শনিবার | ২৬শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | দুপুর ১:০৭
Logo
এই মুহূর্তে ::
বাবু-ইংরেজি আর সাহেবি বাংলা : মাহবুব আলম সিন্ধুসভ্যতার ফলক ও সিলে হরিণের শিং-বিশিষ্ট ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি : অসিত দাস বৈশাখ মাসে কৃষ্ণপক্ষে শ্রীশ্রীবরুথিনী একাদশীর ব্রতকথা মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত সিন্ধুসভ্যতার লিপি যে প্রোটোদ্রাবিড়ীয়, তার অকাট্য প্রমাণ : অসিত দাস বাঙালির মায়াকাজল সোনার কেল্লা : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ট্যাটু এখন ‘স্টাইল স্টেটমেন্ট’ : রিঙ্কি সামন্ত ফের আমেদাবাদে হিন্দুত্ববাদীদের অন্য ধর্মের উপর হামলা : তপন মল্লিক চৌধুরী লোকসংস্কৃতিবিদ আশুতোষ ভট্টাচার্য ও তাঁর চিঠি : দিলীপ মজুমদার নববর্ষের সাদর সম্ভাষণ : শিবরাম চক্রবর্তী নববর্ষ গ্রাম থেকে নগরে : শিহাব শাহরিয়ার ফিরে আসছে কলের গান : ফজলুল কবির সিন্ধুসভ্যতার ফলকে খোদিত ইউনিকর্ন আসলে একশৃঙ্গ হরিণ : অসিত দাস একটু রসুন, রসুনের কথা শুনুন : রিঙ্কি সামন্ত ১২ বছর পর আরামবাগে শোলার মালা পরিয়ে বন্ধুত্বের সয়লা উৎসব জমজমাট : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কোনিয়াকদের সঙ্গে দু’দিন : নন্দিনী অধিকারী স্বচ্ছ মসলিনের অধরা ব্যুৎপত্তি : অসিত দাস বাড়বে গরম, চোখের নানান সমস্যা থেকে সাবধান : ডা. তনুশ্রী চক্রবর্তী আঠালো মাটি ফুঁড়ে জন্মানো শৈশব : আনন্দগোপাল হালদার মাইহার ঘরানার সম্রাট আলি আকবর খান (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত ওয়াকফ হিংসার জের কি মুর্শিদাবাদেই থেমে গিয়েছে : তপন মল্লিক চৌধুরী এক বাগদি মেয়ের লড়াই : দিলীপ মজুমদার এই সেনসরশিপের পিছনে কি মতাদর্শ থাকতে পারে : কল্পনা পাণ্ডে শিব কম্যুনিস্ট, বিষ্ণু ক্যাপিটেলিস্ট : জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় ‘গায়ন’ থেকেই গাজন শব্দের সৃষ্টি : অসিত দাস কালাপুষ্প : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু হোক বাঙালি-অস্মিতার প্রচারযাত্রা : দিলীপ মজুমদার মাইহার ঘরানার সম্রাট আলি আকবর খান (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত পেজফোর-এর নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ১৪৩২ প্রকাশিত হল সিন্ধিভাষায় দ্রাবিড় শব্দের ব্যবহার : অসিত দাস সিন্ধুসভ্যতার জীবজগতের গতিপ্রকৃতির মোটিফ : অসিত দাস
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-এর আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

রমাপদ চৌধুরী-র ছোটগল্প ‘রেবেকা সোরেনের কবর’

রমাপদ চৌধুরী / ২২৯ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ৪ মার্চ, ২০২৩

আশপাশের পাঁচটা কোলিয়ারির ভিড় ভেঙে পড়লো কারানপুরার বুকে। কারানপুরা-যার আদি নাম কর্ণপুর।

কিংবদন্তী শোনা যায়, মহাভারত-চরিত্র কর্ণের রাজধানী ছিলো এটা। দুসাদ দুবে মাহাতো সিংরা শুধু বলেই খালাস নয়। পাহাড়ের গায়ে এক সারি প্রাচীন গুহার দিকে আঙুল দেখিয়ে জানায়, ওই হলো কর্ণের দরবার। অরণ্যচর বীরহড়দের যে দলটা তীর ছোঁড়ার সময় বুড়ো আঙুলটা মুড়ে রাখে তাদের দেখিয়ে বলে, একলব্যের বংশধর ওরা।

কে কি বলছে না-বলছে, জংলা ডেরার সান্তালরা অবশ্য তার খোঁজ রাখে না। খোঁজ রাখে না, তবে রাখে কান। ঢেঁড়ি কাঠির ডুগডুগির দিকে। সে ডুগডুগি মাঝে মাঝে জানিয়ে দেয়, লোক লাগবে বাঁশরিয়ার খাদানে, কিংবা নাটুয়া দল তাবু ফেলেছে ঝিন্‌কাগাড়ায়।

এমনি এক ডুগডুগির ডাক শুনেই মেয়ে-মরদের ভিড় ভেঙে পড়লো কারানপুরার রাম-লীলার মাঠে।

ভিখারিয়ার নাচ এসেছে, ভিখারিয়ার নাচ। নামে নাচ, আসলে গান। কানে আঙুল দেওয়া কবিগানের লড়াই। যা শোনবার আগ্রহে আঠারো ক্রোশ পথ হাঁটতেও উৎসুক হয়ে ওঠে দেহাতীরা, কোলিয়ারির হড় হো ভুম্পি খাড়িয়া রেজাকুলির দল।তাই ডুগডুগি শুনতে না-শুনতে প্লাবন নামলো রামলীলার মাঠে, কুলিকামিন আর জোয়ান সান্ডা, বাচ্চা বুড়ো হাড়াম হপন্, সবাই।

ভিড়ের মুখে গা ভাসিয়ে রূপমতীও এসে পৌঁছলো। পৌঁছলো যখন, তোতা আর ম্যোর ভিখারিয়া ছাড়েনি তখনো।

‘ভিখারিয়া হলো গ্রামের নাম, তা থেকে ভিখারিয়ার নাচ!’ বোঝালেন কারানপুরা কোলিয়ারির কম্পাসবাবু।

মারাঠী ম্যানেজার সাঠে সাহেব মাথা নাড়লেন। ও তল্লাটের চীফ মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার ডিকসন আর এজেন্ট ফার্নহোয়াইট চুরুট-চাপা ঠোঁটে বললেন, আই সী! সব কৃতিত্বটুকু কম্পাসবাবু নিয়ে নিচ্ছেন দেখে কনুইয়ের ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে এলেন

মিশিরজী। বললেন, তোতা পাখি আর ময়ূর সেজে দুজন লোক আসবে এখনি, নাটকটার কাহানী বলে দেবে।

কাহানী? ফার্নহোয়াইট ভুরুতে প্রশ্ন তুলে তাকালেন। নিমন্ত্রিত সাহানা বললেন, কাহানী না ছাই। ভিলেজ স্ক্যান্ডাল, যত সব কেচ্ছা ভিন গাঁয়ের মেয়েদের নামে। ছড়া বেঁধে গাইবে ওরা, আর পারে তো সে গাঁয়ের লোক জবাব দেবে গান গেয়ে! না পারে তো লাঠিসোঁটা নিয়ে হইহই করে উঠবে।

