১ জুলাই, বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রেবার সেই খালাতো বোন শামসুন্নাহার আজিম–যার স্বামীকে গোপালপুর সুগার মিলে আর্মি মেরে ফেলেছিল, তার খবর পাওয়া গেছে। শামসুন্নাহার তার তিন বাচ্চা আর ছোট ভাই সালাহউদ্দিনকে নিয়ে গ্রামে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পালিয়ে পালিয়ে বহুকষ্টের ভেতর দিয়ে শেষমেষ তারা ঢাকায় এসে পৌঁছেছে গত মাসের মাঝামাঝি। ওদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় নেই, কিন্তু রেবা-মিনি ভাইয়ের মুখে শুনলাম পুরো ঘটনাটা।
শামসুন্নাহারের স্বামী আনোয়ারুল আজিম গোপালপুর সুগারমিলের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ছিল। বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে ঐ অঞ্চলের জনসাধারণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সেও সাড়া দিয়েছিল। অসহযোগ আন্দোলনের সময় গোপালপুর সুগার মিলে চিনি উৎপাদন বন্ধ করা হয়। ২৯ মার্চ পর্যন্ত এলাকা ছিল পাক শত্রুমুক্ত। ৩০ মার্চ সকালে লোকমুখে খবর পাওয়া গেল নাটোর বনপাড়ার রাস্তা দিয়ে পাক আর্মি মিলের দিকে আসছে। তখন মিল এরিয়ার সমস্ত লোক একত্র হয়ে মিলে আসার রাস্তার ওপর যে রেলক্রসিং ছিল, সেইখানে একটা ইঞ্জিন টেনে এনে ব্যারিকেড দিল। পাক আর্মি ব্যারিকেডের ওপাশে পজিশান নিয়ে গুলিগোলা মর্টারশেল যা আছে সব বর্ষণ করল, এ ধারে মুক্তিযোদ্ধারা মান্ধাতা আমলের বন্দুক, রাইফেল থেকে গুলি ছুঁড়ে তার উত্তর দিল। তখনকার মতো কিছু আহত সৈনিকসহ পাক আর্মি ফিরে যায়। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে আজিম মিলের হিন্দু শ্রমিকদের পালিয়ে যেতে বলে। নিজেরাও আধ-মাইল দূরে নরেন্দ্রপুর ফার্মে সাময়িকভাবে সরে যায়। সেখানে ওরা ১০/১২ দিন ছিল।
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে মিল এরিয়া থেকে কিছু লোক নরেন্দ্রপুরে এসে আজিমদের বলে যে, ওরা শুনেছে কয়েকদিন আগে মুলাডোলে পাক আর্মি আর মুক্তিবাহিনীর মধ্যে নাকি একটা খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে। তাতে আসলাম বলে এক পাকিস্তানি মেজর আর দুজন সৈন্য মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। মুক্তিবাহিনী ওদের লালপুর বলে একটা জায়গায় নিয়ে গুলি করে। কিন্তু গুজব ছড়িয়েছে ওদের লাশ নাকি মিলের ভেতর ফেলে দেওয়া হয়েছে। নাটোরে পাকিস্তানি মেজর শেরওয়ানি খান খুব ক্ষেপে রয়েছে। এসব শুনে আজিম ইন্ডিয়া চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ঐ এলাকার অধিবাসীরা আজিমকে অনুরোধ করে, তাদেরকে বাঘের মুখে ফেলে আজিম যেন চলে না যায়। আজিম গোপালপুরে তার তিন বছরের চাকরির সময়ে এলাকার সকলের কাছে খুব প্রিয় ও পরিচিত হয়ে উঠেছিল সবাই তাকে নেতার মতো গণ্য করতো। ওদের অনুরোধে পড়ে আজিমের ইন্ডিয়া যাওয়া হলো না। তবে নিরাপত্তার জন্য আরেকটু দূরে কৃষ্ণা ফার্মে গেল। সেখানে দিন সাত/আট ছিল।
ইতোমধ্যে রাজশাহীর পতন হয়েছে, সমগ্র উত্তরাঞ্চল পাক আর্মির নিয়ন্ত্রণে। মিল থেকে কিছু লোক ও আশপাশের গ্রামের আখচাষীরা এসে আজিমকে ধরল, আপনি মিলে ফিরে আসুন, আর্মি বলছে মিল চালু করতে হবে, আর কোনো ভয় নেই।
আজিমরা মিলে ফিরে গেল। কিন্তু মিল চালু করা তো মুখের কথা নয়, সময় লাগে অথচ পাক আর্মি তা বুঝতে চায় না। নাটোরে ছিল পাকিস্তানি মেজর শেরওয়ানী খান। সেখানে আজিম ও আরো কয়েকজন অফিসারকে ধরে নিয়ে গিয়ে মিল চালু করার জন্য হুকুম দেওয়া হলো। গোপালপুর মিলে বিহারি শ্রমিক ছিল প্রচুর। তাদেরই এখন দিন। তারা মুখে বিনয় দেখিয়ে বলে, স্যার, আমাদের ছেড়ে যাবেন না। আমরা মিল চালু করার ব্যাপারে সবরকম সাহায্য করব। এসব বলে আর পাহারার মতো করে ঘিরে রাখে। মাঝে-মাঝে একদল করে পাকিস্তানি সৈন্য মিলে আসে, বিহারিদের সঙ্গে হৈ হৈ করে–তখন আবার মিলে বাঙালিদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি হয়। কোয়ার্টার্স ছেড়ে পালায়-আবার ফিরে আসে। মাঝে-মাঝে কিছু সৈন্য বাঙালিদের বাড়িতে ঢুকে টাকা পয়সা দাবি করে, দামি জিনিসপত্র উঠিয়ে নিয়ে যায়। আজিমের কোয়ার্টার্সেও একবার এই রকম হামলা হয়। সেবার ঘরে যা টাকা-পয়সা ছিল, পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তুলে দিয়ে নিষ্কৃতি পায়। তখন আজিম ঠিক করে নিজের কোয়ার্টার্সে থাকবে না। অন্য এক স্টাফের কোয়ার্টার্সে থাকতে শুরু করে। মিল চালু করতে আজিমের টালবাহানায় পাকিস্তানিরা ক্রমে অধৈর্য হয়ে উঠছিল। দেশের সর্বত্র কলকারখানা ঠিকমতো চলছে, উৎপাদন ঠিকমতো হচ্ছে এসব দেখানো দরকার। অথচ আজিম স্থির করেছে–মিল সে চালু করবে না। পাকিস্তানি ও বিহারিদের ধোকা দেবার জন্য প্রাথমিক কিছু তোড়জোড় শুরু করে কিন্তু ভেতরে ভেতরে কয়েকজন বাঙালি অফিসারের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় পাঁচ মে মিল বন্ধ ঘোষণা করে ঢাকা চলে যাবে।
পাঁচ মে সকালে আজিম কয়েকজন অফিসারসহ মিলের বাইরে যায়। মিলের স্টোর অফিসার সে সময় আসন্ন প্রসবা স্ত্রী নিয়ে মিল এরিয়ার বাইরে থাকত। পাঁচ মে খুব সকালে খবর আসে স্টোর অফিসারের বাসায় ডাকাতি হয়েছে। আজিম তাড়াতাড়ি কাপড় পরে সামান্য নাশতা খেয়ে সেখানে যায়। শামসুন্নাহারের সঙ্গে তার স্বামীর এই শেষ দেখা।
পরে যে আজিমরা মিলের পেছন দিকের এক গেট দিয়ে মিলে ফিরে এসে অফিসে গেছে, শামসুন্নাহার তা জানে না। বেলা প্রায় দশটার দিকে সে ছোট ছেলের গেঞ্জি খুলেছে তাকে গোসল করাবে বলে। যে ভদ্রলোকের বাসায় তারা ছিল, সেই এসিস্ট্যান্ট কেমিষ্ট রহমান সাহেবের চাকর বাইরে থেকে দৌড়ে এসে খবর দিল–মিলের মধ্যে মিলিটারি ঢুকেছে, বাড়ি বাড়ি দরজা ধাক্কা দিয়ে সবাইকে বের করছে। চারদিকে লোকজন ছুটে পালাচ্ছে। তখন মিসেস রহমান সবাইকে নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে অন্য একটা বাসায় (এক বিহারি ফোরম্যানের খালি বাসা) খিড়কি দরজা দিয়ে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। সে বাসার সদর দরজায় একটা তালা ঝুলছিল। এই তালাই পরে ওদের বাঁচিয়ে দেয়।
শামসুন্নাহার জানতে পারে নি যে, আর্মি মিলের অফিস থেকে আজিম ও অন্যান্য বাঙালি অফিসারকে ডেকে মিল এরিয়ার ভেতরে যে পুকুরটি আছে, তার পাড়ে নিয়ে গিয়েছে। এই পুকুরের পাড়ে আজিম, অন্যান্য অফিসার ও শ্রমিক মিলে প্রায় তিনশো বাঙালিকে পাকসেনারা মেশিনগান ব্রাশ ফায়ার করে মারে। শামসুন্নাহাররা সবাই যে, বাসাটাতে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে বসে ছিল, সেটা এই পুকুর থেকে অনেক দূরে। কিছু দেখা বা শোনা যায় না। তাছাড়া সুগার মিলের বয়লারে এক ধরনের ঝিকঝিক শব্দ হবার দরুনও তারা গুলির শব্দ শুনতে পায় নি। ঐ বাড়িতে বসে শামসুন্নাহার ভাবছে, আজিম তো মিল এরিয়ার বাইরেই আছে। অতএব, সে নিরাপদ। ঘণ্টা দেড়েক পরে ওরা সবাই ঐকোয়ার্টারের পেছনের ভাঙা (আগে থেকে ভেঙে রাখা হয়েছিল) বাউন্ডারি দিয়ে বেরিয়ে মাঠের মধ্যে ছুটে আধ-মাইল দূরে এক গ্রামে যায়। দেখে চারপাশ দিয়ে লোকজন ছুটে পালাচ্ছে। মিলের ভেতরে গুলিবিদ্ধ এক লোককে তার আত্মীয়স্বজন বাঁশের ভারে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঐগ্রামের লোকজনও ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে। আরো মাইল খানেক হেঁটে বিলসরিয়া বলে এক গ্রামে আশ্রয় নেয় শামসুন্নাহাররা সবাই। এখানে দেখে মিলের এক অফিসার শওকত তার আসন্ন প্রসবা স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে এসেছে। এখানে এক গরিব গৃহস্থের বাড়িতে কোনমতে রাতটা কাটিয়ে পরদিন গরুগাড়ি করে পাঁচ মাইল দূরে বিলমারিয়া নামে আরেকটা গ্রামে গিয়ে এক গৃহস্থের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এই বাড়িতে ওরা সবাই ৰারো দিন ছিল। শামসুন্নাহার এক কাপড়ে এই বারো দিন কাটায়। ছেলে খালি গায়ে। সেই যে গোসল করার আগে জামা খুলেছিল, সেই অবস্থাতেই পালাতে হয়েছিল। পায়ে জুতো লাগাবারও সময় পায়নি। শওকত জানত যে আজিমকে গুলি করে মারা হয়েছে। কিন্তু প্রথম অবস্থায় সে শামসুন্নাহারকে বলতে পারে নি কথাটা। তবে মিলের বাইরে এসেও আজিমের কোন খোঁজ না পেয়ে এবং বিভিন্ন গ্রামবাসীর কথাবার্তায় সন্দিগ্ধ হয়ে শামসুন্নাহার শওকতকে চাপ দিয়ে আসল খবর বের করে ফেলে।
শামসুন্নাহার জানত–বিশ-ত্রিশ মাইল দূরে যুগীপাড়া গ্রামে তার নানাশ্বশুরের বাড়ি।
একজন লোককে কিছু টাকা কবুল করে যুগীপাড়ায় খবর পাঠায়। যুগীপাড়া থেকে লোক এসে দুটো গরুগাড়ি ভাড়া করে শামসুন্নাহারদের নিয়ে রওয়ানা দেয়। অর্ধেক রাস্তা গিয়ে গরুগাড়ির গাড়োয়ানরা আর যেতে অস্বীকার করল। তখন টমটম ভাড়া করে খানিক গেল। এক নদীর পাড়ে এসে টমটম ছেড়ে দিয়ে নৌকায় নদী পেরিয়ে হেঁটে গেল কতকদূর। এভাবে যুগীপাড়ায় পৌঁছায় ওরা। এখানে এসে শামসুন্নাহার দ্বিতীয় কাপড় পরে। ছেলের গায়ে জামা ওঠে। এখানে ওরা বিশ-পঁচিশ দিন থাকে।
রাজশাহীর রাণীনগরে শামসুন্নাহারের শ্বশুরবাড়ি। ওর শ্বশুর ইন্ডিয়ান রেডিওতে ছেলের খবর জেনে পাগলের মতো পুত্রবধূ, নাতি-নাতনীদের খোঁজ করে শেষমেষ যুগীপাড়ায় খোঁজ পান। ছোট ছেলেকে পাঠিয়ে যুগীপাড়া থেকে শামসুন্নাহারদের আনিয়ে নেন। আবার কিছুদূর গরুগাড়ি, কিছুদূর নৌকা, কিছুদূর পায়ে হেঁটে শেষে টমটমে ওরা সবাই রাণীনগরে পৌঁছায়।
ওদিকে শামসুন্নাহারের বাবা-মা বরিশালে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন, তাঁরা ইন্ডিয়ান রেডিওতে জামাইয়ের খবর শুনে পাগলের মত হয়ে ঢাকা চলে আসেন। মেয়ের খোঁজ বের করতে তাদের অনেকদিন লেগে যায়। তারপর বি.আই.ডিসিতে বলে-কয়ে একটা জীপ পাঠানোর ব্যবস্থা করেন রাণীনগরে। সঙ্গে পাঠান বোনের ছেলেকে আর নিরাপত্তার জন্য এক বিহারি অফিসারকে।
রাণীনগর থেকে ঢাকা আসার রাস্তাও খুব সহজ ছিল না। জীপ রাণীনগর পর্যন্ত নেওয়া সম্ভব হয় নি। আত্রাই নদীর এপারে জীপ রাখতে হয়েছিল। শামসুন্নাহাররা নৌকায় নদী পেরিয়ে অনেকদূরে হেঁটে তারপর জীপে ওঠে। গত মাসের মাঝামাঝি শামসুন্নাহার তার তিন ছেলেমেয়ে ও ছোট ভাই সালাহউদ্দিন এমনি অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে অবশেষে ঢাকা এসে পৌঁছেছে।
সব শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। কারবালার ঘটনা কি এর চেয়েও হৃদয়বিদারক ছিল?
২ জুলাই, শুক্রবার ১৯৭১
গতকাল সন্ধ্যার পর ডাক্তাররা এসে পৌঁছেছেন। নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে এসেছেন। পরশু দিন ট্রাঙ্কলে বলেছিলেন সকালেই রওয়ানা দেবেন। সে হিসেবে তাদের বিকেল তিনটে-চারটের মধ্যে এসে পৌঁছানোর কথা। দেরি দেখে আমরা সবাই বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। বিশেষ করে খুকুর যা অবস্থা। দেরির কারণ সম্বন্ধে বললেন, পথে বহু জায়গায় পাক আর্মি গাড়ি থামিয়ে চেক করেছে। উনি রাওয়ালপিন্ডিতে মিটিং করতে যাচ্ছেন শুনে এবং করাচি থেকে আসা মিটিঙের চিঠি দেখে ওকে সব জায়গায় ছেড়ে দিয়েছে। গতকালই ওঁর কাছ থেকে রাজশাহীর কথা শুনতে খুব ইচ্ছে করছিল; কিন্তু সারাদিন ধরে পথের ধকলে ওদের সবার যা বিধ্বস্ত চেহারা হয়েছে–তাতে সে ইচ্ছে চেপে বললাম, আজ বিশ্রাম নিন। কাল সব শুনব।
আজ সারাদিন ডাক্তার ব্যস্ত ছিলেন, পি.জি হাসপাতালের ডিরেক্টর ডাঃ নূরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করা, প্লেনের টিকিট ও যাত্রার অন্যান্য ব্যবস্থা করার জন্য। সন্ধ্যার পর এসে বসলেন আমাদের বসার ঘরে। সঙ্গে সানু ডাক্তারের স্ত্রী।
ডাক্তার বললেন, আমরা তো প্রথমে ভেবেছিলাম ঢাকায় কিছু নেই। সব ভেঙেচুরে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মিসমার করে দিয়েছে। কোনদিক থেকে কোন খবর পাবার উপায় নেই। শুধু ইন্ডিয়ান রেডিও, বিবিসি, রেডিও অস্ট্রেলিয়া আর ভয়েস অব আমেরিকার খবর। তা সেসব খবর শুনে তো মাথা খারাপ। ঢাকার সঠিক খবর পেতে অনেকদিন লেগেছে।
রাজশাহী ফল করে কবে?
খুব সম্ভব তের কি চৌদ্দ এপ্রিল। ভোরবেলা নদীর ধার দিয়ে পাক আর্মি শহরে ঢুকে পড়ল। সেদিনের স্মৃতি ভয়াবহ। টাউনের চোদ্দ আনা লোক বোধহয় পালিয়েছে, বাকি দুআনা ঘরে দরজা-জানালা সেটে বসে ছিল। রাজশাহী টাউন সেদিন শ্মশানের মত দেখাচ্ছিল। পরে জেনেছি, পাক আর্মি পথের দুপাশে সব জ্বালাতে জ্বালাতে শহরে ঢুকেছিল। বহু লোক মরেছে তাদের গুলিতে। কদিনের মধ্যেই পাকবাহিনী রাজশাহী শহরের পুরো কন্ট্রোল নিয়ে নিল। আমাদের সবাইকে বলা হল, কাজে জয়েন করতে, হাসপাতাল চালু করতে। আমরা প্রাণ হাতে করে হাসপাতালে যাতায়াত করতে লাগলাম।
হাসপাতালে রুগী ছিল?
মাঝে কিছুদিন ছিল না। কিন্তু হাসপাতাল আবার চালু করার পর রুগী আসতে লাগল। খালি জখমের রুগী।
জখমের রুগী?
হ্যাঁ। সাধারণ কোন রুগী বহুদিন হাসপাতালে কেউ আনেনি, এনেছে গুলি খাওয়া, বেয়নেট খোচাননা, হাত পা উড়ে যাওয়া রুগী। আরো একরকম রুগী হাসপাতালে লোক আনত, তারা আমাদের জীবনে ব্যথা হয়ে আছে।
ডাক্তারের গলা ভারি হয়ে উঠল, আমরা সবাই নীরবে চেয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ডাক্তার প্রায় আর্তনাদের মতো স্বরে বললেন, ধর্ষিতা মহিলা। অল্প বয়সী মেয়ে থেকে শুরু করে প্রৌঢ় মহিলা,, নানী, দাদী–কেউ রেহাই পান নি। অনেক বুড়ি মহিলা বাড়ি থেকে পালান নি, ভেবেছেন তাদের কিছু হবে না। অল্প বয়সী মেয়েদের সরিয়ে দিয়ে নিজেরা থেকেছেন, তাঁদেরও ছেড়ে দেয়নি পাকিস্তানি পাষণ্ডরা। এক মহিলা রুগীর কাছে শুনেছিলাম তিনি নামাজ পড়ছিলেন। সেই অবস্থায় তাঁকে টেনে রেপ করা হয়। আরেক মহিলা কোরান শরীফ পড়ছিলেন, শয়তানরা কোরান শরীফ টান দিয়ে ফেলে তাকে রেপ করে।
ডাক্তার থমথমে মুখে চুপ করে মাটির দিকে চেয়ে রইলেন। আমরা খানিকক্ষণ স্তম্ভিত, বাকহারা হয়ে বসে থাকলাম।
খানিকক্ষণ পর ডাক্তার আপন মনেই বললেন, যদি আল্লার অস্তিত্ব থাকে, তবে এই শয়তানের চেলা পাকিস্তানিদের ধ্বংস অবধারিত। আর যদি এরা ধ্বংস না হয়, তাহলে আল্লার অস্তিত্ব সম্বন্ধে আমাকে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে।
৩ জুলাই, শনিবার ১৯৭১
আজ ডা. এ. কে. খান রাওয়ালপিন্ডির পথে করাচি রওয়ানা হয়ে গেছেন ডাঃ নূরুল ইসলামের সঙ্গে। পাকিস্তান মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের মিটিং ডাকা হয়েছে পিন্ডিতে। এঁরা দুজন পূর্ব পাকিস্তান থেকে কাউন্সিলের সদস্য। গেছেন মাত্র চার পাঁচদিনের জন্য। তবুদুশ্চিন্তা হয়। ঠিকমত ফিরে আসবেন তো?কতোজনেগ্রাম থেকে ফিরে শহরে চাকরিতে জয়েন করতে অফিসে গেছে, আর বাড়ি ফেরে নি। তবে একটা ভরসার কথা, ডাঃ ইব্রাহীম করাচিতে রয়েছেন। ওখানকার জিন্না পি.জি. হাসপাতালে পোস্টেড। উনি এই মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের চেয়ারম্যানও। এই মিটিংটা উনিই ডেকেছেন।
বিকেলে বাগানে চেয়ার পেতে বসে সানুর সঙ্গে সব কথাই বলাবলি করছিলাম। মাগরেবের আজান পড়তে সানু উঠে নিজের বাড়ির দিকে গেল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শরীফের গাড়ি ঢুকল গেট দিয়ে। নেমেই মৃদুস্বরে বলল, ঘরে এস। তার দুই চোখ চকচক করছে, কি এক চাপা উত্তেজনায় সারা মুখ লাল হয়ে আছে।
বেডরুমে ঢুকে শরীফ বলল, রুমীর চিঠি—
রুমীর চিঠি! আমার হাত-পা কেঁপে সারা শরীর অবশ হয়ে এল। ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। কই, কোথায়।
শরীফ প্যান্টের পকেট থেকে একটা ছোট্ট চিরকুট বের করে আমার হতে দিল, চেয়ে দেখলাম সেই প্রিয় পরিচিত হাতের লেখায় তিনটি ছত্র : আমি ভালো। মণি ভাইদের সঙ্গে আছি। এদের যা যা দরকার, সব দিয়ো।–রুমী।
কোথায় পেলো? কে এনেছে।
সেই ছেলে দুটো। সেই শাহাদত আর আলম, গেল শনিবারে যারা বাঁকার বাসায় গিয়েছিল। ওরা আজ আমাদের অফিসে এসেছিল।
টাকা নিতে?
না। ওরা এখন ব্রিজ চায়।
ব্রিজ? সে আবার কি?
শরীফ হাসল হা-হা করে। ওকে এরকম সুখী হয়ে হাসতে দেখি নি অনেকদিন।
এমনিতেই রাশভারী স্বল্পবাক মানুষ। হাসেও মেপে মেপে। এই রকম খোলামেলা হাসি খুব কম সময়েই হাসতে দেখেছি ওকে।
শরীফ বুঝিয়ে বলল : খালেদ মোশাররফ বাংলাদেশের সবকটা ব্রিজ আর কালভার্টের তালিকা চেয়ে পাঠিয়েছে। সেই সঙ্গে ব্রিজ ও কালভার্ট ওড়ানোর ব্যাপারে কতকগুলো তথ্য। ব্রিজের ঠিক কোন্ কোন্ পয়েন্টে এক্সপ্লোসিভ বেঁধে ওড়ালে ব্রিজ ভাঙবে অথচ সবচেয়ে কম ক্ষতি হবে অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হবার পর খুব সহজে মেরামত করা যাবে তার বিস্তারিত তথ্য ও নির্দেশ। তাদের উদ্দেশ্য ভেতরে যতগুলো পারা যায় ব্রিজ আর কালভার্ট ভেঙে পাক সেনাবাহিনীর যোগাযোগ ও চলাচল ব্যবস্থাকে অচল করে দেওয়া।
রুমী সম্বন্ধে মুখে কিছু জিগ্যেস কর নি? জায়গাটার নাম, কি করছে–
ওরা আগরতলার কাছাকাছি, একটা জায়গায় আছে। ওটাকে ওরা নাম দিয়েছে দুই নম্বর সেক্টর। খালেদ মোশাররফ ওখানে সেক্টর কমান্ডার। ঢাকার বেশির ভাগ ছেলে ওইখানেই যায়। ঢাকা থেকে আগরতলার দিকটাই সবচেয়ে কাছে। রুমী ওখানে গেরিলা ট্রেনিং নিচ্ছে।
রুমী কবে নাগাদ আসবে কিছু বলেছে?
অত কথা জিগ্যেস করা যায়? যা লোকের ভিড় আর কাজের চাপ অফিসে!
৫ জুলাই, সোমবার ১৯৭১
জামী স্কুলে যায় না, আমি প্রতি মাসে একবার গিয়ে তার মাইনেটা দিয়ে আসি। হেডমাস্টার খান মুহম্মদ সালেক সাহেব ব্যস্ত না থাকলে তার সাথে, না হয় টিচার্স রুমে অন শিক্ষকদের সঙ্গে খানিক গল্প করে আসি। ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে চাকরি করেছি মাত্র দুবছর। কিন্তু ঐসময় গভঃ ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে যে হৃদ্যতা হয়েছিল, তা আজো অটুট রয়েছে।
আজ সালেক সাহেব একাই বসেছিলেন তার ঘরে। ফলে বেশ সুযোগ পাওয়া গেল সেন্সরবিহীন কথাবার্তা বলার। একটু পরেই ফোন বেজে উঠল। সালেক সাহেব ধরে কথা বলতে লাগলেন, আমি চুপচাপ শুনে গেলাম। কোন অভিভাবকের সঙ্গেই হচ্ছে, বোঝা গেল। সালেক সাহেবের কথাগুলো এরকম :
জি হ্যাঁ স্কুল তো ভোলাই। টিচার, দপ্তরী, দারোয়ান সবাই তো হাজির।
জি, জি, রোজই আসছে। আজো তো পঁয়তাল্লিশজন ছাত্র স্কুলে এসেছে।
না, না, একক্লাসে হবে কেন? আঠারোটা ক্লাসে।
পাঠাতে চাইলে নিশ্চয় পাঠাবেন। পথের দায়িত্ব আমরা নেই কি করে বলুন? স্কুলের গেটের ভেতর ঢুকলে, তার পরের দায়িত্বটুকু আমাদের।
আরো খানিকক্ষণ ধৈর্য ধরে শুনলেন, জি হ্য, জি না, হ্যাঁ হ্যাঁ- করে গেলেন। তারপর ফোন রেখে হাসলেন, বেচারী গার্জেন!কিছুতেই ডিসিশান নিতে পারছেন না। ছেলে পাঠাবেন কি পাঠাবেন না। ঘরে রাখার মতো মনের জোর নেই, স্কুলে পাঠাবার মতও দাপট নেই এ যেন সেই মাথায় রাখলে উকুনে খাবে, মাটিতে রাখলে পিপড়েয় খাবে।
সালেক সাহেবের স্ত্রী-পুত্রকন্যারা কেউ কোয়ার্টার্সে থাকেনা, একেকজনকে একেক জায়গায় রাখার বন্দোবস্ত করেছেন। ক্লাস নাইনে পড়া একটি মাত্র ছেলে ওঁর সঙ্গে থাকে। হেসে বললাম, অন্তত দেখাবার মতো একটি কুমির ছানা সঙ্গে রেখেছেন।
কি করব বলুন। সরু চুলে বাধা ডেমোস্থিনিসের খাড়া ঝুলছে মাথার ওপর। তাই একটু সাবধানে থাকতে হয়। রাতে বাসায় থাকি না। তবে কেয়ারও করি নে। হায়াত যদ্দিন আছে, কেউ মারতে পারবে না। সুতরাং আগে থেকেই মরে কি লাভ?
একটু পরে জিগ্যেস করলেন, জামী কেমন আছে? ও বাড়িতে ঠিকমতো পড়াশোনা করছে তো? দেখবেন যেন ঢিলা দিয়ে সব ভুলে খেয়ে বসে না থাকে। স্কুল বয়কট করা যেমন দরকার, বাড়িতে বসে স্কুলের পড়াটা ঠিকমতো চালিয়ে যাওয়াটাও তেমনিই দরকার।
বাড়ি ফিরে দেখি সাদ আর গালেব রুমীর খাটে বসে দাবা খেলছে। জামী খাটের পাশেই মেঝেতে বসে খাটের ওপর কনুই রেখে খেলা দেখছে। বারেককে ডেকে চা নাশতার কথা বলে আমিও খাটের অন্য পাশে কনুই রেখে মাটিতে বসলাম ওদের খেলা দেখবার জন্য।
৭ জুলাই, বুধবার ১৯৭১
গত তিনদিন ধরে বাঁকা আর শরীফের নাওয়া-খাওয়া বলে কিছু নেই। সারা দেশের সবগুলো ব্রিজ আর কালভার্টের তালিকা বানানো মুখের কথা নয়। প্রথমত, রোডস এন্ড হাইওয়েজ এর ডিজাইন ডিভিশন থেকে ব্রিজের ফাইলগুলো বের করা নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। ডিজাইন ডিভিশনের এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার সামাদ শরীফের খুব ভক্ত। সরকারি চাকরিতে শরীফ যখন ডিজাইন ডিভিশনে ছিল, তখন সামাদকে সে ডিজাইন অফিসের জন্য গড়ে পিঠে তৈরি করে নিয়েছিল। কিন্তু ফুলের বোঁটায় কাঁটার মতো সামাদের সঙ্গে কাদের খানও শোভা পাচ্ছে–ডিজাইন ডিভিশনের অবাঙালি এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার। তার সন্দেহ উদ্রেক না করে অফিস থেকে ফাইল সরানো যায় কিভাবে? বাঁকা, শরীফ আর মঞ্জুর একত্র হয়ে অনেক সলাপরামর্শের পর ঠিক করল, চীফ ইঞ্জিনিয়ার মশিউর রহমান সাহেবকে ধরতে হবে। মশিউর রহমান সাহেব কাদের খানকে বললেন ব্রিজের ফাইলগুলো তার অফিসে দিয়ে যেতে। সেখান থেকে রাতের অন্ধকারে ফাইল গেল সামাদের বাসায়। তারপর শরীফ আরবাঁকারদীন-দুনিয়া নেই।৩,৫০০টি ব্রিজ আর কালভার্ট। সে সবের তালিকা বানানো কি চাট্টিখানি কথা? আবার বেশি লোক জানাননি হলে চলবে না। সামাদের বাসায় বসে বসে বাঁকা নিজের হাতে ফাইল থেকে তালিকা কপি করেছেন। শরীফ বিভিন্ন টাইপের ব্রিজের ড্রয়িং করিয়ে প্রত্যেকটির স্পেসিফিকেশান লিখেছে।
শরীফ ও বাঁকার হাতের লেখা যাতে চেনা না যায়, সেজন্য দুজনের হাতে লেখা অংশগুলো অন্য একজনকে দিয়ে আবার কপি করানো হয়েছে।
এখন সব রেডি। এক বোঝা কাগজ গোল করে গুটিয়ে শরীফ আজ বাড়িতে নিয়ে এসেছে। ছেলে দুটি আজ-কালের মধ্যেই বাসায় আসবে ওগুলো নিতে। শরীফ ওদের বলে দিয়েছে ওদের পক্ষে ওগুলো হাতে করে অফিস থেকে বেরোনো রিস্কি। কারণ ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের অফিসের ওপর আই.বির লোকেরা চব্বিশ ঘন্টা নজর রাখে।
৮ জুলাই, বৃহস্পতিবার ১৯৭১
গত রাত থেকে জামী অসুস্থ। জ্বর, কাশি, বুকে ব্যথা, নিঃশ্বাস নিতে শোঁ-শোঁ শব্দ, কষ্ট।
সন্ধ্যের মুখে আমি আর শরীফ বাগানে বসেছিলাম। দুটি ছেলে গেট দিয়ে ঢুকে ধীর পায়ে আমাদের কাছে এসে দাঁড়াল। এদেরকে আগে কখনো দেখি নি, তবু একপলক তাকিয়েই চিনলাম। পরনে সাধারণ প্যান্ট-সার্ট, মাথার লম্বা চুল প্রায় ঘাড় অব্দি, গাল পর্যন্ত নেমে আসা জুলপি, প্রায় চিবুক ছোঁয়া ঝোলানো গোঁফ। দুই নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত চৌধুরী আর হাবিবুল আলম।
ছেলে দুটি একটু হেসে আদাব দিল। শরীফ মৃদুস্বরে বলল, বস। সামনের দুটো খালি বেতের চেয়ারে ওরা বসল। শরীফ বলল, সব রেডি। বাসায় এনে রেখেছি। একটু বুঝিয়ে দিতে হবে।
শরীফ আমার দিকে তাকাতেই আমি উঠে ভেতরে গেলাম। ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম টেবিলটা পরিষ্কারই আছে, পাশের জানালার পর্দাও টেনে ঢাকা আছে। রান্নাঘরে গিয়ে কাসেমকে বললাম, গোটা চারেক শামি কাবাব আর দুটো চাপ এখুনি ভেজে ফেল। ফ্রিজ খুলে রসমালাইয়ের হাঁড়ি থেকে খানিকটা রসমালাই একটা বাটিতে তুলে দিয়ে বললাম, ওগুলো ভাজা হলে এই মিষ্টিসুদ্ধ ট্রেতে সাজিয়ে কোয়ার্টার প্লেট, চামুচ, পানি সব দিয়ে ডাইনিং টেবিলে দিবি পনের মিনিট পর। আমি আর আসতে পারব না। বুঝলি?
বাইরে বেরিয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, কোথাও কোন বাড়ির জানলায় কারো চেহারা দেখা যাচ্ছে না, রাস্তাতেও কেউ নেই। শরীফকে বললাম, ডাইনিং টেবিলে বসো গিয়ে।
ওরা তিনজন ঘরে গেলে আমি বাগানেই বসে রইলাম গেট পাহারা দিতে। বুক দুরু দুরু করছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে ওদের সঙ্গে গিয়ে বসতে, ওদের মুখ থেকে রুমীর কথা শুনতে। কিন্তু গেট ছেড়ে আমার যাবার উপায় নেই। জামীটাও অসুখ বাঁধিয়ে পড়ে থাকার আর সময় পেল না।
সন্ধ্যে হয়ে আসছে। আমাদের উল্টোদিকের দুটো বাড়ির পর রেজা সাহেবের ছেলে সাজ্জাদ এসে দাড়াল গেটে, খালাম্মা, একটা ফোন করব। আমি বললাম, ফোন তো খারাপ। ও চলে যেতেই দ্রুত পায়ে ঘরে গেলাম। এক্ষুণি কোথাও থেকে ফোন এলে মুশকিলে পড়ে যেতাম। দোতলায় উঠে বেডরুমের এক্সটেনশান ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রাখলাম এক ডায়াল করে। তারপর আবার বাগানে গিয়ে বসলাম। আমাদের সিঁড়িটা ডাইনিংরুমের ভেতর পুবের দেয়াল ঘেঁষে। নামার সময় পায়ের গতি শ্লথ করে ডাইনে আড়চোখে ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকালাম। শরীফ টেবিলে ড্রয়িংয়ের কাগজ মেলে তার ওপর আঙুল দিয়ে দেখিয়ে মৃদুস্বরে কিছুবলছে, কানে এলো দুচারটে শব্দ। অ্যাটমেন্ট, পিয়ার, গার্ডার, বিয়ারিং। ছেলে দুটি কাগজের ওপর মাথা ঝুঁকিয়ে একমনে শুনছে।
সন্ধ্যারও অনেক পরে ছেলে দুটি গোল করে গোটানো কাগজ হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরোল। আমার গলার কাছে কি যেন পাকিয়ে উঠল। এই কাগজের রোল হাতে নিয়ে বাইরে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো খুবই বিপজ্জনক। ওদের তাড়াতাড়ি ডেরায় পৌঁছানো দরকার। একটা প্রশ্ন করলেও দেরি হয়ে যাবে। বোবার মতো তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ওরা নীরবে মাথার কাছে হাত তুলে গেট দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল।
৯ জুলাই, শুক্রবার ১৯৭১
আজ সকালেই ড্রয়িং-ডাইনিং রুমের আসবাবপত্র কিছু সরা-নড়া করে ব্যবস্থা বদলে দিলাম। ড্রয়িং ও ডাইনিং রুমের মাঝখানে দুটো রুম ডিভাইডার আলমারি বসানো আছে। ঘরের এ জায়গাটার প্রস্থ হল মোল ফুট। আলমারি দুটো চার ফুট করে আট ফুট চওড়া। আলমারির দুপাশে চার ফুট করে জায়গা খোলা। সদর দরজা দিয়ে ঢুকে বাদিকে ড্রয়িং রুম, ডানদিকে ডাইনিং রুম। কোন লোক দরজা দিয়ে ঢুকে ডানদিকে তাকালেই ডাইনিং টেবিলসহ প্রায় পুরো ঘরটাই একনজরে দেখে ফেলবে। শরীফ, কাসেম, বারেক আর ড্রাইভার আমিরুদ্দি–এই চারজনে মিলে আলমারি দুটো ঠেলে সদর দরজার পাশে দেয়ালে লাগিয়ে দিল। এখন এদিকের দেয়াল থেকে শুরু করে ঘরের আট ফুট পর্যন্ত দুটো আলমারি দাঁড়িয়ে গেল। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই ডানদিকে তাকালে ডাইনিং রুমটা আর দেখা যাবে না। এখন বাকি আট ফুটের ব্যবস্থা করতে হবে। ডাইনিং রুমের দূরতম উত্তর-পশ্চিম কোণে যে চার ফুট চওড়া আলমারিটা ছিল, সেটা ঠেলে এনে ঘরের অপর পাশের দেয়াল ঘেঁষে রাখা হলো। এখন এই আলমারি আর এ পাশের দুটো আলমারির মাঝে ফাঁক রইল চার ফুট। এখানে একটা পর্দা ঝুলিয়ে দেবো। ব্যস, চমৎকার আলাদা দুটো ঘর হয়ে গেল। ড্রয়িংরুমের কেউই আর কোন মতে দেখতে পাবে না ডাইনিংরুমে কে কি করছে। আর একটা ছোট্ট সমস্যা রইল। রুম ডিভাইডার আলমারি দুটোর দুদিকেই পাল্লা দেয়া। বসার ঘরের দিকে বই রাখার জন্য, খাবার ঘরের দিকে গ্লাস, প্লেট ইত্যাদি রাখার জন্য। এ আলমারির পেছন দিক বলে কিছু নেই। কিন্তু অন্য আলমারির পেছন দিকটা একেবারে বার্নিশবিহীন পেছনদিকই বটে। সেটা আবার বসার ঘরের দিক থেকে দেখা যাচ্ছে। এই পেছনে কিছু সঁটা দরকার। মাঝখানের চার ফুট ফাঁকের জন্য পর্দার কাপড় কিনতে গিয়ে দোকানে। খোঁজ করে একটা মোটা কাপড়ের টুকরো কিনে নিয়ে এলাম। ক্রিম রঙের মোটা কাপড়ে খানিক দূরে দূরে নানা রঙের পোশাক পরা নর্তকীর ছাপ দেওয়া। এই কাপড়টা ঐআলমারির পেছনে বোমার্কাটা দিয়ে সেঁটে দিলাম। পর্দার কাপড় কিনলাম.খুব মোটা ঘন নীল রঙের ঘন কুচি ফেলার জন্য ডবল চওড়া কাপড় নিলাম। যাতে, পর্দাটা বাতাসে উড়লেও ঘনকুচির দরুন দুপাশ দিয়ে দেখা না যায়। এসব শেষ করতে সন্ধ্যে পেরিয়ে গেল। সারা দিন অন্য কোনো কাজ করি নি।
সব হয়ে গেলে দুঘরের চারটে পাখা ফুল স্পীডে ছেড়ে দিয়ে বসার ঘরে ঘুরে ফিরে বার বার করে দেখতে লাগলাম কোনভাবে খাবার ঘরের ভেতর দৃষ্টি চলে কি না। না, একেবারেই দৃষ্টি চলে না। এত ঘন কুচিওয়ালা এত ভারি পর্দাও নড়ে না এত ফুল স্পীডের পাখার বাতাসে। খুব সন্তুষ্টি লাভ করলাম সারাদিনের হাড়-ভাঙা খাটুনির পর। এখন যত খুশি প্রতিবেশীরা ফোন করতে আসুক, যখন খুশি আসুক।
১০ জুলাই, শনিবার ১৯৭১
ডাক্তার সহি-সালামতে রাওয়ালপিন্ডি থেকে ফিরেছেন। দুপুরে আমাদের সঙ্গে ভাত খাবার পর বসে বসে ঔর করাচি-পিন্ডির ট্যুরের গল্প শুনলাম। করাচি পৌঁছে হোটেলে উঠেই ওঁরা দুজনে ডাঃ ইব্রাহীমকে ফোন করেন। উনি সঙ্গে সঙ্গে ওঁদের হোটেলে চলে গিয়ে প্রথমেই শুনতে চান ঢাকা এবং সারা পূর্ব বাংলার খবর। ডাঃ ইব্রাহীম ওঁদের দুজনকে বলেন, মিটিংটা আমি ইচ্ছে করেই পিভিতে ডেকেছি যাতে তোমাদের মুখ থেকে আসল খবর সব শুনতে পাই। এ কে খান, নূরুল ইসলামের মুখে ঢাকা ও পূর্ব বাংলার প্রকৃত অবস্থা জেনে ডাঃ ইব্রাহীম খুবই মর্মাহত ও বিচলিত হন। করাচিতে একরাত থেকে পরদিন ডাঃ ইব্রাহিমসহ ওঁরা দুজন মিটিং করতে যান পিন্ডিতে।
চারটের দিকে বললাম, চলুন, সবাই মিলে কাওরান বাজার যাই। চেঁকি-ছাটা লাল বিরুই চাল কিনে আনি।
ডাক্তার বললেন, চাল পরে কেনা যাবে। আগে টিউবওয়েল বসানোর কাজটা সেরে নিই।
ঢাকায় কিছুদিন থেকে গুজব চলছে :মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ক্রমে ক্রমে সবগুলো পাওয়ার স্টেশন অচল করে দেবে। ঢাকা শহরে লাইট, পানি কিছুই থাকবে না। শরীফ কিছুদিন থেকেই ভাবনাচিন্তা করছে বাসায় টিউবওয়েল বসানোর কথা। আমাদের বাথরুমগুলোয় ইয়োরোপিয়ান কমোড়, কিন্তু পানি ফ্লাশ করার সিস্টার্নটা সেকেলে। সাত ফুট উচুতে দেয়ালে বসানো। ছাদের ট্যাঙ্ক থেকে পাইপ দিয়ে পানি আসে। ওগুলো বদলে তিন ফুট উঁচুতে লো-ডাউন বসানোর কথাও ভাবছে শরীফ। তাহলে ট্যাঙ্কে পানি না থাকলেও কোন সমস্যা হবে না। লো-ডাউনের ঢাকনা খুলে বালতি থেকে পানি ভরে ফ্লাশ টানা যাবে।
ডাক্তার রাজশাহী ফিরে যাবার আগেই বাসায় টিউবওয়েল বসানোর কাজ সেরে রাখতে চান। এবার উনি একাই ফিরে যাবেন। সানু খুকু লুনা ঢাকাতেই থাকবে। এনায়েতপুরে চিঠি লিখে দিয়েছেন খোকন ও মঞ্জুকে ঢাকা চলে আসার জন্য।
বিকেলে শরীফ ঢাকা ক্লাবে গেল টেনিস খেলতে, আমি মার বাসায়। সন্ধ্যার আগ দিয়ে বাসায় ফিরে দেখি বারেক–কাসেম দুজনেই বা বিছানা বেঁধে উধাও! কি তাজ্জবের কথা! জামী ওপরে ছিল, টেরও পায় নি। কপাল ভালো, খোলা খিড়কি দরজা দিয়ে কোনো চোর বা ফকির বাসায় ঢোকে নি।
১২ জুলাই, সোমবার ১৯৭১
বারেক-কাসেম পালিয়ে যাবার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল–ভালোই হল। এখন মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে-মাঝেই আসবে। বাসায় কাজের লোক না থাকাই ভালো। পরশুদিন রাতে টেবিল লাগানো, খাবার গরম করা, খাওয়া শেষে টেবিল সাফ, থালাবাসন ধোয়া ইত্যাদি কাজে জামী-শরীফ দুজনই সাহায্য করেছে। গতকাল রোববার ছিল, বাপবেটা দুজনে মিলে বাজার করে এনেছে। রান্নাঘরের কাজেও হাত লাগিয়েছে। তাই ধকল টের পাই নি।
তবে এ বাসার যে একটা ব্যারাম রয়েছে–অত্যধিক মেহমান আসা–আমার মেহমান, শরীফের মেহমান, জামীর মেহমান, বাবার মেহমান, এখন আবার নতুন আরেক ধরনের মেহমান–সকাল-দুপুর, সন্ধ্যা, রাত-তাদের মেহমানদারী করার পরিশ্রমটা গায়ে লাগে না কাজের লোক থাকলে। গতকাল রোববার তবু শরীফ-জামী চা বানানো, ট্রেতে করে এনে দেওয়া ইত্যাদি কাজে হাত লাগিয়েছিল বলে অতটা টের পাইনি। তাই গতকাল সন্ধ্যার মুখে মালু মিয়া হন্তদন্ত অবস্থায় পলাতকদুজনকে ধরে আনলেও আমি বলে দিয়েছিলাম ওদের আর রাখব না। (মালু মিয়া গভঃ ল্যাবরেটরি স্কুলের পিওন, বহু বছর ধরে কাজের ছেলে সাপ্লাই দেওয়া ওর একটা বাড়তি কাজ।)
কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই এলে গিয়েছি। পুরনো ঠিকে ঝি রেণুর মাকে খুঁজে বের করলাম। দুবেলা দুটো কাজের জন্য আবার ওকে রাখলাম। কাজ করে দিয়ে চলে যাবে–এই ভালো। বাসায় কে এলো, কে গেল অত খেয়াল করবেনা। শাহাদত আর আলমের সঙ্গে রুমীর কথা বলতে পারি নি–সেইদুঃখে কদিন খুব কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু এখন সেই কষ্ট আর নেই। রুমী যেখানে গেরিলা ট্রেনিং নিচ্ছে, সেই মেলাঘর থেকে বিভিন্ন দিনে এসে আমার সঙ্গে দেখা করেছে জিয়া, মনু, দুলু, পারভেজ।
পারভেজ বলল, খালাম্মা ওদিকে কি যে এক চোখের অসুখ শুরু হয়েছে
আমি কথা শেষ করতে না দিয়েই চেঁচিয়ে উঠলাম, এখানেও তো। গেল মাস থেকে। আমাদের চেনাজানা অনেকের হয়েছে। খুব কষ্ট। কপাল ভালো আমাদের বাড়িতে এখনো ঢোকে নি। তোমাদের ওদিক থেকেই নাকি এসেছে?
নতুন খবরটা দিতে না পেরে পারভেজ হতাশ হয়ে মুখ বন্ধ করেছিল, এখন বলল, সবাই তো বলে এদিক থেকেই ওদিকে গেছে।
এখানেকি গুজবজান? খানসেনারা এটার নাকিনাম দিয়েছে জয় বাংলা চোখ ওঠা। ওদেরই নাকি বেশি হচ্ছে এগুলো। ওরা বলে বি গেরিলাদের চেয়েও বেশি বিচ্ছ এই চোখ ওঠা।
সত্যি বিন্দু চোখ ওঠা খালাম্মা। এত জ্বালা-যন্ত্রণা হয়, তাকানো যায় না, খালি চুলকায় আর পানি পড়ে লাল হয়ে থাকে।
হ্যাঁ, এখানকার খবরের কাগজগুলোতেও এ নিয়ে বেশ লেখালেখি হয়েছে। ভাইরাল কনজাংটিভাইটিস না কি যেন বলে। সারতে আট-দশদিন লাগে। ওষুধ দিলেও সারতে ঐ একই সময় লাগে। আসলে ওষুধে সারে না, একটা সাময়িক আরাম হয় মাত্র।
তবে হোমিওপ্যাথিক একটা ওষুধ আছে, খালাম্মা, শুরুতেই খেলে আর চোখ ওঠে না।
তাই নাকি? নাম জান ওষুধটার?
