বিক্রমশীলা মহাবিহার
বিক্রমশীলা মগধের গঙ্গার তীরের অন্যতম বড়, গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে লামা তারানাথ বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান নির্ণয় করেছেন মগধে, গঙ্গার পাড়ে পাহাড়ি সানুদেশে। জেনারেল কানিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান বিষয়ে বলছেন পাটনা জেলার বড়গাঁওয়ের কাছে সিলাও গ্রামে। মহামহোপাধ্যায় সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ বলছেন ভাগলপুর জেলার সুলতানগঞ্জে। এন দের দ্য বিক্রমশীলা মনাস্ট্রি প্রবন্ধে বলছেন মহাবিহারটি ভাগলপুরের কাছে পাথরঘাটার গ্রাম কলঙ্গে অবস্থিত ছিল। পাথরঘাটার প্রাচীন নাম ছিল বিক্রমশীলা-সংগ্রাহম বা ছোট করে শীল-সঙ্গম। এটাকেই মোটামুটি বিহারের অবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অষ্টম শতে ধর্মপালের রাজত্বে বিক্রমশীলা মহাবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা হয়। শুরু থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয় তিব্বতের মঠগুলোর জন্যে ভিক্ষু পাঠাতে থাকে। বিক্রমশীলা শিক্ষা কেন্দ্রের কয়েকজন প্রখ্যাত পণ্ডিত হলেন বুদ্ধ জ্ঞানপাদ, বিরোচন রক্ষিত, জেতারি, প্রজ্ঞান করমতি, বাগীশ্বর কীর্তি, বীর্য সিংহ, দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান (অতীশ), অভয়ঙ্কর গুপ্ত, তথাগত রক্ষিত এবং ধর্ম কীর্তি।
রাজা ধর্মপাল বিক্রমশীলা মঠটি স্থাপন করে মঠের অধিবাসীদের বিনামূল্যে বাসস্থান এবং খাদ্যের ব্যবস্থা করেন। ১২০৩ অবদি ধর্মপাল এবং তার উত্তরাধিকারী পাল রাজারা বিক্রমশীলা মহাবিহারে বিপুল পরিমানে অর্থ সাহায্য করেছেন। ডি জি আপ্তে ইউনিভার্সিটিজ ইন এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়ায় নালন্দা মহাবিদ্যালয়ের পতনের অন্যতম কারন সম্পর্কে বলছেন বিক্রমশীলার উত্থান। বিক্রমশীলা বিদ্যালয় নিয়ে পাল রাজাদের আগ্রহ বাড়তে থাকে। বিক্রমশীলায় রাজার দান বিপুলভাবে বাড়াতে থাকায় ক্রমশঃ নালন্দা মহাবিদ্যালয় অস্তাচলে যায়। আপ্তে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে বলছেন — The university worked with great vigour upto 1100 A.D. when its greatness began to be eclipsed by Vikramasila which began to receive a greater share of royal patronage।
বিহারের কেন্দ্রস্থলে ছিল বিশালকায় মহাবোধির মূর্তি/ছবি (ইমেজ)। বিহারের মধ্যে ভিক্ষুদের ব্যক্তিগত উপাসনার জন্য ছিল ৫৩টা ছোট ছোট স্তুপ (টেম্পল) এবং ৪৪টা সাধারণ স্তুপ। বিহারে মোট ১০৮টা স্তুপ ছিল। বিহারটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনায় তৈরি। বহু শিক্ষক অশিক্ষক ভিক্ষুদের থাকা পাঠ নেওয়া উপাসনা করার জন্যে এই কাঠামোটি পরিকল্পিত হয়েছিল। কেন্দ্রে মহাবোধি মন্দির ঘিরে ছিল বিশালকায় কিন্তু তার থেকে ছোট ১০৮টি মন্দির। এছাড়াও মধ্যাঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান ইত্যাদি সমাধা করার জন্যে ছিল ছটি বিশালকায় বিদ্যালয় বাড়ি। সবমিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে ওপর থেকে ফোটা পদ্মের মত দেখতে লাগত — পদ্মসম্ভবের প্রতিরূপ। প্রত্যেকটি বিদ্যালয় বাড়িতে পঠনের জন্যে বিপুল সংখ্যক ঘর ছিল। প্রত্যেকটা বাড়ি চওড়া দেওয়াল দিয়ে সুরক্ষিতভাবে ঘেরা থাকত।
ধর্মপাল বিহারকে শুধু রাজকীয় সাহায্য দিতেন তাই নয়, ছাত্র আর শিক্ষকদের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থাও করেছিলেন। তার মনে হয়েছিল শুধু থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করলেই বিহারটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে রূপান্তরিত হবে না, বরং বিহারে অধ্যাপকদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তিনি ১০৮টি অধাপক পদ সৃষ্টি করলেন তার মধ্যে ছিল উড অফারিং আচার্য, অর্ডিনেশন আচার্য, একজন সুপারিনটেন্ডেন্ট অব ওয়ার্ক্স, পায়রার পাহারাদার, স্তুপে দাস সরবরাহ করার কর্মীদের আচার্য ইত্যাদি। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজা ধর্মপাল আরও ১১৪ প্রজ্ঞাবান অধ্যাপক নিয়োগ করলেন। তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং বস্ত্রের সরবরাহ ছাড়াও অন্যান্য চাহিদা রাজকোষ থেকে মেটানো হত। মঠের বিপুল খরচ নিয়ে একটা সাধারণ ইঙ্গিত দেওয়া যাক। বেতন হিসেবে চারজন অশিক্ষক কর্মীর পিছনে যে মুদ্রা ব্যয় হত, একজন অধাপকের জন্য সেই পরিমান মুদ্রা ব্যয় করা হত।
বিশ্ববদ্যালয়ে বিদ্যাদান পরিকল্পনার জন্য অধ্যাপকেদের নির্দিষ্ট সমিতি ছিল। বিক্রমশীলা বিহার বিষয়ে তারানাথ একটি আকর্ষণীয় মন্তব্য করেছেন — অধ্যাপকেদের সমিতির অধ্যাপকেরা সরাসরি নালন্দা বিহারের পরিচালন কাজকর্মের ওপরেও নজরদারি করতেন — অর্থাৎ নতুন বিহারকে দায়িত্ব দেওয়া হয় পুরোনো বিহারের পড়াশোনার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে। আমরা যদি এই মন্তব্যকে গুরুত্ব সহকারে বিচার করি তাহলে বুঝতে পারব যে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বের অটুট সম্পর্ক বজায় ছিল (অথবা দুই বিদ্যালয়কে রাজার পক্ষ থেকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল)। দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ই কিন্তু ধর্মপালের প্রশাসনের শাসনাধীন ছিল — তিনি হয়ত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সমতিকে নালন্দার মত পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা ব্যবস্থার ওপর কিছুটা নজরদারি করতে অনুরোধ করে থাকবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে দেখেছি দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অথবা অভয়ঙ্করেরমত প্রথিতযশা অধ্যাপক দুটি বিশ্ববিদ্যালয়েই কালক্রমে অধ্যাপনা করেছেন। আমরা জানিনা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি বিক্রমশীলা বিশ্ববদ্যালয়ের আচার্যের পরিচালনাধীন ছিল কি না।
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বিক্রমশীলা বিদ্যালয়েও উচ্চশ্রেণীতে নানান বিষয়ে পাঠ দিত। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়টা অনেকটা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হত, বেছে ছাত্র নেওয়া হত। তার কারণ হল অধিকাংশ ছাত্রই পাঠ শেষ করে দূর দেশে অবলোকিতেশ্বরের বাণী ছড়াবার কাজে যাওয়ার জন্যে শপথবদ্ধ ছিল। বিক্রমশীলা মহাযানপন্থী বিদ্যালয়। কিন্তু হীনযানের দর্শনও সমান্তরালভাবে এখানে পড়ান হয়েছে। এই জন্যে বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে নানান ধরণের, নানান বৈচিত্রের বই রাখা হত। যদিও এছাড়াও অবৌদ্ধ নানান বিষয়ও পড়ানো হত, কিন্তু সেগুলির সব কটা যে বৌদ্ধ জ্ঞানচর্চার অংশ ছিল না, সেটা স্পষ্ট বোঝা যেত না। ততদিনে বৌদ্ধ জ্ঞানচর্চায় প্রচুর অবৌদ্ধ নানান বিষয় প্রবেশ করেছে। তাই বিক্রমশীলায় কিছু কিছু অবৌদ্ধ জ্ঞানচর্চা পড়ানো হত যেমন ব্যাকরণ, তর্কবিদ্যা, অধিবিদ্যা, আচারঙ্গ ইত্যাদি। আধিদৌবিক ক্ষমতা অর্জনের জন্যে তন্ত্রের নানা বিষয় পড়ানো হত। মাথায় রাখতে হবে বিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিদেশে মঠে পাঠানোর জন্যে ভিক্ষু তৈরি করা, ফলে পাঠ্যক্রম সেই উদ্দেশ্য মাথায় রেখে তৈরি করা হত।
পাঠ্যক্রম কতদিনের ছিল তার কোনও নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। মনে হয় পড়াশোনার অবধি শিক্ষার্থীদের বুদ্ধি আর আগ্রহের ওপরে নির্ভর করত। শিক্ষার্থীদের শংসাপত্র দেওয়ার সময় রাজা পৌরোহিত্য করতেন। তিব্বতি সূত্র আমাদের জানাচ্ছে জেতারি এবং রত্নবজ্র যথাক্রমে বিদ্যালয়েই রাজা মহীপাল এবং রাজা কণকের হাত থেকে শংসাপত্র নিয়েছেন। যে সব ছাত্র খুব ভাল ফল করত, তাদের ছবি বিদ্যালয়ে টাঙ্গিয়ে রাখা হত। অতীশ এবং নাগার্জুনের ছবি বিদ্যালয়ে টাঙ্গানো ছিল।
বিদ্যালয়ের রোজকার প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার জন্যে বিভিন্ন সমিতি ছিল। বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকের শিক্ষাদান বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। শিক্ষার্থীদের প্রবেশ বিষয়ে কড়াকড়ি করা হত। বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা সাক্ষাৎকার নিয়ে ছাত্র ভর্তি করতেন। ছাত্র ভর্তিতে শিক্ষকদের সন্তুষ্টিই শেষ কথা ছিল। চণকের রাজত্বে (৯৫৫-৯৮৩খ্রি) ছ’জন তর্কবিদ ছাত্র ভর্তির কাজে নিযুক্ত ছিলেন — রত্নাকরশান্তি ছিলেন পূর্ব দরজায়, পশ্চিম দরজায় ছিলেন বাগীশ্বরকীর্তি, উত্তরে নারোপা, দক্ষিণে প্রজ্ঞাকরমতি, প্রথম মূল দরজায় ছিলেন রত্নবজ্র, দ্বিতীয় মূল দরজায় ছিলেন জ্ঞানশ্রীমিত্র।
যে সব শিক্ষক মহাবিদ্যালয়ে যুক্ত ছিলেন, তারা যে শুধু দেশেই প্রখ্যাত ছিলেন তাই নয় তাদের খ্যাতি বিদেশেও ছড়িয়েছিল। এই জন্যে তিব্বতের সঙ্গে বিদ্যালয়ের একটা সাহিত্যিক এবং কৃষ্টিশীল যোগসূত্র গড়ে ওঠে। তিব্বতি পণ্ডিতেরা চারশ বছর ধরে শিক্ষাকেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তন্ত্র এবং অন্যন্য বিষয়ে জ্ঞানলাভ করেছে। বিক্রমশীলা বিহারের শিক্ষকদের দয়া, করুণা এবং ধর্মজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই তিব্বতের নতুন কৃষ্টিগজতের ভিত গড়ে উঠেছে। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নানান বিষয়ে পুস্তক লিখেছেন মূলত সংস্কৃত ভাষায়, এছাড়াও তিব্বতি ভাষাতেও বেশ কিছু বই লিখেছেন। শুধু অতীশ দীপঙ্করই দু’শ বই লেখেন — কিছু মৌলিক, কিছু অনুবাদ। তিব্বত থেকে বিপুল সংখ্যক পণ্ডিত আসতেন বিদ্যালয়ে। তাদের জন্যে আলাদাকরে বিশেষভাবে থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা করা হত। ভারতবর্ষর নানান এলাকা থেকেও বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীরা আসতেন জ্ঞান লাভের আশায়। দ্বাদশ শতে এখানে ১২০০ শিক্ষার্থী ছিল। বখতিয়ার খলজির হাতে ১২০৩-এ বিক্রমশীলা ধ্বংস হয়ে যায়।