it. Mahatma Gandhi himself proposed this resolution. Leaders like Motilal Nehru, Azad etc. were full-fledged supporters of this claim for ‘Dominion Status’. The only fearless, fully celibate, young, self-sacrificing, youthful Subhas Chandra Bose stood up with an amendment to the motion raised by Mahatmaji in the open session and said: —
“Now is the time to express in clear terms whether India wants Dominion Status or full independence. The interpretation or the word Swaraj should not be hazy or murky any longer.… Devotion to the ideals of India – Despite having deep respect and love for much older venerable leaders, I am being inspired by fresh inspiration — Complete independence should be our demand.”
“Everyone was shocked and surprised by this speech of Subhas Chandra Bose. It is very sad that though Jawaharlal himself was initially a supporter of Subhas Chandra’s proposal, he later went into hiding after being charmed by the magic aura of Gandhi & Motilal. Although Subhas Chandra’s amendment lost in the vote at the Congress session that day, the world got an opportunity to know Subhas Chandra. When respected Sudhir Chandra Mitra was narrating the proceedings of the Congress session and Subhas Chandra’s proposal of complete independence to his Guru Swami Bholananda Giri, the Gurudeva of the heroic revolutionary Baghajatin of the Buribalam fame, Swami Bholananda Giriji, was elated with joy like the way Samarth Ramdas used to be (for Shivaji’s valour), and said, “SUBHAS JO KAHTA HAI, OHI THEEK HAI”. I (Premananda Giri) was present there. What Maharaj later said in Hindi — I have written it in Bengali — “Vedanta advocates the eternity and indestructibility of Atman (soul) — ‘Na me bandhaha: na me mokshaha: nityamukta swabhavbaan.” Kramamukti (or incremental liberation) speaks of dualism — those who say that the living being and the universe are both true. Vedanta does not accept the separation of living being and the universe. “Jiva: Brahmaiva nah paraha” “Harireba Jagat Jagadeva Hari:”
Swamiji’s style was to reduce and interpret everything in the light of Brahman (God). Thus Swamiji endorsed Subhas Chandra’s proposal for ‘complete independence’ — “Jagat Jaalat Pinjaradiba Kesari.”
Narahari (half man and half lion, incarnation of Vishnu) Subhas Chandra thus became a realist by breaking the swindle of Congress’s Swaraj-imbroglio. Unnoticed, Subhas Chandra Bose got the blessings and support of Maharaj Swami Bholananda Giri.”
SPECIAL NOTE : —