বুধবার | ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১০ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৩:৫৮
Logo
এই মুহূর্তে ::
নোবেল বিজয়ী কথাসাহিত্যিক উইলিয়াম ফকনার : মনোজিৎকুমার দাস কার্ল মার্কসের পরিজন, পরিকর (তৃতীয় পর্ব) : দিলীপ মজুমদার সফলা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত সুবিমল মিশ্র-র ছোটগল্প ‘বাব্বি’ হাইনরিখ হাইনে ও তাঁর ইতিহাসবোধ : মিনহাজুল ইসলাম আবার মহাভারত : শশী থারুর ভিয়েতনামের গল্প (দ্বিতীয় পর্ব) : বিজয়া দেব মহারানী ভিক্টোরিয়া ও মুন্সী আব্দুল করিম-এর অমর প্রেম : মাহবুব আলম শাড়িদিবসে এক শাড়িবিলাসিনীর ভালোবাসা : নন্দিনী অধিকারী আম্বেদকর প্রসঙ্গে বিজেপি দলিত বিরোধী তথা মনুবাদী রূপ প্রকাশ করে ফেলেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী যে আখ্যানে অভিজ্ঞতার উত্তরণ ঘটেছে দার্শনিকতায় : ড. পুরুষোত্তম সিংহ যেভাবে লেখা হলো ‘কবি’ উপন্যাস : জাকির তালুকদার শ্যামাপ্রসাদ ঘোষের ছোটোদের লেখা কবিতা — শব্দে-বর্ণে নির্মিত শৈশবের চালচিত্র : অমৃতাভ দে ভিয়েতনামের গল্প (প্রথম পর্ব) : বিজয়া দেব লেখা যেন কোনভাবেই মহত্ না হয়ে যায় : অমর মিত্র আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্ত : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন চাল চকচকে করতে বিষ, সবজিতেও বিষাক্ত হরমোন প্রয়োগ, চিন্তায় বিশেষজ্ঞরা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কার্ল মার্কসের পরিজন, পরিকর (দ্বিতীয় পর্ব) : দিলীপ মজুমদার স্মিতা পাতিল — অকালে ঝরে পড়া এক উজ্জ্বল নক্ষত্র : রিঙ্কি সামন্ত কীভাবে রবীন্দ্রনাথ ‘ঠাকুর’ হলেন : অসিত দাস সর্ব ধর্ম সমন্বয় — ক্ষীর ভবানী ও শঙ্করাচার্যের মন্দির : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী কার্ল মার্কসের পরিজন, পরিকর (প্রথম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার হরিপদ দত্ত-র ছোটগল্প ‘আত্মজা ও পিতা’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : আবদুল মান্নান সৈয়দ নবেন্দু ঘোষ-এর ছোটগল্প ‘ত্রাণ-কর্ত্তা’ অরণি বসু সরণিতে কিছুক্ষণ : ড. পুরুষোত্তম সিংহ অন্য এক ইলিয়াস : আহমাদ মোস্তফা কামাল খেজুর গাছের সংখ্যা কমছে, গাছিরা চিন্তায়, আসল সুস্বাদু খেজুরগুড় ও রস বাজারে কমছে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কেকা অধিকারী-র ছোটগল্প ‘গাছমানুষ’ মনোজিৎকুমার দাস-এর ছোটগল্প ‘বিকেলে ভোরের ফুল’
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে বড়দিনের বিশেষ দিনে জানাই Merry Christmas! আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

মরণোত্তর জীবনানন্দ লিখছেন রহমান মতি

রহমান মতি / ৮৪৩ জন পড়েছেন
আপডেট বুধবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

দৃশ্য : এক

জীবনানন্দ দাশ মারা গেছেন ২২ অক্টোবর। বাসায় আনার পর সবাই আসছেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কাউকে কিছু না বলে একা একা শোক প্রকাশ করে চলে গেলেন। এরপর অন্যান্যরা। (আলেখ্য জীবনানন্দ, ভূমেন্দ্র গুহ)

দৃশ্য : দুই

বুদ্ধদেব একটা কথা বলেছিলেন, তা আমাকে আলোক সরকার মনে পড়িয়ে দিলেন এতদিন পরে : জীবনানন্দ আজ প্রয়াত, কিন্তু তার মরণোত্তর সময় যত খরচ হয়ে যেতে থাকবে, আমরা ততই উপলব্ধি করতে থাকব যে, তিনি কতো বড়ো কবি ছিলেন, সজনীকান্ত বললেন অনুশোচনার সুরে; সুধীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর কিছু বললেন না; তারপরে উঠলেন বলতে সঞ্জয় ভট্টাচার্য, বললেন না কিছু, একটা কবিতা পড়লেন : ‘তুমি ঘুমে কেঁদে ওঠো বলে আমি অপরাধে জাগি’। (জীবনানন্দ ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য, ভূমেন্দ্র গুহ)

দৃশ্য দুইটি মরণোত্তর জীবনানন্দ দাশের। আজ মরণোত্তর জীবনানন্দ জীবিত জীবনানন্দের থেকে অনেক বেশি আলোচিত ও প্রভাব বিস্তারকারী। কালাতিক্রমী আবেদনের জন্যই এই আলোচিত ও প্রভাববিস্তারী অবস্থান জীবনানন্দের।

মৃত্যুপরবর্তী আলোচিত হওয়ার পরিস্থিতি এই উপমহাদেশের জনপ্রিয় পদ্ধতিও বটে। বেঁচে থাকতে যেন অন্ধ হয়ে ঘোরে সবাই, চিনতে পারে না কোনটি মৌলিক আর কোনটি ক্ষণস্থায়ী। জীবনানন্দ দাশ তাঁর উজ্জ্বল উদাহরণ। জীবনানন্দ তাঁর ‘জীবন ও সাহিত্য’ দিয়েই আলোচিত হওয়ার এবং প্রভাব বিস্তার করার মৌলিক পারঙ্গমতা দেখান। শুরুটা হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে পাঠ করার আয়োজন ক্রমশ বেড়েছে যা আজ আরো বেশি স্রোতস্বিনী প্রবাহে গতিশীল। পাঠের পাশাপাশি তাঁকে ঘিরে আড্ডা, বিতর্ক, সমালোচনা, তথ্যচিত্র বা ডকুমেন্টারি নির্মাণ, নানারকম লেখাজোকা ইত্যাদির পরিমাণ বেড়েছে। পুরো ব্যাপারটা জীবনানন্দ ভক্ত-পাঠক-সমালোচকদের হূদয়ের ঘটনাও বলা যায়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে যে বৃহত্ কলেবর পেয়েছি তাতে বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক সবার মধ্যেই জীবনানন্দ পাঠের খবর পেয়েছি। তারা বেশিরভাগই হূদয় থেকে মুগ্ধতা বোধ করেন জীবনানন্দের কবিতায় এবং তারা সিরিয়াস পাঠক। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে যে লেখাজোকা হয়েছে, এই বিপুল কাজের পরিমাণ দেখেই তা উপলব্ধি করা যায়। বলা হয় জীবনানন্দকে নিয়ে যত কাজ হয়েছে, বাংলা সাহিত্যের অনেক কবিকে নিয়েও তত কাজ হয়নি। জানি এর মধ্যেও উত্তম বা দুর্বল কাজের সন্ধানও মিলবে। কিন্তু কাজের ক্ষেত্র প্রমাণও করে জীবনানন্দ অসম্ভব রকম পঠিত কবি।

