সেই কবে থেকেই গাছগাছার দ্রব্যগুণ সম্বন্ধে মানুষ অবহিত ছিল। প্রাগৈতিহাসিক যুগের যাযাবর মানুষরাও রোগ মুক্তি দাওয়াই খুঁজে বেড়াতেন বনে বনে। রামায়ন, মহাভারতের মতো প্রাচীন মহাকাব্যেও ভেষজ ব্যবহারের উল্লেখ আছে, বৈদিক যুগের পরবর্তী আর্যরা যে অনেক বনৌষধির ব্যবহার জানতেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় সেকালের খ্যাতনামা সার্জেন সুশ্রুত এবং চিকিৎসক চড়ক রচিত সংহিতায়। বাড়ির ঠাকুমা, দিদিমা, মা, পিসিমারাতো নানা রকম টোটকা ভেষজ দিয়েই বাড়ির লোকের অসুখ সারিয়ে তুলতেন। তাই আজও আমাদের দ্বারস্থ হতে হয় ভেষজের উপর।
ষড়ঋতুর মধ্যে বসন্তকালেই হাম, পক্স, হারপিস ও অন্যান্য সংক্রামক অসুখের সমস্যা দেখা যায়। সিজন চেঞ্জের সময় যদি কিছু ঘরোয়া উপাদান হাতের কাছে থাকে, তবে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া যায়। এমনি অতি সাধারণ অথচ উপকারী ভেষজের নাম হলো ‘নিম’। ভারতীয় উপমহাদেশে ঔষধি গাছ হিসেবে পাঁচ হাজার বছর ধরে নিমের ব্যবহার চলে আসছে। ‘গ্রামের ডাক্তার’ হিসেবে পরিচিত নিমকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আখ্যা দিয়েছে একুশ শতকের বৃক্ষ বলে।
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী চৈত্র থেকে জৈষ্ঠ্য মাস পর্যন্ত নিমের ছাল ও কাঠ ব্যবহার এবং শীত থেকে বসন্তকালে কচি নিমপাতা ব্যবহার করা খুবই ফলপ্রসু। তাই নিম-বেগুন ভাজা দিয়ে গরম ভাত… বসন্ত কালের প্রায় সব বাড়ীরই বাঁধা ধরা রান্না।
বহুবর্ষজীবী ও চিরহরিৎ বৃক্ষটির উৎপত্তিস্থল গ্রীষ্মমন্ডলীয় ভারত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এবং পশ্চিম আফ্রিকা দেশগুলিতে। বলা হয় এর আদিবাস মিয়ানমার। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওষুধ হিসেবে নিমের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। শুধু তাই নয় ধর্মীয় সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা এমনকি সাহিত্যক্ষেত্র যুগ যুগ ধরে বিভিন্নভাবে আদৃত হয়ে আসছে। নিয়মের গুনকীর্তন শত প্রহর ধরে চললেও শেষ হবার নয়।
সুপ্রাচীনকাল থেকেই নিমের অ্যান্টিসেপটিক গুণ সম্বন্ধে ধারণা ছিল বলে নিমের ডাল দিয়ে দাঁতন করা হতো। নিম দাঁতন লালার ক্ষারীয় মাত্রা বজায় রাখে, দাঁতে ক্যাভিটি সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে। বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যালসে পাউডার মাজন তৈরি হতো অথচ খ্যাতকীর্তি বিজ্ঞানী প্রত্যহ নিমের দাঁতন ব্যবহার করতেন।
নিম গাছ, বীজ এবং তেলে বিভিন্ন অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিফাঙ্গাল এবং অ্যানথেলমিন্টিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই কারণেই ছোটোবেলায় মেয়েদের কান বেঁধানো হলে কানের লতির ছিদ্রে সরু নিমকাঠি দেওয়া চালু হয়েছিল। এতে কানের ফুটে যেমন বুঁজে যায় না, তেমনি বাঁধনের জায়গাটির ক্ষত দূষিত হয় না। অনেকে আবার নিম কাঠের তৈরি চিরুনি ব্যবহার করেন, এতে চুল পড়া, খুশকি-সহ চুলের গোড়ার নানান সমস্যা দূর হয়।
নিমগাছের তক্তা দিয়ে খাটের পাটাতন করার চলও দেখা যায়, কারণ নিমের কাঠে ঘুন ধরে না, উইপোকাও নিমের তক্তা খেতে চায় না। এমনকি নিম খাটে শুলে রোগ ব্যাধিও কমে। নিম পাতা বইয়ের আলমারিতে ছড়িয়ে রাখলে বইগুলি পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচে।
ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক প্রতিরোধক বলে বাজারে প্রচলিত নিমের তৈরি সাবান, শ্যাম্পু. ক্রিম, টুথপেস্ট ও প্রসাধন সামগ্রীর চাহিদা ভালো রকমের। নিমের ফল আবার কৃমি ও কুষ্ঠ রোগ নিরাময়ের সাহায্য করে। নিমফুল মুত্রবর্ধক আর নিমপাতা থেকে যে তেল তৈরি করা হয় চর্মরোগ, কুষ্ঠ, কৃমি, বাত, ক্ষত সারাতে সাহায্য করে।
গবেষণা অনুসারে, নিম গাছের হাইপোগ্লাইসেমিক বা রক্তে শর্করা কমানোর বৈশিষ্ট্য রয়েছে অর্থাৎ নিম রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে উপকারী এবং ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য আদর্শ হতে পারে। এছাড়াও নিম অক্সিডেটিভ স্ট্রেস প্রতিরোধ করে যা ডায়াবেটিসের কারণে হয়।
নিমের শক্তিশালী বৈশিষ্ট্যের কারণে গর্ভনিরোধক হিসাবে ব্যবহার করা হয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে ইঁদুরগুলিকে নিমের তেল দিয়ে চিকিত্সা করা হয়েছিল, তারা আশ্চর্যজনকভাবে কিছু সময়ের জন্য বন্ধ্যাত্ব বজায় ছিল। নিমের তেল শুক্রাণুর বিস্তারকে ০.০৫ থেকে ১% পর্যন্ত কমাতে পারে, তাই স্পার্মিসাইড হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। বর্তমান গবেষণায় দেখা যায় যে নিম তেল একটি “আদর্শ” মহিলা গর্ভনিরোধক হিসাবে ব্যবহার করা যায় যা সহজলভ্য, সস্তা এবং অ-বিষাক্ত।
নিম গাছের ছালে থাকে ট্যানিন। এই ছাল ভেজানো জল খেলে কেঁচো কৃমি নষ্ট হয়। এছাড়া শিকড়ের ছালও কৃমির শত্রু। স্নায়বিক মাথার যন্ত্রণায় নিম ফুল বেটে প্রলেপ লাগালে ব্যথা সেরে যায় অনেক সময় গ্রামের বৈদ্যরা ‘রাতকানা’-দের একটি বিশেষ মুষ্টিযোগ হিসেবে নিমফুল ভাজা খেতে বলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, নিমপাতা অন্তঃসত্ত্বা এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের দেওয়া উচিত নয় এছাড়াও নিম পাতা অতিরিক্ত ব্যবহার ও ভালো নয়। একজন ব্যক্তির প্রতিদিন ছয় থেকে আটটি নিম পাতা খাওয়া উচিত।
শুধু আমাদের দেশ নয়, বিভিন্ন রাজ্যেই লোকাচারে নিমের ব্যবহারকে সংস্কার হিসেবে মানা হয়। এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও আছে–যেমন বাংলার মৃত জনের দেহ সৎকার হয়ে গেলে শ্মশানযাত্রীদের ঘরে ফিরে দাঁতে নিম পাতা কাটতে হয়। রাজস্থানে মারোয়ারি ব্যবসায়ী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিয়ের সময় নিম গাছের একটি ডালকে বরানুগমন করাতে হয় এবং সে নিম ডালটি বরের হাতেই ধরা থাকে। নিম যেন সেখানে গাছপুরুতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
বেদে বলা হয়েছে নিম অশুভ শক্তিকে দূরে সরিয়ে দেয়। তাই আঁতুড় ঘরকে বিষাক্ত বায়ু বা পোকামাকড়ের প্রকোপ থেকে মুক্ত রাখতে নিম পাতা ব্যবহারের উপদেশ দেওয়া হয়েছে।
আজ শেষ করি বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের নিমগাছ নমের একটি ছোটো গল্প দিয়ে।
“কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে।
পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ।
কেউ বা ভাজছে গরম তেলে।
খোস দাদ হাজা চুলকুনিতে লাগাবে।
চর্মরোগের অব্যর্থ মহৌষধ।
কচি পাতাগুলো খায়ও অনেকে।
এমনি কাঁচাই…..
কিংবা ভেজে বেগুন-সহযোগে।
যকৃতের পক্ষে ভারী উপকার।
কচি ডালগুলো ভেঙে চিবোয় কত লোক…। দাঁত ভালো থাকে।
কবিরাজরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
বাড়ির পাশে গজালে বিজ্ঞরা খুসী হন।
বলেন— “নিমের হওয়া ভাল, থাক, কেটো না।”
কাটে না, কিন্তু যত্নও করে না।
আবর্জনা জমে এসে চারিদিকে।
শান দিয়ে বাধিয়েও দেয় কেউ — সে আর এক আবর্জনা।
হঠাৎ একদিন একটা নূতন ধরণের লোক এল।
মুগ্ধ দৃষ্টিতে বেয়ে রইল নিমগাছের দিকে। ছাল তুললে না, পাতা ছিঁড়লে না, ডাল ভাঙ্গলে না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শুধু।
বলে উঠলো, “বাঃ কি সুন্দর পাতাগুলো… কি রূপ। থোকা থোকা ফুলেরই বা কি বাহার… এক ঝাঁক নক্ষত্র নেমে এসেছে যেন নীল আকাশ থেকে সবুজ সায়রে। বাঃ —”
খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে চলে গেল।`
কবিরাজ নয়, কবি।
নিমগাছটার ইচ্ছে করতে লাগল লোকটার সঙ্গে চলে যায়। কিন্তু পারলে না।মাটির ভেতর শিকড় অনেক দূরে চলে গেছে। বাড়ির পিছনে আবর্জনার স্তূপের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল সে।
ওদের বাড়ীর গৃহকর্ম-নিপুণা লক্ষ্ণী বউটার ঠিক এই দশা।”
নিমপাতা আর বেগুন একসাথে মিশিয়ে ভাজা কথা হবে না।
অনেক ধন্যবাদ ❤️