“সূয়া রে মোর সূয়া
মোর ব্যথায় ভরা হিয়া
বঁধুয়া ঐ আনবাড়ি যায়
মোর আঙিনা দিয়া।
ও মোর পিঞ্জরেরই পাখি,
তোর শুধুই ডাকাডাকি
কোন বনেতে গেছে প্রিয়
খবর দিবি তা’কি?
মহুয়া নেশায় মাতাল হয়ে
সঙ্গী যে মোর দূর,
যা উড়ে যা তোতা
তাকে শোনাস দুখের সুর।
কোন বনেতে চম্পা ফোটে
কোথায় নাচে মোর
ওকর লিহে পরান রোয়ে
যা সূয়া তু উড়।”
মাঠের ধানে রঙ লেগেছে। সকালবিকেল কুয়াশার চাদর জড়িয়ে গাঁয়ের পথঘাট। ছোটো দিনের বেলা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে গ্রামের পথঘাট। তুলসীতলায় মনমরা পিদিমের আলো। দীপাবলীর উৎসব শেষের বিষণ্ণতা তাতে লেগে আছে। বাতাসে ঝিম ধরানো ছাতিম গন্ধ। সরীসৃপদের শীতঘুমের সময় এল।
সকাল হতেই ঘরদুয়ারে জল দিয়ে হাতের কাজ সেরে নিল ছত্তিশগড়ের জানকী, এতোয়ারী, কুমারী, মঙ্গলা, দ্রৌপদী, সোমবারীরা। আজ যে তাদের সূয়া নাচার দিন। সংসারের ঊনকোটি চৌষট্টি কাজ থেকে ছুটি নিয়ে আজ মেয়েরা নাচবে, গাইবে। মনের কথা বলে ফিরবে পথে পথে। গৃহস্থের দুয়ারে দুয়ারে। কেউ দু-মুঠো চাল দেবে। কেউ দুটো পয়সা। তাই দিয়ে একদিন বনভোজন হবে। সংসারের দিনগত পাপক্ষয় থেকে মিলবে আরেকদিন মুক্তির আনন্দ।
তাদের মাথার ঝুড়িতে আছে তাদের পরানপুতলি মাটির সূয়া (টিয়া) আর নবীনধানের গুচ্ছ। একটি মাটির জ্বলন্ত প্রদীপ। তাতে আশার সলতেটি উসকে আছে। আজ তারা মনের সুখে সেজেছে। পেটি থেকে বার করেছে তুলে রাখা শাড়ি। ডালডাচাঁদির গয়না। যত্ন করে ঘুরিয়ে পরেছে প্রকৃতির রঙে রঙ মিলিয়ে লাল-সবুজ-বেগুনী-নীল রঙের লুগরা। নাকে নাকফুল। গলায় তিলরি, কণ্ঠী, সিক্কা কা মালা। হাতে নাগমোরি, আঁগঠী, ককনী। কানে ঢাঁড়ঝুমকো। মহাবর (আলতা) লাগানো পায়ে লাচ্ছা, মুন্দরী। কোমরে শাড়ি বেষ্টন করে আছে কর্ধন।
গা ভরা গয়না, এত সাজগোজ করেও তাদের কন্ঠে প্রিয়বিরহের গান। দুঃখের পাঁচালি। পায়ের লাচ্ছার ঘুঙুরে মিলিত ছন্দ। হাতে তালি দিয়ে ঘুরে ঘুরে তারা নাচে। প্রিয় মিটঠুকে শোনায় মনের দুঃখ। রট্টু তোতা মুখস্থ করে নেবে এ গান। দূতী হবে চিরদুঃখী মেয়েদের। কলকলিয়ে শোনাবে এ গান তাদের উদাসী প্রেমিক, সংসারবিমুখ স্বামীকে। তারা মেয়েদের মন বোঝেনা। কামবুতায় মন নেই। পরকীয়া করে। একদিন জনমজুরি খেটে রোজগার করে তো পরের দিন মহুয়ার নেশায় মাতাল হয়ে পথেঘাটে পড়ে থাকে। বিবাগী হয়ে এদিক সেদিক ঘোরে।
পুরুষ ঘরমুখো না হলে সংসার চলে না। মেয়েরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। জঙ্গলে তেন্ডুপাতা কুড়োয়। বিড়ি বেঁধে সংসারে দুটো আয় হবে। বাচ্ছাবুড়ো সবাই এ কাজে হাত লাগায়। যদিও বুড়ো শাস-শ্বশুর, ছেলেপিলের ক্ষুধার্ত সংসার তারই মুখের দিকে চেয়ে বসে থাকে। একলা নারী মাঠঘাট থেকে ছাতু (মাশরুম) খুঁজে বেড়ায়। পুকুরঘাট থেকে তোলে গেঁড়ি-গুগলি। এখানওখান থেকে শাকপাতা তুলে রান্না করে। গোটা সংসারের ক্ষিদে মেটায়। হাটে গিয়ে সবজি বেচে। সাহাবমনের ঘরে কামবুতা করে দুটো পয়সা রোজগার করে। ছেলেমেয়েকে পাঠশালায় পাঠায়। বন থেকে জ্বালানির কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরে।
সে বনপথে কোনো মুগ্ধ চোখের ইশারায় হয়তো বা কেউ সাড়া দেয়। ঘর ছেড়ে আবার সুখের সন্ধানে চলে। পিছুটান আর দুঃখের পুনরাবৃত্তিতে ছিন্নভিন্ন হয়। সংসার যাদের বড় দায়, তারা ঘরছাড়াদের যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে।
প্রেমিকপুরুষটিও মন দিয়ে কথা রাখে না। অনূঢ়া মেয়েটি আশায় আশায় বসে থাকে। বছর ঘুরে যায়। তাদের বয়স বেড়ে যায়। বিরহরাতি আর কাটে না। বাপ-মা গরীবের মেয়েকে কানা, খোঁড়া, বুড়ো, দোজবরে বিয়ে দিয়ে পার করায়।
সূয়াকে সাক্ষী করে সেইসব দুঃখের বারোমাস্যা গায় মেয়েরা। নদী, ঝর্ণা সে গান শিখে কলধ্বনি করে। প্রাচীন অরণ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাতা ঝরায়। পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয় সে বিষাদগীতি। ঋতুর আবর্তনে প্রকৃতি তার রূপ বদলায়। আকাশে মেঘ ঘনিয়ে আসে। প্রকৃতির কন্যারা আবার নতুন আশায় বুক বাঁধে।
গানের অনুবাদ অসাধারণ।
ধন্যবাদ। খুব খুশি হলাম।