এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসের গরম আমরা সবাই অনুভব করেছি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন গত ১২০ বছরে ফেব্রুয়ারি মাসে এ রকম গরম দেখা যায় নি। শুধু তো ভারতবাসী নয়, সারা বিশ্বের মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের ফল তো ভোগ করছে প্রতি নিয়ত। খরা ও বন্যার প্রবণতা বাড়ছে। ভূমিভাগ পরিণত হচ্ছে মরুভূমিতে। বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের জলস্তর। গলে জল হচ্ছে গ্লেসিয়ার। অথচ পুঁজিবাদীরা জলবায়ুর এই পরিবর্তনকে স্বীকার করতে চান না। অ্যালায়েন্স ট্রাস্টের সিইও ক্যাথারিন গ্যারেট কক্স (Katherine Lucy Garrett-Cox) — বলেছেন যে কর্পোরেট জগতের মাথারা জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারটাকে আজগুবি বলে উড়িয়ে দিতে চান। তাঁদের উক্তি, “It’s not real, it’s not something I should be bothered about.” জলবায়ু পরিবর্তনে আমার তো কিছু হচ্ছে না, তাই তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাব কেন?
২০১৪ সালে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্রকাশিত হয় একটি বই। নাম ‘দিস চেঞ্জেস এভরিথিং : ক্যাপিটালিজম ভার্সেস ক্লাইমেট (This Changes Everything: Capitalism vs. the Climate)।’ বইটির লেখক নাওমি ক্লেইন (Naomi Klein)। ইনি একজন পুরস্কারবিজয়ী সাংবাদিক, কলামিস্ট ও লেখক। ৩টি অধ্যায় ও ১৩টি উপ-অধ্যায়ে সম্পূর্ণ এই বইটিকে নিউইয়র্ক টাইমস ‘আন্দোলনের বাইবেল’ আখ্যা দিয়েছেন। আমাদের জলবায়ুকে, সামগ্রিকভাবে পৃথিবীর পরিবেশকে বাঁচাতে হলে পরিবর্তন করতে হবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার। আন্দোলন করতে হবে সেজন্য।
ক্লেইন নানা তথ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে ১৯৯৭ সালে কিয়েটো প্রোটোকল থেকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি পর্যন্ত বিস্তর আলোচনা হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় নি। সেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রধান স্থান অধিকার করেছে। তাই ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার লক্ষ্য শেষ পর্যন্ত পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক হাস্যরসে।
পুঁজিবাদীরা চান উন্নয়ন। কি তার বৈশিষ্ট্য? তার বৈশিষ্ট্য হল প্রাণজগতকে বিষাক্ত বর্জ্য নিষ্কাশনের বিশাল মলাধাররূপে ব্যবহার করে সমাজের উপর পরিবেশগত ধ্বংসের দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া। ক্লেইন বলেছেন নব্য উদারনীতিবাদ ও বাজার অর্থনীতি অবারিত করেছে গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমনকে . অবারিত করেছে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, দুর্যোগকে আপনাপন স্বার্থ সাধনের কাজে লাগিয়েছে — যাকে ক্লেইন বলেন ‘ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট’ (Disaster Management)।
জলবায়ু সমস্যা যত প্রকট হচ্ছে, ততই তাকে অস্বীকার করার চেষ্টাও প্রকট হচ্ছে। পরিবেশ আন্দোলনে ফাটল ধরাবার চেষ্টা করা হচ্ছে। পরিবেশকর্মীদের নিষ্ক্রিয় ও বিপথগামী করার চেষ্টা হচ্ছে। জিও ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সাহায্যে অলীক সমাধানের চেষ্টাও চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ক্লেইনের মতে এ সব হল ‘ম্যাজিক্যাল থিংকিং’। এই ধরনের ভাবনাকে পরিহাস করে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘মন্ত্রবলে সোনা ফলাইবার চেষ্টা’।
ক্লেইনের এই বই তাই একটা দিগদর্শন, আন্দোলনের একটা হাতিয়ার। ওয়াশিংটন মান্থলিতে এই বই সম্বন্ধে ডি আর টাকার সঠিকভাবে বলেছেন, ‘এটা শুধুমাত্র একটা বই নয়, শুধু একটা আন্দোলন নয়, এটা ন্যায়বিচারের অস্ত্র, এই বই আমাদের বেঁচে থাকার একটা প্রকৃষ্ট পন্থা।’
লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক