মহারাষ্ট্রের খেরে জন্মগ্রহণ করেন বিপ্লবী শিবরাম হরি রাজগুরু। ১৯২৮ সালে বিপ্লবী ভগত্ সিংহ ও সুখদেবের সঙ্গে মিলিতভাবে লাহৌরে ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার জে পি সন্ডার্সকে হত্যা করেন। যা লাহৌর ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। সন্ডার্সকে হত্যার দায়ে ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ মাত্র ২৩ বছর বয়সে তাঁর ফাঁসি হয়।
স্বাধীনতা মাসে স্মরণপথে আসেন বীর সেনানিরা। স্মরণ করি গান্ধি, মৌলানা, প্যাটেলদের। অহিংস পথের পাশাপাশি যাঁরা সহিংস পথে দেশের স্বাধীনতা আনার পণ করে প্রাণ দিয়েছেন অকাতরে, তারা কি একটু আড়াল হয়ে যান এই মুক্তি-ঋতুতে?
এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ অগণিত বীরের আত্মদানগাথা। শিবরাম রাজগুরু তাঁদেরই অন্যতম। রাজগুরুদের আত্মদানের প্রেক্ষিতটা সংক্ষেপে একবার স্মরণ করা যেতে পারে। ভারতের শাসন কাঠামো ও তার সম্ভাব্য সংস্কার নিয়ে বিচার-বিবেচনা করতে ১৯২৮ সালে ভারতে এসেছিল সাত সদস্যের সাইমন কমিশন। কমিশনের নেতা স্যর জন সাইমনের নামেই কমিশনের এহেন নাম প্রচলিত হয়েছিল। কিন্তু ভারতীয়রা এহেন কমিশনে তীব্র আপত্তি জানায়। মহাত্মা গান্ধী, নেহরু, জিন্না সহ বহু নেতা কমিশনের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, কারণ, ভারতের বিষয়ে বিবেচনা করতে যে কমিশন, তাতে একজনও ভারতীয় নেই। সাইমন কমিশন বয়কটের ডাক সমর্থন করেন সহিংস বিপ্লবীরাও। সারা দেশে প্রতিবাদ-সভা, মিছিল হতে থাকে। তখনই ঘটে যায় এক নৃশংস ঘটনা।
লালা লাজপত রায়ের মৃত্যু
লাহোরে সাইমন কমিশন-বিরোধী মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন পাঞ্জাব কেশরী লালা লাজপত রাই। ১৯২৮ সালের ৩০ অক্টোবর শান্তিপূর্ণ মিছিলের মধ্যেই এই নেতাকে পুলিশ নির্মম ভাবে মারে। দারুণ আহত হয়েও লালা সমবেত জনগণের উদ্দেশে সংক্ষিপ্র বক্তৃতা করেন।পুলিশের মারে গুরুতর আহত পাঞ্জাব কেশরী লালা লাজপত রাই ১৭ নভেম্বর ১৯২৮ প্রয়াত হন। কিছুটা দূরে, নীরবে ভগত সিংহ ও তাঁর সহযোগী বিপ্লবীরা ঠিক করে নেন, বদলা নেওয়া হবে। ১৯২৮ সালেই ভগত সিংহ, আসফাকুল্লা খান, চন্দ্রশেখর আজাদ, সুখদেব থাপার এবং যোগেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্ম দিয়েছিলেন হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন সংগঠনের। এরই সশস্ত্র শাখার নাম ছিল হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি। লালা লাজপত রাই-এর মৃত্যুর জন্য দেশবাসী লাহোরের পুলিশ সুপারিনটেন্ডেন্ট জেমস এ স্কট-কে দায়ী করতেন। ভগত সিংহরা এই স্ক-এর ভবলীলা সাঙ্গ করে দেবার পরিকল্পনা করেন।
পাঞ্জাব কেশরীর মৃত্যুর বদলা নিতে যান ভগত সিংহ, শিবরাম রাজগুরু, চন্দ্রশেখর আজাদ প্রমুখ। চিনতে না পেরে স্কট-এর বদলে লাহোর পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার স্যান্ডারস-কে গুলি করা হয়। পুলিশের হাত এড়িয়ে পোস্টার দিয়ে বিপ্লবীরা জানিয়ে দেন লালার মৃত্যুর বদলা নেওয়া হয়েছে।
লালা লাজপত রাইয়ের মৃত্যুর ঠিক একমাস পরে ১৭ ডিসেম্বর ১৯২৮ স্যান্ডারস নিহত হলেন। ১৯২৯ সালের ৮ এপ্রিল এই বিপ্লবীরা দিল্লির সংসদ ভবনে বোমা ফেলে ভীতির সঞ্চার করেন। যদিও কাউকে হত্যা করতে তাঁরা চাননি, তাঁদের আদর্শের প্রচারের জন্যই অ্যাকশন করা হয়েছিল।
১৯২৯ সালের এপ্রিল মাসেই একে একে হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি-র বিপ্লবীরা পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। পুলিশ অভিযোগ আনে, এই সহিংস স্বাধীনতা সংগ্রামীরাই স্যান্ডারস-কে হত্যা করেছেন। বিচারে ভগত সিংহরা নিজেদের আদর্শ প্রচারেই জোর দিয়েছিলেন, মামলা থেকে মুক্ত হতে ততটা নজর দেননি। ব্রিটিশ আদালত ভগত সিংহ, শিবরাম রাজগুরু ও সুখদেব থাপারের ফাঁসির আদেশ দেয়। সারা দেশ এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে ওঠে। অনেকেই আশা করেছিলেন, মহাত্মা গান্ধি বিপ্লবীদের ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাতে বড়সড় উদ্যোগ নেবেন। অনেকে মনে করেন, সহিংস বিপ্লব-বাদ সম্পর্কে অনীহার কারণেই গান্ধী এব্যাপারে তেমন সক্রিয় হননি।
আমি তোমার নাম লইয়্যা কান্দি
আদালতে রায় অনুসারে ফাঁসির দিন ঠিক হয়েছিল ১৯৩১ সালের ২৪ মার্চ। কিন্তু সারা দেশব্যাপী বিক্ষোভের পরিস্থিতিতে নজিরবিহীন ভাবে ফাঁসির সময় এগিয়ে আনা হয়। দিনের বেলা ফাঁসি না হয়ে ভগত সিংহ, শিবরাম রাজগুরু ও সুখদেব-এর ফাঁসি হয় রাত্রে। ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ফাঁসুড়ের হাতের ঝটকায় তিনটি দেহ ঝুলতে থাকে। শোনা যায়, শেষমুহূর্ত পর্যন্ত তাঁদের মুখের হাসি ও বিপ্লববাদে বিশ্বাস অটুট ছিল।
স্বাধীন দেশে ক্ষমতায় বসলেন নেহরু-প্যাটেলরা। ইতিহাসও নীরবেই নিজেকে কিছুটা বদলে ফেলল। অহিংস আন্দোলনই স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল ধারা, বিপ্লবীরা কেবলই ব্যাতিক্রম, এমনই একটা ধারণা ক্রমেই ব্যাপ্ত হয়ে পড়ল। আমরা ব্যস্ত হয়ে রইলুম রামমন্দির, অভিনেতার আত্মহত্যা আর সীমান্ত সারাদিন নিয়ে। কোথাও কি কেউ একলা নীরবে তাঁর জন্মদিনে শিবরাম রাজগুরুর জন্য দু-ফোঁটা চোখের জল ফেললেন? কি জানি!