কাজের ক্ষেত্রে লিটলম্যাগ বা সংবাদপত্রভিত্তিক সাহিত্য সাময়িকী—এই দুই মাধ্যমের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক বিভিন্ন জার্নাল এবং নানা প্রাতিষ্ঠানিক জার্নালও লেখা ছাপে জীবনানন্দ বিষয়ক। এগুলোর বেশিরভাগই অ্যাকাডেমিক বিষয়ভিত্তিক লেখা, কিন্তু কাজের লেখা। বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক কাজে যে তথ্যসূত্র থাকছে তার সাহায্যে তথ্যকে কাজে লাগিয়ে চলে নতুন কাজের আয়োজন। তাতে পরিসর বাড়ছে। সিরিয়াস পাঠকরা উপকৃত হচ্ছে। কবিতা পাঠের পাশাপাশি সমালোচনাও বেড়েছে এভাবে। পাঠ ও কাজ দুটোই হাত ধরাধরি করে চলছে।

মৃত্যুর পর জীবনানন্দকে নিয়ে একাধিক সমপাদিত গ্রন্থ বেরিয়েছে। দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সমপাদিত ‘জীবনানন্দ দাশ : বিকাশ-প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত’ বইটি সাড়া ফেলেছিল। বইটিতে এক মলাটে ভরাট নানা আয়োজন ছিল যা তথ্য এবং সমালোচনায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে, আজও রাখছে। এর দ্বিতীয় খণ্ড ‘জীবনানন্দ দাশ : উত্তরপর্ব’ বইটিও বড় কাজ। রণেশ দাশগুপ্ত ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্যসম্ভার’ নামে প্রথম প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতার সংকলন করেন। কলকাতাভিত্তিক কাজই এক্ষেত্রে আছে প্রধান ভূমিকায়। দেবেশ রায় সমপাদিত জীবনানন্দ খণ্ড বেরোয় পরপর। প্রতিক্ষণ থেকে তাতে কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, প্রকাশিত কবিতা ও অন্যান্য রচনা যেমন—দিনলিপি, পাণ্ডুলিপি ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি তখনকার প্রধান লেখকদের মূল্যায়নে জীবনানন্দের আরো নানা বই বেরিয়েছে। ভূমেন্দ্র গুহ যিনি জীবনানন্দকে দেখেছেন, মিশেছেন নানা ঘটনার সাক্ষী, তিনি লিখেছেন অসাধারণ সব বই। উল্লেখযোগ্য দুটি বই ‘আলেখ্য জীবনানন্দ’ এবং ‘জীবনানন্দ ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য’। অসামান্য সব তথ্য-উপাত্ত, ব্যক্তিক অনুভূতিজাত বই দুটি জীবনানন্দ ভক্ত-পাঠকদের খোরাক মিটিয়েছে অনেকখানি। ভূমেন্দ্র গুহরা সেসব ব্যক্তি, ইতিহাস কালে কালে যে পাপ তৈরি ও জমা করে তার প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য এরকম মানুষের আবির্ভাব হয়। কবি বিনয় মজুমদার রচিত ‘ধূসর জীবনানন্দ’ বইটি বিখ্যাত। শঙ্খ ঘোষ সমপাদিত ‘এই সময় ও জীবনানন্দ’ বইটি অসাধারণ সব লেখার সমন্বয়জাত ভাণ্ডার। এ বইয়ে দেবেশ রায় তাঁর ‘অন্যরকম এক আরম্ভের অপেক্ষায়’ প্রবন্ধে বলেন—‘জীবনানন্দ দুর্বল পাঠকের কবি বা লেখক নন। তিনি একটি যুগকে ভাষা দিয়েছিলেন, তিনি তাঁর পরবর্তী যুগের ভিতর বহুদূর পর্যন্ত প্রবেশ করেছেন। এমন কবি ও লেখকের জন্যে পাঠককে সাহসী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী হতে হয়। জীবনানন্দ তাঁর সেই পাঠকের জন্যে অপেক্ষা করছেন’। জীবনানন্দের জীবদ্দশায় সেই পাঠক যা মিলেছে তার মধ্যেও এ ধরনের পাঠক ছিল, কিন্তু আজ সে পাঠকের পরিমাণ যেন আরো বেশি বিস্তৃত হয়েছে। সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘কবি জীবনানন্দ’ নামে একটি বই, যে বইটি জীবনানন্দ বিষয়ক ধ্যান-ধারণা এবং তাঁর কবিতা পাঠ-উপলব্ধির ধারাই পরিবর্তন করেছে, অসামান্য কাজ। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ‘জীবনানন্দ’ নামে লিখেছেন অসামান্য একটি বই। বইটি কাব্যিক এবং সঙ্গীতের আলাপ, অন্তরা, সঞ্চারি, আবেগ ইত্যাদি নতুন স্টাইলে লেখা। বইটিতে আত্মিক তৃপ্তি মিলবে। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রসঙ্গ : জীবনানন্দ’; অম্বুজ বসুর ‘একটি নক্ষত্র আসে’; সুব্রত রুদ্র সমপাদিত ‘জীবনানন্দ :জীবন আর সৃষ্টি’; জহর সেন মজুমদারের ‘জীবনানন্দ ও অন্ধকারের চিত্রনাট্য’ বইগুলো চমত্কার কাজের উদাহরণ। ক্লিন্টন বি সিলি ‘অ্যা পোয়েট অ্যাপার্ট’ নামে জীবনানন্দের সাহিত্যিক জীবনী লিখেছেন যা বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন ফারুক মঈনউদ্দীন। বাংলাদেশে জীবনানন্দ গবেষক হিসেবে আবদুল মান্নান সৈয়দের নাম আগে চলে আসে। তাঁর ‘জীবনানন্দ’ বা ‘শুদ্ধতম কবি’ বই দুটি সুপরিচিত। ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর কাজ আছে। সৈকত হাবিব ‘বনলতা সেন : ষাট বছরের পাঠ’ নামে একটি চমত্কার সমপাদনার কাজ করেছেন। হরিশংকর জলদাসের ‘জীবনানন্দ ও তাঁর কাল’ নামে একটি কালানুক্রমিক গ্রন্থের কাজটি উল্লেখযোগ্য। জীবনানন্দের গদ্যসত্তা নিয়ে শান্তনু কায়সারের ‘গভীর গভীরতর অসুখ গদ্যসত্তার জীবনানন্দ’ কাজটি মৌলিক। ১৯৯৯ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রণীত উত্তরাধিকারের জীবনানন্দ জন্মশতবর্ষ সংখ্যাটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও আলোচিত কাজ। এছাড়া লিটল ম্যাগাজিনের অবদান আছে। কলকাতাভিত্তিক অনুষ্টুপ, ময়ুখ, বিভাস পত্রিকাগুলো অবদান রেখেছে। সংবাদপত্রের সাময়িকীগুলোর তত্পরতাও  লক্ষণীয়। কাজ এভাবেই হচ্ছে এবং যে জোয়ার আছে তাতে কাজ আরো বেগবান হবে।