মিশিরজী সায় দিয়ে বললেন, হ্যাঁ স্যার। ভিখারিয়ার নাচ হয়েছে অথচ দু-চারটে খুন-জখম হয়নি এমন ঘটনা আমরা অন্তত শুনিনি।

বলতে না-বলতেই হইহই চিৎকার উঠলো ওদিক থেকে। না। মারপিট দাঙ্গাহাঙ্গামার ব্যাপার নয়। তোতা আর ম্যোর দেখা দিয়েছে বাঁশ দিয়ে ঘেরা আসরের মাঝখানটিতে। তোতার মাথায় সাদা পালকের ঝুঁটি, ম্যোর অর্থাৎ ময়ূরের পেখম আঁটা আরেকজনের বুকে পিঠে। হঠাৎ দেখলে ভয় পাবার মতো চেহারা হয়েছে দু-জনেরই। দুজনেই সুর করে গান শুরু করেছে। মূল গায়েন যতক্ষণ না এসে পৌঁছয় দলবল নিয়ে ততক্ষণ আসর জামিয়ে রাখার দায়িত্ব এদের। তোতা আর ম্যোরকে আসতে দেখেই আনন্দে হইহই করে দাঁড়িয়ে উঠেছে কুলিকামিন কোড়াকুড়ীর দল।

বাঁশের বাতা দিয়ে ঘেরা আসরের চারপাশে উবু হয়ে বসা নোংরা জনতার ভিড় যে কত দূর অবধি ছাড়িয়ে গেছে ঠাহর হয় না। আর জনতাকে ঘিরে এক সারি ফার্নেসের মতো বড় বড় আগুনের কুণ্ড। কারানপুরার খাদানে কয়লা থাকতে শীতে কাঁপবে কেন লোকগুলো,

ফার্নহোয়াইট তাই পঁচিশ বাকেট কাঁচা কয়লা স্যাঙশন করেছেন। অগ্নিকুণ্ডের মতো দাউ-দাউ করে জ্বলছে সেগুলো, আসরকে চারপাশ থেকে মালার মতো ঘিরে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী তো নয়, যেন সিন্ধবাদের কুঁড়িয়ে পাওয়া হাঁডিঁ থেকে দুলে দুলে উঠছে এক-একটা দৈত্য। দেহাতীদের থেকে খানিকটা দূরত্ব রেখে বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে বসে বসে দেখছিলেন

ফার্নহোয়াইট, ডিকসন, সাঠে, ঠিকাদারের দল আর সাহানা। শেষজনের ইঙ্গিতেই কে যেন সামনের টুলে দু বোতল হুইস্কি আর আনুসাঙ্গিক রেখে গেল।

ফার্নহোয়াইটের কিন্তু সেদিকে চোখ ছিলো না! দোষও দেওয়া যায় না। কাছে-পিঠে রূপমতীর মতো মেয়ে শরীর কাঁপিয়ে ঘুরে বেড়ালে কি অন্য দিকে চোখ যায়! সান্তালদের ভিড়ে এমন মেয়ে? আশ্চর্য হয়েই তাকিয়েছিলেন ফার্নহোয়াইট। আর তা লক্ষ করেই ঠিকাদার সিং ফিসফিস করে বললে, রূপমতী ! আমাদের তিন নম্বর খাদে কাজ করে মেয়েটা।

রূপমতী? ফার্নহোয়াইটের বাউন্ডুলে ছেলেটা যার পেছনে ছায়ার মতো ঘুরতে চায়? খাদানে নেমে তার আজ মাটি-কাটারি প্লটে, কাল মাল-কাটারিদের কাছে-পিঠে ঘুরঘুর করা মেয়েপুরুষ কারও চোখ এড়ায়নি। কানাঘুষো ফিসফিস, চোখে হাসি, মুখে আঁচল-চাপা কৌতুক বোধ করেছে রেজা মেয়ের দল। সবাই লক্ষ করেছে কার খোঁজে জল-কাদা ডিঙিয়ে কালো কয়লার অন্ধকূপে নেমে আসে ম্যাকু। লক্ষ করে দেখেছে, রূপমতী যখন মাল-বোঝাই ঝুরিতে ঝাঁকানি দিয়ে সেটা মাথায় তুলে ফিরে দাঁড়ায় আর চোখাচোখি হয় ম্যাকুর সঙ্গে, তখন হঠাৎ যেন তৃপ্তির ঝর্না নামে বাউন্ডুলে সাহেবটার মুখে-চোখে। আর রূপমতীও বোধ হয় ছোকরা সাহেবের নির্লজ্জ পাগলামি দেখে ফিক করে হেসে ফেলেই মুখ গম্ভীর করে।

কিন্তু দিনের পর দিন এমনি একভাবে আসা, দেখা হওয়া, হাসি কৌতুক…কেমন যেন নেশা ধরে যায় রূপমতীর। ঝুড়িটা উলটে নিয়ে তার ওপর বসে পা ছাড়য়ে একদিন লালোয়া কুড়ুখের সঙ্গে গল্প না করতে পেলেও বোধ হয় মন খারাপ হয় না রূপমতীর। মন খারাপ হয় দৈনন্দিন নেশা না মিটলে।

এদিকে কানাঘুষো হাসাহাসি থেকে ব্যাপারটা গুরুতর হয়ে দাঁড়াচ্ছে, বেশ টের পাচ্ছিলো রূপমতী। পট্টির বুড়াবুড়ীরাও বলা-কওয়া শুরু করেছিলো। লালোয়া কুড়ুখও বেজাত, কিল্লির মিল নেই। তবু তাকে নিয়ে রটনার মৌমাছি গুনগুন করে না। যত আপত্তি ম্যাকু-সাহেবের বেলা।

সাহেব। ও হলো আমাদের শত্রুর জাত। চান্দো বোঙা পাপের জল ছিটিয়ে দিয়েছে ওদের ওপর। ধরম নাই ওদের, তাই সান্তালদের ধরম নষ্ট করতে এসেছে ওরা’। চান্দো বোঙার কাছ থেকে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে খিস্টেন করে দেয় ওরা। যেমন করেছে ওই মরিয়ম, সেবাস্তিনা, মেরিয়া, রেজিকে। তাই রূপমতীকেও সাবধান করে দিয়েছিলো পাট্টির সর্দারনী। মুণ্ডা গিতিওড়ার মেয়ে-দের, ওঁরাও ধুমকুড়িয়ার কুমারী মেয়ের দলকেও।

সান্তালপাড়ার ছিমছাম মেয়ে সোনামিরু কানে কানে রূপমতীকে বলেছিলো, বুড়ারা নজর রাখছেন তুয়ার পানে। সোনামিরুর এই সাবধান-বাণী শুনেই ভয় পেয়ে গেল রূপমতী। বুড়ারা নজর রাখছেন! কেন তা রূপমতী ভালো করেই জানে।

বিটলাহা !

চোখের সামনে ভেসে উঠেছিলো বছর খানেক আগের একটি দৃশ্য। বিটলা হওয়ার পর তিলে তিলে শুকিয়ে মরতে দেখেছে ও সেবাস্তিনার মাকে। পঞ্চায়েতের ভয়ে ওঁরাও-মুণ্ডারাও কথা বলতো না, এক পয়সার তেল কি নুন কিনতে পেতো না। শানচারীর হাটে। অশ্লীল ঠাট্টা-বিদ্রুপ, নোংরা অঙ্গভঙ্গি করে তাকে পাগল করে তুলতো বারো বছরের বাচ্চাগুলোও। আর-ভাবতেও শিউরে ওঠে রূপমতী।

জোয়ান বুড়ো সবাই ধরম অধরম ভুলে হল্লা বাধাতো তার ডেরায়, রাতে-বিরেতে। লাজশরমের বালাই ছিলো না লোকগুলোর। তাই কারও দিকে চোখ তুলে তাকাতেও ভুলে গিয়েছিলো রূপমতী। এক শুধু চুপচাপ দেখাশোনা লালোয়া কুড়ুখের সঙ্গে। দু কুড়ি টাকা জমলেই চলে যাবে কুমাণ্ডির খাদানে। দুজনে বাসা বাঁধবে সেখানে। বিটলার ভয়ে কাঁপতে হবে না। তাই সন্ধ্যে পার না হতেই পাট্টির পথ ধরতো ও, সাহস হতো না আগের মতো ম্যাকু-সাহেবের সঙ্গে রয়ে-বসে রসিকতা করতে। মান্কির হুকুম না নিয়ে যেতো না আড্ডায়-আখড়ায়। কিন্তু ভিখারিয়ার ডুগডুগি উপেক্ষা করতে পারলো না ও। এসে হাজির হলো এই রামলীলার মাঠে।

ভিড় থেকে উঠে এসে সটান গিয়ে দাঁড়ালো ও মিঠাপানির দোকানটার সামনে। লাল নীল নানা রঙের বোতলে সস্তা লেমনেড আর চা-বিস্কুট নিয়ে রীতিমতো একটা দোকান বসে গেছে। আর কি আশ্চর্য, এই শীতেও যত চাহিদা ওই দুর্লভ মিঠাপানির। রূপমতীর খাটো শাড়ির আঁচলে বাঁধা খুচরো পয়সা গুনতে গুনতে তাকালো এদিক-ওদিক। অর্থাৎ পিয়াস গলার নয়, মনের। খুঁজছিলো লালোয়া কুড়ুখকে। দুফেরী পাল্লার কাজ সেরে সটান এখানে চলে আসবার কথা তার!

আসবে ঠিকই, জানে রূপমতী। ভিখারিয়ার নাচ আর রূপমতীর নাম— দু দুটো হাতছানি উপেক্ষা করার মতো ছাতির জোর লালোয়ার মতো বাইশ বছরের সান্ডার অন্তত নেই। তবু একটু অধীর না হয়ে পারে না ও। সাঁঝের ‘আওয়াজ’ শোনা যায়নি এখনো। ভয় সেটুকুই। কাজ শেষ করে হাতের শাবল নামিয়ে রেখে লালোয়াটা খাদানে বসেই গল্প শুরু করে দেয় কোনো কোনো দিন, ডিনামাইটের সাবধানী ঘান্টিটাও শুনতে পায় না। এমন এক ব্লাস্টিং-এর সময়েই কয়লার সীম চাপা পড়ে মারা গেছে রূপমতীর আঠারো বছরের জোয়ান ভাই হরবনশী।

এদিক-ওদিক খুঁজে আবার গিয়ে আসরে বসলো রূপমতী। টের পেলো না ভিড়ের মধ্যে চুপচাপ বসে কোথায় লালোয়া কুড়ুখ একমনে তোতা আর ম্যোরের গান শুনছে। ভিড়ের গলায় গলা মিলিয়ে হো হো করে হেসে উঠছে থেকে থেকে।

ভিখারিয়া জমে উঠলো এদিকে। সন্ধ্যা নামলো। ঘন হলো অন্ধকার। আর মূল গায়েন থেকে সবাই এসে একে একে দেখা দিয়ে গেল। এদিকে রূপমতী, ওদিকে লালোয়া-নাটুয়াদের মুখে অপরের কুৎসা শুনে দুজনেই হাসছিলো হো হো করে। কিন্তু কে জানতো সে গানের ধুয়ো ঘুরে ঘুরে রূপমতীতে এসে ঠেকবে।

‘বাঁশরিয়ার রূপমতী, মোতির মতো তার রূপ। ঝিনুকের ভেতর যেমন আড়াল থাকে মোতিয়া, তেমনি চুপচাপ মন রূপমতীর। গরিবে কুড়িয়ে পায়, তারপর হাতে হাতে ঘুরে রাজার আঙুলে গিয়ে শোভা পায় সে মোতিয়া। মন-চুপচাপ রূপমতী হাতে হাতেই ঘুরছে এখন, কিন্তু মন জানে ওর রাজার হাদিস।’ এত কাব্য করে বলবার লোক তো নয় ভিখারিয়ার নাটুয়ারা। তাই গানটা কেমন যেন অসহ্য লাগলো লালোয়ার। অপেক্ষা করলো কেউ জবাব দেয় কি না শোনবার জন্যে। কিন্তু সবাই শুধু হো হো করে হাসলো। এমন কি, রূপমতী নিজেও। আর রাগ সামলাতে না পেরে হাতের কাছে একটা কয়লার চাঙড় পেয়ে সেটা ধাঁই করে ছুঁড়ে মারলো লালোয়া, গায়েনকে লক্ষ্য করে।

হইহই হট্টগোল। আসর-শুদ্ধ লোক দাঁড়িয়ে উঠলো উৎকণ্ঠায় আশঙ্কায়। একদল লাঠিসোঁটা নিয়ে তাড়া করলো গায়েনের দিকে। আরেক দল তাড়া করে এলো লালোয়া কুড়ুখকে।

ফার্নহোয়াইট, ডিক্‌সন, সাঠে আর সাহানার নেশা জমে উঠেছে তখন। কার হাত থেকে যেন গেলাসটা ছিঁটকে পড়লো ঝনঝন শব্দ করে। রঙিন চোখ চেয়ে ব্যাপারটা ঠাহর করবার জন্যে উঠে দাঁড়ালো সাঠে। টলতে টলতে দু কদম এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো, ক্যা হয়া? চিল্লাতা কাহে? কেউ হয়তো শুনলো না তার কথা। উত্তর দিলো না কেউ।

রূপমতীও ভয়-কাঁপা চোখে তাঁকয়ে দেখাছিলো। কি করবে, কি করা উচিত কিছুই যেন ঠিক করতে পারলো না প্রথমটা।তারপর চোখ জোড়া লালোয়ার মুখের উপর পড়তেই ভিড়ের দিকে ছুটে যাবার জন্যে পা বাড়ালো ও। আর পরমুহূর্তেই থেমে পড়তে হলো।কাঁধের ওপর ভারি হাতের অনুভব পেয়েই ফিরে তাকালো রূপমতী। ফার্নহোয়াইটের ছেলে ম্যাকুসাহেব বললে, যাও মাৎ। বলে রূপমতীর হাত ধরে ডাক দিলো, চলো, ডেরামে ভাগ্‌ চলো রূপমটি। এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করলো রূপমতী, পারলো না। অসহায় চোখমেলে ও শুধু তাকালো ম্যাকুসাহেবের মুখের দিকে। ঠিক সেই মুর্হূতেই ভিড়টা যেন রুপমতীর দিকে ভেঙে পড়লো। লালোয়া কুড়ুখের ওপর যত রাগ, সব এসে পড়লো রপমতীর ওপর। পাপ যদি না করেছে তো রূপমতীর নামে ছড়া বাঁধবে কেন ভিখারিয়ারা, কুইলার চাঙড় ছুঁড়বে কেন লালোয়া কুড়ুখ। ও হলো সান্তাল, সাথাসাথি কিসের এত লালোয়ার সঙ্গে।

আসরটা ভাঙে দিবার তরেই তৈরী ছিলো কুড়ীটো। বলাবলি করলো সকলে। বলে রূপমতীর দিকে ছুটে এলো দলটা। পাশ থেকে মরিয়ম ফিসফিস করে বললে, পালায় যা, তু পালায় যা রূপমতী। আর ম্যাকু বললে, আও, চলে আও রূপমটি। বলেই ওর হাত ধরে টানতে টানতে অগ্নি-কুণ্ড ছাড়িয়ে অন্ধকারে নেমে পড়লো।

নির্জন ফাঁকা মাঠের অন্ধকারে এসেই পা থেমে পড়লো রূপমতীর। অস্ফুটে বললে, লালোয়া, লালোয়ার কি হবেক সাহেব? পরমুর্হূতেই ম্যাকুর হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বললে, আমি আছি ইখানে, লালোয়াকে তু বাঁচা রে সাহেব! কান্না এলো যেন ওর গলা ঠেলে।

—ডরো মাৎ।

রূপমতীর পিঠে ভারি হাতখানা রেখে সান্ত্বনা দিলো ম্যাকু। আর এই সময়েই বাতাস চিরে একটা বন্দুকের আওয়াজ হলো। থরথরিয়ে কেঁপে উঠলো রূপমতী। ম্যাকুসাহেবের চওড়া বুক টের পেলো ঝড়ো পায়রার ছটফটানি।

আশ্লেষ শিথিল করে ম্যাকু বললে, যাও, ডেরামে যাও রূপমটি। লালোয়া বাঁচেগা। বলেই আসরের দকে ছুটতে শুরু করলো সে। বেশ কিছুক্ষণ অন্ধকারের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে ডেরার দিকেই পা বাড়ালো রূপমতী।

লালোয়া বাঁচলো, কিন্তু ভিখারিয়াদের টাঙির ঘায়ে জখম হলো তার একখানা হাত। আর জখম হলো সান্তালপট্টির মান- ইজ্জত।

রূপ-ঝরানো ফুর্তি নিযে হাসি-হাসি মুখে হেলেদুলে বেড়াতো রূপমতী। ফার্নহোয়াইট বা ডিকসন হঠাৎ যদি বা কখনো খাদে নেমেছে কয়লার সম পরীক্ষা করতে, কিংবা ওভার-বার্ডেনের স্তূপ ডিঙিয়ে দেখতে গেছে ঠিকাদারের সাক্ষীর নাপী ঠিক ঠিক হয়েছে কি না,তো মাথার ঝুড়ি ফেলে বড় বড় চোখের কৌতুক আর কৌতুহল মেলে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছে রূপমতী, সাহেবের মুখপানে চোখ এঁটে। শনিচারীর হাটে হুড়ু কিনতে গিয়ে ফিরেছে রঙিন কাচের জলচুড়ি নয়তো গলায় পুঁতি-আঁটা হাঁসুলি পরে। কেউ সন্দেহ করেনি, দোষ দেখেনি কেউ। খাদানের রেজা, কদমে কদমে তার চোখ রাখলে চলে না। মন যুগিয়ে চললে তবেই ঘরে চালের যোগান আসে, সে খবর সবাই জানে। তা বলে এমন বে-আবরু হয়ে ইজ্জত হারানো?

ভিখারিয়ার গায়েন কিনা ছড়া বাঁধলো রূপমতীর নামে? সান্তালপট্টির মান রইলো কোথায় তা হলে?

বুড়া চুন্দু, হাঁসদা পঞ্চায়েত ডাকলো। ডাকলো রূপমতীর বাপ মাধো সোরেনকে। আর সে খবর দিয়ে গেল রূপমতীর সই সোনামিরু। বললে, পঞ্চায়েত ডাকছে বুড়া চুন্দু।

—ক্যানে? বিস্ময়ে চোখ কপালে তুললো রূপমতী।

সোনামিরু হেসে বললে ভিখারিয়ার রাতে ম্যাকুসাহেবের সঙ্গে পাপ করেছিস, স্মরণ নাই তুয়ার?

—হু। হাসলো রূপমতী। বললে, পঞ্চায়েত বসুক গিয়া। কাল চুন্দু বুড়ার ঘাড়ে বাক্‌টো ফেলায় দিব, হঁ। কিন্তু ঘাড়ে বাকেট ফেলে দিয়ে চুন্দু বুড়োকে মেরে কি হবে, দুর্নাম রুখবে কে?

সারনাতলায় পঞ্চায়েত বসলো, আর পঞ্চায়েতের লোক এক কথায় বিচার দিলো।

—বিটলাহা।

বিচার শুনে মাধো সোরেন ফিরলো মাঝরাতে। মেয়েকে ডাকলো কাঁদো-কাঁদো গলায়। রূপমতী-কি আপুং?

মাধোর চোখ সজল হলো। —পঞ্চায়েত বিটলার বিচার দেছে রূপমতী!

—বিটলা? হতাশ চোখ মেলে প্রশ্ন করলো রূপমতী।

—বিটলা চমকে উঠলো ম্যাকুসাহেবের খবরটা শুনে।

খাদানের কাজ সেরে ফেরবার সময় ম্যাকুকে খবরটা জানাতে গিয়েছিলো সোনামিরু। সোনামিরু চোখ মুছে বললে, সায়েব, তুই পাপ করেছিস, তু ইবার বাঁচা উয়ারে। কিন্তু বাঁচাতে বললেই তো বাঁচানো যায় না।

দুটো টান দিয়েই সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো ম্যাকু। জেলেকনাইটের কাঠের বাক্সটা টেনে নিয়ে বসলো তার ওপর। আর টিপলারে যেখানে কয়লার স্তূপ জমছে বাকেট উলটে উলটে, সেদিকে তাকিয়ে ভাবতে চেষ্টা করলো, কি করা উচিত। তারপর হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো ম্যাকু। ধীরে ধীরে নিজেরই অজান্তে কখন পাট্টির দিকে পা বাড়ালো। শুধু হুকুমই নয়, পাঁচ গাঁয়ের মানকি তখন পঞ্চায়েতের বিচার দিয়ে দিয়েছে। ভিখারিয়ার গানই নয়, হইহল্লার সুযোগ নিয়ে রূপমতী ম্যাকুসাহেবের সঙ্গে আঁধারে গা ঢাকা দিয়েছিলো কেন, তা নাকি কারও বুঝতে বাকি নেই। অতএব, বিটলা।

বিচার শুনে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো রূপমতী। যে লোকগুলো এত ধরম-অধরমের কথা বলছে, ও জানে এরাই এসে ইজ্জত কাড়বে ওর। খিদের যন্ত্রণায় কিংবা রোগে ভুগে ভুগে যখন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে ও, তখনো দয়ামায়া দেখাবে না কেউ। বিটলা! বিচার দিলো বড় পঞ্চায়েত। আর সঙ্গে সঙ্গে সারা গাঁয়ের ছেলে-ছোকরারা দলে দলে বাঁশ আর মাদল বাজিয়ে নাচতে নাচতে ঘিরে ফেললো রূপমতীকে। আর তার পিছনে পিছনে আরেক দল এলো তীর-ধনুক উঁচিয়ে।

ঠাট্টা বিদ্রুপ হাসাহাসি আর অশ্লীল গান। কেউ তীরের খোঁচা দিলো, কেউ টানলো তার শাড়ির আঁচল। আর মাঝে মাঝে হইহই চিৎকার। বাচ্চা ছেলেগুলোও ছড়া কাটতে শুরু করলো। দু হাত তুলে চিৎকার করতে করতে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো রূপমতীর গায়ে।

এদিকে বাঁশ পোঁতা হলো রূপমতীর ডেরার সামনে। পোড়া কাঠ, পুরোনো ঝাঁটা, আর ভাত খাওয়ার পর ফেলে দেওয়া শালপাতা গেঁথে দেওয়া হলো বাঁশের ডগায়। কেউ উনোন ভাঙলো, কেউ হাঁড়ি কড়াই টুকরো টুকরো করলো।কিন্তু তারপর, তারপর পাড়ার মেয়েরা পালালো সেখান থেকে। যে যার ঘরে ঢুকে কপাট বন্ধ করে দিলো, লজ্জাশরমের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যে।

লোকগুলোর কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি দেখে কিন্তু স্থির থাকতে পারলে না ম্যাকু। গাছটার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বললে, বীস্টস্‌। যাকে সামনে পেলে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। তারপর শাড়িটা কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিলো রূপমতীর গায়ে। ম্যাকুসাহেবকে দেখে ভয়ে থেমে পড়লো সবাই।

গায়ে কাপড়টা কোনোরকমে জড়িয়ে নিয়ে দাঁড়ালো রূপমতী। কপাল থেকে ঝরঝর রক্ত পড়ছে তখন। সারা গায়ে কাদা। ম্যাকু এগিয়ে এসে শক্ত করে ধরলো রূপমতীর একখানা হাত। তাকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে তুললো বাংলোয়।

ফার্নহোয়াইট বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। বিস্ময়ে কপালে ভ্রু তুলে তাকালেন। অর্থাৎ কি ব্যাপার?

বাউন্ডুলে ম্যাকু একগাল হেসে বললে মাই লেডী লাভ, মাই ওয়াইফ তারপর বললো সব ঘটনা। শুনে হাসলেন ফার্নহোয়াইট।-এ প্রাইজ ইন্ডিড, এ প্রাইজ ফর ইওর শিভালরি। বলে সামনের টুল থেকে হুইস্কির গেলাসে আরেকটা চুমুক দিলেন। কথাগুলো শুনলো রূপমতী, কিন্তু বুঝলো না কিছুই। কৃতজ্ঞতার চোখ মেলে ও শুধু তাকালো ম্যাকুর দিকে, অপমান আর নির্যাতন থেকে যে ওকে বাঁচিয়েছে। রাতটাও কাটলো ফার্নহোয়াইটের বাংলোতেই, যে বাংলোর কোণের ঘরে ওঁরাওদের খিস্টানী মেয়ে মেরিয়ার রাত কাটতো! রূপমতীর কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিলো মেরিয়া।

—সাহেবের বেটার নজর পড়ছে তুয়ার পরে, ডর নাই রে রূপমতী।

ডর নাই? যত ভয়ডর তো সেইজন্যেই। খাদানের কাজের ফাঁকে হাসি দিল্লাগী এক জিনিস, আর তার বাংলোয় রাত কাটানো অন্য। পিরীত ওর লালোয়া কুড়ুখের সঙ্গে। ঠিগিয়া হবে দু কুড়ি টাকা জমলেই। তা নয়, ম্যাকুসাহেব হাসতে হাসতে এসে বলে কিনা রূপমতীকে শাদি করবে ও। বেজাত খিস্টানের সঙ্গে শাদি? লালোয়াকে মুছে ফেলে ম্যাকুসাহেবের সঙ্গে মিতালি পাতাতে হবে? মেরিয়া বোঝালো রূপমতীকে।— ম্যাকুসাহেবের বাপটা আমারে সুখে রাখছে রে রূপমতী, বেটাও সুখে রাখবেন তুয়ারে। বলছে বিয়া করবে বটে। শুনে ভয়ে কাঁপলো রূপমতী। শিকল ছিঁড়ে পালালো ফার্নহোয়াইটের বাংলো থেকে।

হোক বিটলা। পাট্টিই ভালো ওর। তবু তো লালোয়া কুড়ুখের সঙ্গে দেখা করতে পাবে লুকিয়ে। আর, আর বুড়ো বাপ মাধো সোরেন। তাকে ফেলে কিনা সুখের ঘর বাঁধবে রূপমতী? অন্ধকারে শরীর লুকিয়ে ফিরে গেল রূপমতী। পা টিপে টিপে ঝাঁপি সরালো, ঢুকলো ভেতরে।

মাধো সোরেন বিছানায় শুয়ে শুয়ে তখন কাশছে খুকখুক করে। আর জ্বরের ঘোরে গোঙাচ্ছে থেকে থেকে। রূপমতী ডাকলো ধীরে ধীরে —আপুং।

—রূপমতী? চোখ খুললো মাধো।

রূপমতী এগিয়ে এলো কাছে, বাপের নির্বিকার মুখটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ও। দেখলো মাধো সোরেনের দু চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আশঙ্কায় আগ্রহে প্রশ্ন করলো, আহার পাইছোন না আপুং? মাধো বিষন্ন হাসি হেসে মাথা নাড়লো।

তারপর ধীরে ধীরে সব কথা বলে গেল মাধো। বিটলা হয়েছে রূপমতী। তাই মাধোর ঘুনসিতে কড়ি থাকলেও দাম নেই তার। হাটের লোককেও জানিয়ে দিয়েছে পঞ্চায়েত। হুড়ু বেচবে না কেউ ওকে, সিম-সমারি কিনবে না।

—পট্টির সকলে ডাইন বুলছে তুয়ারে। ডাইনীর বাপে ভুখা মরতে হবেক।

—সোনামিরু? আশায় আশায় প্রশ্ন করলো রূপমতী।

হাসলো মাধো। ধুমকুড়িয়ার মেয়ে বটে সোনা, পঞ্চায়েতের ডর নাই উয়ার?

দীর্ঘশ্বাস ফেললো রূপমতী। পঞ্চায়েতের ভয়ে সাহায্য তো দূরের কথা, দেখা হলে কথাও বলবে না কেউ, জিনিস বেচবে না দোকানী। শুধু বিদ্রুপ আর অত্যাচার। না খেতে পেয়ে তিলে তিলে মরতে হবে। সে সাংঘাতিক দৃশ্য দেখেছে রূপমতী। তবু আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করলো। হয়তো লালোয়া কুড়ুখ আসবে, সব বিপদ থেকে তাকে বাঁচাবে।

কিন্তু লালোয়ার দেখা মিললো না। পঞ্চায়েতের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে আসতে সাহস পেলো না হয়তো। শুধু সোনামিরু একদিন গভীর রাতে লুকিয়ে এসে খাবার রেখে গেল। আর চাপা গলায় বলে গেল, ইখান থেকে পালায় যা রূপমতী, তু পালায় যা। উয়ারা দল বাইন্ধা হামলা করবে তুয়ার পরে, আমি শুনছি। ভয়-চাপা গলায় বললে সোনামিরু. ভয় বাড়িয়ে দিলো রূপমতীর। কিন্তু কি করবে রূপমতী? কি করতে পারে? সারারাত বসে বসে ভাবলো ও। তবু বুড়ো বাপ মাধো সোরেনকে ফেলে যেতে মন চাইলো না।

পরের দিন সোনামিরুর কথাই ফললো। রাত না বাড়তেই রূপমতী হইহল্লা শুনতে পেলো। দল বেঁধে আসছে সবাই। ঝাঁপির ফাঁকে চোখ রেখে দেখলো রূপমতী। কুৎসিত উত্তেজনার হাসি চমকে উঠছে তাদের মুখে চোখে। আর বুড়ো মাধো সোরেন নিঃশ্বাস চেপে ভয়ে ভয়ে বললো, পালায় যা রূপমতী, তু পালায় যা। পিছনের ঝাঁপি খুলে পালালো রূপমতী। বুড়ো বাপের দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে ছুটে পালালো অন্ধকারে। ম্যাকৃুসাহেবের বাংলোর পথ ধরে। ম্যাকুসাহেব ওকে বিয়া করবে বলেছে, ম্যাকুসাহেব ওকে আশ্রয় দেবে।

ওঁরাওদের খিস্টানী মেয়ে মেরিয়া বলেছে, সাহেবের বেটার নজর পড়েছে তুয়ার পরে, ডর নাই রে, সুখ্যে রাখবেন।

সব কানাকানি খেউড় হল্লা চুপ হয়ে গেল।

পঞ্চায়েত বললে, মানকির বিচার মিছা হয় না। পাপ করেছিলো রূপমতী, আখন পাপীর ঘরে ঠাঁই পায়েছে। কোলিয়ারির কুলিকামিনরা বললে. বিটলাটো ঠিকই হইছে, কিন্তুক ডাইন ইবার হামাদের মজুরি কাটবেক। বুড়া সাহেবের বেটার ঘরনী হয়েছে উ।

ম্যাকুসাহেবের ঘরনী হয়েছে রূপমতী, খবরটা শুনলো উঁচুতলার লোকরাও। ডিক্‌সন সিগারেটের টুকরোটা জুতোয় মাড়িয়ে বললে, ন্যুইসেল্স। একটা সান্তাল গার্লকে কিন৷ বাংলোয় নিয়ে গিয়ে তুলতে দিলো ফার্নহোয়াইট? মিশিরজী আর সাহানা চোখ চাওয়াচাওয়ি করে হাসলো। অর্থাৎ বুড়ো নিজেই বা কম কি! মেরিয়া? কম্পাসবাবু চোখ কুচঁকে কি যেন

ইঙ্গিত করলেন।

সোনামিরু এসে বসলে লালোয়া কুড়ুখের ক্লান্ত গাইতিটার পাশে। কোমরের গামছাটা খুলে পাখার মতো নাড়তে নাড়তে বললে, জোয়ান মানুষটো তুই সায়েবের ডরে লুকায় থাকবি? দীর্ঘশ্বাস ফেললো লালোয়া বললে, রূপমতীরে সমঝায়ে দেখ তুই, কুমাণ্ডির খাদানে কাম মিলবেক বটে, ধাওড়ায় ঘর মিলবেক। বিটলার ডর নাই। সোনামিরু বললে, হুঁ, সমঝাবো রূপমতীরে। কিন্তুক তুয়ার দুইটো হাতে ঘর বাঁধবারহইল নাই, একটো হাতে কি ঘর বাঁধবারে পারবিন?

কাটা হাতটার দিকে তাকিয়ে বিষন্ন হাসি হাসলো লালোয়া। কিন্তু রূপমতী বুঝলো না। —লালোয়া? শুনে খিলখিল করে হেসে উঠলো ও। বললে, ওটা মরদ বটেক, না ধুমকুড়িয়ার কুড়ী? বিটলার সময় যাতে পারে নাই টাঙ্গি লিয়ে?

শুনে আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো লালোয়া। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে নিজেই গিয়ে হাজির হলো বাংলোর বাগানে।

ফার্নহোয়াইটের বাচ্চা মেয়েটার পেরাম্বুলেটর ঠেলছিলো রূপমতী। প্রথমটা চিনতে পারেনি, ভাবছিলো আয়াট্যকেই জিগ্যেস করবে রূপমতীর খবর। কিন্তু বাঁক ঘুরে রূপমতীর সামনাসামনি হতেই সারা মূখ ম্লান হয়ে গেল লালোয়ার।

মাজাঘষা রূপ, তকতকে ফরসা একখানা শাড়ি, চুলে যত্নের চাকচিক্য। লালোয়া বললে যা বলবার। অনুনয়, অনুযোগ। আর রূপমতী শুধু অসম্মতির ঘাড় নাড়লো। -ম্যাকুসাহেব কে তুয়ার, ও কি বিয়া করবে সান্তাল কুড়ীকে?

রূপমতী হাসলো। বললে, হুঁ। গির্জায় যায়ে খিস্টান হবো, ম্যাকুসাহেব বলেছে আমার হাসবাঁধ বটে।

সত্যিই হলো তাই। শুনলো কোলিয়ারির সবাই। সুন্দরগড়ের সাদা-আলখাল্লা পাদরী-সাহেব বাইকে চেপে এসে হাজির হলো একদিন, ছোট গির্জার অল্টারের সামনে দাঁড়িয়ে কি বলে গেল কিছুই বুঝলো না রূপমতী। শুধু বুঝলো ওর নতুন নাম হলো রেবেকা। রূপমতী থেকে রেবেকা। সান্তাল থেকে খিস্টানী।

খুশিতে উছলে ওঠে রূপমতীর মন। পরের রবিবারেই ওদের বিয়ে। তারপর? তারপর ওকে রেবেকা মেমসাহেব বলবে সকলে। খাদানের কুলকামিনরা আর পঞ্চায়েতের যারা বিটলার জন্যে চিৎকার করেছিলো তারাই সেলাম জানাবে দেখা হলে। এ যেন হারানো ইজ্জত ফিরে পাওয়া। লালোয়ার সঙ্গে ঠিগিয়া হলে কি এ সম্মান পেতো ও। সারা জীবন শুধু ভয়ে ভয়ে কাটাতে হতো। কে কি কানাঘুষা করে, কে কি বিচার দেয়।

ম্যাকুর কাছে কতবারই তো শুনেছে ও, বিয়ের পর ম্যাকু হবে ওর হেরেল, স্বামী। খিস্টান ভাষায় যাকে বলে হাসবাঁধ অর্থাৎ হাসব্যাণ্ড। আমলকীর ঝিরঝিরে পাতার ফাঁকে বাঁকা চাঁদের জ্যোৎস্নায় রূপমতী সব ভূলে গেল।

ভাবলো, সুখের জীবন বুঝি মোড় নিলো এবার। কিন্তু ভুল ভাবলো রূপমতী।

কোলিয়ারির চাকরি তো জুয়ার টাকা। আসতে যেতে সময় লাগে না। হিসেবের গলদ ধরা পড়লো, কোলকাতার অফিস জানালো ফার্নহোয়াইট বিদায় নিতে পারে চাকরি থেকে। ফার্নহোয়াইট ছেলেকে ডেকে বললো, চাকরি যাক দুঃখ নেই। দুঃখ শুধু টাকাগুলো ওড়ানোর জন্যে। তুমিও তো রোজগারের ধার দিয়ে গেলে না। চুপ করে রইলো ম্যাকু ফার্নহোয়াইট বললে, তল্পিতল্পা বাঁধতে হবে এবার। ভাবছি বাঙ্গালোরে গিয়ে থাকবো, আর যদি চাকরি একটা পেয়ে যাই ভালোই।

—আমি? প্রশ্ন করলো ম্যাকু।

—হ্যাঁ, তোমার বাবস্থাও করেছি। তোমার বোন ডোরা এসে পৌঁছবে এই সপ্তাহেই তার সঙ্গে আসছে পার্সিভালের মেয়ে সিলভিয়া।

—তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক?

ফার্নহোয়াইট হাসলেন। —তার যোগ্য হতে পারো তো পার্সিভাল নিশ্চয় একটা রেলের চাকরি তোমাকে দিতে পারবে।

বিয়ে?

—কপালে চোখ তুলছো কেন? লাভ ইজন্ট সামাথং ইম্পসিবল? মৃদু হেসে ফার্নহোয়াইট বললেন, রেবেকার কথা ভাবছো? ওটা কি বিয়ে নাকি?

রোজগারের টাকাগুলো নষ্ট করেছি বটে, কিন্তু তোমার পাগলামির জন্যে দু-পাঁচ শো টাকা খেসারত দেবার সঙ্গতি এখনো আছে।

শুনে কি একটা দাঁতে চিবোনো কটুক্তি করে সরে পড়লো ম্যাকু। কিন্তু দিনকয়েক পরেই যখন ডোরার সঙ্গে সিলাভিয়াও এসে পৌছলো, ম্যাকুর হঠাৎ মনে হলো বাপের কথাটা নেহাত মিথ্যে নয়। আর ফার্নহোয়াইট রূপমতীকে ডেকে বললেন,

চৌকিদারের ঘরটা খালি আছে, কটা দিন এখানে থাকবি। খুশী মনেই রাজী হলো রূপমতী। সত্যি তো। মেয়ে এসেছে, এসেছে মেয়ের সাথী। ও থাকলে বেমানান হবে বড়। আর অসাবিধেও হবে, হবে রূপমতীর নিজের।

সেই কথা বুঝিয়েই একদিন লরীতে মালপত্র তুললেন ফার্নহোয়াইট। ডোরা আর ‘সিল-ভিয়া আগেই চল গিয়েছিলো। তাই বিদার-মুহূর্তে রূপমতীর কান্না-ঝরা চোখ মুছিয়ে দিলো ম্যাকু। বাপের চোখ এড়িয়ে নিজের চোখও মুছলো হয়তো।

বললে, ফিরে আসবো এক সপ্তাহের মধ্যেই। তারপর নিয়ে যাবো আমার রেবেকাকে। সজল চোখে আনন্দের হাসি দেখা দিলো রূপমতীর। যাবার সময় এক গোছা নোট গুঁজে দিলো ম্যাকু, রূপমতীর হাতে। লরী ছেড়ে দিলো, পিছনে পিছনে ফার্নহোয়াটের ছোট্ট মোটরখানাও। কিন্তু ম্যাকু ফিরলো না আর।

ফার্নহোয়াইটের জায়গায় মাস কয়েক পরে এলেন মিস্টার পেরেরা। এসেই বাবুর্চিকে বললেন, চৌকদারের ঘর থেকে সান্তাল মেয়েটাকে তাড়াও। টুকটুকে বাচ্চাকে বুকে আঁকডে চোখ রাঙালো রূপমতী। বললে, কে জানিস আমি?

ম্যাকুসাহেব আমার হাসবাঁধ।

শুনে হাসলো বাবুর্চি, হাসলেন মিস্টার পেরেরা। মিশিরজী, সাহানা. কম্পাসবাবু, সবাই হাসলেন। আর ঠাট্টা-বিদ্রুপের ছড়া বাঁধলো সান্তালপট্টির মেয়েপুরুষ। হাসবাঁধ! সব বাঁধিন ছিঁড়ে পালিয়েছে ম্যাকু, তা কি এখনো বোঝেনি নাকি মেয়েটা?

হাসলো সবাই, হাসলো না শুধু একজন। লালোয়া কুড়ুখ।

গির্জার সামনের ঘরটায়, যেখানে বাচ্চা কোলে নিয়ে উঠে আসতে হলো রূপমতীকে, সেখানেই ভীরু ভীরু চোখে উঁকি মারলো সে একদিন। রূপমতীর চাটাইয়ের এক কোণে ভয়ে ভয়ে বসলো লালোয়া। বললে, চল রূপমতী, ইখান থেকে কুমাণ্ডির খাদানে চলে যাই। চোখ রাঙালো আবার রূপমতী। বললে, পাপের কথা সান্তাল কুড়ীদের সাথে বলবি, আমি খিস্টানী বেটি, পাপ কারি না আমি। ম্যাকুসায়েব আমার হাসবাঁধ।

সোনামিরুও এলো একদিন দেখা করতে। বললে, খাবি কি রূপমতী? খাদানে কাম নিবি তো চল, মুনশীরে বলি।

—খাদানের কাম? চোখ কপালে তুললো রূপমতী। বললে, আমার না ম্যাকুসায়েবের সাথে বিয়া হইছে। ম্যাকুসায়েবের ইজ্জত খতম্‌ করতে চাস তুরা?

—ম্যাকুসায়েবের ইজ্জত? রাগে দাঁতে দাঁত চাপলো সোনামিরু। —উ আর ফিরবে নাই রে, উ আর ফিরবে নাই। অবিশ্বাসের হাসি হাসলো রূপমতী।-ম্যাকুসায়েব মানুষটারে তুরা বুঝিস নাই বটে। ও আমারে কয়ে যেছে ফির‍্যা আসবে।

কিন্তু ফিরলো না ম্যাকুসায়েব। আর ম্যাকুসায়েবের ইজ্জত বাঁচাবার জন্যে অনাহারে অভাবে দারিদ্র্যে রূপ হারালো রূপমতী। দিনের পর দিন স্বাস্থ্য ভেঙে পড়লো তার।

লালোয়া কুড়ুখ এলো একদিন। বসে গল্প করলো অনেকক্ষণ, তারপর অনুরোধ জানালো কুমাণ্ডির খাদানে যাবার। আর সে কথা হেসে উড়িয়ে দিলো রূপমতী। কিন্তু হাসি মুছে গেল ক্রমশ তার মুখ থেকে। সত্যিই ফিরলো না ম্যাকু।

তবু ম্যাকুর বাচ্চাকে মানুষ করে তোলবার স্বপ্ন দেখলো রুপমতী। এক ইটের দেয়াল দেওয়া দেহাতী গির্জার পশ্চিমের ছোট ঘরটায় চাটাইয়ে শুয়ে শুয়ে দিনের পর দিন স্বপ্নদেখলো।

ছেলে বড় হবে, খাদানের সাহেব হবে তার ছেলে। সোনামিরু বলে কিনা খাদানে কাজ নিতে। নিজের মনেই হাসলো রূপমতী। সে হলো ম্যাকুসাহেবের মেম, ইজ্জত নাই তার? সুন্দরগড়ের সাদা আলখাল্লার পাদরী বাইক ঠেলে আসতো প্রতি রবিবার। বাইবেল পড়ার পর আর-আর খিস্টানীদের সঙ্গে রূপমতীও সুর টেনে টেনে গাইতো প্রার্থনার গান,

তারপর ইশু বোঙার কাছে বলতো, ম্যাকুসায়েবেরে তাড়াতাড়ি পাঠায় দে ইশু বোঙা। পাদরী যাবার সময় সান্ত্বনা জানিয়ে যেতো। কখনো বা ওঁরাও আর মুন্ডা খিস্টানীদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে দিয়ে যেতো রূপমতীকে। সোনামিরুও আসতো মাঝে মাঝে। এনামেলের থালায় করে ঠাণ্ডি ভাত এনে রাখতো তার পাশে। বসতো, গল্প করতো।

আর বাইরের রাস্তায় গাড়ির শব্দ শুনলেই ছুটে আসতো রূপমতী। ওই বুঝি ম্যাকু-সাহেবের গাড়ি এলো। একমুখ আশা-উজ্জ্বল হাসি নিয়ে ছুটে আসতো রাস্তা অবধি। তারপর মুখ কালো করে দীর্ঘশ্বাস বুকে পুষে ফিরে যেতো।

সোনামিরুকে বলতো, ফিরবো রে, ফিইরা আসবো। বেটার মুখ দেখবারে বাপ না ফিইরা পারবো ক্যানে। লালোয়াও এসেছে কোনো কোনো দিন। সোনামিরুর সঙ্গে। আর ফেরার পথে ওরা বলাবলি করেছে. রূপমতীটো পাগল হইছে।

সোনামিরু এসে জানিয়েছে, কাজ না করলে না খেয়ে মারা যাবে রূপমতী। বলেছে, মুনশীকে বলে কাম ঠিক করে দেবে।

আর রূপমতী হেসেছে সে কথা শুনে। ম্যাকুসায়েবের ওড়াগমকে অর্থাৎ ঘরনী কিনা খাদে গিয়ে ঝুড়ি বইবে? তাতে যে ম্যাকুসায়েবের ইজ্জত নষ্ট হবে।

এমনি করেই দিনের পর দিন কেটেছে। শেষে মৃত্যুও ঘনিয়ে এলো একদিন।

দুপুরের ছুটির সাইরেন বাজার পর এনামেলের থালায় করে ঠাণ্ডা ভাত নিয়ে এসে সোনামিরু ঘরে ঢুকেই চিৎকার করে উঠলো রূপমতীর বীভৎস চেহারা দেখে। এনামেলের থালাটা ধীরে ধীরে নামিয়ে রেখে রূপমতীর বুকের কাছ থেকে তুলে নিলো ফুটফুটে বাচ্চা ছেলেটাকে।

তারপর—

চাঁদা তুলে কবর দেওয়া হলো রূপমতীর। সুন্দরগড়ের সাদা আলখাল্লার পাদরী বাইক ঠেলে এলো আবার, বাইবেল থেকে দু লাইন বিড়বিড় করে বলে গেল।

কবরের নিস্তব্ধতায় নামিয়ে দেওয়া হলো রূপমতীর মৃতদেহ। কবর নয়, মাটির ঢিবি। তার ওপর দু টুকরো কাঠ আড়াআড়ি করে বেঁধে একটা ক্রস পুঁতে দেওয়া হলো। তারপর খিস্টান পল্লীর সবাই ভুলে গেল রূপমতীর কথা।

ভুললো না শুধু একজন। লালোয়া কুড়ুখ।

কারানপুরার কুলিকামিন, কোড়াকুড়ীরা বলে, প্রতিদিন সন্ধ্যায় এসে বসতো ও কবরের পাশে, ভয়ে ভয়ে হাত বুলাতো কবরের মাটির ওপর। চোখ থেকে জল ঝরে পড়ে সে মাটি ভিজে যেতো কোনো কোনো দিন। তারপর একসময় মাটির প্রদীপটা জ্বেলে দিয়ে চলে যেতো লালোয়া।

খিস্টান পল্লীর সান্তালরা বলে, লালোয়ার দেখাদেখি সোনামিরুও এসে বসতো কবরের পাশে। রূপমতীর ঘুম ভেঙে যাবে এই ভয়ে একটাও কথা বলতো না সে। শুধু কোনো কোনো দিন প্রদীপটা এগিয়ে দিতো নিজেই,কিংবা লালোয়ার হাত থেকে প্রদীপটা নিয়ে চকমকি ঠুকে ঠুকে নিজেই জ্বালাতো সেটা।

সান্তালপট্টির বুড়া-বুড়ীর দল বলে-শালপাতার আড়াল দেওয়া প্রদীপের শিখাটা জ্বলতো তারার মতো, দেখেছে তারা নিজের চোখে, প্রতিদিন দেখতে পেতো। আর তা দেখে একে একে সান্তালপল্লীর সবাই এসে বসতে শুরু করলো রূপমতীর

কবরের পাশে। এসে চুপচাপ বসে থাকা, তারপর প্রদীপ জ্বালিয়ে ফিরে যাওয়া। এ প্রদীপের শিখা সবাই দেখতে পেতো দূর থেকে।

ক্রমশ মর্গিবলি শুরু হলো রূপমতীর কবরের পাশে, পৌষ পরবে নাচ শুরু হলো। ওঁরাও মুণ্ডা, সান্তাল, হো সবাই মিলে পাথর দিয়ে বাঁধিয়ে দিলো রূপমতীর কবর, আর সেই কবরের গায়ে নাম খোদাই করার সময় ঝগড়া বাঁধলো সাদা আর কালো খিস্টানদের মধ্যে। কালো চামড়ার খিস্টানরাই জিতলো শেষ অবধি। রূপমতী নয়, রেবেকা ফার্নহোয়াইট নয়, মাধো সোরেনের মেয়ে রেবেকা সোরেনের কবর।

বড় বড় হরফ পাথর খোদাই করে লেখা হলো রেবেকা সোরেনের নাম। আজও কারানপুরার কোলিয়ারিতে রেবেকা সোরেনের কবর ঘিরে সারি সারি প্রদীপ জ্বলে। লালোয়া কুড়ুখের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবাই।

কিন্তু একটি নাম ডুবে গেছে বিস্মৃতির অতলে। নিবে গেছে শুধু একটি প্রদীপ।

যে প্রদীপ শুধু লালোয়া কুড়ুখই জ্বালাতে পারতো। যে আলো জ্বলতো শুধু সোনামিরুর বুকে।


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন