গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক ঘটনার তীর্থক্ষেত্র দেনুড়। বর্তমানে গ্রামটি পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর থানার অধীনে। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর সন্ন্যাস গুরু কেশব ভারতী ও শ্রীশ্রী বৃন্দাবন দাসের শ্রীপাট এই দেনুড়। শ্রীপাট বলতে বোঝায় বৈষ্ণব মহাপুরুষদের জন্মভূমি বা ভজনস্থান বা লীলাক্ষেত্র। দেনুড়ের প্রাচীন নাম ছিলো দেন্দুড়।
কথিত আছে নিত্যানন্দ মহাপ্রভু সপার্ষদ নবদ্বীপ থেকে নীলাচলে চলেছেন রথযাত্রা দেখতে। সঙ্গে ছিলেন প্রভুর অনুগত শিষ্য বৃন্দাবন দাস। যাত্রাপথে এসে পৌঁছলেন দেনুড় গ্রামে। গ্রামে এক স্বচ্ছ বিরাট জলাশয় এবং একটি বিশাল আমবাগানের শীতল ছায়ায় এসে নিত্যানন্দ প্রভু ঠিক করলেন এখানেই সাময়িক বিশ্রাম নিয়ে কাল ফের যাত্রা শুরু করা হবে।
গ্রামের ভক্তজনেরা সকলের আহারের আয়োজন করলো। আহার শেষে নিত্যানন্দ প্রভু বললেন, ‘মুখশুদ্ধি হলে ভালো হতো।’
তখন শিষ্য বৃন্দাবন দাস একটি হরিতকি দিলেন। নিত্যানন্দ মহাপ্রভু বিস্ময় হয়ে জিজ্ঞেস করলেন ‘হরিতকি কোথায় পেলে?’
বৃন্দাবন দাস জানায় তিনি দুটি ভিক্ষালব্ধ হরিতকি জোগাড় করেছিলেন। আগের দিন একটি প্রভুকে দিয়েছিলেন আর একটি রেখে দিয়েছিলেন যদি আজ আবার প্রভুর লাগে ভেবে।
শিষ্য ভেবেছিলো প্রভুর কাছ থেকে বাহবা জুটবে কিন্তু উল্টে জুটলো ভর্ৎসনা। নিত্যানন্দ প্রভু বললেন, ‘তোমার এখনও সঞ্চয়ী গৃহস্থ মনোভাবই রয়েছে তাই তুমি আর নীলাচলে যেও না। এখানে বসেই গৌর সাধনা করো।’ শোনা যায়, শ্রীচৈতন্য চরিত্র রচনা করার কথা নিত্যানন্দ প্রভু বলেন বৃন্দাবন দাসকে।
রয়ে গেলেন সেখানে বৃন্দাবন দাস। ভক্তগণের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সেই গ্রামের রামহরি সরকার। বৃন্দাবন দাসকে সসম্মানে নিজ গৃহে নিয়ে এলেন। রামহরির বসত বাড়ির মহল রূপায়িত হলো বৃন্দাবন দাসের ভজন অঙ্গনে। এখানেই তিনি রচনা করেন ‘শ্রী চৈতন্য ভাগবত’। ভক্তি প্রবলতা, অলৌকিক বিশ্বাস প্রভৃতির মধ্যে দিয়ে চৈতন্যদেবের মানবরূপ জীবন্ত হয়ে উঠেছে বৃন্দাবন দাসের সৃষ্টির নিপুণ রূপায়ণে। তাঁর মতে, চৈতন্য অবতারের উদ্দেশ্য ছিলো কলিযুগে হরিনাম সংকীর্তনের মাধ্যমে মানবজাতির কল্যাণ।
এই মহাগ্রন্থ রচনার কাল নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। আজও দেনুড় গ্রামে গেলে দর্শন পাওয়া যায় বৃন্দাবন দাসের হস্তে রচিত শ্রী চৈতন্য ভাগবতের। চৈতন্য ভাগবতের আদি নাম ছিলো চৈতন্যমঙ্গল। শ্রীচৈতন্যভাগবত তিনটি খণ্ডে বিভক্ত : আদিখণ্ড, মধ্যখণ্ড ও অন্তখণ্ড। চৈতন্যভাগবত লেখা হয়েছিলো তুলোট কাগজে। এটি বর্তমানে কাঁচ ও কাঠের বায়ু নিরোধক বাক্সে রাখা আছে।
এখানে আছে বৃন্দাবন দাসের সেবিত গৌর-নিতাই বিগ্রহ। আছে দারু নির্মিত জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরামের বিগ্রহ। মন্দিরের গর্ভগৃহে আছে শ্রীরাধা-বৃন্দাবনচন্দ্র যুগল, মদনমোহন, বংশীহারি, দ্বাদশ গোপাল অনুসারে বারোটি ছোট থেকে বড়ো গোপাল মূর্তি, কষ্টিপাথরের শ্যামসুন্দর অষ্টধাতুর শ্রীরাধা। রয়েছে রামহরি সরকারের কুলদেবতা শ্রীশ্রীরঘুনাথ শিলা ও আরো কয়েকটি শালগ্রাম শিলা, ধাতু নির্মিত মনসা মূর্তি।
পাশের ঘরে বৃন্দাবন দাসের ধ্যানমগ্ন মূর্তি ও চিত্রপট।
আছে কেশব ভারতীর বাড়ি ও দালান-মন্দির। যদিও এখানে বেশিদিন থাকেননি তিনি, সন্ন্যাস নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। মন্দিরে জগন্নাথ-রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ আছে। তার বামদিকে কেশব ভারতীর প্রস্তর মূর্তি। সামনে ভগ্ন রাসমঞ্চ।
পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ পাঁচশো বছরের পুরনো দেন্দুরেশ্বর বা দিনেশ্বর শিব মন্দির। এখানে শিব নাকি পাতাল-ফোঁড়। জনশ্রুতি আছে দিনেশ্বর থেকে দেনুড় নামের উৎপত্তি। মন্দিরটিতে আটচালা রীতির ছাপ মেলে। মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। মন্দিরের সামনে বড় দীঘির নাম দিনেশ্বর পুকুর। শিবরাত্রির বার্ষিক অনুষ্ঠানে জমজমাট হয় মন্দির চত্ত্বর।
রয়েছে কালো পাথরের প্রাচীন দেবী বিক্রমচণ্ডীর মন্দির। দেনুড় পঞ্চায়েতেরই পাতুন গ্রামে রয়েছে পঞ্চেশ্বর শিবমন্দির। দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে জীর্ণদশা প্রাপ্তি ঘটেছে। আগাছায় ঢেকে গেছে মন্দিরের চূড়া।
গ্রামের আলপথ দিয়ে একটু এগোলেই পরে নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর বিশ্রামস্থল যেখানে তিনি বৃন্দাবন দাসকে রেখে গেছিলেন। সেই আমবাগান এখন আর নেই, আছে সুন্দর সুবিস্তৃত বটগাছ। রয়েছে ছোট্ট একটি মন্দিরে নিত্যানন্দের চরণচিহ্ন।
ঠিক এর পাশেই রয়েছে হরিতকি বৃক্ষ। কথিত আছে, বৃন্দাবন দাস যে হরিতকিটি নিত্যানন্দ প্রভুকে দিয়েছিলেন সেটি ভক্ষণ না করে স্বহস্তে পুঁতে দেন মাটিতে। তবে সে বৃক্ষটি আজ আর নেই তবে সেখানে সেবাইত পঞ্চানন মোহন্ত আর একটি হরিতকি গাছ লাগান।
মূল প্রবেশদ্বারের সামনে একটি কাঠের রথ রাখা আছে যেখানে রথযাত্রার সময় শুধুমাত্র জগন্নাথ দেব বসেন। এখানে সোজা রথ হয়, উল্টোরথ হয়না। ভক্তদের জন্য প্রাসাদের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। এখানে পোলাও কে বলে পুষ্পান্ন।
গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজে বৃন্দাবন দাসকে চৈতন্য সমকালের ব্যাসদেব বলা হতো। বিরল পুঁথি আর নানান ইতিহাসের পবিত্র ভূমি দেনুড়। পাঠকদের পড়তে পড়তে যদি ভরে যায় মনপ্রাণ, তবে ঘুরে আসুন বৈষ্ণব তীর্থ দেনুড়।
সংসারের পার হৈয়া ভক্তির সাগরে।
যে ডুবিবে সে ভজুক নিতাই চাঁদেরে।।
আমার প্রভুর প্রভু শ্রী গৌর সুন্দর।
এ ভরসা চিত্তে ধরি নিরন্তন।।(চৈতন্যভাগবত)
Sources : Various articles and journals have been referred.
হাওড়া থেকে কি ভাবে গেলে সুবিধা হবে।