বাংলার দুর্গাপুজো কেবল বাঙ্গালির শ্রেষ্ঠ উৎসব নয়, যে পুজোকে কেন্দ্র করে এই উৎসব সেই পুজোর মধ্যে রয়েছে বিস্ময়, বিশেষ করে বাড়ির পুজোতে। তাই সেই পুজো নিয়ে বলার মতো অনেক কিছুই থেকে যায়। পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম থানা এলাকার খাটুন্দি গ্রামের একটি আশ্চর্য দুর্গাপুজো হল সাত বাড়ির দুর্গাপুজো। বর্তমানে ছ’টি পুজো। কিন্তু কেন এই পুজোর নাম সাতবাড়ির দুর্গাপুজো। আবার এই সাতবাড়িকে কেষ্ট রায় উঠোন বলা হয়। কারন একই সঙ্গে যেখানে দুর্গাপুজো হয় সেখানে কৃষ্ণ পুজোও হয়।
সাতবাড়ির দুর্গাপুজোর পিছনে রয়েছে একটি বিশাল ইতিহাস। প্রায় ৬৫৮ বছর আগে যেখানে কেতুগ্রাম এলাকার খাটুন্দি গ্রাম, সেই গ্রামের দক্ষিণ দিকে বয়ে যাওয়া কাঁদর নামে একটি নদীখাতের ধারে ছিল ঠাকরুণপুকুরের মাঠ। এই মাঠেই দুর্গা পুজো শুরু করেছিলেন রামগোপাল ভট্টাচার্য। আবার এই গ্রামের বিদ্যাভূষণ পটিতে কৃষ্ণমন্দির তৈরি করেন তারই পরিবারের আরেক সদস্য। তাঁর পাশে তিনিও দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন। তবে ভট্টাচার্য পরিবারের পূর্বপুরুষরা শুরুর দিকে একটি প্রতিমাতেই পুজো শুরু করেছিলেন। কালে কালে যেমন পারিবার ভাগ হয় সেই সঙ্গে ভাগ হয়ে যায় পুজো। তার ফলে পরিবারের সাত বংশধর সাতটি আলাদা দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন।
খাটুন্দির এই পুজোয় বাড়ির উঠোনে মাত্র ২০ মিটারের মধ্যে বর্তমানে হয় ছ’টি দুর্গা প্রতিমার পুজো। পাকা মন্দির রয়েছে কিছু। বাকি গুলো টিনের চাল ও মাটির দেওয়াল। পরিবার বড় হওয়ায় পুজো ভাগ হয়ে গেলেও ভট্টাচার্য বাড়ির দুর্গাপুজোয় পারস্পরিক সম্প্রীতির কোনও অভাব নেই। প্রত্যেকে মিলেমিশেই আয়োজন করেন পারিবারিক দুর্গাপুজো। আর নজরকাড়া বৈশিষ্ট্য হল, একটাই মণ্ডপে পাশাপাশি ছটি দুর্গাপুজো হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। যেখানে পাশাপাশি ছটি পুজো হয়, তার পাশেই রয়েছে কৃষ্ণরায়ের মন্দির। তাই এই সাতবাড়িকে কেষ্টরাই উঠোন বলা হয়।
বাড়ির উঠোনে কৃষ্ণের পাশেই শাক্ত মতে ষোড়শ উপাচারে দুর্গা পুজো হয়। তবে কৃষ্ণের পুজোর হয়ে যাওয়ার পর শুরু হয় দুর্গা পুজো। শতাধিক বছরের প্রাচীন কেতুগ্রামের খাটুন্দি গ্রামের ভট্টাচার্য পরিবারের ‘সাত বাড়ির পুজো’ এ ভাবেই বৈষ্ণব ও শাক্ত মতের মেলবন্ধন ঘটাচ্ছে। প্রতিপদের দিন ঘট ভরা হয় এবং ছ’খানা পুজোর ছ’টি ঘট ঈশাণী নদী থেকে ভ’রে এনে কেষ্টরাইয়ের মন্দিরে রাখা হয়। সেদিন থেকেই শুরু হয়ে যায় পুজোর তোড়জোড়। প্রতিপদ থেকে দশমী পর্যন্ত প্রতিদিন কৃষ্ণের মন্দিরে রাখা ঘটগুলির পুজো হয় আগে, তারপর দুর্গা পুজো। এছাড়া সপ্তমীর দিন ভোরবেলা নবপত্রিকার সঙ্গে ছ’টি দুর্গার নিজস্ব আলাদা আলাদা ঘট ভরা হয় এবং সেগুলিকে দুর্গা মন্ডপে রাখা হয়। পুজোর মতো শ্রীকৃষ্ণকে ভোগ দেওয়ার পরেই দুর্গাকে ভোগ দেওয়া হয়। ছ’টি পরিবারের প্রত্যেকের বাড়িতে কেষ্ট রাইকে নিয়ে গিয়ে অন্নের ভোগ দেওয়া হয়। ভোগ হয়ে গেলে কেষ্ট রায়কে আবার মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয় এবং শয়ন করিয়ে দিয়ে দুর্গার ভোগারতি শুরু হয়। কৃষ্ণকে বাদ দিয়ে কোন কিছু করা হয় না। এই ভাবে ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত চলে পুজো। তারপর মন্দির থেকে বের করে আনা হয় কৃষ্ণকেও। আরতি শেষ হলে হরিনাম সংকীর্তনের পরে স্থানীয় পুকুরে হয় প্রতিমা বিসর্জন। খাটুন্দি গ্রামের ভট্টাচার্য পরিবারের ‘সাত বাড়ির পুজো’য় এটাই হল সব থেকে বড় আকর্ষণ।
এই ভট্টাচার্য পরিবারের দুর্গা মূর্তিগুলিও বংশপরম্পরায় গড়েন নেউল মিস্ত্রির পরিবার। বলিদানের কাজটিও একইভাবে করে আসছেন সহদেব কর্মকারের পরিবারের সদস্যরা। খাটুন্দির ভট্টাচার্য বাড়ির দুর্গাপুজো ছাড়াও কয়েকটি পুজো হয় গ্রামের আশেপাশে। কিন্তু বাকি পুজোর থেকে এই পুজো সম্পূর্ণ আলাদা। পুরোনো যে রীতি নীতি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেই এই পুজো করে আসছেন বাড়ির বর্তমান প্রজন্ম। বর্তমান শরিকরা পুজো উপলক্ষ্যে গ্রামের বাসিন্দাদের খাওয়ানো, জামা কাপড় দেওয়ার রীতিটাও বজায় রেখেছেন। যে কারণে খাটুন্দির ভট্টাচার্য বাড়ির পুজোয় পরিবারের সঙ্গে মেতে ওঠে গোটা গ্রাম। পুজোর ক’দিন উৎসব মুখরিত হয়ে ওঠে ভট্টাচার্য পরিবার।
শোনা যায় ভট্টাচার্য পরিবারের তিন নাতির মধ্যে শরিকানা নিয়ে ঝগড়া বাঁধে। বিবাদের ফলে দুর্গা পুজোও প্রথমে তিনটে হয়ে যায়। বড় ভট্টাচার্য, মেজো ভট্টাচার্য ও ছোট ভট্টাচার্যের আলাদা আলাদা তিনটে পুজো। পরবর্তীতয়ে মেজ ভট্টাচার্যের পুজোও ভাগ হয়। ছোট ভট্টাচার্যের ঠাকুর দৌহিত্র সূত্রে ব্যানার্জিরা পান। সেটিও দুভাগ হয় যায়। বাকি দুটি পুজোর মধ্যে একটি গ্রাম্যসূত্রে মুখার্জিরা শুরু করেন। বছর কুড়ি হল ভট্টাচার্য পরিবারের এক শরিক কাটোয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছে। সেই বাড়িতেও পুজো হয়; কাটোয়ার চাউল পট্টিতে। তাই নামে সাত বাড়ি হলেও খাটুন্দিতে এখন ছয় বাড়ির ছ’টি পুজো হয়। তবে সেই মন্দিরটিতে মূর্তি না আনা হলেও নবমীর দিন ঘটে পুজো দেওয়া হয়। পরপর দুবছর মহাষ্টমীর দিনই এই পরিবারের দুজন পথ দুর্ঘটনায় নিহত হন। তারপর থেকে তাঁরা এখান থেকে কাটোয়ায় কাঠামো স্থাপিত করেছেন।