[নাটক—বাদল সরকার। রূপান্তর—প্রতিভা অগ্রওয়াল। প্রযোজনা অনামিকা। পরিচালনা—শ্যামানন্দ জালান।]
যারা নাটক ভালবাসেন তাদের কাছে বাদল সরকারের ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’-এর নাম আজ আর অপরিচিত নয়। জন্ম-স্কুল-কলেজ চাকরি-বিয়ে-বংশরক্ষা ও মৃত্যুর নির্ধারিত চাকায় বাঁধা জীবন, জীবনের অর্থ খোঁজার জন্য অক্ষম অস্থিরতা এবং শেষে শুধু বাঁচার জন্যই গড়িয়ে গড়িয়ে বেঁচে যাওয়া- মোটের ওপর এই হল নাটকটিয় বিষয়। এই বিষয়বস্তু ও বাঙলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায়-নতুন আঙ্গিকের ব্যবহারে ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ বাঙলাদেশের নাট্যজগতে একটি দিকচিহ্ন। সম্প্রতি শামানন্দ জালানের পরিচালনায় এ নাটকের হিন্দী রূপান্তরের অভিনয় হল। স্বীকার করা ভালো যে প্রয়োগনৈপুণ্য ও সুঅভিনয়ের গুণে উৎরে যাওয়া উল্লেখযোগ্য প্রযোজনার সংখ্যা গত কয়েক বছরে যত বেড়েছে, যথার্থ সাহিত্যিক-মূল্য-সম্পন্ন নাটকের সংখ্যা তত বাড়ে নি। এ অবস্থায় শ্রীবটুকের অসমাপ্ত ‘চাঁদ বণিকের পালা, বিজন ভট্টাচার্য ও মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের একাধিক নাটক, চিত্তরঞ্জন ঘোষের কানামাছি ও বাদল সরকারের ‘ত্রিংশ শতাব্দী’, ‘সারা রাত্রি’, ‘পাগলা ঘোড়া’, ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ মূলত সংলাপপ্রধান নাটক। একদিকে খুব চলতি নিত্যব্যবহার্য ভাষা, আবার অন্যদিকে গভীর চিন্তার বাহক যে ভাষা, যাতে প্রায় প্রতিটি শব্দব্যবহারের গুরুত্ব আছে, এমন কি ছন্দোবদ্ধ পদ পর্যন্ত নাট্যকারের সহজ আনাগোনা। এই স্বাচ্ছন্দ্য হিন্দী অনুবাদে কতটা আসবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল। কিন্তু প্রতিভা অগ্রওয়ালের হিন্দী রূপান্তর শুধু স্বচ্ছন্দ ও সহজবোধ্য (এমন কি যারা হিন্দীভাষী নন তাদের পক্ষেও) বললে কম বলা হবে। এতে মূল নাটকের সমস্ত সূক্ষ্মতা, জটিলতা ও গভীরতা বজায় আছে। এ নাটকের বাঙলা প্রযোজনাটি আগেই দেখেছি, তাই তুলনা ও প্রতিতুলনা মনে আসা স্বাভাবিক। নির্দ্বিধায় বলতে পারি হিন্দী প্রযোজনাটি অনেক বেশি সফল—নাটকের মূল উদ্দেশ্য ও বিষয়ের অনেক বেশি কাছাকাছি। মঞ্চপরিকল্পনা থেকে আরম্ভ করে অভিনয়রীতি পর্যন্ত সর্বত্র এই সাযুজ্যের স্বাক্ষর আছে। এ নাটকের এক অংশে জীবনকে তুলনা করা হয়েছে এমন এক রেল লাইনের সঙ্গে যেখানে কখনও গাড়ি আসে না। এই লাইনটির প্রতি আক্ষরিক আনুগত্যের জন্য শৌভনিকের মঞ্চসজ্জায় রেলওয়ে সিগন্যাল এবং লাল ও সবুজ আলো রাখা হয়েছিল। তাতে পুরো ব্যাপারটি হাস্যকর ছেলেমানুষির স্তরে নেমে এসেছিল। হিন্দী প্রযোজনার মঞ্চসজ্জা অনেক বেশি ব্যঞ্জনাময়। মঞ্চের মাঝখানে কোনাচে আকারের একটি গুহা – গুহার প্রবেশমুখটি প্রায়-বৃত্তাকার। গুহার মাথায় একটি বৃত্ত। তার ডানদিকে ( মঞ্চ থেকে) আরো দুটি প্রায়-বৃত্ত। এগুলি গতানুগতিক জীবনের প্রতীক। এ ছাড়া গুহাটিতে পারিবারিক জীবনের একটা আভাস আছে। মাসিমা ও প্রেমিকা বা স্ত্রী প্রায় সর্বদাই ঐ গুহার ভিতর থেকে কথা বলেন। পাশের চক্রাকারে পথগুলির মধ্য দিয়ে নিয়ম-মেনে-চলা মানুষের অর্থাৎ অমল-বিমল-কমলেরা যাওয়া-আসা করে। কিন্তু নাটকের প্রথম অংশে নিয়মের বাইরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে যে মানুষ, অর্থাৎ ইন্দ্রজিৎ, সে কখনই এই প্রায়-বৃত্তাকার পথগুলি ব্যবহার করে না। এ পথে ইন্দ্রজিৎ-এর প্রথম প্রবেশ বিদেশ থেকে আসার পর—যখন সে তার ইন্দ্রজিৎ পরিচয় ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নির্মল হতে চাইছে—অমল-বিমল-কমলদের একজন হতে চাইছে। কোন সংলাপ উচ্চারিত হওয়ার আগেই, শুধু ইন্দ্রজিৎকে এই গুহা থেকে বেরোতে দেখেই দর্শকের মনে ধাক্কা লাগে—তারা মুহূর্তেই ইন্দ্রজিৎএর পরিবর্তন বুঝতে পারেন। ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ স্বভাববাদী নাটকের থেকে আলাদা। মঞ্চপরিকল্পনা ও অভিনয়রীতিতে পরিচালক সেই স্বাতন্ত্র্য অক্ষুন্ন রেখেছেন। পিকচার ফ্রেমের গণ্ডি ভেঙে মঞ্চ অডিটোরিয়াম পর্যন্ত বিস্তৃত দর্শকদের মধ্য থেকেই আমাদের মতো সাধারণ মানুষরা অমল-বিমল-কমল ইত্যাদি চরিত্রের অভিনেতারা মঞ্চে উঠে যান। তাদের জীবন যে একটা জায়গায় এসে স্থির হয়ে গেছে, আর কোন নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত বহন করছে না — এটা বোঝানোর জন্য অনেকটা চলচ্চিত্রের ফ্রিজ শটের ধরনে অভিনেতাদের বিশেষ ভঙ্গিতে স্থিরভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। রীতিবদ্ধ ( স্টাইলাইজড ) অভিনয়, মূকাভিনয়, জীবনের গতানুগতিকতা বোঝানোর জন্য একই বৃত্তের মধ্য দিয়ে ক্লান্তভঙ্গিতে অভিনেতাদের আনাগোনা, যান্ত্রিকভাবে অর্থহীন শব্দউচ্চারণের মতো করে কথা বলা, একই অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে দিয়ে বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করানো (যেমন, একই অভিনেতা লেখক, বেয়ারা পরীক্ষাগৃহে গার্ড ইত্যাদি ; একই অভিনেত্রী মাসিমা, প্রেমিকা, স্ত্রী, অফিসের স্টেনো ও হঠাৎ দেখা অপরিচিত মেয়ে ), মঞ্চসজ্জার কোন রকম পরিবর্তন না করে, শুধু সংলাপ ও দর্শকের কল্পনাশক্তির ওপর ছেড়ে দিয়ে একই দৃশ্যকে কখনও ঘর, কখন ও ক্লাস, কখনও অফিস, কখনও বা মাঠ হিসেবে ব্যবহার করা —ইত্যাদি থেকে পরিচালকের আধুনিক নাট্যরীতির পরিচয় পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা এ প্রযোজনায় আঙ্গিক কখনই নিছক কেরামতি দেখানোয় পর্যবসিত হয় নি। সব সময়ই নাটকের ভিতরের সত্যকে পরিস্ফুট করতে সাহায্য করছে। নাট্যকারের মঞ্চনির্দেশনায় অবশ্য বহু ব্যাপারের ইঙ্গিত দেওয়া ছিল। কিন্তু তার নিপুণ ব্যবহার ও কল্পনাশক্তি দিয়ে সেই ইঙ্গিতকে থিয়েটারি প্রকাশরীতিতে স্পষ্ট করে তোলার কৃতিত্ব সম্পূর্ণভাবে পরিচালকের।
বলা বাহুল্য, এ নাটকের সাফল্য অনেকটাই অভিনয়-ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল। লেখকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন পরিচালক শ্যামানন্দ জালান স্বয়ং। ভূমিকাটি এক হিসেবে অত্যন্ত দুরূহ—গোড়া থেকে শেষ অবধি প্রায় সারাক্ষণ মঞ্চে উপস্থিত, অথচ সূত্ৰধারের মতো এক ধরনের নৈর্ব্যক্তিক চরিত্র, হঠাৎ জমিয়ে লার সুযোগ নেই, কিন্তু প্রায় সব সময়ই দর্শকের চোখ ঘুরে ফিরে লেখকের উপর পড়বে; এ ছাড়া লম্বা লম্বা বক্তৃতার মতো সংলাপ, তার মধ্যে কয়েকটি আবার ছন্দে লেখা। সবচেয়ে মুস্কিলের কথা এই, কাব্যাংশগুলির কয়েকটি আবার কবিতার ভাষা হিসেবে একটু কাঁচা, নাটকের দিক থেকে একটু অতিরিক্ত, এমন কি জায়গায়-জায়গায় একঘেয়ে। নাটকের এই দুর্বলতা শ্রীজালানের অভিনয়গুণে অনেকটা ঢেকে গেছে। তবু মনে হয় দু-একটি ক্ষেত্রে সংলাপ সংক্ষিপ্ত করলে ভালো হত। শ্রীজালানের অভিনয়ের ধরনটি বুদ্ধিদীপ্ত, সজ্ঞান ও সহজ–আদৌ চড়ানো সুরের নয়। শুধু মাঝে মাঝে ইচ্ছাকৃত অতিনাটকীয়তা আছে। কিন্তু সেটুকুও নাটকের প্রয়োজনে। বাদল সরকারের মঞ্চনির্দেশে ‘লেখকের অতিনাটকীয় হাঁক’ ইত্যাদি ইঙ্গিত থেকে বোঝা যায় যে অভিনয়ে এই অতিনাটকীয় ভাবের একটি নাটকীয় প্রয়োজন আছে। ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ নাটকে নাট্যরীতির যুগোপযোগী রূপ নিয়ে কিছু কিছু চিন্তা আছে। সাধারণ মানুষের জীবনে ‘নাটক’ যে বড়ই কম, প্রচলিত নাট্যরীতিতে আধুনিক জীবনকে যে আর ধরা যাচ্ছে না—এ রকম একটা ভাবনা বারবারই এতে প্রকাশিত হয়েছে। তাই লেখক যতই প্রচলিত নাট্যরূপের মধ্যে (এবং চলতি অভিনয়রীতির মধ্যে) জীবনকে বাঁধার চেষ্টা। করুন না কেন, থেকে থেকেই ইন্দ্রজিৎ বা অন্য কোন চরিত্র নিতান্ত সহজ সুরে কথা বলে, ঝুলিয়ে অভিনয় করে, নাটকীয়তার ব্যর্থতা ফাঁস করে দিচ্ছে। শ্রীজালানের পরিচালনা ও অভিনয়গুণে নাটকীয় ফর্ম ও ‘অ-নাটকীয় জীবনের মধ্যে এই টানাপোড়েনের ভাবটি খুব পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ে ইন্দ্রজিৎ-এর সংশয়, যন্ত্রণা, হতাশা ইত্যাদি খুব সুন্দরভাত্তে এসেছে। কিন্তু নাটকের শুরু থেকেই তাকে যেন একটু বেশি অস্থির, বেশি উত্তেজিত লাগছিল। অধ্যাপকের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় তার যন্ত্রণাক্ত স্বর ও মুখভঙ্গি একটু বাড়াবাড়ি রকম লাগে। এ ছাড়া ‘ঐ তারাভরা আকাশ সব গুলিয়ে দেয়’ বলার সময় তার অভিনয় একটু আড়ষ্ট। এ সময় ইন্দ্রজিৎ-এর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে দর্শকদের দিকে ঘাড় উচু করে তাকিয়ে কথা বলার ভঙ্গিটি পরিচালকের কাছে কি খুব অপরিহার্য মনে হয়? অন্যান্যদের মধ্যে বিভিন্ন স্ত্রী চরিত্রে ( কখনও বৃদ্ধা মাসিমা, কখনও অত্যাধুনিক তরুণী, কখনও ঝগড়াটি গিন্নী, আবার কখনও সলজ্জ নববধূ) চেতনা তেওয়ারী ও অমলের ভূমিকায় বিমল লাটের সু-অভিনয় চরিত্রগুলিকে বেশ স্পষ্ট করে তুলেছে। শুধু পুরো প্রযোজনাটির মানকে বারবার নামিয়ে দিচ্ছিলেন কমলের ভূমিকাভিনেতা অরিন্দম। বিশেষ করে নাচের দৃশ্যে ও ইন্টারভিয়ুর সময় তার অক্ষমতা বড় বেশি চোখে পড়ে।
স্বচ্ছন্দ অনুবাদ, কল্পনাসমৃদ্ধ মঞ্চসজ্জা ও সু-অভিনয়ের গুণে ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ সাম্প্রতিক কালের একটি অবশ্য দ্রষ্টব্য প্রযোজনা। কিন্তু এ ছাড়াও এই প্রযোজনার আরেক ধরনের গুরুত্ব আছে। সাধারণভাবে বলতে গেলে আমরা বিভিন্ন সাহেবী দেশের নবতরঙ্গের উদ্যোক্তারা কী দিয়ে দাঁত মাজেন তা পর্যন্ত জানি। কিন্তু ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রায় কোন খবরই রাখি না। এ অবস্থায় অনামিকার প্রযোজনা হিন্দী-বাঙলা নাট্যকর্মীদের পারস্পরিক সংযোগের একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। শুধু থিয়েটারের দিক থেকেই নয়, সাধারণভাবে সাংস্কৃতিক জগতেও এটি অত্যন্ত জরুরী ব্যাপার।
সপ্তাহ, ৩০ মে ১৯৬৯
ঋণ স্বীকার : চিত্তরঞ্জন ঘোষ সম্পাদিত কেয়ার বই (১৯৮১)