বিদ্যাসাগরের কীর্তি এতই বিচিত্র দিকে ছড়িয়ে যে অন্ধের হস্তী দর্শনের মতো আমরা নিতান্তই টুকরো টুকরো করে তাঁকে পরিমাপ করতে যাই।তাঁর সম্পর্কে যতই বলা হোক না কেন তা প্রায় সমুদ্র থেকে এক ঘটি জল তুলে নেওয়া বৈ কিছু নয়। মনীষীদের সম্পর্কে গাল গল্প চালু হওয়া খুব স্বাভাবিক। বিদ্যাসাগরের সম্পর্কেও হয়েছে।কিন্তু এই সব অলীক কাহিনী ও অসার কিংবদন্তী মূলক গালগল্পের ফলে তাঁর জ্ঞান ও কর্মের বিশাল জগৎ কিন্তু চোখের আড়ালেই থেকে গেছে। তাঁর সাঁতরে দামোদর পেরোনো বা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় পড়ালেখার গল্প যত জনপ্রিয় হয়েছে, ততটাই অন্তরালে থেকে গেছে তাঁর বিশাল কর্ম জগতের বিস্তৃতি। তাঁর বিচিত্র বিষয়ে অক্লান্ত কর্ম করে যাওয়ার বিস্ময়কর ক্ষমতা চর্চার অভাবে সাধারণের জ্ঞানের অগম্য থেকে গেছে। তাঁর জীবদ্দশায় পরিবেশ ও পরিস্থিতি তাঁকে সামান্যই সাহায্য করেছে।নিজের ক্ষমতা বলে তিনি প্রভাবিত করেছেন তাঁর চারপাশের পরিবেশকে, অকল্পনীয় সাহস ও পরিশ্রমের মূল্যে অনেক খানি পাল্টেও ছিলেন শিক্ষা ব্যবস্থার অচলায়তন ও সমাজ ব্যবস্থার স্থবির অবস্থান। উচ্চপদস্থ সাহেব সুবোরা তাঁকে পছন্দ করতেন তাঁর উদার ও আধুনিক চিন্তাভাবনা ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানসিকতার জন্যে।
আজকের ভাষায় যাকে বলে ‘পসিটিভ থিংকিং’ বিদ্যাসাগর ছিলেন তার মূর্ত প্রতীক। যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে হার না মানা মানসিকতাই ছিল তাঁর সাফল্যের চাবিকাঠি। বিধবা বিবাহ প্রবর্তন, বাল্য ও বহু বিবাহের বিরোধিতা ও বাংলা ভাষাকে সাবলকত্ব দেওয়ার পাশাপাশি স্বদেশীয়দের জন্য শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে তাঁর অভূতপূর্ব অবদান রয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর ভেবেছিলেন পুরোপুরি নতুন এক ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থার কথা। পড়া, লেখা, আঁক কষেই যা ফুরিয়ে যাবে না। তিনি চান মনের দরজা জানালা খুলে দিতে। প্রাথমিক শিক্ষা তার আরম্ভ মাত্র। তিনি চান এমন স্কুল যেখানে ছেলে মেয়েরা শিখবে আধুনিক ভূগোল বিজ্ঞান, পড়বে বিজ্ঞানীদের জীবনী। সেই সঙ্গে পাবে ‘অধর্মীয়’ অর্থাৎ ‘সেক্যুলার’ নীতিশিক্ষা। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে বোধের বিস্তার তাঁর শিক্ষা ভাবনার লক্ষ্য। এর জন্যে তাঁকে অনেক যুদ্ধ লড়তে হয়েছে। সংস্কৃত কলেজে পাঠ্যক্রমের পরিবর্তন করতে গিয়ে বিদেশি শাসকের সঙ্গে যুদ্ধে নামতে হয়েছে। নিন্দুকের অভাব তাঁর কোনো কালেই হয়নি। তাঁর প্রবর্তিত ‘secular’ বা ‘অধর্মীয়’ শিক্ষা নীতির জন্যে সমালোচিত হয়েছেন,তবু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধৰ্মীয় ছোপ লাগতে দেননি। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে শিক্ষক ও ছাত্র তাঁর প্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছেন ও পড়েছেন। সরকারি সাহায্য ছাড়াই গড়ে তুলেছেন তাঁর প্রতিষ্ঠান। বিদেশি শাসক দের দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁর ক্ষমতা।
সংস্কৃত কলেজের ছাত্ররা যাতে সরকারি চাকরি পায় তার জন্যে তিনি তদবির করেছেন। আজ থেকে কত দিন আগে তিনি ছাত্রদের ‘প্লেসমেন্ট’ এর কথা ভেবেছেন। আজকাল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে ‘campassing’-এর মাধ্যমে যে ছাত্রদের ‘placement’ এর ব্যবস্থা করা হয়, প্রায় দুই শতাব্দী আগেই বিদ্যাসাগর এর মাথায় এই ধারণা এসেছিল। তাঁর যুগের তুলনায় অনেক এগিয়ে ভাবতে পারতেন বলেই তাঁর জীবনে বাধা বিপত্তিও প্রচুর এসেছে। কি বিধবা বিবাহ প্রচলনে কি বাল্য বিবাহ বা বহু বিবাহ রদ কি স্ত্রী শিক্ষার প্রচারে — সব ক্ষেত্রেই রক্ষনশীল সমাজের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েছেন। কিন্তু কখনোই লক্ষ্যচ্যুত হননি।
তাঁর আর এক অভাবনীয় কীর্তি হল তিনি সেই পরাধীন যুগেও মেট্রোপলিটন কলেজে সমস্ত বাঙালি শিক্ষক দিয়ে পড়িয়ে অভূতপূর্ব সুফল পেয়েছেন। মেট্রোপলিটন কলেজের ছাত্ররা যখন এফ.এ পরীক্ষায় হিন্দু কলেজের ছাত্রদের থেকেও ভালো রেজাল্ট করে তখন সাহেবরাও মানতে বাধ্য হন যে “the pundit has done wonders”. আরো একটি উল্লেখ করার মতো বিষয় যে মেট্রোপলিটন কলেজের বাঙালি অধ্যাপকরা অভিজাত হিন্দু কলেজের অধ্যাপক দের থেকেও বেশি বেতন পেতেন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সুপারিশে। সংস্কৃত প্রেস ও পুস্তক প্রকাশনী শুরু করে তিনি যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছিলেন। নিজেকে পরিচয় দিতেন ‘বিদ্যা বণিক’ বলে। বিদ্যা চর্চার সঙ্গে ব্যবসার বিরোধ নেই তিনিই প্রথম প্রমাণ করলেন। তাঁর বিপুল পরিমাণে দানধ্যানের কাজে এই ব্যবসালব্ধ অর্থের অবদান অনেকখানি। ব্যবসার ক্ষেত্রেও তিনি স্বাধীনচেতা। একবার শিক্ষাবিভাগের উড সাহেব দাবি করেন যে বিদ্যাসাগরের প্রকাশিত বইগুলির অত্যধিক দাম বেশী। দাম না কমালে সরকারি বিদ্যালয় এইসব বই কেনা বন্ধ করবে। বিদ্যাসাগরের উত্তর ছিল তিনি ন্যায্য দামেই বই বেচেন। তাই বইয়ের দাম কমানো সম্ভব নয়। সরকার যা খুশি করতে পারেন।
প্রখর আত্মমর্যাদা বোধের পরিচয় বরাবরই পাওয়া গেছে। Asiatic Society-র সদস্য থাকা কালীন জাদুঘরে তাঁকে প্রায়ই যেতে হতো। একদিন এক দারোয়ান তাঁকে বলে যে চটি পরে ভিতরে প্রবেশ করা যাবে না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসেন।কর্তৃপক্ষ একথা জানতে পেরে বার বার ক্ষমা প্রার্থনা করে ও তাঁকে বলে যে তিনি স্বচ্ছন্দে জাদুঘরে যেতে পারেন।তাঁর জন্যে নিয়ম শিথিল করা হবে। কিন্তু তিনি জানান যে যদি সবার জন্য নিয়ম পরিবর্তন করা সম্ভব না হয় অর্থাৎ সাধারণ ভারতীয় দর্শনার্থীরা যদি চটি পায়ে জাদুঘরে প্রবেশ করতে না পারে তবে তিনি আর কোন দিন জাদুঘরে যাবেন না।
বাস্তব বুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞান, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষমতা এই গুণগুলির পরিচয় দিয়েছেন সব সময়। নিজে সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত হয়েও যুগের প্রয়োজনে ইংরেজি ভাষা শেখার প্রয়োজন বুঝে সংস্কৃত কলেজে ছাত্রদের ইংরেজি পড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন। আগে অঙ্ক শেখানো হতো সংস্কৃতে। বিদ্যাসাগর ইংরেজিতে অঙ্ক শেখানোর ব্যবস্থা করলেন। তাতে সুফলও পাওয়া গেলো। সংস্কৃত কলেজে ছাত্র সংখ্যাও বাড়তে লাগলো। Fort William কলেজে চাকরি করতে করতে নিজেও রীতিমতো ইংরেজি শিখেছেন। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় আস্থা থাকায় হোমিওপ্যাথি বই কিনে শুধু পড়েননি, ডাক্তারি শেখার জন্য নরকঙ্কাল পর্যন্ত কিনেছেন। বিনামূল্যে চিকিৎসা করে বহু লোককে সুস্থ করেছেন। বিশেষত কারমাটাঁড়ে থাকার সময় বহু দরিদ্র সাঁওতাল তাঁর চিকিৎসায় সুস্থ হয়েছে।
দেশের মানুষের উপর কোনো অন্যায় দেখলেই রুখে দাঁড়িয়েছেন। সে তাঁর শিক্ষাঙ্গনের বাইরের বিষয় হলেও। একবার জানতে পারলেন যে বর্ধমান জেলার একটি মহকুমায় ছোট ব্যবসায়ী দের উপর অন্যায় ভাবে ইনকাম ট্যাক্স ধার্য করা হচ্ছে।ওই ছোট ব্যবসায়ীরা বিদ্যাসাগরের শরণাপন্ন হলেন। বিদ্যাসাগর ছোট লাট সাহেব কে বলে তদন্ত কমিশন বসানোর ব্যবস্থা করেন। দু-মাস অন্য সব কাজ ফেলে এই কাজে নিযুক্ত থাকেন। সেই আমলে প্রায়দুই হাজার টাকা তাঁর এই কাজে ব্যয় হয়। দেশের অতিসাধারণ লোকের জন্যে তাঁর এই সহানুভূতি প্রমাণ করে যে সব মানুষই তাঁর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। বর্ধমানে যখন ম্যালেরিয়ার প্রকোপ হয় বিদ্যাসাগর নিজ ব্যয়ে ডাক্তার ও ঔষধ নিয়ে সেখানে যান। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে লোকের দরজায় দরজায় গিয়ে সেবা করেছেন।এই জাতিভেদ আক্রান্ত দেশে একজন ব্রাহ্মণের এই আচরণ সত্যি বিস্ময়কর। নারী শিক্ষার বিস্তারে একের পর এক স্কুল খুলেছেন। নিজের খরচে স্কুল গুলি চালিয়েছেন। সরকারি সাহায্য ছাড়া। নিজে স্কুল গুলিতে গিয়ে ছোট ছোট মেয়েদের বই উপহার দিয়েছেন,তাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্যে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বাস্তবধর্মী ও আধুনিক মনস্ক। অতীত থেকে বর্তমান, বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের অভিমুখে তাঁর চলার পথ তিনি নিজেই তৈরী করেছেন। কাউকে অনুকরণ বা অনুসরণ করেননি। নিজের অভিজ্ঞতা ও বিচার বুদ্ধির দ্বারাই সমাজ সংস্কারের কাজ করেছেন। এমন একজন মানুষ হাজার দেবতার চেয়েও বড়। তাঁর দুই শত দুই তম জন্মবার্ষিকীতে ফুল মালা ধূপ ধুনো দিয়ে মূর্তিপূজার থেকে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর কাজ করার অপরিসীম উৎসাহ, প্রতিকূল পরিস্থিতিকে নিজের আয়ত্তে আনার মত ইতিবাচক চিন্তা ধারা, অদম্য মনের জোর থেকে যদি কিছু শিক্ষা নিতে পারি তবেই তাঁকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে বলে আমার মনে হয়।