ছোটগল্পের রূপ কী হবে, তা নিয়ে গল্পের লেখকদের মধ্যে প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প বিষয়ক ছোট সংজ্ঞাটি আজকের গল্পকারদের কাছে আর মান্যতা পায় না। নিরীক্ষার নামে আজকের গল্পকার গল্পকে গল্পহীন করে তুলছেন। ছোটগল্পের একরৈখিকতাও আজ বহুরৈখিকতার নামে শৃঙ্খলাহীন হয়ে পড়ছে। এ বড় আশংকার কথা। ছোটগল্পের মৌলগুণ একরৈখিকতা; পূর্ণতা নিটোল গল্প বুননে। গল্পের ভেতর অনাবশ্যক বিবরণ উপস্থাপন গল্পের শিল্পগুণ যতটা ক্ষুণ্ন করে, ততোধিক ক্ষুণ্ণ করে পাঠকের মনোযোগ। গল্পে নন-ফিকশনের বিবরণচর্চায় গল্পকার নিজের পাণ্ডিত্য, নিরীক্ষাপ্রবণতার স্বাক্ষর হয়তো রাখেন, কিন্তু সে স্বাক্ষর গল্পের পক্ষে সহায়ক না হয়ে পাঠককে গল্পবিমুখ করার কারণ হয়ে ওঠে।
ছোটগল্প কি কেবল লেখকের কল্পনাপ্রসূত কাহিনির ঘনঘটা? আন্তন চেখভ, কিংবা রবীন্দ্রনাথের কোনও কোনও গল্প পাঠ শেষেও স্পষ্ট হয়, গল্প নিছক কোনও কাহিনি বুননের নৈপুণ্য উজিয়ে মহত্তর কোনও শিল্প হয়ে ওঠেনি। যে কাহিনি গ্রামের কোনও প্রখর স্মৃতিধর প্রবীণের মুখেও শোনা যায়, তার জন্য দীক্ষিত মানুষের সযত্ন প্রয়াসের প্রয়োজন হয় না। এসব গল্পের বিষয় মানুষের দৃষ্টিগ্রাহ্য আচরণের পরম্পরা। কখনও কখনও আকস্মিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে নির্বাচিত ঘটনাও গল্পের শরীর ও আত্মপ্রতিষ্ঠার নিয়ামক হয়ে ওঠে।
ভিন্ন ধরনের গল্পও রয়েছে। সেসব গল্পে মনভোলানো কথার ফুলঝুরি ছাড়াও নতুন নতুন চিন্তার বীজও লুকিয়ে থাকে। ফলে এ ধরনের গল্প পাঠ শেষে পাঠকের চিন্তার ভরকেন্দ্রে আমূল পরিবর্তনের ঢেউ জাগে। কোনও কোনও ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্কের জট খোলাও পাঠকের অভিরুচির মধ্যে পড়ে। একই গল্পের তখন ভিন্ন ভিন্ন পাঠ ও ব্যাখ্যাও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ফলে এসব গল্পে কাহিনির চেয়ে কাহিনির সূত্র, চরিত্রের আচরণের চেয়ে চরিত্রের অবদমন প্রধান ভূমিকা পালন করে। গল্পের বিস্তীর্ণ ক্যানভাস জুড়ে চরিত্রগুলো আপন মহিমার ঔজ্জ্বল্য ছড়াতে সক্ষম। গল্পকার যখন কোনও গল্পের বিষয়কে চরিত্রের আচরণ ও মনস্তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে তোলেন, তখন পাঠক স্বাধীনভাবে চরিত্র নির্বাচনের সুযোগ পান। ব্যাপারটা অনেকটা চিত্রকলার মতোই। ছবি যেমন নিজে কথা বলে না, দর্শককে দিয়ে বলিয়ে নেয়, তেমনি এসব গল্পের চরিত্রগুলো নিজে কথা না বললেও পাঠক সেসব চরিত্রের ভেতর আপন স্বভাবের স্পর্শও অনুভব করেন।
এধরনের গল্পে পাঠকও একটি বিপুল অধ্যায়, যেখানে পাঠকের অনুধ্যান আর গল্পের চরিত্রের নৈপুণ্য ঐকান্তিক হয়ে ওঠে। গল্পের ভেতর বুদ্ধির মুক্তি ঘটে, গল্পের চরিত্র তখন সংস্কারমুক্তচিত্তে আত্ম-উদ্বোধনের ছাড়পত্র লাভ করে। তার জন্য লেখকের ভূমিকা ষোল আনা। লেখকের স্বভাবই তার সৃষ্ট চরিত্রের আচরণে প্রকাশ পায়। সঙ্গত কারণে দীক্ষিত লেখক চরিত্র সৃষ্টির সময় কোনও একটি বিশেষ চরিত্রের প্রতি পক্ষপাত দেখান না।
কিন্তু একথাও সব সময় সত্য নয়, বিশেষত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পের চরিত্রগুলোর স্বভাব বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনিও তার কোনও কোনও চরিত্রের প্রতি বিশেষ পক্ষপাত দেখিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রে বিশেষ চরিত্রের প্রতি দুর্বলতা মেনে নেয়া যায়। তার কারণ তার হাতে ছোটগল্পের উন্মেষ; অনেকাংশে বিকাশও। কিন্তু উত্তরকালের কোনও দীক্ষিত ছোটগল্পের লেখকের ভেতর সে বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেলে তাও কি সমান গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পটি একজন কাবুলিওয়ালার বণিক মনোবৃত্তির সঙ্গে পিতৃস্নেহের যুগল আচরণের মনস্তাত্ত্বিক কাহিনি। আবার ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পেও সে মানবিক প্রেম মুখ্য। পার্থক্য ‘কাবুলিওয়ালা’র প্রেম আত্মজার প্রতি, যৌক্তিক ও বিশ্বস্ত। কিন্তু সমান বিশ্বস্ততা অর্জন করতে পেরেছে কি পোস্টমাস্টারের প্রতি ছোট্ট বালিকা রতনের অবিকশিত প্রেম?
তাহলে গল্পকেও সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে বিশ্বস্ত হয়ে উঠতে হবে? রূপকথা বলার দিন সে কবেই অস্ত গেছে! আজকের দিনে চাঁদের দেশের চরকাবুড়ির সুতাকাটার কাহিনি কেউ শোনে? না কি শোনা উচিৎ ? চাঁদ অধরা যতদিন ছিল, ততদিন মানুষের কাছে চাঁদের মর্যাদা ছিল ভিন্ন ধরনের। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে চাঁদ মানুষের গবেষণার বিষয় হয়ে থাকেনি কেবল, হয়ে উঠেছে ভ্রমণের স্থানও। সঙ্গত কারণে চাঁদ নিয়ে কল্পকাহিনি বুননের রুচি অচল হয়ে পড়েছে। রূপকথা বলার যুগ যেমন অস্ত গেছে, তেমনি সময় হয়েছে বিজ্ঞানমনস্কতার। বিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞানসম্মত; দর্শন নয়, দর্শনময় গল্প বলার সময় এখন। ঐশিধর্মের পরিবর্তে মানবধর্ম, রাজনীতি নয়, রাজনীতিনিষ্ঠ গল্প বলার যুগ আজ। সুতরাং আজকের গল্পে ভাবালুতা পরিত্যাজ্য।
শরৎচন্দ্রের ভাবালুতাসর্বস্ব গল্প আজকের যুগে অচল। অচল কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যগন্ধী গল্পের ধারাও। চরিত্রের হয়ে লেখকের ওকালতিও এখন চলতে পারে না। বিশেষ চরিত্রের প্রতি স্রষ্টার বিশেষ পক্ষপাত পাঠককে বিব্রত করে। পাঠক অসহায় বোধ করেন স্রষ্টার পক্ষপাতিত্বে। তবু শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পের মানবিক বোধ এবং সর্বপ্রাণের প্রতি সমান সম্মানবোধই এ গল্পকে কালোত্তীর্ণ হওয়ার পথে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। তাই শরৎচন্দ্রীয় গল্পের স্থানে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মনস্তাত্ত্বিক গল্প পাঠকের আরাধ্য হয়ে ওঠে। ভাবালুতাসর্বস্ব গল্পের জায়গা দখল করে মনোবিশ্লেষণাত্মক গল্প। সেখানেও সমস্যা থেকে যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘নয়নচারা’ মন্বন্তরের পটভূমিতে রচিত। গল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্র আমুর ক্ষুধার্ত জীবনের এক সহমর্মী কাহিনি। গল্পকার এ গল্পে চরিত্রের মনোবিশ্লেষণে এত বেশী মনোযোগী হয়ে পড়েন যে, পাঠকের চরিত্র বিচারের স্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে যায়।
শওকত ওসমানের ‘সৌদামিনী মালো’ গল্পের বিষয়বস্তু সামান্য। কিন্তু সে সামান্য বিষয়কেই আসামান্য দরদ দিয়ে বুনেছেন। সৌদামিনী মালো একজন তেজোদীপ্ত মেরুদণ্ডসম্পন্ন নারী। তার স্বামী, বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন জগদিশ মালো, নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে সৌদামিনী ছাড়া তার সম্পত্তির আর কোনও উত্তরাধিকার থাকে না। তার বিশাল ভূসম্পত্তির প্রতি নিকটাত্মীয় মনোরঞ্জণ মালোর দৃষ্টি পড়ে। সে সম্পত্তি রক্ষা ও মাতৃহৃদয়ের হাহাকার মেটানোর জন্য সৌদামিনী একটি ছেলেকে দত্তক গ্রহণ করে। এতেই ক্ষেপে ওঠে সমাজের ধর্মরক্ষাকারী সম্প্রদায়। ব্রাহ্মণের ছেলের প্রতিপালন ক্ষত্রিয়ের ঘরে? তারা মেনে নিতে পারে না। ফলে সৌদামিনীকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। সেখানে সে নিজেই এক বিস্ময়কর তথ্য ফাঁস করে। ছেলেটি হিন্দু নয়, মুসলমান। দত্তক হরিদাস তার মুসলমানিত্বের পরিচয় জানতে পেরে শেষ পর্যন্ত গৃহত্যাগী হয়। সৌদামিনী এবার ভেঙে পড়ে। হয়ে পড়ে দিশাহারা। যে সম্পত্তির জন্য এত লাঞ্ছনা, সেই সম্পত্তি গীর্জাকে দান করে নিজেও ধর্মান্তরিত হয়। তাতেও তার শেষ রক্ষা হয় না। অপ্রকৃতিস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। উপাসনালয়গুলো মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নিতে পারে, মানুষের বিপদে কোনও সাহায্য দূরে থাকুক কোনও সান্ত্বনাও দিতে পারে না। সৌদামিনীর সম্পত্তি ওঠে নীলামে। সেখানে কথক শোনে সৌদামিনীর সংগ্রামমুখর জীবনের ইতিকথা। গল্পে সম্পত্তির প্রতি লোলুপ মানুষের হীন মানসিকতার পরিচয় স্পষ্ট।
শওকত ওসমান নিপুণ কৌশলে ফুটিয়ে তুলেছেন সমাজের লোভী মানুষের পরধনলোলুপতার চিত্র। সম্পত্তির প্রতি সাধারণ মানুষেরই যে কেবল অন্যায় লোভ রয়েছে তা নয়, উপাসনালয়গুলোরও রয়েছে লালসা। সৌদামিনী নিকটাত্মীয় মনোরঞ্জণের লোভ থেকে সম্পত্তি রক্ষার জন্য নিজের অবদমনকেও সহ্য করেছেন। ধর্মান্তরিত হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন গীর্জায়, সেখানে অবদমনের সাথে সাথে সম্পত্তি আর নিজের জীবন সবই হারালেন। ব্রাদার জন সৌদামিনীকে ধর্মান্তরিত হতে প্রথমে নিরুৎসাহিত করেন। কিন্তু গোপনে ধর্মান্তরিত হওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করে রাখেন। সঙ্গত কারণে লেখক শওকত ওসমান বিষয়টিকে ব্যঙ্গ করেন, ‘নৌকা ঠেলে দিয়ে বেয়াইকে আজ না গেলে নয়, বলে থেকে যেতে বলা।’ সৌদামিনীর সম্পত্তি, সম্ভ্রম, আর সম্মান রক্ষার কোনও সম্ভাবনাই যখন হিন্দু সমাজে অবশিষ্ট নেই, তখন ব্রাদার জনকেই শেষ আশ্রয়দাতা বলে মনে হয়। অথই সমুদ্রে অসহায় মানুষ খড়কুটো ধরেও শেষবারের মতো টিকে থাকতে চায়, সৌদামিনীও চেয়েছেন। কিন্তু রক্ষকই যেখানে ভক্ষক সেখানে সে সম্ভাবনা অলীক। এ সুরই বেজে উঠেছে এ গল্পে। শওকত ওসমান ভাববাদের সঙ্গে বস্তুবাদের অন্বয়সাধন করে একধরনের বিমিশ্র অনুভূতিসম্পন্ন গল্প বুনেন।
হাসান হাফিজুর রহমান অনেক গল্প লিখেছেন। নানা কারণে তার গল্পকারখ্যাতি অর্জিত হয়নি। কিন্তু তার ‘আরো দুটি মৃত্যু’ গল্পটি বাংলা ভাষা কেন বিশ্বসাহিত্যেরও শ্রেষ্ঠ গল্পগুলোর সমান্তরালে পথ চলার সামর্থ্য রাখে। ‘নারায়ণগঞ্জ থেকে বাহাদুরাবাদ’গামী রাত্রির ট্রেনের কয়েকজন যাত্রীর ভ্রমণকালীন একটি মানবিক ঘটনার গল্প এটি। গল্পের চরিত্র সংখ্যা চার। একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষ, একজন মাঝবয়সী নারী; অপরজন নয়-দশ বছরের একটি মেয়ে। আর শেষজন গল্পের কথক। মূল গল্পে কথকের কোনও ভূমিকা নেই। যা আছে তা কেবল কিংকর্তব্যবিমূঢ় দর্শকের। সেখানে প্রসববেদনাউদ্ভূত এক নারীর অন্তিম মুহূর্তের চিত্র আঁকা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত নানা উৎকণ্ঠায় আর ভয়ের ভেতরই অন্তঃসত্ত্বা নারীটির মৃত্যু ঘটে, ছোট মেয়েটির আর্তচিৎকারে পরিচয় মেলে, মৃতা আর বয়স্ক পুরুষের ভাসুর-ছোটবউ সম্পর্ক। মৃত্যু ঘটে এক নারীর, সাথে অনাগত শিশুরও। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কুফল, মানুষকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
অন্যদিকে আবুল কালাম শামসুদ্দিন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, বুলবন ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক-এর গল্পে নিম্নবর্গের মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের দাবি-দাওয়া উন্মোচিত হতে থাকে। ফলে পাঠক দেখতে পায়, এদের গল্পে একটি নতুন প্রত্যয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মানবিকতার প্রশ্নে, গল্পের ভেতর গল্প পাঠের আনন্দে পাঠক স্বস্তিবোধ করেন। শাহেদ আলী এদেশের কৃষক, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণীর ভেতরের সুখ-দুঃখ, আশা-হতাশা ও ক্ষোভ-সন্তুষ্টির বয়ান হাজির করেন। তার ‘শানযর’, ‘মহাকালের পাখনায়’, ‘জীবরাইলের ডানা’, কিংবা ‘একই সমতলে’ এর শিল্পসফল উদাহরণ। আলাউদ্দিন আল আজাদ উচ্চবিত্তের জীবনচক্রে যেমন ডুবুরি, তেমনি নিম্নবিত্তেরও। তার ‘ঠাণ্ডাভাত’, ‘ঈশ্বরের পলায়ন’, ‘একহাজার একরাত্রি’ গল্প সে সাক্ষ্যই বহন করে। অন্যদিকে সৈয়দ শামসুল হকের গল্পে সমকালীন সমাজবাস্তবতার রূঢ়চিত্র প্রতিফলিত। তিনি লিখেছেন ‘মানুষ’, ‘জমিরুদ্দিনের মৃত্যুবিবরণ’, ‘আনন্দের মৃত্যু’, ‘প্রাচীন বংশের নিঃস্বসন্তান’-এর মতো কয়েকটি শিল্পসফল ছোটগল্প। ‘মানুষ’ এক চাকুরীচ্যুত সাজাপ্রাপ্ত মানুষের সাথে তার পুরনো শত্র“র একরাতের আকস্মিক সাক্ষাতের গল্প। কথক যার জন্য চাকুরি হারিয়ে কারাবরণ করলো, ঝড়ের রাতে একই স্থানে তার সাথেই দেখা। কথক যদিও সব ভুলে লোকটির সাথে কথা বলার কাক্সক্ষা পোষণ করে, তবুও লোকটি সমাজব্যবস্থায় প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষের আচরণের কথা মনে করে গল্পের কথককে বিশ্বাস করতে পারে না। তাই কথকের সাথে কথা বলার চেয়ে জীবনবাজি রেখে পথে নেমে পড়াকেই শ্রেয় মনে করে।
আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ‘মাসকাটাল’ শ্রমজীবী মানুষের ক্রমপরিবর্তমান পরিস্থিতিকে মানিয়ে নিতে না পারার গল্প। একদিকে সাধারণ মানুষের সেবা, অন্যদিকে খেটে খাওয়া মানুষের রুটিরুজির পথ রুদ্ধ হওয়ার কষ্ট। গল্পের মূল চরিত্র ছিটু মাঝি। মাসকাটাল নদীর বুকে নৌকা বেয়ে তিনপুরুষ ধরে জীবনযাপন করে আসা মাঝি। এ নদীতে যখন জমিরুদ্দিন মৃধা ইঞ্জিনচালিত লঞ্চ নামানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তখন ছিটু মাঝি, রমিজ, হামিদ, রসিদ মেনে নিতে পারে না। লঞ্চ নদীতে না নামানোর জন্য অনুরোধ করলে মৃধা ছিটু মাঝির বড় ছেলে আজিজের বেকারত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তাকে দেখা করারও প্রস্তাব দেয়। রসিদের কাছে মৃধার যুক্তি নিষ্ঠুর বলেই মনে হয়, তাই সে ক্ষোভের কথা প্রকাশই করে দেয়, ‘লঞ্চ না চললে দেশের কেউ মারা যাবে না, কিন্তু চললে আমরা দুশো আড়াইশো নাইয়া সকলে একযোগে যে মারা পড়বো মৃধা সাহেব।’ এ ক্ষোভমিশ্রিত উক্তির ভেতর নিঃস্বপ্রায় মানুষের আর্তনাদ শোনা যায়, সত্য; কিন্তু স্বার্থপরতাও আছে। আছে শ্রেণীচেতনাও। মানুষ কম খরচে নিরাপদে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য নৌকার চেয়ে লঞ্চই উত্তম। এ সত্য নাবিককুল বোঝেও, নিজের স্বার্থে সে সত্য মেনে নিতে অনীহ। এরপর লঞ্চবিরোধী ছিটু মাঝিরই বড় ছেলে আজিজকে লঞ্চের চাকুরী দেয়া হয়। ছিটু মাঝি বিষয়টা মেনে নিতে পারে না, তার সঙ্গী হয় তার অপর ছেলে গনি। গনির ভেতর ছিটু মাঝি নিজের যৌবনের রূপ দেখতে পায়। ছিটু মাঝি তার প্রথম ছেলে সিরাজকে মাসকাটাল নদীতে হারিয়েছিল এক ঝড়ের রাতে। বৈঠা বাইতে গিয়ে হঠাৎ সিরাজ নদীতে পড়ে যায়। তার আর্তচিৎকার শুনেও ছিটু মাঝি ছেলেকে উদ্ধার না করে দুই আরোহীর জীবন বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। গল্পের শেষে দেখা যায়, যে লঞ্চ বৈঠাচালিত নৌকার মাঝিমাল্লার অন্ন সংস্থানের প্রধান অন্তরায়, সে লঞ্চের সংকটময় সময়ে গনি দাঁড় বেয়ে বিপদাপন্ন মানুষকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে যায়। যে মানবিক গুণ সমাজের উঁচুতলার মানুষ জমিরুদ্দিন মৃধার নেই, সে মানবিক গুণ নিম্নবর্গের সুবিধাবঞ্চিত, শোষিত গনির রয়েছে। আব্দুল গাফফার চৌধুরী এ গল্পে মানুষের মানবিকতাবোধের সাথে পাশবিক আচরণের সাংঘর্ষিক সম্পর্ককে ফুটিয়ে তুলেছেন।
আল মাহমুদ-এর ‘কালো নৌকা’, ‘পানকৌড়ির রক্ত’, ‘জলবেশ্যা’ তিনটি গল্পই সমাত্মীয়। তবে ‘কালো নৌকা’ ব্যতিক্রম। প্রচলিত সমাজব্যবস্থার প্রতি সূক্ষ্ম বিদ্রুপ স্পষ্ট। গল্পের চরিত্র সংখ্যা সাকূল্যে পাঁচ। রাসু জলদাস, তার ছেলে দামোদর, পুত্রবধু কালী, প্রতিবেশী শ্যামা আর অধীর জলদাস। ছেলে দামোরের সলিল সমাধির পর বৌ কালী অপ্রকৃতিস্থ। যখন-তখন দিগম্বর হয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ানো তার স্বভাবে পরিণত হয়। শ্যামার পরিচর্যায় কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ঘরমুখো হয়। একদিন একা ঘরে দিগম্বর অবস্থায় রাসু কালীকে দেখে রাসু। তার শরীরের ঘাম মুছে দেয়। কিন্তু নিজে থাকে স্বাভাবিক। সেটা সামাজিক ভীতি হয়তো। দিনের শেষে রাসু অধীর জলদাসের দোকান থেকে মদ খায়। নিজের ভেতরে জেগে ওঠে আদিম প্রবৃত্তি। কালীকে খুঁজতে বেরয়। পেয়েও যায়। নিজের ডেরায় দিগম্বর পেয়েও যে কালীর শরীর নিয়ে মেতে উঠতে সংকোচবোধ ছিল, অন্যের কোষায় কালীকে একা বস্ত্রহীনা পেয়ে আহ্বান করে। আহ্বানের ভাষাও কামার্ত আর পরমনির্ভরতার। যখন রাসু কালীকে মৃত স্ত্রী সতীর নামে আহ্বান করে, ‘তুই সতী, তুই সতী- তোর বুকে সতীর গন্ধ। তুই সতী হয়ে যা কালী।’ তখন কালীও শ্বশুরের আলিঙ্গনে টের পায় মৃত স্বামী দামোদরের স্পর্শ। তাই ‘‘রাসুর শক্তবাহুর পেষণে কালী একবার শুধু অস্পষ্টভাবে আওয়াজ তুলে উচ্চারণ করলো, ‘দামোদর’।” গল্প এখানেই শেষ। পরবর্তী অংশ তাদের আদিম আর মৌল প্রবৃত্তির ছন্দে দুলে ওঠা নৌকা আর সমুদ্রের মিলিত আলোড়নের বর্ণনা। এ গল্পে আল মাহমুদ দেখিয়েছেন, কীভাবে অবদমন মানুষকে মানসিক ভারসাম্যহীন করে তোলে।
হাসান আজিজুল হকের ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ গল্প। এ গল্পে সামাজিক অবক্ষয়, দারিদ্র্য, নীতিবোধ, নৈতিকতার স্খলনকে চিত্রায়িত করা হয়েছে। মানুষের দেহই হয়ে ওঠে মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন। শরীরই হয়ে ওঠে জীবনদাতা। তাই পিতা হয়েও আত্মজার শরীরের বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থের জন্য খদ্দেরের অপেক্ষা করতে হয়। এ মানবেতর জীবনের কদর্য দিকটি চিত্রায়নের জন্যই এ গল্পটি নিত্য পাঠ্য ও স্মরণযোগ্য গল্প হয়ে ওঠে। তার ‘শকুন’ গল্পটি সবচেয়ে বেশী ব্যঞ্জনাময় গল্প। এ গল্পে দেখানো হয়েছে একদল গ্রাম্য কিশোরের সামনে এসে পড়েছে হঠাৎ সুদখোর, মহাজনপ্রতিম একটি শকুন। শকুনটি কোথাও উড়ে যেতে পারছে না। শকুনটিকে কিশোরের দল পালক খসিয়ে, দৌড়িয়ে ক্লান্ত করে তোলে। একসময় শকুনটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কিন্তু শকুনটা মৃত্যুর সময় যে বমি করে, সেখানে মহাজনদের ঘৃণ্য ভূমিকা আর কৃতকর্মের ফল কিছুটা স্পষ্ট হয়। সে শকুনের পাশে একটি বেওয়ারিশ শিশুর লাশকে ঘিরে আরও আরও শকুন উন্মত্তের মতো নেমে আসে। এ গল্পের শেষ দিকে মৃতশিশুর মাতৃপরিচয় ‘ই কাজটো ক্যা করলো গো?’ বলে যে নারী-পুরুষের ভীড় জমে ওঠে তারা টের পায় না ঠিক; কিন্তু পাঠক বুঝে ফেলে, ‘শুধু কাদু শেখের বিধবা বোনকে দেখা যায় না। সে অসুস্থ। দিনের চওড়া আলোয় তাকে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে’ বলে। মৃত শিশুর লাশ আর শকুনের লাশের পাশাপাশি শকুনের বমি করার মধ্যে একটি কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে। সুদখোর মহাজন, কিংবা সমাজপতির অন্যায় আচরণ সহজে প্রতিহত করা সম্ভব নয়। কেবল বিশেষ মুহূর্তেই তা প্রকাশিত হয়। তাদের লাম্পট্যের ফল প্রকাশ পায় অবৈধ সন্তান গর্ভধারণে নয়, সন্তান প্রসবে। শকুন যেমন যাই ভক্ষণ করুক, যতক্ষণ তার উদরে আছে ততক্ষণ প্রমাণ অসম্ভব; বমি করলেই সপ্রমাণ; তেমনি লাম্পট্যেরও।
এপর্বে উঠে আসে আব্দুল মান্নান সৈয়দের ‘মাতৃহননের নান্দীপাঠ’। কেন্দ্রীয় চরিত্র আতিকুল্লাহ। নিজের মাকে হত্যা করার কার্যকারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ক্রমাগত যুক্তিতর্কের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। বিধবা মা যখন আতিকুল্লাহকে অতিস্নেহে আগলে রাখতে চান, তখন আতিকুল্লাহ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। আবার মা যখন অন্য পুরুষের সাথে মেলামেশা করে নিজের নিঃসঙ্গতা দূর করার উপায় বের করে নেন, তখনও আতিকুল্লাহ সহ্য করতে পারে না। মানবজীবনের এ এক ভয়াবহ দিক। নিজে যে অভাব পুরণ করতে পারে না, সে অভাব কেউ পুরণ করে দিলেও মানবমন সহজে মেনে নিতে পারে না। সন্তান মাকে সঙ্গ দিতে পারে, সাময়িক কষ্ট দূরও করতে পারে। কিন্তু শারীরিক যোগ্যতাসম্পন্ন মায়ের জৈবিক ক্ষুধা নিবারণ কি সন্তানের পক্ষে সম্ভব? সে ক্ষুধা নিবারণের জন্য সন্তানের পিতা ভিন্ন অন্য কোনও পুরুষের সাথে বৈধ কি অবৈধ কোনওভাবেই জৈবিক সম্পর্ক রক্ষাকে সন্তান সহজ বিবেচনায় গ্রহণ করতে অনীহ। তাই সন্তানের চোখে পিতা ভিন্ন অন্য পুরুষের সাথে মায়ের জৈবিক সম্পর্ক হয়ে ওঠে দণ্ডনীয়। এখানে মায়ের চাহিদার চেয়ে সন্তানের সামাজিক মর্যাদা, একক কর্তৃত্বই বড় হয়ে ওঠে।
গল্পকে শেষ পর্যন্ত গল্প হয়ে উঠতে হয়। নিরীক্ষার নামে চিন্তার জড়ভরত যেমন গ্রাহ্য হয় না, তেমনি আবেগের তারল্য মান্যতা পায় না। সুতরাং গল্পকারকে নির্বাচন করে নিতে হয় কীভাবে তার গল্প তিনি বুনবেন। কখন প্রতীকী ভাষা ব্যবহার করবেন, আর কখন সান্ধ্যভাষা ব্যবহার করবেন, সে দায়ও তার।
মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর কালখণ্ডে দেশত্যাগী মানুষের নাড়ির টানও গল্পের বিষয় হয়ে ওঠে। আপন মৃত্তিকা ছেড়ে যারা দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল, তাদের জীবনবেদ আর মৃত্তিকার প্রতি টান নিয়ে রফিকুর রশীদ লিখেছেন, ‘মাটির ঘ্রাণ’। এ গল্পে মাটির টানে ছুটে আসা অর্চনা ও বাংলাদেশের কালাম-এর মধ্যকার সম্পর্ক এবং পারিবারিক অবস্থান ও পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে একটি অন্তর্ভেদী বিবরণ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকসেনার ধর্ষণের ফলে যে মানবপিণ্ড অর্চনার জীবনে কলঙ্ক হয়ে আসে, সে মাটিতে পুঁতে রাখা অবাঞ্ছিত মানবপিণ্ডের টানেই অর্চনা বাংলাদেশে ফিরে আসে। কী সে অমোঘ টান! এমন মানবিক প্রেম ব্যতিক্রম। সে ব্যতিক্রমের একটি বিস্ময়কর চিত্রায়ন এ গল্প।
প্রকৃত কথাশিল্পী মাত্রই জীবনশিল্পী। সে জীবনশিল্পীর সাধন-সূত্রই তার বাকবিভূতি নির্মাণের পথে সহায়ক হয়ে ওঠে। সে সঙ্গে শিল্পীর আত্মপ্রক্ষেপন ও স্বাধিকারপ্রমত্তস্বভাব তার শিল্পকর্মের নির্গলিতার্থকে উপলব্ধি ও বোঝার পক্ষে উদ্বোধন-সূত্র হিসেবে কাজ করে। তার বিশেষ বাকবিভূতি ও গদ্যশৈলীই তার স্বাতন্ত্র্য অর্জনের পথে মূল নিয়ামক হয়ে ওঠে। এ জন্য তাকে প্রাণপাত করতে হয় না। ছোটগল্পের ক্ষেত্রে গল্পের কাহিনী বিন্যাস, সংলাপ রচনা, চরিত্র নির্বাচনে লেখকের ব্যক্তিগত মূল্যবোধ, অভিরুচি ও শিক্ষা-দীক্ষার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। সঙ্গত কারণে ছোটগল্পের লেখক খুব সহজেই গল্পের ভেতর সন্তর্পণে নিজের ছায়া অঙ্কন করে রাখেন। না এ ছায়া অঙ্কনের বিষয়কে কোনওভাবেই মনোবিকারের বিশেষ স্তরে পর্যবসিত করা যাবে না। কারণ মনোবিকলনের ক্ষেত্রে যে-যে নিয়ামকগুলো অনিবার্য হয়ে ওঠে, গল্পের বুননশৈলীতে সে-সে নিয়ামকগুলো আপততঃ অবান্তর হয়ে যায়। কারণ, মনোবিকলনের ফলে শিল্পীর অবচেতন মনে একটি বিশেষ দৃশ্য, ঘটনা ও মানসিক স্তরের বিকার ঘটে মাত্র; তাতে সচেতন মনের পূর্ণ সম্মতি থাকে না। অপর দিকে গল্পের ভেতর মানবজীবনের গূঢ়ৈষার উদ্বোধনের জন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের বিশেষ শ্রেণিবিন্যাস। সে হিসেবে গল্পকার মাত্রই সমাজচিন্তক। সমাজের ভাল-মন্দের বিভিন্ন দিক গভীরভাবে পর্যবেক্ষণও তার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। সমাজস্থ মানুষের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও পেশাগত জীবনের বহু কৌণিক দিক সমাজচিন্তকের ভাবনার বিষয়। এ অর্থে ছোটগল্পকারও একজন নিখাদ সমাজচিন্তক। সুতরাং তার গল্পের ভেতর সমাজের একটি বাস্তবসম্মত ধারণা ও প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। সে প্রতিচ্ছবিতে কোনও রঙ লাগানো থাকে না। তবে রঙের প্রলেপ থাকে। সে প্রলেপে প্রহসন নয় সহানুভূতিই মূখ্য হয়ে ওঠে।
আবু ইসহাকের ‘জোঁক’ শোষকের প্রতি বিদ্রুপাত্মক ভাষায় ও কৌশলে লিখিত। আবু বকর সিদ্দিকের ‘ফজরালি হেঁটে যায়’, হাসনাত আব্দুল হাইয়ের ‘নবাবের তলোয়ার’, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘আমৃত্যু আজীবন’, মাহমুদুল হকের ‘কালো মাফলার’ কায়েস আহমদের ‘মহাকালের খাড়া’, ‘নচিকেতাগণ’ কালোত্তীর্ণ হওয়ার সব মাত্রাই পূরণ করেছে। আকিমুন রহমান-এর ‘উদ্বাস্তু’ গল্পে আত্মপরিচয়সঙ্কটাপন্ন মানুষের জীবনের মনোযাতনা প্রকাশিত। মঈনুল আহসান সাবের-এর ‘কবেজ লেঠেল’ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লিখিত। তবে এ গল্পে কেবল মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ই প্রধান নয়, সঙ্গে উঠে এসেছে কবেজ লেঠেলের আত্মআবিষ্কারের প্রসঙ্গও। শুভবোধ ও ন্যায়বোধের প্রশ্নে সমাজের চিহ্নিত দাগী আসামীর বিবেক জেগে ওঠে। তারই প্রমাণ কবেজ। কবেজ কেবল আকমল প্রধানের প্রতিদ্বন্দ্বী রমজান শেখকে খুন করে না, খুন করে দেশের শত্র“কে। হরিশংকর জলদাস-এর ‘শোধ’ গল্পের বিষয়বস্তুও স্বতন্ত্র। ব্যক্তিগত দুঃখবোধকে নৈর্ব্যক্তিকতায় উন্নীত করার পক্ষে কেউ কেউ ব্যক্তিবিশেষের মনোবিকার ও ভিন্ন ঘরানার যৌনবিকারের চিত্র এঁকে গল্পকে সীমিত পাঠকের জন্য নির্দিষ্ট পরিসর নির্মাণের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। গ্রামীণ জনপদের আর্থিক নিরালম্ব শিক্ষিত যুবকের জৈবিক লালসা চরিতার্থ করার জন্য অপ্রাপ্তবয়স্কা এক শিশুকন্যাকে ধর্ষণের নিরাপদ মনস্তাত্ত্বিক কৌশলের যে চিত্র মহীবুল আজিজ ‘মাছের মা’ গল্পে আঁকেন, সে গল্পের নায়ক গৃহশিক্ষক আখলাক নৈর্ব্যক্তিক সত্তায় উন্নীত হয় গল্পকারের গল্প বুননের দক্ষশৈলীতে। এ গল্পে মহীবুল আজিজ দারিদ্র্য-পীড়িত বেকার যুবকের যৌনক্ষুধা মেটানোর মনস্তাত্ত্বিক কৌশলকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। শিশু ছাত্রীকে ধর্ষণের জন্য তাকে মানসিকভাবে বিভ্রান্ত করে প্রস্তুত করে তার মস্তিস্কের কোষে সাঁতার শেখার জন্য মাছের অনবরত আরামদায়ক বেদনার অভিজ্ঞতার প্রয়োজন আছে মর্মে বিশ্বাস চারিয়ে দেয়ার বিশ্বাসযোগ্য পটভূমি নির্মাণের দক্ষতা দেখিয়েছেন গল্পকার। ফলে জলের নিচের কলাকৌশলকে শিশু ছাত্রীর মনে মাছের কর্মকাণ্ড হিশেবে ছায়াপাত করে। যৌনতার প্রসঙ্গ গল্পের মৌল অনুষঙ্গ হয়েছে।
মনিরা কায়েস গল্প লিখতে বসে কেবল কল্পনার ফানুস উড়িয়ে মনোবিকারকে অলজ্জভাবে প্রকাশ করেন না। সমাজস্থ মানুষের আচরণ ও অভ্যাসের যৌক্তিক পরম্পরার উদ্বোধনও করেন। সেখানে মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানবিক সংকটকে শিল্পীত মহিমায় ভাস্বর করে একটি বিশাল ক্যানভাসে চিত্রায়িত করেন। যে ক্যানভাস ধারণ করতে পারে প্রান্তবর্তী মানুষের আচরণগত সামঞ্জস্য-অসামঞ্জস্য ও অসহায়তার বহুমাত্রিক রূপরেখার সঙ্গে কেন্দ্রমুখী মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, আত্মবিকলন ও আত্মউদ্বোধনও। মানুষের বাহ্যিক আচরণের চেয়ে মনস্তত্ত্বের দিকেই আলোকসম্পাত করার পক্ষপাতী তিনি। তাই তার গল্পের নাম ‘মাটিপুরাণ পালা’। মানবিক গূঢ়ৈষাকে অস্বীকার না করে, কেবল দেখার কাক্সক্ষাকে চরিতার্থ করার ভেতর যে বিপুল ফাঁকি লুকায়িত সে সত্যকে প্রকাশ করে একজন শেকড়চ্যুত যুবকের তুমুল মনোবিকারকে ব্যাবচ্ছেদ করেছেন এ গল্পে। কেবল কল্পনার ফানুস নয়, অভ্যাস ও আচরণের মধ্যে যে সাংঘর্ষিক সম্পর্ক তৈরি হয়, সে সম্পর্কের সূত্রে যে মানবিক সংকটের জন্ম, সে মানবিক সংকটের গল্প ‘মাটিপুরাণ পালা’। শেকড়বিচ্ছিন্ন তারিক নামক যুবক তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর অসুস্থতার কথা সাময়িক ভুলে ধনী বন্ধুর পানের উৎসবে যোগ দেয়, বন্ধুপত্নীর খোলা গলার কামনা দেখার জন্য। সে কামনার ইশারায় দগ্ধ হয়, কিন্তু কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন হয় না সে উৎসব থেকে। বরং গভীর রাতে ভাড়াবাড়িতে ফিরে গিয়েই জানতে পারে তার স্ত্রী সাবিহা হাসপাতালে। হাসপাতালে জন্ম নেয়া সন্তানের ‘জন্মফুল’ মাটি চাপা দেয়া নিয়ে তারিক অকস্মাৎ শেকড়সন্ধানী হয়ে ওঠে। তার মনে হয় তার সন্তানের জন্মফুল তার নিজস্ব বাড়িতেই হওয়া উচিৎ। তা না হলে তার সন্তান নাড়ির টান অনুভব করবে কীভাবে? নাড়ি-ছেঁড়া ‘জন্মফুল’ যেখানে প্রোথিত থাকবে মানব সন্তান স্বভাবতই সেখানে থাকার কিংবা যাওয়ার আকাঙ্খা পোষণ করবে মনে মনে।
নাজিব ওয়াদুদ-এর ‘আবাদ’ নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। একজন নারী ও ফসলীক্ষেতের জন্মদানের যোগ্যতাকে অভিন্ন সমতলে বিবেচনা করার এক অব্যর্থ শিল্পরুচির পরিচয় এ গল্প। এ গল্পের মূল চরিত্র জগলু নিম্নবর্গের মানুষ। রূপাকে ভালবাসে; বলা হয় না। বলার আগেই সমকালীন নকশাল আন্দোলন দমনের শিকার হয়ে জগলু জেলে চলে যায়। ততদিনে রূপা বিবাহিতা। কিন্তু বন্ধ্যা হওয়ার অপরাধে সংসার ভাঙে। জগলু জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফিরে আসে গ্রামে। আবার দেখা হয় রূপার সাথে। রূপা বন্ধ্যা — একথা জগলু মানতে পারে না। রুক্ষ জমিতে পরিচর্যার জোরে যে জগলু ফসল ফলাতে পারে, সে জগলু রূপাকে বন্ধ্যা বলে স্বীকার করতে চায় না। তাই জগলুর বিয়ের প্রস্তাবে যখন রূপা তার বাপকে বলে, ‘অখে ঠগাবে ক্যানে? আমি বাঞ্জা তুমি জানো না? আমি বাঞ্জা গো মাঝির ব্যাটা’, তখন জগলু ক্রোধে ফেটে পড়ে, ‘কুন শালা বুলে এই কথা?’ সফল চাষার কাছে বন্ধ্যাজমির অস্তিত্ব যেমন অকল্পনীয়, তেমনি বন্ধ্যা নারীরও। একের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে যারা চিরকাল নিজের সুবিধা আদায় করে এসেছে তাদের প্রতি এ গল্প সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রতিবাদ। এ গল্পের চরিত্রগুলো যেমন বিশ্বস্ততা অর্জনে সমর্থ হয়েছে, তেমনি কাহিনিও স্বাভাবিক পরিণতি লাভ করেছে। পরিস্থিতির চাপে পড়ে দমে না গিয়ে জীবনকে জয় করার যে প্রত্যয় গড়ে ওঠে একজন সাধারণ কৃষক যুবক জগলুর মধ্যে তার মাটিলগ্ন ক্রমবিকাশ বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ফলে গল্পটি নিছক কাহিনি হয়ে থাকেনি, হয়ে উঠেছে কয়েকজন মানুষের যাপিতজীবনের শৈল্পিক ক্যানভাসও। নাজিব ওয়াদুদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প ‘মেঘভাঙা রোদ’, কিংবা ‘খনন’ ও ‘জীয়নকাঠি’ও একই কারণে অবশ্যপাঠ্য হয়ে ওঠে।
আহমাদ মোস্তফা কামাল-এর ‘অশ্রু অথবা রক্তপাতের গল্প’ সমকালীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক অস্থিরতার গল্প। রাজীব নূর-এর ‘নহ মাতা, নত কন্যা’ গল্পটি ব্যতিক্রম। এ গল্পে মিথ ও উপকথার আবহ তৈরি করে চাচা ও ভ্রাতুষ্পুত্রির যৌন সম্পর্ককে একটি যুক্তিনিষ্ঠ আবহের দিকে পরিণতি দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে তাদের সামাজিক বিবেচনায় আপাতত অনৈতিকতাও গ্রাহ্যতা পায়, ঘটনার পরম্পরা ও আকস্মিকতায়।
লেখকের বিশ্বাস, কর্মবিশ্ব ও আচরণের সঙ্গে গল্পের চরিত্রগুলোর বিশ্বাস, কর্মবিশ্ব ও আচরণের পরিচয় না থাকলে লেখকের চিন্তার কোনও গহণঅঞ্চলই স্বচ্ছ ও স্বয়ম্ভু হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় না। বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে তুলনা ও প্রতিতুলনায় বাংলা কথাসাহিত্যের চরিত্রগুলোকে অনেকটা অসহায় ও লেখকের করুণা প্রার্থী হতে দেখা যায়। চরিত্রগুলো প্রায়ই আপনযোগ্যতা বলে বিকশিত হয় না। এর কারণ কি লেখকের অনবধানতা? নাকি নায়ক ও খলনায়ক সৃষ্টিতে লেখকের ব্যক্তিগত ও সচেতন পক্ষপাতও এর জন্য দায়ী? জীবনের ভাঁড়ারে প্রচুর অভিজ্ঞতা জমা না থাকলে ব্যক্তিগত অভিরুচিতেও অনেক সময় সমাজবাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কহীন চরিত্র বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে লেখকই নির্দিষ্ট করে দেন তার পক্ষপাত কোন চরিত্রের দিকে। তখন পাঠক অসহায়বোধ করেন কেবল। লেখকের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে পাঠক স্বাধীনভাবে চরিত্র নির্বাচন করার সুযোগ না পেলে সেখানে পাঠক গল্প পাঠ শেষে কিছুটা হলেও মর্মপীড়ায় ভোগেন। কালের বিবর্তনে, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের ফলে যে পরিমাণ রুচির পরিবর্তন সাধিত হয়, সে পরিমাণ দূরদর্শিতা লেখক দেখাতে না পারলে গল্পের নির্দিষ্টকালের বিবরণ থেকে চিরকালীন ব্যঞ্জনার স্মারক হয়ে উঠতে পারে কতটুকু?
প্রথম প্রকাশ : মার্চ ২০১৩