হ্যাঁ, বেলেডোনা সিক্স্।
ঠিক আছে পারভেজ। আমি বেলেভোনা-৬ কিনে রাখব। তুমি মেলাঘর ফেরত যাবার আগে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে।
১৫ জুলাই, বৃহস্পতিবার ১৯৭১
আজ এস.এস.সি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। টাট্রু এ বছরের পরীক্ষার্থী। কিন্তু সে পরীক্ষা দিচ্ছে না। বাঙালি ছেলেমেয়েরা যাতে এস.এস.সি পরীক্ষা না দেয়, তার জন্য মাসখানেক ধরে বিভিন্ন জায়গায় কোথা থেকে কারা যেন গোপন ইস্তাহার বিলি করে যাচ্ছে তাই নিয়ে মহল্লায় মহল্লায়, বাড়িতে বাড়িতে উত্তেজনা, আলাপ-আলোচনা, ভয়-ভীতি। পরীক্ষার্থী ছেলেমেয়েদের বাবা-মার মাথা খারাপ হবার যোগাড়। এমন কথাও শোনা যাচ্ছে–ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা দিতে গেলে কেন্দ্রে নাকি বোমা মারা হবে।
অন্যদিকে, সরকারের তরফ থেকে পরীক্ষা দেওয়ার সপক্ষে প্রচুর ঢাকটোশ পেটানো হচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে মাইকযোগে বলে বেড়ানো হচ্ছে : ছাত্রছাত্রীরা যেন দেশদ্রোহীদের দুরভিসন্ধিমূলক ও মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হয়, তারা যেন একটি মূল্যবান শিক্ষা বছর নষ্ট না করে। (পাকসেনারা যে গুলি মেরে কত মূল্যবান জীবন নষ্ট ও নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে সে কথা তাদের মনে নেই।) পূর্ব পাকিস্তান কাইয়ুমপন্থী মুসলিম লীগের সভাপতি হাশিমুদ্দীন, পাকিস্তান শান্তি ও কল্যাণ কমিটির সভাপতি ফরিদ আহমদ, জেনারেল সেক্রেটারিমওলানা নূরুজ্জামান এবং তাদের মতো আরো বহু দেশদরদী, জনদরদী নেতা কদিন ধরে পরীক্ষা দেওয়ার সপক্ষে বিবৃতি দিয়ে দিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন। পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তাদেরকে সহায়তা করার জন্য বহুসংখ্যক রাজাকারকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মোড়ে মোড়ে পুলিশ। রাস্তায় রাস্তায় টহল পুলিশের গাড়ি। রাজাকারগুলো এই সুযোগে বেশ প্রাধান্য পেয়ে গেল।
আজ ধলু ও চিশতী সপরিবারে ঢাকা আসছে ইসলামাবাদ থেকে এক মাসের ছুটিতে। শরীফ গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্টে গেল পৌঁনে চারটেয়। জামীকে বাবার কাছে রেখে আমি পাঁচটার সময় মার বাসায় ওগলাম। ধলুরা এলো সোয়া পাঁচটায়। কতোদিন পরে দেখা। দুবোনে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলাম। মালালুওকাদলেন। কিন্তু আমার কান্না যেন কিছুতেই থামাতে পারছিলাম না। কেন? ওর মধ্যে কি রুমীর জন্যও কান্না মেশানো ছিল?
১৭ জুলাই, শনিবার ১৯৭১
গতকাল সন্ধ্যারও পরে ডাক্তারের ছেলে খোকন আর খোকনের ছোট খালা মঞ্জু এনায়েতপুর থেকে ঢাকা এসে পৌঁছেছে। ডাক্তার পরশুদিনই সকালে রাজশাহী রওনা হয়ে গেছেন। অল্পের জন্য ডাক্তারের সঙ্গে ওদের দেখা হল না।
আজ সকালে রান্নাঘরে তরকারি কুটতে কুটতে মঞ্জুর কাছে শুনছিলাম ওর ঢাকা আসার পথের আতঙ্কিত, লোমহর্ষক অভিজ্ঞতার কাহিনী।
মঞ্জুররা এনায়েতপুর থেকে যমুনা নদীর ঘাটে লঞ্চে ওঠে। লঞ্চ সিরাজগঞ্জ ঘাট ছুঁয়ে টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর ঘাটে এসে থামে। এখানে মঞ্জুর এক দুলাভাই শাজাহান ঢাকা থেকে গাড়ি নিয়ে গিয়ে অপেক্ষা করছিল। সেখান থেকে গাড়িতে ঢাকা।
লঞ্চে থাকার সময় নদীর বুকে এমন একটা ঘটনা ঘটে, যেটার কথা মনে করে মঞ্জু এখনো মাঝে-মাঝে শিউরে উঠছে।
বুঝলেন আপা, সিরাজগঞ্জ ঘাট ছাড়ার পর হঠাৎ একটা আর্মি ভর্তি স্টিমার। আমাদের লঞ্চের পাশ দিয়ে আসতে আসতে চিৎকার করে লঞ্চ থামাতে বলল। আমরা তো ভয়ে কুঁকড়ে এতটুকু। আর বুঝি কারো রক্ষা নেই। কিন্তু ওরা শুধু একজন। লোককেই খুঁজছিল। সে হলো সিরাজগঞ্জ কওমী জুট মিলের এক ইঞ্জিনিয়ার। তাকেই ধরে নিয়ে গেল। অন্য যাত্রীদের কাউকে কিছু বলল না।
তুমি চিনতে ঐ ইঞ্জিনিয়ারকে?
না আপা, আমি কি করে চিনব? উনাকে ধরে নিয়ে যাবার পর লঞ্চের অন্য লোকেরা বলাবলি করছিল–তাই থেকে জানলাম। আমার সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল আর্মিগুলো যেভাবে ঐ দ্রলোককে নিয়ে ঠাট্টা-মস্করা করছিল, তা শুনে। ওরা বলছিল, তোমার মতো এরকম মশহুর আদমির এত ছোট লঞ্চে যাওয়া কি মানায়? এই খে, তোমার জন্য আমরা কতো বড়ো স্টিমার নিয়ে এসেছি।
আমার বুক ফেটে একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। ঐ ইঞ্জিনিয়ারটি নিশ্চয় গোপনে মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল। ওর কপাল মন্দ, ব্যাপারটা কোনভাবে পাক আর্মির কাছে ফাঁস হয়ে গেছে। ফাঁস করে দেবার মতো দালাল, রাজাকারদের তো অভাব নেই দেশে। নাকি, দেশের কাজ করতে গেলে এভাবে জীবন দিতেই হবে? কপাল মন্দ বলছি কেন? এতো ঐ লোকটির জন্য গৌরবের কথা।
গৌরবের কথা?
হঠাৎমনে হলো দম আটকে আসছে। লোহার সাঁড়াশি দিয়ে কেউ যেন পাঁজর চেপে ধরেছে।
আর তরকারি কুটতে পারলাম না। বসার ঘরে এসে ডিভানে শুয়ে পড়লাম, মঞ্জুর ভয় পেয়ে জামীকে ডাকাডাকি করতে লাগল। আমি বললাম, ও কিছু না। শরীরটা। কিছুদিন থেকে ভালো যাচ্ছে না। খাটনি বেশি হয়ে গেছে। রান্নার লোক নেই তো, তাই। একটু পরে ঠিক হয়ে যাব।
১৮ জুলাই, রবিবার ১৯৭১
শরীফের দাঁতে ভীষণ ব্যথা হয়েছে। সন্ধ্যাবেলা ওর জন্য পিপাস্ রান্না করছিলাম। উস্কখুষ্ক চুল নিয়ে ফকির এসে হাজির, ভাবি, ময়মুরব্বিদের দোয়া ছিল, তাই অল্পের জন্য বেঁচে গেছি।
কি ব্যাপার? কোথায় কি হলো?
জীবনে এই প্রথম চোখের সামনে গেরিলা অপারেশান দেখলাম।
বলেন কি? দাঁড়ান, দাঁড়ান, এক্ষুণি শুরু করবেন না। চুলো থেকে হাঁড়িটা নামিয়ে আসি।
বিকেলবেলা জিন্না এভিনিউতে গিয়েছিলাম একটা কাজে। গ্যানিজের দোকানটা আছে না? ওইখানে কয়েকজন বিচ্ছ গুলি আর গ্রেনেড ছুড়ে কয়েকটা পুলিশ মেরে দিয়ে চলে গেল। উঃ, কি সাহস ছেলেগুলোর। একেবারে প্রকাশ্য দিবালোকে, বুঝলেন?
উত্তেজনায়, আনন্দে ফকিরের চোখ চকচক করছে। সারামুখ লাল টকটকে। শরীফ দাঁতের ব্যথা ভুলে সোজা হয়ে বসে জিগ্যেস করল, আঃ আরেকটু খুলে বল না। কয়টা ছেলে ছিল? কিসে করে এসেছিল?
অত কি গুনেছি? দুটো তো দেখলাম হাতে স্টেনগান বা মেশিনগান ঐরকম কিছু একটা হবে। দোকানের ভেতরে ঢুকে গেল আর ব্রাশ ফায়ারের শব্দ শুনলাম। একটা গ্রেনেড়ও ফাটিয়েছে। গাড়ি একটা ছিল বটে, কিন্তু ঠিক গ্যানিজের সামনে তো দেখি নি। সামনে মনে হয় একটা মোটরবাইক ছিল, একটা ছেলেও যেন বসে ছিল বাইকটাতে।
আমি বলে উঠলাম, একটা কথা যদি ঠিক করে বলতে পারেন! খালি মনে হয় আর যেন!
জামী বলল, মা তুমি কিন্তু চাচার ওপর অবিচার করছ! তখন মেশিনগান থেকে লাশ ফায়ার হচ্ছে, পুলিশ মরছে। রাস্তার লোকজন ছুটে পালাচ্ছিল নিশ্চয়। তাই না চাচা? আপনি তখন কি করলেন? ছুটে পালাননি কোথাও? ফকির সোফায় হেলান দিয়ে বললেন, পালিয়েছিলাম তো বটেই। ওরকম অবস্থায় কেউ দাড়িয়ে থাকে গোরস্থানে যাবার জন্য? গ্যানিজের দুটো দোকান পরে সিঁড়িঘর ছিল একটা সেইখানে ঢুকে সিঁড়ির নিচে লুকোই। আমার সঙ্গে আরো অনেকে।
শরীফ আবার জিগ্যেস করল, কজন লোক মরেছে, জানতে পেয়েছ?
না, ছেলেগুলো চলে যাবার পর তাড়াতাড়ি ওখান থেকে পালিয়ে আসি। তক্ষুণি তো মিলিটারিতে ভরে যাবে জায়গাটা। তবে আসার সময় দেখলাম গ্যানিজের দরজার সামনে কয়েকটা মিলিশিয়া পড়ে আছে।
এখন মুখরোচক বিষয়, আলাপ-আলোচনা করতে করতে কোথা দিয়ে দুই ঘণ্টা উড়ে গেল। গেরিলারা আজকাল বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতেও প্রায় প্রায়ই বোমা ফাটিয়ে যাচ্ছে এত কড়া পাহারা সত্ত্বেও। কি করে করে ওরা? জানের ডর বলে কিছু নেই বোধ হয়। জীবন মৃত্যু পায়ের ভূত?
রাত প্রায় দশটা। ফকিরসহ আমরা সবাই মিলে শরীফের জন্য রান্নাকরা পিপাস্ খেলাম খুব তৃপ্তি করে।
১৯ জুলাই, সোমবার ১৯৭১
মালু মিয়া আজ আবার বারেককে নিয়ে এসেছে। এ কদিনে কাজের ঠেলায় আমারও মন নরম হয়ে এসেছে। মালু মিয়ার কাকুতি-মিনতি এবং বারেকের মাফ চাওয়ার পর ওকে আবার ফিরিয়ে নিলাম। কাসেমের অন্য বাসায় চাকরি হয়ে গেছে, বারেকের হয় নি। জামী বলল, ভালোই হল। এই দুর্দিনে গ্রামে গিয়ে না খেয়ে মরত।আমি হেসে বললাম, হ্যাঁ বারেক না এলে তুমিও মরতে দাদার ডিউটি করতে করতে।
পারভেজ এসেছে সন্ধ্যার পর। ও আগামীকাল রওনা দেবে। আমি আগেই বেলেডোনা–৬ কিনে রেখেছি অনেক কয়টা শিশি, আরো কিনেছি কয়েকটা নেইল কাটার, গোটা তিনেক সানগ্লাস। একটা সান গ্লাস, একটা নেইল কাটার রুমীর জন্য। বাকিগুলো তোমরা ব্যবহার করো। বেলেডোনা যখন যার লাগবে। পারভেজকে দুশো টাকা দিলাম, একশো তুমি নিয়ে, একশো রুমীকে দিয়ো।
এসব কথা বলতে বলতে হঠাৎ গুলিগোলার শব্দে চমকে উঠলাম। পারভেজ বলে উঠল, কাছাকাছি কোথাও মনে হচ্ছে? বলতে না বলতেই বাতি চলে গেল। আমি হেসে বললাম, ওই বুঝি শুরু হলো। মোমবাতি জ্বালতে জ্বালতে চিন্তা করতে লাগলাম, গুলির শব্দটা ঠিক কোন জায়গা থেকে এলো? উত্তর-পূর্বদিক থেকেই তো মনে হচ্ছে। ওদিকে কোথায়? শরীফ বলল, কেন পি.জি. হাসপাতালে যাবার রাস্তাটায় পুকুরটায় এপাশে যে পাওয়ার সাবস্টেশনটা আছে, ওখানে হতে পারে।
জামী লাফ দিয়ে উঠল, হা, হা রেললাইন পার হয়েই ঐ যে মেইন রোডের বাঁ হাতে উঁচু দেয়াল আর কাটা তার দিয়ে ঘেরা সাব-স্টেশনটা–কথার মাঝখানেই জামী হঠাৎ ইয়া হু- বলে এক চিল্কার এবং আরেক লাফ–ঐটাকে ধানমন্ডি সাব-স্টেশন বলে না? মার দিয়া কেল্লা! জয় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা।
আমি সন্ত্রস্ত হয়ে ধমকে উঠলাম, থাম্ থাম। অত চেঁচাস্ নে। কে কোথায় শুনে। ফেলবে।
পারভেজ উসখুস করে বলল, আমাকে এবার যেতে হয়।
আরেকটু পরে যাও। রাস্তায় অন্ধকারে কোথায় বিপদ ওঁৎ পেতে আছে কে জানে?
না, অন্ধকারেই বরং সুবিধে। গুলির শব্দ তো শাহবাগের দিক থেকে এসেছে, আমি নিউ মার্কেটের দিক দিয়ে চলে যাই। কিছু হবেনা খালাম্মা। এর চেয়ে ঢের বেশি ঝুঁকি নিয়ে আমরা চলফেরা করি।
ঘন্টাখানেক পরে হঠাৎ বাতি জ্বলে উঠল। মনটা দমে গেল, এত তাড়াতাড়ি সব ঠিক করে ফেলল? তবে ভোল্টেজ খুবই কম, এত কম যে মোমবাতির মতো আলো।
রাতে ভাত খেতে খেতে আবার কারেন্ট চলে গেল। আমরা মোমবাতি জ্বেলে বাকি কাজ সেরে শোবার ঘরে গিয়ে রেডিও নিয়ে বসলাম। একটু পরেই ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা অনুষ্ঠান শুরু হবে। আজকাল রেডিওতে ব্যাটারিই ব্যবহার করি সব সময়। কারণ কখন কোন জায়গায় বসে রেডিও শুনব, তার ঠিক নেই। বাড়ির সর্বত্র ইলেকট্রিক তার বয়ে বেড়ানো সম্ভব না। আর এখন তো কারেন্টই নেই।
আজ ভয়েস অব আমেরিকার খবর শুনে অবাক হয়ে গেলাম। ঢাকার রাস্তায় পাকসেনা ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে গান-ফাইট। বলে কি? একেবারে মুখোমুখি সংঘর্ষ গুলি বিনিময় কই, আমরা তো ওরকম কিছু টের পেলাম না? গুলি গোলার শব্দ শুনেছি বটে তবে দুদলে একেবারে গান-ফাইট হবার মতো অত সাংঘাতিক বলে মনে হয়েছে কি?
জামী বলল, কি জানি হয়তো এখানে সামান্য হয়েছে, ঢাকার অন্য এলাকায় বেশি হয়েছে। আমরা বাড়ি বসে সেটা টের পাচ্ছি না।
শরীফ বলল, আপাতত চারদিক বেশ সুমসামই মনে হচ্ছে। এটুকু ঠিক যে এখন অন্তত কোন গান-ফাইট হচ্ছে না। এখন শোয়া যাক। কাল খবর নেব কোথায় কি হলো।
আমি বললাম, ভোয়া বি. বি. সি.র বরাত দিয়ে বলল। বি.বি.সি.তে আগেই বলেছে নাকি? আজ আমাদের বি.বি.সি. শোনা হয় নি। কিন্তু বি.বি.সি. বাংলা অনুষ্ঠান তো পৌঁনে আটটা থেকে সোয়া আটটা। ঘটনাটা তো ঐরকম সময়েই ঘটেছে। তাহলে?।
শরীফ বলল, কেন বি.বি.সি. ইংরেজি খবরেও তো দিতে পারে। বি.বি.সি ঘন্টায় ঘন্টায় ইংরেজি খবর বলে না? দেখি কাল খোঁজ নেব. আর কেউ শুনেছে কি না।
রাতে ভালো ঘুম হলো না। উত্তেজনায় সারা শরীর মন চনমন করছে। গুজব সত্যি হতে চলেছ নাকি? রাজধানী ঢাকা শহরে ইলেকট্রিসিটি থাকবে না। কিন্তু কাল দিনের আগে জানবার কোনো উপায় নেই।
২০ জুলাই, মঙ্গলবার ১৯৭১
আজ সকাল থেকে পানি নেই। গত রাতে কারেন্ট না থাকার দরুন মিউনিসিপ্যালিটির পাম্প চালানো সম্ভব হয় নি–সেটা বোঝাই যাচ্ছে। বারেককে একটা ছোট বালতি হাতে ডাক্তারের বাসায় টিউবওয়েল থেকে পানি আনতে পাঠালাম। নিচের বাথরুমে দুটো বড় বালতি, রান্নাঘরে কয়েকটা ডেকচি ভর্তি করে নিলাম। ট্যাপে পানি না আসা পর্যন্ত কোনোমতে রাধাবাড়া আর হাত-মুখ ধোয়ার কাজ চালিয়ে নিতে হবে।
শরীফ অফিসে গিয়েই ফোন করেছে, শোননা, জামীকে পি.জির দিকে রাস্তায় যেতে বারণ করো। ধানমন্ডি পাওয়ার সাবস্টেশনের সামনে আর চারপাশে মেলাই মিলিটারি। পুরো জায়গাটা কর্ডন করে রেখেছে। রেললাইনের কাছ থেকে সব ট্রাফিক ঘুরিয়ে দিচ্ছে। আমি তো গাড়ি ঘুরিয়ে আবার আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে গিয়ে বলাকা-নীলক্ষেত হয়ে অফিসে এসেছি।
আর কোন খবর।
এখনো জানি না। জানলেই ফোন করব।
ধলু আর চিশতী এসেছে সাড়ে নটার দিকে। রাজশাহীতে ট্রাঙ্কল করবে। লাইন পেতে পেতে এগারোটা বাজল। অনেকক্ষণ গল্প করা গেল ওদের সঙ্গে।
পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ লোকেরা নাকি জানেনা যে পূর্ব পাকিস্তানে মিলিটারিরা এত খুন-খারাবি করেছে। সরকারি প্রচার মাধ্যমের চমৎকার ব্যবস্থাপনার ফলে তারা জানে যে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয়রা হামলা করছে, দেশের ভেতরের কিছু গাদ্দার বাঙালি তাদেরকে সাহায্য করছে, সেই জন্য পাকিস্তান আর্মি ভারতীয় দমন আর হিন্দু মারার কাজে ব্যস্ত রয়েছে।
বুবু, জানেন তো পশ্চিম পাকিস্তানিরা কি ভয়নক রকম অ্যান্টি-ইন্ডিয়ান। এটা আরো বেড়েছে ৬৫ সালের ইন্ডিয়া-পাকিস্তান যুদ্ধের পর থেকে। ইয়াহিয়া সরকার এই সেন্টিমেন্টটার সুযোগ নিয়ে এমন নির্লজ্জের মতো মিথ্যে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে যে কি বলব! তাছাড়া ওদিককার জনসাধারণও এমন কট্টর পাকিস্তানপ্রেমিক যে, সরকার যা বোঝাচ্ছে, নির্বিচারে তাই বুঝে নিশ্চিন্তে দিন-গুজরান করছে।
ও দিকের লোকেরা কি বি.বি.সি, ভয়েস অব আমেরিকা, রেডিও অস্ট্রেলিয়া এসব শশানে না?
শোনে, কিন্তু বিশ্বাস করে না। ওরা সরকারের ছেলে ভুলানো ছড়া শুনেই সন্তুষ্ট।
শরীফ আবার ফোন করল এগারোটার দিকে, কাল রাতে উলান আর গুলবাগ পাওয়ার স্টেশনে শর্ট সার্কিট হয়েছে।
আর শাহবাগে?
না, ওখানে ঠিকমত হয় নি।
উলান কোথায়? গুলবাগ?
উলান রামপুরার দিকে। গুলবাগ-খিলগাঁওয়ে। আরেকটা খবর : পরশু বিকেলে শুধু গ্যানিজে নয়। ভোগ-এও।
তাই নাকি? বাঃ বেশ তো। একই দল নাকি?
ঠিক জানি না। কেউ বলতে পারল না।
শোনো, বাসায় ফেরার পথে আজই লো-ডাউন কিনে নিয়ে এসো। কমোড ব্যবহার করা যাচ্ছে না তো। বালতি দিয়ে পানি ঢাললে ঠিকমত ফ্রাশ হয় না।
আনব। তুমি আহাদ মিস্ত্রিকে বিকেলে আসতে বলে দাও।
চিশতীকে বললাম, তোমরা বাড়ি ফেরার পথে দুটো হারিকেন আর কিছু মোমবাতি কিনে নিয়ে যাও।
লুলু এল একটার দিকে। বলল, কি কাণ্ড জানেন মামী? ধানমন্ডি পনের নম্বর রোডে কাল রাতে কারা যেন একটা মোটরগাড়ি বোমা দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। আজ ভোর ওখানে লোকে লোকারণ্য। কিন্তু মজা কি জানেন? যেই সূর্য উঠলো, অমনি লোকজন সব ফরসা!
কেন?
সূর্য ওঠার পরে মিলিটারি আসবে। মিলিটারিরা তো বিচ্ছুদের ভয়ে নিজেই নিজেদের কারফিউ দিয়ে রাখে সারারাত!
তুই না আজিমপুর রোডে থাকিস। তুই ধানমন্ডি পনের নম্বর রোডের খবর জানলি কি করে?
বারে, আমি রোজ ভোরে মর্নিং ওয়াক করতে বেরোই না?
লুলু, তুই কি উলান গুলবাগের কথা শুনেছিস আজ কারো মুখে? আর আমাদের পাড়ার ঘটনা?
লুলু, অবাক হয়ে বলল, না তো। কেন কি হয়েছে?
লুলুকে সংক্ষেপে বললাম, গতকাল রাতের ঘটনা আর সকালে শরীফের ফোনের কথা। তোর মামা এলে সব বিস্তারিত শোনা যাবে। বস্। খেয়ে যাবি।
আড়াইটে বেজে গেছে। শরীফ এখনো আসছে না। ছটফট করছি। ও এলে তবেই শোনা যাবে উলান-গুলবাগের ঘটনার পুরো বিবরণ। ফোনে খোলাখুলি কথা বলা বিপজ্জনক। তাই শর্ট সার্কিট শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে।
শরীফ এসে বলল, গেরিলারা ঐ দুটো পাওয়ার স্টেশনের ট্রান্সফরমার উড়িয়ে দিয়ে ঠিকমতো ভেগে গেছে। খানসেনারা একটাকেও ধরতে পারে নি। তবে বিস্ফোরণের পর থেকে ঐদুই এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব শুরু হয়েছে। ধরপাকড়, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি, রামপুরা আর খিলগাঁও এলাকা নাকি খানসেনা দিয়ে গিজগিজ করছে। ওদিকের রাস্তা দিয়ে হাঁটাও নাকি বিপজ্জনক।
আমার ভয় হলো, ধানমিন্ড সাব-স্টেশনের দরুন মিলিটারি হামলা আমাদের বাড়ি পর্যন্ত গড়াবে না তো আবার? শরীফ বলল, মনে হয় না। আমাদের বাড়ি ও জায়গা থেকে বেশ দূরে–গলির ভেতরে। ওরা সাব-স্টেশনের চারপাশটা ঘিরে তল্লাশি করছে। ওখানে বিচ্ছুরা ভেতরে যন্ত্রপাতি বিশেষ নষ্ট করতে না পারলেও পুলিশ বেশ কয়টা মেরে দিয়ে গেছে।
শরীফ তিনটে লো-ডাউন কিনে এনেছে। আহাদ মিস্ত্রি কাজে লেগে গেছে। অন্তত একটা লো-ডাউন আজকের মধ্যে লাগাতেই হবে। প্রথমে দোতলায় বাবার বাথরুমটায় কাজ শুরু হয়েছে। আহাদ এ পাড়ারই লোক, দরকার হলে ও রাত দশটা পর্যন্ত কাজ করতে পারবে।
ডাক্তারের টিউবওয়েলটা খুব মোক্ষম সময়ে বসানো হয়েছিল। আজ বড়ো কাজে লাগলো। আমি তো সকালেই পানি আনিয়ে সেরেছি। বিকেলে দেখি, সব বাড়ি থেকে কলসি, বালতি, জগ সারে সারে চলছে ডাক্তারের বাড়ির দিকে।
দিনের বেলা ডোমেস্টিক অর্থাৎ লাইট ফ্যানের লাইনে দুএকবার কারেন্ট এসেছিল অল্পক্ষণের জন্য। পাওয়ার লাইন একেবারেই ছিল না। সন্ধ্যার পর সব লাইন চলে গেল। সারা ঢাকা শহর নিকষ কালো।
বিকেলেই তাড়াহুড়ো করে চারটে হারিকেন কিনে আনা হয়েছে। দোকানে শরীফ আর জামী গিয়েছিল। এসে বলল, হারিকেন আর মোমবাতি কেনার জন্য দোকানে যা ভিড়! সবাই কিনছে। দোকানীরা এই সুযোগে দামও বাড়িয়ে দিয়েছে।
২২ জুলাই, বৃহস্পতিবার ১৯৭১
দুপুরে খেয়ে একটু শুয়েছিলাম। কলিং বেলের শব্দে উঠে দরজা খুলে দেখি, মনু।
উঃ খালাম্মা, গোটা শহর পানির তলায় ডুবে গেছে। এমন বৃষ্টি দেখি নি।
আমাদের ঘরের ভেতরেও তো পানি ঢুকেছিল। মেঝের ওপর এক ফুট। রাস্তায় ছিল কোমর সমান। এই তো ঘন্টা দুয়েক আগে রাস্তার পানি নেমেছে।
মনু ঘরের চারদিকে এলোমেলো জিনিসপত্রের দিকে তাকাল, তাই? ভালোই হয়েছে খালাম্মা। এই রকম বৃষ্টিতে খানসেনারা খুব বেকায়দায় পড়ে গেছে। একেতো ওরা এই রকম বড় বড় নদী, বিল, হাওড়, দেখেই নি, তার ওপর এই রকম একনাগাড়ে তোড়ে বৃষ্টি। ঢাকা শহরে রাস্তায় এক-কোমর পানি। ওদের দেশে তো ড্রেনের মতো খালে একহাঁটু পানি জমলে ওরা ডুবে মরে!
সবাই মিলে খুব হাসলাম। তারপর আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, এখন থেকে একটু বেশি সাবধানে থেক মনু। গভর্নমেন্ট তো রাজাকারদের অনেক ক্ষমতা দিয়ে দিল। সামরিক আইন আদেশ-১৫৯ জারি করে ওদেরকে ইচ্ছেমতো গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওদেরকে পাইকারি হারে অস্ত্র দেওয়া হচ্ছে। সন্দেহ হলেই যে-কোনো লোককে ওরা গ্রেপ্তার করতে পারবে। গুলি করতে পারবে।
শরীফ একটু হেসে বলল, এসব ক্ষমতা রাজাকারদের প্রথম থেকেই দেওয়া ছিল। এখন একটা সামরিক আইন আদেশের ঘোষণা দিয়ে হালাল করে নিল বলতে পার।
মনু বলল, পাকিস্তান সরকার এখন বেশ ঘাবড়ে গেছে। ঢাকা শহরে রোজই দিনে রাতে বিচ্ছুরা একটা-না-একটা কিছু করেই যাচ্ছে। তাছাড়া সারাদেশের বর্ডার জুড়ে যুদ্ধও তো বেশ জোরেশোরে চলছে। কিছু কিছু বর্ডার এলাকা মুক্তও হয়ে গেছে। কাজেই সরকার এখন শুধু রাজাকার কেন, আরো যদি কিছু বাহিনী বানাতে পারে, তাও বানাবে।
কেন, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রচুর পরিমাণে মিলিশিয়া আনছে না? ঐ যে কালচে ছাই রঙের সালোয়ার কামিজ পরা সৈন্যগুলো?
হ্যাঁ, ওগুলোয় তো সারাদেশ ছেয়ে গেছে।
মনু আসাতে একটু ভালো লাগল। কিছুদিন থেকে মনটা কোনমতেই বাগে থাকছে। সবসময় মন খারাপ, একটু কিছু হলেই লুকিয়ে বা প্রকাশ্যে কান্না, যখন-তখন পাঁজরে ব্যথা। কিছুদিন থেকে আরেকটা কথা সবসময় মনে জাগছে : অন্য ছেলেরা প্রায় প্রায়ই ঢাকা আসছে কত রকমের ডিউটি নিয়ে। রুমী কি একবার আসতে পারে না?
মনু বলল, আসবে, খালাম্মা আসবে। ওর ট্রেনিং হয়ত এখনো শেষ হয় নি। ওভো অনেক দেরিতে গেছে।
তা বটে। রুমীর যাওয়াতে আমিই তো বাদ সেধেছি প্রথমে দিকে।
মনু আগামীকাল ফিরে যাবে। ওর হাতে দুশো টাকা দিলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের এখন টাকার খুব দরকার। যখন যার হাতে পারছি পাঠাচ্ছি। পারভেজ নিয়ে গেছে। টাট্রুর সঙ্গে। দুবারে দুশো পাঠিয়েছি। টাট্রুর মাধ্যমে পরিচয় হয়েছে রাজু বলে এক। মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে। তার হাতেও কয়েকবার দুশো পাচশো করে টাকা পাঠিয়েছি। আমাদের নিজেদের টাকা বেশি নেই। কিন্তু আল্লাই টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। শরীফের অনেক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু, পাকিস্তান কনসালট্যান্টস-এর ডিরেক্টর মজিদ সাহেব শরীফকে বলেছেন:তাঁর দুটি মাত্র মেয়ে, বিয়ে-শাদিহয়ে তারা বিদেশে আছে। তাদের জন্য তিনি যথেষ্ট দিয়ে দিয়েছেন। এখন কিছু টাকা তিনি দেশের জন্য খরচ করতে চান। মজিদ সাহেব স্থির করেছেন, দশ হাজার টাকা তিনি মুক্তিযুদ্ধের জন্য খরচ করবেন। কিন্তু তার কোন সোর্স নেই পাঠাবার। তাই শরীফকেই অনুরোধ করেছেন। তিনি সেভিংস সার্টিফিকেট ভাঙ্গিয়ে দুবারে পাঁচ হাজার করে দশ হাজার টাকা শরীফের হাতে তুলে দিয়েছেন। শরীফ এ টাকা ক্রমান্বয়ে কিছু কিছু করে বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধার হাত দিয়ে পাঠাবার ব্যবস্থা নিয়েছে। ছেলেরাও এক সঙ্গে বেশি টাকা সঙ্গে নেবার ঝুঁকি নিতে চায় না। তার চেয়ে যখনই আসবে, অল্প অল্প করে নিয়ে যাবে।
মজিদ সাহেব শরীফকে একটি শর্ত দিয়েছেন তাঁর এ টাকা দেওয়ার কথা কাউকে ঘুণাক্ষরেও বলা চলবে না। শুধু তিনি আর শরীফ জানবেন। শরীফ রাজি হয়েছে। শরীফ অবশ্য আমাকে বলেছে। তবে নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে বলাটা বোধ হয় শর্তভঙ্গের মধ্যে পড়ে না।
তিনটে বাথরুমে লো-ডাউন লাগানোর কাজ শেষ হয়েছে। আহাদ মিস্ত্রি আজ থেকে ভেতরের উঠানে টিউবওয়েল বসাচ্ছে।
২৪ জুলাই, শনিবার ১৯৭১
আজ আহাদ মিস্ত্রি টিউবওয়েল বসানো শেষ করল, আর আজই দুপুর থেকে ডাইরেক্ট ট্যাপটাতে চিরচির করে একটু একটু পানি আসা শুরু হলো। বিকেলের মধ্যে পাওয়ার লাইন ঠিক হয়ে গেল।
লাইট পানি আসাতে খুব আরাম লাগছে বটে কিন্তু মনে মনে কোথায় যেন একটা আশাভঙ্গের খচখচানি। ঢাকার মতো জায়গায় কারেন্ট থাকবে না, বিজলিবাতি জ্বলবে না, ট্যাপের পানি পাওয়া যাবে না, হারিকেন জ্বালিয়ে রাতে কাজ চালাতে হবে, টিউবওয়েল টিপে পানি নিতে হবে–এই রকম একটা পরিস্থিতির সম্ভাবনায় মনটা কি ২৫/৩০ বছর আগের শৈশবকালে ফিরে যাবার জন্য উন্মুখ হয়েছিল?
কদিনের এলোপাতাড়ি খাটুনিতে শরীরটা বড়ো কাহিল হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে-মাঝে শুয়ে বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করে। ড্রয়িংরুমের। ডিভানটায় শোয়া যায় বটে কিন্তু মেহমান থাকলে তা আর সম্ভব হয় না। তাই আজ। ডাইনিং টেবিল আর সিড়ির মাঝামাঝি জায়গায় উত্তরের দেয়াল ঘেঁষে একটা ছোট চৌকি পেতে ফেললাম। তোষক বিছিয়ে সুন্দর একটি ফুলতোলা বেড় কভার দিয়ে ঢেকে দিলাম। এইবার ঠিক হয়েছে। বাইরের ঘরে মেহমান থাকলেও আমি রান্না করার ফাঁকে ফাঁকে এখানে শুয়ে বিশ্রাম করতে পারব। এটার পায়ের দিকে সিঁড়ির পাশে পুব ঘেষে দুটো সোফাও রাখলাম। মনু, দুলু, পারভেজ, রাজু, টাট্রু, এরা আজকাল প্রায় প্রায় আসে। আজকাল এ পাশেই বসাই যাতে বাইরের ঘরে হঠাৎ কেউ এসে ওদের
দেখে। কিছুদিন আগে একদিন পারভেজ জিগ্যেস করছিল : খালাম্মা, দুটো বাড়ির পরের বাড়িটার একটা ছেলে দেখি যখনি যাই বা আসি, আমাকে নানা কথা জিগ্যেস করে। আমি রুমীর কে হই, রুমী কোথায় গেছে–এই সব কথা।
ঐ শোনার পর থেকে পারভেজ, মনু, জিয়া, রাজু সবাইকে বলে দিয়েছি–কেউ জিগ্যেস করলে যেন বলে ওরা রুমীর চাচাত ভাই।
মাসুম সেই মার্চে দেশে গিয়েছিল। আজ সন্ধ্যার পর হঠাৎ দেখি সে এসে হাজির বাড়ি থেকে। ওকে দেখে খুব খুশি হয়ে উঠলাম। বাড়িটা বড়ো খালি হয়ে গিয়েছিল।
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর আমার বিশ্রামের চৌকিটাতে আরাম করে শুয়ে বললাম, এবার বল দেশের খবর। ২৫ মার্চের পর খাটুরিয়া, ডোমার–ওদিকে কি হয়েছিল?
খাটুরিয়া আমার শ্বশুরবাড়ির গ্রাম, ডোমার থানা।
মাসুম বলল, ২৫/২৬ মার্চ চিলাহাটি থেকে এক দল ই.পি.আর, খাটুরিয়ার ওপর দিয়ে সৈয়দপুরের দিকে মার্চ করে যায়।
কেন?
সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করবে বলে। খাটুরিয়ায় কয়েকটা বাঙ্কারও তৈরি করেছিল ওরা।
বাঙ্কার কেন?
ওদের কাছে যা শুনেছিলাম–চিলাহাটি থেকে শুরু করে মাঝে-মাঝেই ওরা বাঙ্কার বানাতে বানাতে আসছিল। যদি পরে সে রকম যুদ্ধ করতে হয়, তাহলে যাতে
সুবিধা হয় সেজন্য। যুদ্ধ হয়েছিল?
ওই দলটা সৈয়দপুর পর্যন্ত পৌঁছোতে পারে নি। মাঝপথে দারোয়ানীতে পাক আর্মি যুদ্ধ করে হটিয়ে দেয় ওদের। দুদিন পরে ওরা খাটুরিয়ার ওপর দিয়েই আবার ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়।
নীলফামারীর খবর জানিস কিছু?
নীলফামারী মহকুমার দূরত্ব খাটুরিয়া থেকে বেশি নয়। আমাদের অনেক আত্মীয়স্বজন নীলফামারীতে থাকেন। মাসুম বলল, ছয় এপ্রিল পর্যন্ত নীলফামারী মুক্ত ছিল। সাত তারিখে সকালে পাক আর্মি যুদ্ধ করে মুক্তিবাহিনীকে হটিয়ে দেয়।
জামী বলল, একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছ মা? ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশের আর সব জায়গাতেই কিন্তু প্রথম কিছুদিন মুক্তিযোদ্ধারাই দখল নিয়েছিল। বাংলাদেশের সবগুলো জেলা সদরে প্রথমদিকে পাক আর্মি ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে ছিল। তারপর তারা বেরিয়ে যুদ্ধ করে মুক্তিবাহিনীকে হটিয়েছে। তারপর তারা জ্বালাও-পোড়াও করতে পেরেছে। তার আগে নয়।
মাসুম বলল, আমরা তো ২৬ মার্চই আকাশবাণী, বি.বি.সি, ভয়েস অব আমেরিকা শুনে ভেবেছিলাম ঢাকা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
আসলেও প্রায় তাই হয়েছিল। ঢাকায় যত বস্তি, যত বাজার, যত কাঁচা বাড়িঘর, সব পুড়িয়ে দিয়েছিল। নেহাৎ বিল্ডিং পুড়িয়ে ছাই করা যায় না, তাই গোলা মেরে মেরে যতটা পেরেছিল ইকবাল হল, জগন্নাথ হল, শহীদ মিনার চুরমার করে দিয়েছিল। শহীদ মিনার এখনো ওইভাবে আছে। ওখানে মসজিদ লেখা একটা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছে। ঢাকার রাস্তায় ট্যাঙ্ক নামিয়েছিল। জামী বলল, মাসুম ভাই, রমনা রেসকোর্সের কালীমন্দিরটা কিন্তু নেই–ওটা গোলা দিয়ে পুরোপুরি গুঁড়িয়ে ওখানকার মাটিটা পর্যন্ত সমান করে দিয়েছে।
আমি বললাম, তুই আরো আগে ঢাকা এলে পারতিস।
কি করব। বাবা কিছুতেই আসতে দেবেন না। ওদিকে তখন গুজব–ঢাকার মিরপুর-মোহাম্মদপুরে বাস-কোচ থেকে বাঙালিদের নামিয়ে মেরে ফেলে। এখন আবার ওদিকে নতুন উপদ্রব শুরু হয়েছে। সৈয়দপুরে এয়ারপোর্ট তৈরি হচ্ছে। তাতে চারপাশের এলাকা থেকে লোক ধরে এনে এয়ারপোর্ট তৈরির কাজে লাগানো হচ্ছে। ওদিককার সব ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানদের ওপর হুকুম হয়েছে–নিজ নিজ। এলাকার গ্রামগুলো থেকে প্রতিদিন নির্দিষ্টসংখ্যক লোক পাঠাতে হবে। মাটিকাটা থেকে শুরু করে এয়ারপোর্ট বিল্ডিং বানানো, রানওয়ে তৈরি সমস্ত কাজই ওইসব লোকদের দিয়ে বিনা মজুরিতে করানো শুরু হয়েছে। পুরো অঞ্চলে একেবারে হাহাকার পড়ে গেছে। প্রত্যেক চেয়ারম্যান গ্রামভিত্তিক নির্দিষ্টসংখ্যক লোক পাঠাতে বাধ্য। কোনো গ্রামে কামলা-মজুর সব পাওয়া না গেলে শিক্ষিত, সচ্ছল লোকদের মধ্য থেকে নিয়ে হিসেব পুরো করে দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে কোন ছাড়াছাড়ি নেই। যে এলাকা থেকে যতগুলো মজুর পাঠাবার কথা, ঠিক ততগুলো পাঠাতেই হবে। তাতে যদি গ্রামের মোড়লকে বা তার ছেলেকে বা অন্য কোন শিক্ষিত লোককে নিতে হয়, তাহলে তা ই নিতে হবে। এইবার বাবা একটু ভয় পেয়েছেন বলে ঢাকা আসতে দিলেন।
রাস্তায় কি রকম ভোগান্তি হলো? পৌঁছাতে এত দেরি হল যে?
দেরি হবার কারণ অনেক জায়গায় ব্রিজ নষ্ট। মুক্তিবাহিনী উড়িয়ে দিয়েছে। এক বাস ছেড়ে নৌকায় নদী পেরিয়ে অন্য বাস ধরা, বাসে ওঠার সময় আবার চেকিং। ঢাকা ঢোকার আগে থেকে আরো কড়া চেকিং বাস থেকে নামিয়ে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে বডি চেক করা–জিনিসপত্র সবনামিয়ে তন্নতন্ন করে চেক করা–প্রতিটি চেকপোস্টে একই ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত যে এসে পৌঁছেছি এতেই আল্লার কাছে হাজার শুকুর।
জামী বেসুরো গলায় গেয়ে উঠল, মনে হল যেন বেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ আসিতে ঢাকার দ্বারে। (জামী শৈশবকালে কিছুদিন বাফায় গান শিখেছিল!)
২৫ জুলাই, রবিবার ১৯৭১
সকালে নাশতা খাবার সময় বললাম, অনেক দিন আতাভাইয়ের বাড়ি যাওয়া হয় নি। মাসুম এসেছে, চল ওকে নিয়ে যাই।
শরীফ বলল, ঐ সঙ্গে ফকিরের বাসাও ঘুরে আসব। ওকে ফোন করে দাওতো, যেন বেরিয়ে না যায়।
আতাভাই নারিন্দায় থাকেন, ফকির লারমিনি স্ট্রিটে।
ফোন করতেই ফকির বললেন, আজকে এদিকে না আসাই ভালো। কাল সারারাত ধরে যাত্রাবাড়ীর ওদিকটায় গোলাগুলি চলেছে। সকাল হতে হাটখোলার মোড় থেকে যাত্রাবাড়ী-ডেমরা ঐ এলাকায় কারফিউ দিয়ে রেখেছে।
তাই নাকি? কি বৃত্তান্ত–কিছু জানতে পেরেছেন?
না, এখন বৃত্তান্ত জানতে বেরোনো খুব নিরাপদ হবে না। যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকায় বহুত ধরপাকড়, মারধর হচ্ছে। আমরা তো পাশেই–আমি অবশ্য ইচ্ছে করলে নবাবপুর রোডের দিক দিয়ে বেরোতে পারি কিন্তু আমার বউ বলছে, কি দরকার? অন্তত একটা ছুটির দিন বউ-বাচ্চা নিয়ে বাড়িতে আরাম করলে হয় না?
করুন। আমরাও তাহলে তাই করি।
আতাভাইকেও ফোন করে জিগ্যেস করলাম, রাতে গোলাগুলির শব্দ শুনেছেন?
উনি বললেন, শুনেছি প্রচুর। আমরা তো ভয় পেয়ে গেছিলাম–শেষ পর্যন্ত আমাদের পাড়াতেও শুরু হলো কিনা। কিন্তু এদিকে আর আসে নি।
গোলাগুলি কোনদিকে হয়েছে বলে মনে হয়?
শব্দটা তো যাত্রাবাড়ির দিক থেকেই এসেছে, মনে হয়। হাটখোলার মোড় থেকে ঐদিকে তো কারফিউ অজ।
মনটা খুব চনমন্ করতে লাগল।
যাত্রাবাড়ির দিকে সারারাত গোলাগুলি। না জানি কি যুদ্ধ হয়েছে। কার কাছে, কেমন করে ঘটনার বিবরণ পাই?
২৬ জুলাই, সোমবার ১৯৭১
যাত্রাবাড়ির ঘটনা নিয়ে সারা শহরে তুমুল হৈচৈ। কাল থেকে কলোজনের মুখে যে কতোবার একই বৃত্তান্ত শুনলাম, তার হিসাব নেই। আমাদের সকলের আনন্দ আর উত্তেজনার আরো একটা বড় কারণ–সারারাত ধরে গুলিগোলাটাদুইদল খানসেনার মধ্যেই হয়েছে।
আসল ব্যাপারটা হলো এই : যাত্রাবাড়ির রাস্তা দিয়ে সারারাত ধরে মিলিটারি ভর্তি বড় বড় লরি যাতায়াত করে। ওদের যাতায়াতের সুবিধের জন্য রাত দশটার পর ওই রাস্তা দিয়ে অন্য সব গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে। পরশু মাঝরাতে কয়েকজন বিচ্ছ পথের ওপর কয়েকটা ছোট সাইজের মাইন বসিয়ে দেয় কোন এক ফাঁকে। তাতে দুটো খানসেনা ভর্তি লরি উল্টে রাস্তার পাশের ঢালু জমিতে পড়ে যায়। রাতের অন্ধকারে শব্দ ও চিল্লাচিল্লি শুনে যাত্রাবাড়ি চেকপোস্ট থেকে পাক আর্মি ভাবে, ওখানে নিশ্চয় গেরিলারা কিছু করছে। অমনি তারা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। তা শুনে খাদে-পড়া পাকসেনারা মনে করে ওগুলো মুক্তিদের গুলি। তারাও তখন গুলি করা শুরু করে। এমনিভাবে খানসেনারা অমাবস্যার ঘোর কালো রাতের অন্ধকারে মুক্তি ভেবে নিজেদের মধ্যেই
আমরা যত শুনি, তত হাসি। কাগজে ভিয়েতনাম যুদ্ধের খবর প্রসঙ্গে মাঝে-মাঝেই সেমসাইড কথাটা পড়েছি। এবার ঢাকাতেই সেমসাইড হলো।
২৭ জুলাই, মঙ্গলবার ১৯৭১
আজ ইমনের জন্মদিন। বেচারা এখনো হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায় নি। কি যে দুর্দিন যাচ্ছে আনোয়ারের পরিবারের ওপর দিয়ে।
সকালে ডলি আপাকে সঙ্গে নিয়ে ইমনের জন্য পুতুল কিনলাম। আরো দুচারটে টুকিটাকি উপহারও কেনা হলো।
সাড়ে তিনটেয় ডলি আপা এসে আমায় তুলে নিয়ে হাসপাতালে গেলেন।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এককাপ চা নিয়ে জুত করে বসতেই দাদাভাই আর মোর্তুজা ভাই এলেন। এম.জি. মোর্তুজা এসৃসো তেল কোম্পানির সিনিয়র এক্সকিউটিভ শরীফের বন্ধু। তার বড় ভাই এম.জি, মোস্তফা ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির ম্যানেজার মোর্তুজার সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও দাদাভাই হয়ে গেছেন। সপ্তাহে কমপক্ষে চারদিন আমরা একে অন্যের বাড়িতে যাওয়া-আসা করি।
ঢুকেই দাদাভাই বলে উঠলেন, সাতটা তো বেজে গেছে। শুধু চা নিয়ে বসেছেন?
আমি হকচকিয়ে তাকাতেই দাদাভাই হেসে ফেললেন, রেডিও কই? স্বাধীন বাংলা শুরু হয়ে গেছে না?
স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান আমরা সবাই বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনি বটে, তবে অন্য কাজের ধকলে মাঝে-মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য বাদ পড়ে যায়। দাদাভাই আর শরীফের বেলায় তা হবার যো নেই। জামীকে রেডিও আনতে বলে বললাম, এত তাড়া কিসের? এইটাই তো আবার সকালে রিপিট হবে।
সকালে ম্যাডাম, আমরা চাকরি করি। আপনাদের মতো ঘরে বসে আরাম করার কপাল নিয়ে জন্মেছি নাকি?
মোর্তুজা জিগ্যেস করলেন, ভাবী ইমাম ভাই কই?
উনি একটা কাজে মার বাসায় গেছেন। এক্ষুণি এসে—
কথা শেষ হবার আগেই বেল বাজল। শরীফ এসে গেছে। রেডিওটা ডাইনিং টেবিলে রেখে আমরা চারধারে ঘিরে বসলাম।
লেখক জাহানারা ইমাম-এর লেখা একাত্তরের দিনগুলি বই থেকে সংগৃহীত। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ ও জীবিত গেরিলাদের উদ্দেশে।