মরণোত্তর জীবনানন্দের সবচেয়ে আগ্রহের বিষয় তাঁর ব্যক্তিজীবন। তাঁর সংসারজীবন, তাঁর দাম্পত্য, তাঁর নিঃসঙ্গতা,তাঁর সামাজিকতা। ব্যক্তিজীবন নিয়ে প্রচুর লেখালেখি আছে। জীবদ্দশায় জীবনানন্দের সঙ্গে ওঠাবসা করার খাতিরে ভূমেন্দ্র গুহ, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সুরজিত্ দাশগুপ্ত, দীলিপকুমার গুপ্ত, দেবেশ রায় তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অনেক রচনা লিখেছেন। স্মৃতিচারণ করেছেন। সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল রচনা কবিপত্নী লাবণ্য দাশের লেখা ‘মানুষ জীবনানন্দ’ বইটি। এটি জীবনানন্দকে আপন আলোয় চেনায়। মৃত্যুপরবর্তী ব্যক্তিজীবনের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য এ বইটি মাল্যবান উপন্যাসের দাম্পত্য সমপর্ক কলহের সূক্ষ্ম তথ্য প্রদান করে। এ বইয়ে লাবণ্য দাশ নিজেই বলছেন, ‘তাঁর বাইরের রূপ দেখে বোঝার উপায় নেই যে ছাইচাপা আগুনের মতই লুকিয়ে আছে তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। অকারণে তাঁকে প্রকাশ করতে তিনি পছন্দ করতেন না।’ যার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হতে পারে নতুন সমালোচনা। যেখানে ব্যক্তিজীবন নিয়ে এসময়ে এসেও একের পর এক সমালোচকরা জীবনানন্দের সাহিত্যকর্মকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে আগ্রহী, কেবল করুণা হয় এ ধরনের সমালোচনার প্রতি। মরণোত্তর জীবনানন্দের সমালোচনা বা পাঠ মূল্যায়ন যেমন শক্তিময়ও ছিল তেমনি এ ধরনের ‘নির্জনতাপ্রিয়’, ‘অসামাজিক’, ‘নৈরাশ্যবাদী’ কবি হিসেবেও তাঁকে বিবেচনার খায়েশটা ভালোই লক্ষযোগ্য। কবি যদি কথাসাহিত্যে হাত দেন সেটাও কাব্যিক হয়ে যায় এমনই ধারণা সেই সমালোচকদের। কবির হাতে যে গল্প উপন্যাস এসেছে তার পেছনেও একটাই ধারণা প্রতিষ্ঠিত—এ গল্প উপন্যাসগুলো ব্যক্তিজীবনের হতাশা বা দাম্পত্যবিরহ কল্লোলই শেষমেষ। আচ্ছা আমরা কি এভাবে ভেবেছি কখনো বা ভাবব না কখনো, যা কিছু জীবনানন্দর অভিজ্ঞতা সে অভিজ্ঞতার জীবন আমাদের সমাজ, সংসারসমুদ্রেও ঘটতে পারে। পারে বলছি কেন, ঘটছেও তো অহরহই। এখনকার নাগরিক সমাজ বা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের যে সম্পর্ক, চরিত্র, নৈতিকতা, দাম্পত্য ওঠানামা, বিচ্ছেদ, কাদা ছোড়াছুড়ি, নিন্দা—এসব তো জীবনানন্দ দেখেছেন সেসময়েই। তাহলে তা আধুনিক তো অবশ্যই। আমার আপনার জীবনে স্বাভাবিক জীবনবাস্তবতার অংশ হিসেবেও এসবকিছু ঘটতে পারে। তাহলে কেন শুধু জীবনানন্দ ব্যক্তিজীবনে যে জীবন যাপন করেছেন, তার ওপর ভর করে চলবে এই সাহিত্য বিবেচনার চল। ভ্লাদিমির নবোকভ এ কারণেই তাঁর বিখ্যাত (ললিতা) উপন্যাসে লেখকের ব্যক্তিজীবন দিয়ে লেখকের সাহিত্য বিচার না করার জন্য অনুরোধ করেছেন। অনুরোধটা এখনকার সেসব কুসংস্কার ধারণকারী সমালোচকদেরও করতে ইচ্ছা করে। ব্যক্তিজীবন অবশ্যই কথামতো আসতে পারে লেখকের জীবন সম্পর্কে জানতে, কিন্তু তা যেন সর্বস্বতা না পায়। জীবনানন্দ নিজে যে সত্ সমালোচনায় বিশ্বাসী ছিলেন সে সমালোচনা তাঁর কালে যেমন হাতেগোনা হয়েছে, তাঁর মৃত্যুর পরেও ওই হাতেগোনাই ।

মরণোত্তর জীবনানন্দকে সামনে রেখে তাঁর পরের কবিরা বের হতে চেয়েছেন তাঁর প্রভাব থেকে, প্রবণতা থেকে। উদ্দেশ্য একটাই, নতুন কী লেখার আছে তা নিয়ে ভাবা। নতুন কী বলার আছে যা পাঠকের আরাধ্য হতে পারে। এখানেও কথা আছে। আয়োজনটা কি শুধু জীবনানন্দ থেকে আলাদা হবার নাকি আরো যাঁরা কবি ছিলেন তাঁদের থেকেও? জীবনানন্দ থেকে বের হতে হবে এটা এখনকার কবিরাও বলছেন। বিশেষ করে নব্বই বা শূন্য দশকের কবিরা। তাদের কেউ কেউ বেশ জোরের সাথে জীবনানন্দকেই ভাবছেন। যেন জীবনানন্দই প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই কি হওয়া উচিত? হ্যাঁ, জানি জীবনানন্দের প্রভাবটাই বেশি বোধ করেন তাঁর কবিভাষা নির্মাণের অসাধারণত্ব ও গ্রাস করবার মতো শক্তি দেখে। কিন্তু বাঁকবদল বা জীবনানন্দপরবর্তী কবিভাষা নির্মাণের জন্য সে আয়োজনটা শুধুই জীবনানন্দকেন্দ্রিক হলে সেখানেও একটা খণ্ডিত জায়গার জন্ম হয় অগোচরে। আয়োজনটা জীবনানন্দপরবর্তী যে দশকগুলো গেছে (কবিতার ইতিহাস যেভাবে লেখা হয়) তার সবগুলোর সঙ্গেও হওয়া দরকারি। মানে ষাট, সত্তর, আশির সঙ্গেও। কারণ, সেসময়েও তো একটা কবিভাষা ছিল। যারা বলছেন জীবনানন্দ ‘দুর্বোধ্য’ ভাষার কবি বা তাঁর কবিতার সবটা আঁচ করা কঠিন, তারাও সে জায়গায় সবটাই বোঝার প্রয়াস করে জীবনানন্দের সঙ্গে নিজেদের সম্যক দূরত্ব তৈরি করছেন যা ক্ষতিকর তো অবশ্যই সঙ্গে মৌলিকতাবর্জিতও। কবির সব কথা কেন বুঝতে হবে! কবির ভাষা বক্তব্য রহস্যময় কিনা সেটা আলাদা প্রসঙ্গ। আসল কথা যেখানে কবিতার ভাষার গুণে ভাবপ্রকাশে আড়াল আছে সেখানেই তো কবির সবচেয়ে বড় পাওনাটা ঘটে। পুরোটাই বলে দিলাম তো থাকল আর কী? কিছুটা আড়ালে থাক যাতে ওটা নিয়ে আরো ভাবা যায়। সেটাই তো কবি ও কবিতার শক্তি। জীবনানন্দ ওই আড়ালটা আনেন ‘সে কেন জলের মত ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!’ বা ‘আলো অন্ধকারে যাই-মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়/কোন এক বোধ কাজ করে’। তবেই তো ‘বোধ’ হয়ে যায় বড় কবিতা আর জীবনানন্দ বড় কবি। দুটোই ঘটে গভীরতায়। মরণোত্তর জীবনানন্দের আলোচিত ঘটনা এভাবেই বেড়েছে।

সবশেষে আসে মরণোত্তর জীবনানন্দের ‘আত্মহত্যা’ বিষয়ক সমালোচনার প্রসঙ্গ। জীবনানন্দ আত্মহত্যা করেছেন এটি কতিপয় প্রতি-সমালোচকের বিশ্বাস। বলা সঙ্গত নেতিবাচক মন-মানসের ফল। তাঁর সৃষ্ট শিল্পফসল ‘আট বছর আগের একদিন’ কিংবা ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনার পারম্পর্যে একটা সূত্র খোঁজার প্রবণতা থেকেও অনেকবার আত্মহত্যা প্রসঙ্গের অবতারণা হয়েছে। এ সাদৃশ্যের অনুসন্ধান করলে কবিতাকে আর কবিতার জায়গায় রাখা হয় না। আরোপিত সত্যে বন্দি করা হয়। কারণ ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার ‘তবু সে দেখিল কোন ভূত’—ভিত্তিক জিজ্ঞাসায় স্পষ্ট হয় না যে তিনিই স্বয়ং জীবনানন্দ। জীবনানন্দ যখন তাঁর সমকালের কাব্যসমালোচনার উদ্দেশে তাঁদের ভুল ভাঙানোর জন্য ‘সমারূঢ়’ কবিতা বা ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাকে বলেন তখনই নিশ্চিত হওয়া যায় শিল্পকে ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে মেলানো কতটা ঝুঁকির ব্যাপার। ভ্লাদিমির নবোকভ তাঁর ‘ললিতা’ উপন্যাসের ভূমিকায় যখন বলেন—‘ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে শিল্পকে সাজালে তা নষ্ট হয়ে যায়’। তখন ঝুঁকিটা বহুগুণে বাড়ে। এরকম তথ্য-উপাত্ত থেকে মৃত্যুর পর ভুল ব্যাখ্যা ক্রমশ বেড়েছে আর তা একসময় সংস্কারের/কুসংস্কারের দিকে গেছে। আর এ তো জানা কথা, সংস্কারকে খুব ঘষামাজা করলে তা হয়ে যায় কুসংস্কার। জীবনানন্দকে নিয়ে আত্মহত্যার প্রসঙ্গে তাঁর কবিতায় নানাভাবে ব্যবহূত ‘ট্রাম’-এর ধারণাতেও অনেক সমালোচক আস্থা রেখেছেন যা চলেছে কুসংস্কারের দিকে। ক্লিন্টন বি সিলি তাঁর ‘অ্যা পোয়েট অ্যাপার্ট’ বইতে চুনিলালের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। দুর্ঘটনার পর চুনিলাল-ই জীবনানন্দকে উদ্ধার করেন। ট্রামচালক জানান, বারবার হুঁইসেল দেয়া সত্ত্বেও জীবনানন্দ অন্যমনস্ক ছিলেন এবং অন্যদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। এতেই প্রমাণিত হয় না তিনি আত্মহত্যা করেছেন। সিলভিয়া প্লাথের চুলায় মাথা ঢোকানো বা আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বন্দুকের গুলিতে আত্মহত্যা করা নিজের অংশগ্রহণের সক্রিয় উপস্থিতিতে আত্মহত্যাকে প্রতিষ্ঠা করেছে অথচ জীবনানন্দ ওই ট্রামলাইনে অন্যমনষ্ক আর তাঁকে বাঁচাতে চুনিলাল বা ট্রামচালক এগিয়ে আসলেও তা সফল হয়নি। এটি জীবনানন্দের নিজস্ব অংশগ্রহণ নয়। বরং অবচেতনভাবে ট্রামলাইনে উঠে মৃত্যুর শিকার হওয়ার করুণ বাস্তবতা। সঞ্জয় ভট্টাচার্য তাঁর লেখায় বলেছেন, জীবনানন্দ প্রায়ই ট্রামলাইন বা ফুটপাত বেয়ে হাঁটতেন। থাকতেন কবিতার ঘোরে। যারা একে তবুও আত্মহত্যা বলে চালাতে তত্পর তারা ওই শ্রেণির সমালোচক যেখানে নতুন উদ্ভাবনী শক্তির ‘না-বোধক’ নেশা আছে। আছে জীবনানন্দকে আত্মহত্যাকারী হিসেবে নতুন এক ধারণা সৃষ্টির নেশা। আর কিছু নয়।

আর এভাবেই চলছে জীবনানন্দচর্চা। আবেগে, মুগ্ধতায়, ভালোবাসায়, তাচ্ছিল্যে, কাজের সমালোচনায় কখনো বা অকাজের সমালোচনায়, তর্কে বা বিতর্কে। এভাবেই গতিময় জীবনানন্দচর্চা চলছে ও চলবে। এই চলমানতাই মরণোত্তর জীবনানন্দের বড় অর্জন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন