বাংলায় শারদীয়া দুর্গোৎসবের পর আশ্বিন মাসের শেষে পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার আরাধনা করা হয়। বাঙালি হিন্দুর ঘরে ঘরে এক চিরন্তন প্রার্থনা। প্রায় প্রতি ঘরে ঘরেই দেবী লক্ষ্মীর পুজো হয়ে থাকে। লক্ষ্মী হলেন ধন সম্পত্তির দেবী। ধন সম্পদের আশায় ঘরে ঘরে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা হয়ে থাকে। নারী পুরুষ উভয়েই এই পূজায় অংশ গ্রহণ করেন।
‘কোজাগরী’ শব্দটির অর্থ জানা উচিত সবারই।
কোজাগরী’ শব্দটির উৎপত্তি ‘কো জাগতি’ থেকে। যার অর্থ, ‘কে জেগে আছ’?
হিন্দুদের বিশ্বাস, কোজাগরী পূর্ণিমা তিথিতে দেবী লক্ষ্মী মর্তে আসেন তাঁর ভক্তদের আশীর্বাদ দান করতে। দেবী লক্ষ্মী পার্থিব এবং অপার্থিব সম্পদ, সৌভাগ্য এবং সৌন্দর্যের দেবী। এই তিথিতে যাঁরা রাত্রি জেগে দেবীর আরাধনা করে দেবীর আগমনের অপেক্ষায় থাকেন, তাঁরা লক্ষ্মীর বিশেষ আশীর্বাদ প্রাপ্ত হন।
পুজোর অপরিহার্য অঙ্গের মধ্যে রয়েছে ধানের শিষ ও দেবী লক্ষ্মীর পায়ের পাতার আদলে আলপনা। তারসঙ্গে কলা গাছের খোলা দিয়ে তৈরি বাণিজ্য তরী, সঙ্গে বিশেষ ভোগ। এছাড়াও নারকেল নাড়ু, চিড়ে দেবীর প্রসাদের অঙ্গ হয়ে থাকে। দেবী লক্ষ্মীর পুজোয় নিয়ম মেনে পড়া হয় পাঁচালী। এই পাঁচালী পাঠ করার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। পাঁচালী পাঠের ভালো দিক জেনে নেওয়ার আগে দেখা যাক, লক্ষ্মীর বাহন হিসাবে পেঁচাকে কেন বেছে নেওয়া হয়।
আমাদের মা ঠাকুমাদের আমালে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা সমারোহে সঙ্গে পালিত হতো। লক্ষ্মী পূজার ভোগের জন্য নানা ধরনের আয়োজন করা হতো।কত রকমের নাড়ু মুড়কি যে তৈরি হতো তা বলে শেষ করার নয়।
কত রকমের চেয়ে নাড়ু তা বলে শেষ করার নাই। নারকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু, চিড়ার নাড়ু, খইয়ের নাড়ু, মুড়ির নাড়ু ইত্যাদি ।
সেকালে লক্ষ্মীপুজোর নাড়ু বড়ু, খৈ,মুড়কি ইত্যাদিকে যশোর অঞ্চলে লক্ষ্মীপুজোর ভুজ বলা হত। বাবা-কাকার আমলে এমনকি আমার সৃময়েও গ্রামের লোকজন লক্ষ্মীপূজার ভুজো খাবার চল ছিল।
রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য প্রখ্যাত লেখিকা রানী চন্দ ‘আমার মায়ের বাপের বাড়ি’ বইয়ে সেকালের কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার নাড়ু মুড়কি ও আলপনার যে বর্ণনা দিয়েছেন তা সেকালের লক্ষ্মী পূজার উৎসব এর কথা উঠে এসেছে।
কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা রাত্রে করার নিয়ম থাকলেও একালে নানা কারণে দিনের বেলায় হচ্ছে।
একালে লক্ষ্মী ঠাকুরণ কে জাগে? এ প্রশ্নের উত্তর পান কি!
সেকাল গত হয়েছে। নাড়ুবড়ুর কাল উধাও। নারকেল পাওয়া যায় না। গুড় চিনির দাম আকাশ ছোঁয়া। মুড়ি মুড়কি এখন আর গ্রামের মহিলারও এখন তৈরি করে না। এখন বিলবাওড় নেই। শাপলা ফুল নেই। শাপলার ঢ্যাপ কোথা থেকে আসবে। আগে কথায় বলতো, কাজ নেই খৈই ভাজো। এখন খৈয়ের ধান হয় না, হয় হাইব্রিড ধান, তাতে খৈই তৈরি হয় না।
তিলের নাড়ুর জন্য তিল দরকার,কৃষকের ঘরে তিল নেই। হাট বাজারেও তিল নেই।
একালে নম নম করে লক্ষ্মী পুজো সারছে যেনতেন প্রকারে। সম্পদের দেবী লক্ষ্মীদেবী আজ আর পেচঁকে পিঠে চড়ে এসে বলেন না, ‘কে জেগে আছো?’ কাউকে জেগে না থাকতে দেখে দেবী ফিরে যান সম্পদ না দিয়েই।
মনোজিৎকুমার দাস, প্রাবন্ধিক, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা