দুর্গা যেমন নানা রঙের, নানা মতের, নানা কল্পনায়। ঠিক তাকে নিতে গল্প-গাছারও ইয়ত্তা নেই। ফিল্টার হতে হতে যেটুকু এখনও রয়েগেছে তাও রোমহর্ষক। এইসব গল্প-গাছাকে সঙ্গে নিয়ে উৎসবের দিনগুলো বেশ ভালো কাটে। করোনাকালের যন্ত্রনার মধ্যেও এই মিথগুলো ঠিক ওই সময় সত্য হয়ে আমাদের চারপাশে ঘোরে, বেশ লাগে।
কোড়ো পাহাড়ের দুর্গা
৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে বাঁকুড়া শহর থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে গেলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে নিঃঝুম কোড়ো পাহাড়ে। ছোট্ট সবুজ পাহাড়। উচ্চতা খুব বেশি হলে ৪০০ থেকে ৫০০ ফুট। নাম না জানা লতা-পাতা-গুল্মে ঢাকা পাহাড়ের একপাশ দিয়ে রূপালি ফিতের মতো বয়ে চলেছে শালী নদী। লাল নুড়ি পাথরে ঢাকা পাকদণ্ডী বেয়ে উঠে যাওয়া যায় এক ছিমছাম আশ্রম প্রাঙ্গণে। গাড়ি পথের এখানেই শেষ। এরপর পায়ে হেঁটে বড় পাথরের চাঁই টপকে পৌঁছে যেতে হবে একেবারে পাহাড় চূড়ায়। সেখানেই আছে অষ্টভুজা পার্বতীর মন্দির। যা স্থাপিত হয় ১৩৬৩ খ্রিস্টাব্দে। মন্দিরটি ঘিরে নানা গল্প শোনা যায়। বিশ্বাস ও মিথ্ সব মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে এখানে। স্থানীয়দের দাবি, অনেক বছর আগে এক সাধু হেঁটে হিমালয় যাবার পথে থামেন এখানে। জনহীন এই পাহাড়ের নীচে বিশ্রাম নেবার সময় দেখতে পান এক বালিকা একলা উঠে যাচ্ছে বন পেরিয়ে পাহাড়ের চূড়ায়। দীর্ঘ দিনের ঘড়ছাড়া পরিব্রাজকের কি মনে পড়িছিল তাঁর কুমারী কন্যার কথা? জানা যায় না। পরে কাশী থেকে ফেরার পথে নিয়ে আসেন অষ্টভুজা পার্বতীর মূর্তি। কোড়ো পাহাড়ের চূড়ায় স্থাপন করেন সেটি। সালটা ছিল ১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দ।
শিবরাত্রি ও দুর্গাপুজো উপলক্ষে ভিড় উপচে পড়ে নির্জন পাহাড়ি এই মন্দিরে। আড়ম্বর বা জাঁকজমক নয়, সমস্ত রীতি-নীতি মেনে নিষ্ঠা সহকারে বৈষ্ণব মতে পুজো হয় দেবীর। এখানে বলি হয় না। ভোগ বলতে মুড়ি ও ছোলা। বর্ধমান থেকে ব্রাহ্মণ এসে পুজো করেন এই পাহাড়ি মন্দিরে। পুজোর সময় পর্যটকদের ভিড়ে জমজমাট হয়ে ওঠে নির্জন এই মন্দির প্রাঙ্গণ। এখানে থাকার ব্যবস্থা আছে মন্দির লাগোয়া যাত্রীনিবাসে। পাহাড়ের চূড়া থেকে নীচের দিকে তাকালে মনে হয় কে যেন বিছিয়ে দিয়েছে সবুজ গালিচা। শালি নদীর উপর গাঙ্গুরা জলাধারের জলে পড়ে নানা রংবেরংয়ের প্রতিচ্ছবি। শহুরে কোলাহল থেকে বহু যোজন দূরে নির্জন প্রকৃতির কোলে কয়েকদিন কাটিয়ে আসার আদর্শ স্থান বাঁকুড়ার কোড়ো পাহাড়।
কাত্যায়নী দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী
হাওড়ার রামরাজাতলা অঞ্চলে সুপ্রাচীন পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম এইটি। কাত্যায়নী দেবী আসলে বাংলাদেশের বিক্রমপুরের জমিদার রামপ্রসাদ দাম সরকারের কুলদেবী ছিলেন। বৃন্দাবনে বেড়াতে গিয়ে একটি মন্দিরে কাত্যায়নী দুর্গার মূর্তি দেখে সেটি পছন্দ হয়ে যায় রামপ্রসাদ দাম সরকারের। সেখানেই একই রকম অষ্টধাতুর মূর্তি গড়িয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করেন। পণ্ডিত মুরারিমোহন চক্রবর্তীর বাড়িতে দেবী দুর্গা কাত্যায়নী নামে পূজিতা হন। মুরারিমোহন চক্রবর্তী (শাস্ত্রী) হাওড়ায় এই পুজোর সূচনা করেন। বর্তমানে তাঁর পুত্র বিকাশ চক্রবর্তী ও তাঁর স্ত্রী শুভ্রা চক্রবর্তী এবং পরিবারবর্গ যৌথভাবে এই পুজো করছেন। পুজোটির সঙ্গে একটি গল্প জড়িয়ে আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে দেবী কাত্যায়নীর পুজো শুরু হয়েছিল ঢাকার দাশগুপ্ত পরিবারে। ঢাকেশ্বরী নামে বহু বছর পূজিত হয়েছেন দেবী। কিন্তু কালক্রমে বংশ বিপর্যয় ও দেশভাগের সময় ঢাকার দাশগুপ্ত পরিবারের বংশধর প্রয়াত প্রমোদ দাশগুপ্ত মারফত দেবী প্রতিমা রামরাজাতলার মুরারিমোহন শাস্ত্রীর বাড়ি আনা হয়। তাই বলা যায়, এটি মূলত বাংলাদেশের দুর্গাপুজো যা পরবর্তীকালে ভারতে হচ্ছে।
দেবী প্রতিমা অষ্টধাতু দ্বারা নির্মিত। কাত্যায়নী দুর্গাপুজো মহাসমাগমে চারদিন ধরে পালিত হয়। ষষ্ঠীর বোধন দিয়ে পুজো শুরু হয়। সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত পুজো চলে। অষ্টমীতে খিচুড়ি ভোগ হয়। বহু মানুষের সমাগম হয় এইদিন। আগে নবমীতে এখানে ছাগবলি হতো। এখন কলা, শশা, চালকুমড়ো ও আখ বলি হয়। পুজোর চারদিন আত্মীয়স্বজনের কোলাহলে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে চক্রবর্তীবাড়ি। এই সময় বাংলাদেশ থেকেও অনেকে আসেন অতিথি হয়ে। পুজোকে কেন্দ্র করে দু-দেশের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়।